| |||||||
|
|||||||
গুরুদেবের আবির্ভাব তিথি (দুপুর)
শ্রীগুরুপাদপদ্ম ওঁবিষ্ণুপাদ
(১) ক্ষিদা মেটানো
জয় ওঁ বিষ্ণুপাদ জগদ্গুরু শ্রীলভক্তি সুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ কী
জয় আমার সঙ্গে বলুন:
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে । [শ্রোতাগণের মধ্যে গোলমাল] কত অন্য কথা বেরচ্ছে ! দিনের মধ্যে আবল-তাবল কত পচাল পাড়িতে পার, তার মধ্যে কি একবারও গোবিন্দ বলতে নার । কত কথা আমরা বলি ! আমার সঙ্গে সঙ্গে বলুন:
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ।
সমাগত শ্রীগৌরভক্তবৃন্দ কী জয় গুরুদেবের একটা সুন্দর কথা আছে । যখন তিনি মেক্সিকোতে গিয়েছিলেন, তখন একটা হরিকথা বলেছিলেন আর তার পর ওই হরিকথাটা থেকে একটা বই চাপা হয়েছিল । আমি ওই বইটা এখন বাংলায় করে দিয়েছি । ওখানে শ্রীল প্রভুপাদেরও একটা কথা উল্লেখ হয়েছে । মঠে একটা উৎসব চলছে, তার মধ্যে একজন এসে বলছেন, “কাঙ্গালীর ভোজন কখন হবে ?” প্রভুপাদের উত্তর আমি আপনাদেরকে পরে শুনাব, এখন শুধু সংক্ষেপে বলে দেব । মঠে তো উৎসব পাওয়া যায়, হরিকথা শোনা যায়—এই তো প্রসাদ কিন্তু যখন ওই লোকটা জিজ্ঞাসা করলেন, “কাঙ্গালীর ভোজন কবে হবে ?” প্রভুপাদ উত্তরে বললেন : আরে মন, সত্য বল, তুমি কিসের কাঙ্গাল—ভজনের কাঙ্গাল না ভোজনের কাঙ্গাল ? আমরা সবাই ভোজনের কাঙ্গাল । যখন প্রসাদ পাওয়ার সময় হবে, তখন দেখবেন মন্দির লোক ভর্তি হয়ে যাবে, জায়গা হবে না । তাহলে আমরা সবাই ভোজনের কাঙ্গাল । প্রভুপাদ খুব সুন্দর করে লিখে দিয়েছেন । পড়বেন । তাই মন, তুই কিসের কাঙ্গাল ? ভোজনের কাঙ্গাল ? জিহ্বার কাঙ্গাল ? এই আশাতৃপ্তি পোষণ করার জন্যই কি এই জগতে এসেছিস, না শুধু আত্মকল্যাণের জন্য এসেছিস ? কোনটা ? আমরা সবাই কেউ আত্মকল্যাণের চিন্তা করি না । আমরা সবাই ইন্দ্রিয়তর্পণের জন্য চিন্তা করি । ইন্দ্রিয়তর্পণ মানে চখের লালসা, মুখের লালাসা, জিহ্বার লালসা, মনের লালসা—এই সব লালসার জন্য আমরা ভাবছি যে, “এখানে আমার জন্য সব সৃষ্টি হয়েছে !” মহাজনগণের কাছ থেকে যে হরিকথা শুনব, সে দিকে আমাদের কার রতি-মতি নেই । আমরা সবাই ভোজনের কাঙ্গাল । তার জন্য মঠে আসা কী দরকার ? মঠে আসতে হবে কেন ? আত্মকল্যাণের জন্য যদি আসতে চান, তাহলে মঠে আসুন—ভোজনের কাঙ্গাল হয়ে নয়, ভজনের কাঙ্গাল হয়ে আসুন । মঠে আসতে হলে ভজনের কাঙ্গাল হয়ে, ভোজনের কাঙ্গাল হয়ে নয় । এটা সবসময় মনে রাখবেন । যাকগে, আমি এখন বেশি বলব না কারণ আমাদের সময়টা সংকীর্ণ । অন্যান্য সন্ন্যাসীগণ এখানে উপস্থিত হচ্ছেন তাই আমি আপনাদেরকে অনুরোধ করি কিছু গুরুদেবের মহিমা-কীর্ত্তন করবেন । [পূজনীয় ধামভূষণ-সন্ন্যাসীগণের হরিকথার পরে শ্রীল গুরু মহারাজ বলছেন] আমি তো ভাবছিলাম যে, lockdown (লকডাউন) হয়ে গিয়েছে আর ভক্তগণ আমাদেরকে বোধ হয় ভুলে গিয়েছেন, কিন্তু এখন দেখছি যে, নাটমন্দিরে জায়গা হচ্ছে না । জায়গাটা সামনে ও পিছনে ছিল না তাই আমি মন্দিরটা বড় করতে পারি নি । আমার গুরুদেবের মঠটা ছেড়ে চলে এসেছি, এত দুর্ভাগা আমি । তবু এখানে সবাই চলে এসেছেন আমাকে কৃপা করবার জন্য, এটাই আমার খুব সৌভাগ্য । আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি । আমি এখন দুইচারি কথা গুরুদেবের সম্বন্ধে একটু বলব । গুরুদেবের অনেক কথা এবং ওর মহিমা-কীর্ত্তন করবার মত এই অধমের পক্ষে সম্ভব নয়, তাই আমি শুধু দুই-চারি কথা বলব । গুরুদেবের একটা প্রণামমন্ত্র আছে, সেটা আমাদের পরমগুরুদেব ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীলভক্তি রক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ রচনা করেছেন । কোথাও দেখা যায় না যে, কোন শিষ্যের প্রণামমন্ত্র গুরুদেব নিজে রচনা করেন কিন্তু শ্রীল শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ সেটা করেছিলেন (তিনি আমার গুরুদেবের প্রণামমন্ত্র নিজে রচনা করেছেন ) ।
গুর্ব্বাভীষ্টসুপূরকং গুরুগণৈরাশীষসংভূষিতং “গুর্ব্বাভীষ্টসুপূরকং গুরুগণৈরাশীষসংভূষিতং” : তিনি তাঁর গুরুদেবের সব ইচ্ছা পূরণ করে তাঁর গুরুদেবের আশীর্বাদে সম্পূর্ণ ভূষিত । “চিন্ত্যাচিন্ত্যসমস্তবেদনিপুণং” : চন্তাচিন্তের বাহিরে তিনি সমস্ত বেদে নিপুণ । “শ্রীরূপপন্থানুগম্” : শ্রীরূপানুগ-ধারায় তিনি এই প্রচার কর্য করে চলবেন । “গোবিন্দাভিধমুজ্জ্বলং” : শ্রীল গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ নাম করে এই জগতকে তিনি উজ্জ্বল প্রকাশিত হবেন । পরম গুরু মহারাজ বললেন, “আমি বিদেশে প্রচার করতে পারি নি, আমি নিজে অপারক ছিলাম, কিন্তু আমার ও প্রভুপাদের কথাগুলো শ্রীল গোবিন্দ মহারাজ এই বিশ্বে প্রচার করবেন ।” এই তিনি অভয়বাণী দিয়েছিলেন তাঁর শিষ্যের প্রণামমন্ত্রে ।
(২) শ্রীল গুরুদেবের লীলাগুলো—১ আপনারা জানেন যে, আমার গুরুপদপ্ম ১৯৪৭ সালে মঠে এসেছিলেন । পূজ্যপাদ ভক্তিকমল মধুসূদন মহারাজ, নৃসিংহানন্দ ব্রহ্মচারী (পরে তিনি হয়েছেন পূজ্যপাদ ভক্তিবৈভব পুরি মহারাজ) আর ভুতবৃৎ প্রভু (পূজ্যপাদ আশ্রম মহারাজ) নদনঘাটে প্রচারে গিয়েছিলেন । আপনি জানেন—আমি বাড়াতে চাই না—সমস্ত গুরুভ্রাতারা শ্রীলশ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজকে বাৎসল্যরসে ভালোবাসতেন । তাদের অসুবিধা যেন না হয়, তাদেরকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন । ভালো ঘর-টর ছিল না কিন্তু তিনি তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলেন । আমাদের গুরুদেব ওই সময় পিতৃ বিয়োগ হয়ে তার সংসার চলবার জন্য একটা গ্রামে ২০টাকা উপার্জন করতেন । তার মাতৃদেবী ছিলেন, তাই ওই সংসার চলবার জন্য তিনি নদনঘাটে ডাক্তারের কম্পাউন্ডার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন । তখন মঠের ভক্তেরা সারা দিন বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ভিক্ষা করে সন্ধ্যার সময় ওই নদনঘাটের জমিদারের বাড়িতে যার পাশে গুরুদেব কাজ করতেন বসে কীর্ত্তন ও প্রচার করতেন । গুরুমহারাজ আমাদেরকে বললেন, “নৃসিংহানন্দ ব্রহ্মচারীর হরিকথা শুনে আমি একটুকু বুঝেছি । উনি বললেন যে, দেহ কিছু নয়, মন কিছু নয়, আত্মাই সব । এটা শুনে আমার মনে হয়—কী শুনছি ।!” আর তখন কীর্ত্তনের সময় ব্রহ্মচারীরা মৃদঙ্গ বাজাত । গুরুদেবের তখন ছোট বয়স তো (১৪-১৭ বয়স), তিনি মেনে মনে বলছেন, “ওর মৃদঙ্গ বাজানো ভালো হচ্ছে না, আমাকে মৃদঙ্গ দিলে একটু ভালো বাজাতে পারি ।” একথা মনে মনে বলছেন কিন্তু বলতে সাহস পাচ্ছেন না । তখন হাত জোর করে বলেই ফেললেন, “আমাকে একটু মৃদঙ্গ বাজাতে দেবেন ।” গুরুদেব খুব মৃদঙ্গ বাজাতে পারতেন । তাই তিনি ওই দিন মৃদঙ্গ বাজিয়েছেন । সমস্ত সন্ন্যাসীরা তাঁকে বললেন, “মঠে যাবে ।” গুরুদেব বললেন, “হ্যাঁ, যাব । আজকে নিয়ে যাবেন । আজকে যদি নিয়ে যাবেন, আজকেই যাব ।” তখন নদনঘাটে নদী সাঁতরিয়ে নৃসিংহচাতুর্দ্দশী দিন তিনি মঠে প্রথম এসেছিলেন । তারপর ত অনেক গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে । আমি একদিন গুরু মহারাজকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি শ্রীধর মহারাজের চরণে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন, তবু আপনি কি করে সংসারে চলে গেলেন ।” তিনি বললেন, “আমি অন্যায্য করেছি ।” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কী অন্যায্য করেছিলেন ।” গুরুদেব উত্তরে বললেন, “ওই সময় আমার বাচ্চা বয়স ত, আমি জানতাম না কোনটা কী । মঠের মধ্যে একটা পেঁয়াজগাছ লাগিয়েছিলাম । তখন এক দিন শ্রীল শ্রীধর মহারাজ হাঁটতে হাঁটতে বাগানে গিয়ে বললেন যে, তুমি কী গাছ লেগেছ, দেখছি । তখন তিনি দেখেছিলেন যে, কিছু পেঁয়াজ লাগানো হয়েছে । তিনি বললেন, তোমার শেষ ! তোমার পদস্খলন হয়ে যাবে । তুমি চলে যাবে ।” তখন গুরু মহারাজ ২৪ বছর বয়সে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন ; সন্ন্যাস নেওয়ার পরেও তিনি চলে গিয়েছিলেন । গুরুদেব বলেছিলেন, “আমি গর্তের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু আমি কারো হাত ধরে উঠি নি । আমি গর্তের মধ্যে কুক্কুরের মত পড়ে ঘেউ ঘেউ করেছিলাম—একটা কুক্কুর যদি ১০ফুট গর্তের মধ্যে পড়ে গেলে কী করে । গর্তটা থেকে উদ্ধার করবার জন্য ঘেউ ঘেউ করে । আমার গুরুদেব তখন আমাকে হাত দিয়ে অবার উপরে তুলে দিয়েছিলেন ।” শ্রীল শ্রীধর মহারাজ গুরুদেবের নাম “গোবিন্দ মহারাজ” দিয়েছিলেন যখন গুরুদেব ২৪ বয়সে ছেলে ছিলেন । পরে গৃহস্থ হয়েও, মাথায় কোঁকড়া সুন্দর সুন্দর চুল নিয়ে থাকতেন । কলকাতায় তিনি কি করতেন, জানেন । কলকাতায় কিছু ব্যবসা করে শ্রীল শ্রীধর মহারাজকে টাকা পাঠাতেন । তার মেয়ে হয়েছে—উনি এখন স্কুলে হেড-মিস্ট্রেস করছেন, Mathematics MSc করেছেন । গুরু মহারাজ বলতেন, “আমার মেয়ের দুধ কিনার পায়সা ছিল না, বার্লি কিনে ওকে খাওয়াতাম কিন্তু মাসে আমার গুরু মহারাজকে ২০টাকা পাঠিয়ে দিলাম ।” আসলে গুরুদেব স্কুলে বেশি পড়েন নি । প্রাইমারি তিনতে পড়েছেন আর চারতে উঠছেন । তিনি বললেন, “আমি এত দুষ্ট ছিলাম । যে দিন স্কুলে গিয়েছি, কোন দিন আমার পেটানো ২-৪বার পড়ি নি, এমন দিন ছিল না । মাস্টার আমাকে মেরে আনন্দ পেতেন । ওরা মারতেই ভালোবাসতেন ।” এই করম গুরুমহারাজ বলেছেন । তাই তিনি স্কুলে বেশি পড়েন নি, তবু তিনি প্রিন্টিং প্রেসে প্রুফরিডিং করতেন । আমরা লেখাপড়া শিক্ষা যা করেছি কত জড়বিদ্যা পড়েছি কিন্তু এখন বাংলা লিখতে গিয়ে ১০টা ভুল হয় । আর গুরুমহারাজ যখন ইংরেজিতে চেক সই করতেন, আমি দেখলাম এত হাতের লিখা সুন্দর ! আমিও এত সুন্দর করতে পারি না । তিনি সব প্রুফ দেখতেন । আমরা এত বারবারই করে ভুল হচ্ছে দেখছি, প্রুফ দেখছি, কিন্তু তারপর গুরু মহারাজ একটা করে ভুল লক্ষ্য করবেন । তাই তিনি প্রেসে প্রুফ দেখতেন আর কলকাতায় বই চাপিয়ে সে বেইয়ের টাকা শ্রীল শ্রীধর মহারাজকে দিতেন ।
(৩) শ্রীল গুরুদেবের লীলাগুলো—২ [শ্রীল গুরুমহারাজ শ্রীল ভক্তি সুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজের লীলাগুলো বর্ণনা করে বলছেন ।] গুরুদেব আর tour (টুর) করতেন । শ্রীল শ্রীধর মহারাজ তো প্রথম একা ছিলেন, আর গুরুদেব ওই টুরগুলো করে নিয়ে নিয়ে যা উপায় হত, তিনি মঠে পাঠিয়ে দিতেন । তাঁর সংসারও চলতেন, মঠেও পাঠিয়ে দিতেন (ওই সময় গুরুদেব গৃহস্থ আশ্রমে ছিলেন) । আর পরম গুরুমহারাজ ওঁকে যখন সেক্রেটারি করলেন ওই সেক্রেটারি পদ আর কোন দিন পরিবর্তন করেন নি । শুধুমাত্র যখন শ্রীল শ্রীধর মহারাজ ওঁকে আচার্য্য করেছিলেন, তখন সেক্রেটারি-পদটা অন্যজনের কাছে চলে গিয়েছে, তা নাহলে তাঁকে মঠের সেক্রেটারি করে রেখে দিয়েছেন সারা জীবন । কিন্তু মঠে অনকে ব্রহ্মচারী ছিল—একজন (পূজ্যপাদ ভক্তি প্রমোদ পুরী গোস্বামী মহারাজ) ১৯৩৫ সালে এসে প্রভুপাদকেও দেখেছেন, আর একজন প্রভু ছিলেন যে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের স্কুলে পড়তেন (তাঁর নাম হয়েছিল কৃষ্ণশরণ ব্রহ্মচারী ; আবার যখন গুরুদেব তাঁকে সন্ন্যাস দিয়েছিলেন, তখন তাঁর নাম হয়েছিল ভক্তি প্রসূন অরণ্য মহারাজ) । গুরুমহারাজকে সন্ন্যাস দিয়ে পরম গুরুমহারাজ বললেন যে ত্রিদণ্ডী সন্ন্যাস মানে তিনটা জিনিস : ঠাকুরকে রাখা করা, মঠকে রাখা করা আর ভক্তদের রাখা করা । আর গুরুদেব কি করে মঠকে রাখা করছেন শুনবেন ? নবদ্বীপে, কোলের ডাঙ্গায়, ছেলে কি দুষ্ট ও বদমাইশ লোক, বুঝতেই পারছেন । তাই গুরু মহারাজ বলতেন যে, যখন তিনি কোথা থেকে নামতেন বা মঠ থেকে বেরিয়ে আসতেন, মঠের পাশের লোক তাঁকে দেখে বলত, “শালা ! গোবিন্দ মহারাজ আসছে ! পালা !” গুরুমহারাজকে তারা এত ভয় পেত ! আর একবার জানেন কী হয়েছিল ? গুরুদেব আমাকে বলেছিলেন । এক দিন মিউনিসিপ্যালিটি থেকে একজন লোক যে মাপে বিল্ডিং ধরে ট্যাক্স করেন, উনি মঠে রান্নাঘরে মাপ দিতে এসেছেন । গুরুমহারাজ বললেন, “এটা ঠাকুরের ভোগের রান্নাঘর, ভেতরে মাপ দেওয়ার জন্য যাবেন না । আপনি বাহির থেকে মাপুন, তাকে ২০ ইঞ্চি বেশি যদি হয়, তাতে কোন আপত্তি নেই ।” “কেন ভেতরে যাব না ?” লোকটা রাগ করে বললেন । “এটা ঠাকুরের রান্নাঘর ।” “তাই ? আমি ব্রাহ্মণ ! আমি যাব !” উনি জুতা পড়ে বললেন, “ভেতরে যাব !” “আপনি যদি ভেতরে যান, আমি আপনার ঠেংটা কেটে দেব !” শেষপর্যন্ত গুরুদেব বললেন । তখন উনি একবারে হুমড়ি-তুমড়ি করে শ্রীধর মহারাজের কাছে গিয়েছেন : “আপনি কি এটা ছেলে রেখেছেন ওখানে ?! মঠের রান্নাঘরের কাছে কে এ ছিল ? সে এসে বলছে যে আমার ঠেংটা কেটে দেবে !” পরম গুরু মহারাজ বললেন, “নিশ্চয় আপনি কিছু করেছেন । ছেলেটাকে ডাকুন ।” গুরুদেব এসেছিলেন আর পরম গুরুমহারাজ ওঁকে জিজ্ঞাসা করলতেন, “বাবা, তুমি এই লোকটাকে বললে তুমি ঠেং কেটে দেব ? ও ব্রাহ্মণ লোকটা ।” “উনি বলছেন ঠাকুরের রান্নাঘরে জুতা পড়ে যাবে, তখন আমি কী বলব, বলুন ?” এরকম ছিলেন গুরুদেব । দেখেছেন তো তাঁর সেবা-বৃত্তি ?
(৪) শ্রীল গুরুদেবের লীলাগুলো—৩ গুরুদেব কাউকে ছাড়তেন না । নিজের ভাইকেও ছাড়তেন না । তিনি আমাকে একটা হিসাবের খাতা দিয়েছিলেন, বললেন, “সারা বছরে এতগুলা টাকা খরচ করা হয় । খাতাটা রেখে ওখানে সব লিখে দাও ।” তখন এক দিন তিনি আমাকে বললেন, “খাতাটা দিয়ে দাও, আমি দেখব ।” কোথাও কোন ধরে নি কিন্তু একটা জায়গায় আমি নাম দিয়েছি — “ধনঞ্জায় প্রভু, ২০০ টাকা ।” গুরুদেব আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ধনঞ্জায় প্রভুর ২০০টাকা কেন লেখা আছে এখানে ?” ধনঞ্জায় প্রভু গুরুদেবের ছোট ভাই (নিজের অপন ভাই), ও ভান্ডারে থাকত । তখন গুরুদেব ধনঞ্জায় প্রভুকে ডেকে বললেন, “তুমি ২০০টাকা কি জন্য নিয়েছ ?” ও বলছে, “মায়ের জন্য কেউ কারপিন তেল কিনেছি ।” গুরুদেবের নিজের মা তো কিন্তু গুরুদেব বললেন, “বেটা, তোর মা বাড়িতে মুড়ি বেজে খেত আর এখানে ঠাকুরের পয়সা দিয়ে কেউ কারপিন তেল কিনতে এসেছে না কি ?” গুরুদেব নিজের ভাইকেও, নিজের মাকেও ছাড়তেন না । পরে গুরুদেব আমাকে বললেন, “ওই মহিলার ঘরে তুমি যাবে না ।” আমি সেটাই করলাম বলে ঠাকুর মা আমার সম্বন্ধে বলতেন যে, “আচার্য্য মহারাজ এখন বড় মহারাজ হয়ে গিয়েছে, আমার ঘরে আসে না ।” কিন্তু যখন আমাকে গুরুদেব নির্দেশ দিয়েছেন, “তুমি তার ঘরে যাবে না,” তখন আমি কি করে ওখানে যাব ? গুরুদেব বললেন, “ওখানে মায়া আছে । ওখানে গেলে তুমি মায়ার ধরে পাড়বে । ওর ঘরে তুমি কোন দিন যাবে না । দূর থেকে প্রণাম করবে কিন্তু ওর ঘরে যাবে না ।” এইরকম গুরুমহারাজ বলতেন । গুরুদেব আমাকে বলতেন, “ঠাকুরের আরতি তৈরি করে আমরা পঞ্চপ্রদীপ ও অন্যান্য জিনিস দিয়ে করি, তাই ওইসব জিনিস নিয়ে আমা সব কিছু ভালো পরিষ্কার করি, তারপর আরতি করি । আমাদের অবস্থাটা ওইরকম । এই সংসার তৈরি করে এত বাসন হয়ে গিয়েছি আমরা—গুরুদেব আমাদের পরিষ্কার করে আবার ঠাকুরের সেবায় লাগিয়ে দিয়েছেন ।” এইরকম গুরুদেব সোজা কথা বলতেন । আর একটা কথা মনে পড়ে, না বলে পারছি না । আপনি জানেন যে, যখন শ্রীল এ.সি. ভক্তিবেদান্ত স্বামী মহারাজ (ISKCONএ যারা ওকে শ্রীল প্রভুপাদ বলে) গৃহস্থ আশ্রমে ছিলেন, তিনি তখন অভয়চরণ বাবু ছিলেন, কলকাতায় থাকতেন । তখন শ্রীল শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ আমাদের গুরুদেবের সঙ্গে (তিনি তখন গৌরেন্দু ব্রহ্মচারী ছিলেন—খুব অল্প বয়সে, তখন সন্ন্যাস নেন নি) শ্রীল স্বামী মহারাজের বাড়িতে কলকাতায় গিয়ে ৬-৮ মাস থাকতেন । তখন শ্রীল স্বামী মহারাজ খুব গীতা প্রচার করতেন (এখন দেখছেন ওদের গীতাটা খুব প্রচারিত) । গৃহস্থ আশ্রমে বসেও শ্রীল স্বামী মহারাজ গীতার সমস্ত শ্লোকগুলো মুখুস্থ করলেন । তখন তিনি আমাদের গুরুদেবকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যেতেন । তিনি গুরুদেবকে বললেন, “গৌরেন্দু, তুমি ত ব্রহ্মচারী, তাই তুমি ওই ব্যাসাসনে বস । তুমি গীতার শ্লোকগুলো বল আর আমি ব্যাখ্যা করব ।” এইরকম তিনি গুরুদেবকে ভালোবাসতেন । যখন শ্রীল স্বামী মহারাজ রাধা-দামোদরের মঠে বসে শ্রীমদ্ভাগবত ইংরেজিতে অনুবাদ করছিলেন, তখন গুরুদেব গৌড়ীয়-দর্শনে শ্লোকগুলো ও শ্রীধর মহারাজের কথাগুলা লিখছেন (আসলে গুরুদেবই করতেন কিন্তু নাম দিতেন শ্রীল শ্রীধর মহারাজের) । ওই কথা ও ব্যাখ্যা পেয়ে শ্রীল স্বামী মহারাজ বললেন, “আমার কয়েকজন পুত্র আছে, কিন্তু আমি শুধু একজনকে পুত্র বলে মানি—সেটা হচ্ছেন গোবিন্দ মহারাজ । তুমি আমার একমাত্র পুত্র যিনি এই কথাগুলা বলবার জন্য জগতে থাকেন ।” গুরু মহারাজ যখন প্রথম থেকে মঠে এসেছিলেন, সাত দিনের মধ্যেই শ্রীল শ্রীধর মহারাজ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, “এই ছেলেটা আমার পরবর্তী আচার্য্য হবে ।” কেননা? তিনি গুরুদেবকে বললেন, “তুমি মনের কথা শুনবে না । আমার কথা শুনবে ।” তারপর যখন সকাল ভেলা পাঁন্থ ভাতের সঙ্গে পোকা পড়ার ডাল তাঁকে দেওয়া হল, তখন তিনি ওই পোকাটা ফেলে দিয়ে ডালটা খেয়েছিলেন । শ্রীল শ্রীধর মহারাজ সেটা দেখে পরে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি ওই পোকা পড়ার ডালটা কেন খেয়েছো ?” গুরুদেব বলেন, “আমার ত খেতে ইচ্ছা করছিল না কিন্তু সেটা মনের কথা আর আপনি বললেন মনের কথা শুনবে না, আমার কথা শুনবে—তাহলে আমি এই জন্য পোকা পড়ার ডালটা খেয়ে নিয়েছি ।” এই ভাবে গুরু মহারাজ ছিলেন । ১৯৭৩ সালে যখন ISKCONএ মায়াপুরে চন্দ্রোদয় মন্দির খুড়ের ঘরটা স্থাপিত হচ্ছিল, শ্রীল স্বামী মহারাজ গৌড়ীয় মঠ থেকে সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন । অনেকে যান নি কিন্তু শ্রীল শ্রীধর মহারাজ কৃষ্ণদাস বাবাজী মহারাজ ও গুরুদেবকে নিয়ে গিয়েছিলেন । ওই দিনে তুলে নেওয়া ছবিটা এখনও আমাদের বিভিন্ন মঠে আছে—গুরুদেবের তখন মাথায় সুন্দর চাঁচর চুল ছিল, তিনি গৃহস্থ আশ্রমে ছিলেন । গুরুদেব তখন নবদ্বীপে কলকাতা থেকে এসেছিলেন আর শ্রীল শ্রীধর মহারাজ তাঁকে বললেন, “গোবিন্দ মহারাজ, চলে যাবেন না । একবার চলুন, শ্রীল স্বামী মহারাজ আমাদেরকে নিমন্ত্রণ করেছেন ওর মন্দিরের উৎপাদনের উপলক্ষ্যে । যেতে হবে ।” মায়াপুরে গিয়ে, যখন শ্রীল শ্রীধর মহারাজ সেখানে উপস্থিত হলেন, তখন গুরুদেব শ্রীল স্বামী মহারাজকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কই, আপনি বললেন উৎপাদন করবেন, তার যজ্ঞ ইত্যাদি দরকার কিন্তু এই সব যজ্ঞের জিনিস-পাত্র কোতায়? কিছু তো আমরা দেখছি না ।” রীল স্বামী মহারাজ উত্তরে বললেন, “শ্রীল শ্রীধর মহারাজ আমার শিক্ষা গুরু—উনি যেখানে উপস্থিত হয়েছেন, আমার মন্দিরটা already (এখনই) প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছে ।” এই ভাবে শ্রীল স্বামী মহারাজ বলেছিলেন । কিছু ক্ষণ পর শ্রীল স্বামী মহারাজ বক্তৃতা করে শ্রীল শ্রীধর মহারাজকে বক্তৃতা বলতে অনুরোধ করলেন কিন্তু শ্রীল শ্রীধর মহারাজ (একটু কৌশল করে আর কি) উত্তরে বললেন, “আমার অসুস্থ এখন লাগছে । আমার পক্ষে আজকে বক্তৃতা বলবেন গোবিন্দ মহারাজ ।” তখন গুরুদেব সাদা কাপড় পড়তেন কিন্তু পরম গুরু মহারাজ তাঁকে গোবিন্দ মহারাজ ডাকতেন । ওই বক্তৃতা বলতে শুরু করে গুরুদেব ওই শ্লোকটা বলেছেন :
কম্প্রতি কথয়িতুমীশে সম্প্রতি কো বা প্রতীতিমায়াতু । “কাহাকেই বা বলিতে পারি, এখন কেইবা তাহা প্রতীতি করিবে যে, সূর্য্যতনয়া-কুঞ্জে গোপবধুতিগের লম্পট পরম-ব্রহ্ম লীলা করেন ?” (শ্রী চৈতন্যচরিতামৃত, ২/১৯/৯৮) শ্লোকের অর্থটা হচ্ছে এইটাই : কাহাকেই বা বলিতে পারি ? কে এ বা বুঝবে ? কাকেই বলব ? কাকেই শুনাইব ? স্বয়ং পরমব্রহ্ম গোপীর সঙ্গে জঙ্গলের মধ্যে খেলা করছেন ! কে বিশ্বাস করবে ? সেই ভাবে, কাকেই বলব, কাকেই শুনাইব যে, অভয় বাবু যাকে আমরা সাধারণ গৃহস্থরূপে চিনতাম এখন বিরাট জগদ্-গুরু হয়ে গিয়েছেন এবং সারা পৃথিবীতে কৃষ্ণকথা প্রচার করছেন ? গুরুদেবের মনটা বুঝতে পেরে শ্রীল কৃষ্ণদাস বাবাজী মহারাজ চিৎকার করলেন, “হরি বল ! হরি বল !”
(৫) শ্রীল গুরুদেবের লীলাগুলো—৪ শ্রীল শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজের কাছে শ্রীল স্বামী মহারাজও আসতেন আর পূজ্যপাদ ভক্তি হৃদয় বোন গোস্বামী মহারাজ, পূজ্যপাদ ভক্তি দয়িত মাধব গোস্বামী মাহরাজ, পূজ্যপাদ ভক্তি প্রজ্ঞান কেশব গোস্বামী মহারাজ ইত্যাদি বলেছেন, “যদি হরিকথা শুনতে হয়, তাহলে শ্রীল শ্রীধর মহারাজের কাছে যাবেন ।” আর আমাদের গুরুদেব বলতেন, “আমি গুরু মহারাজের কাছে শুনেছি । গুরু মহারাজ আমাকে যেভাবে চালনা করেছেন, আমি সেভাবে চলেছি । গুরু মহারাজ আমাকে যেভাবে ব্যবস্থা করেছেন, আমি সেইভাবে ব্যবস্থা করেছি ।” আপনাদের অনেকের আমার চাইতে বয়স বেশি, আপনারা দেখেছেন ১৯৭৮ সালে নবদ্বীপে বন্যা হয়েছে (আর তার চাইতে বিরাট বন্যা হল পরে, ২০০০ সালে) । আমি ১৯৭৮ সালে মঠে অসি নি, তাই ওই বন্যাটা দেখি নি কিন্তু শুনেছি যে, ওই সালে বিরাট বন্যা হয়েছিল । ওই সময় আমাদের চৈতন্য সারস্বত মঠে পাঁচিলও ছিল না কারণ মঠের তখন খুবি গরিব অবস্থা ছিল, আপনারা জানেন । গুরুদেব তখন গৃহস্থ, তাঁর সংসার ছিল, কিন্তু তিনি বন্যার মধ্যে নবদ্বীপে কলকাতা থেকে এসে তার মঠ রক্ষা করতে । তিনি কলার ভেলা করে মঠ সারা দিন ঘুরতেন । একদিন একজন পাড়ার ঘোষ মঠের মধ্যে কলাগাছ কাটতে এসেছে (গাছটা কেটে নিয়ে ওর গোরুকে খাওয়াবে) । ওকে দেখে গুরুদেব বললেন, “এই ! তুমি এখানে পিছনে ঢুকেছ কেন ?!” “আমি কলাগাছ নিতে এসেছি । দাও না ?” “কেন কলাগাছ তুমি নেবে ?” গুরুদেব উত্তরে বললেন । “আমি এখন পাহারাদার । আমার সামনে তুমি যদি আসতে, আমি তোমাকে গাছটা দিয়ে দিতাম । কিন্তু এখন বন্যায় সব ভেসে গিয়েছে, কোন পাঁচিল কিছু নেয় তাই তুমি পিছন দিয়ে ঢুকেছ চুরি করতে । তুমি চোর আর কি করে নিতে সাহস করবে, আমি দেখব । তুমি চুরি করতে পার কিন্তু আমার পাহারা ডিউটি করে দেখতে হয় । তোমার যদি নিতে হয়, চুরি করে নেবে কিন্তু আমার সামনে — আমি পাহারা দিয়ে রাখব । কি করে তুমি চুরি কর, দেখি ।” এই ভাবে গুরু মাহরাজ মঠ রক্ষা করছেন ।
|
সম্পূর্ণ পাঠ ডাউনলোড / শুনুন | ||||||
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥ | |||||||
© Sri Chaitanya Saraswat Math, Nabadwip, West Bengal, India. For any enquiries please visit our contact page. |