আমাদের শ্রীগুরুপরম্পরা :
শ্রীশ্রীল ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ ভগবান্ শ্রীশ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর
              প্রভুপাদ
“শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠে সূর্যাস্ত কখনই হয় না” :
আমাদের মঠের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
 
আমাদের সম্পর্কে শ্রীউপদেশ শ্রীগ্রন্থাগার শ্রীগৌড়ীয় পঞ্জিকা ছবি ENGLISH
 

গুরুদেবের তিরোভাব তিথি (দুপুর)

শ্রীগুরুপাদপদ্ম ওঁবিষ্ণুপাদ
শ্রীল ভক্তি নির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের পদ্মমুখের হরিকথামৃত
ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজের তিরোভাব তিথি
শিলিগুড়ি, ২৪ এপ্রিল ২০২১, দুপুর

 

(১) গুরুদেবের তিরোভাব


আজকে মদীয় গুরুপাদপদ্ম ওঁ বিষ্ণুপাদ জগৎগুরু শ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজের শুভ তিরোভাব তিথি । গুরুপাদপদ্ম এই দিনটাকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন । খুব বিরহের দিন তবু আমরা আড়ম্বরভাবে গুরুদেবের তিরোভাব তিথি পালন করে থাকি । বৈষ্ণবের তিরোভাব আর আবির্ভাব একই বস্তু কারণ বৈষ্ণবগণ হচ্ছেন ভগবানের নিজজন । গুরুদেব ভগবানের নিজজন ।

সাক্ষাদ্ধরিত্বেন সমস্ত-শাস্ত্রৈ-
রুক্তস্তথা ভাব্যত এব সদ্ভিঃ ।
কিন্তু প্রভোর্যঃ প্রিয় এব তস্য
বন্দে গুরোঃ শ্রীচরণারবিন্দম্ ॥

আজকের দিনে, এই তিথিতে অবলম্বন করে, শ্রীগুরুপাদপদ্ম ৪:২০-৩০ সময় (ভোর বেলায়) এই পৃথিবী ছেড়ে আমাদের চোখকে চলে গিয়েছেন । তিনি সমাধিস্থ অবস্থায় আছেন কিন্তু তিনি ওখান থেকে আমাদেরকে কৃপা করছেন । ভগবান্ ও গুরুদেব সব সময় নিত্যলীলায় থাকেন । তাই গুরুদেব নিত্যলীলায় থেকে আমাদের কাছে ভগবানের বার্তা পৌঁছে দেন, আমাদেরকে ওখান থেকে কৃপা করেন । তিনি কৃপা না করলে আমরা এত দিন বেঁচে থাকতে পারতাম না, এত দিন হরিভজন করতে পারতাম না । গুরুদেব যদি কৃপা না করে আমরা হরিভজন থেকে ছুটি হয়ে যাই (হরিভজন আর থাকে না) । গুরুদেবের কৃপা ছাড়া আমরা হরিভজন কি, গুরুসেবা কি, কৃষ্ণানুশীলন কি আমরা কিছুই জানি না, কিছুই বুঝতে পারি না ।

এই দিনটা খুব করুণ, নিরাশ দিন আমার পক্ষে, সবাইয়ের পক্ষে । এইদিনটা খুবই অসহ্য দিন । আমি অনেক কিছু সহ্য করতে পারি কিন্তু যে দিন আমি শুনেছি যে, গুরুদেব দহ ত্যাগ করেছিলেন, সেই দিনটাকে আমি সহ্য করতে পারি না…

ওই দিনের আগের দিনে আমি গুরুদেবের কাছে সন্ধ্যার সময় চলে এসেছিলাম । ওই দিনকে একাদশী ছিল । গুরুদেবকে দেখে, তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে আমি তখন বলেও বুঝতে পারি নি যে গুরুদেব আমাদেরকে ওই দিনকে ছেড়ে চলে যাবেন । গুরুদেব আমাকে ডেকেছিলেন, আমি তাই কলকাতায় গিয়েছিলাম, তারপর দিন আমার মেদিনীপুরে প্রচারে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু যখন আমি খবর পেছিলাম (৪:৩০-৪৫ ভোর বেলায়), তখন আমি কিছু বুঝতে পারলাম না, কী আমি করব, কী আমার করতে হবে । কেউ আমাকে বললেন যে, “আপনাকের কলকাতায় যেতে হবে ।” আমি কলকাতায় এসেছিলাম গুরুদেবকে দেখবার জন্য… তারপর অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা করা হয়েছিল । সবাই এখানে ছিল—গুরুদেবের মেয়ে ও নাতিও সেখানে ছিলেন, কিছু ভক্তগণও ছিলেন । অ্যাম্বুলেন্সে করে আমি গুরুদেবকে নবদ্বীপে নিয়ে গেলাম । দুপুর বেলায় নবদ্বীপে এসে আমি সব জায়গায় খবর দিলাম (টেলিভিশন, রেডিও, খবরের কাগজ, ইত্যাদিতে) । সমস্ত মায়াপুরের বৈষ্ণব-সঙ্গে ও সমস্ত গৌড়ীয়মঠের আচার্য্যগণকেও খবর দিলাম—তাঁরা তাঁদের লোকজনকে পাঠিয়েছিলেন আমাদের মঠে গুরুদেবকে দেখবার জন্য ।

তার আগে তো আমি গুরুদেবকে প্রশ্ন করলাম, “কোন জায়গা আপনি পছন্দ করেন ?” আমার মনে ছিল মেইন গেটের সামনে, শ্রীল শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজের ভজনকুটিরের কাছে কিন্তু গুরুদেব বললেন, “আমি গুরুমহারাজের সমাধি-মন্দিরের কাছে থাকতে পছন্দ করি ।” আসলে প্রথম তিনি আমাকে বললেন, “আমার দেহটা পুড়িয়ে গঙ্গায় ফেলে দিন,” কিন্তু আমি বললাম, “গুরুদেব, এটা অসম্ভব কারণ সমস্ত পৃথিবীতে যে ভক্তগণ আছেন তারা এই প্রস্তাব মানবেন না ।” তখন গুরুদেব বললেন, “ঠিক আছে, যদি মানবেন না, তাহলে গুরুমহারাজের কাছে রাখবে ।”

যেখানে গুরুদেবের সমাধি-মন্দির এখান আছে, সেখানে আমগাছ ছিল । ওই আমগাছ প্রায় মরে গেল (মরে যাচ্ছিল) । শেষ পর্য্যন্ত শুধু একটা কুঁদা রয়েছে । ওই কুঁদাটা বের করে আমরা সমাধির গর্তটা খনন শুরু করলাম । যখন আমরা গুরুদেবকে নবদ্বীপে নিয়ে এলাম, তখন ঘি-গঙ্গাজলাদি দিয়ে গুরুদেবের দিব্যদেহ স্নান করলাম । তখন প্রায় ৫ বেজেছিল । গুরুদেবের শরীরটা অপ্রাকৃত শরীর তো—যেভাবে তাঁর আত্মটা দেহ ছেড়ে চলে গেচ্ছেন, দেহটা সেইরকমই রহে গিয়েছে । কোন রঙ পরিবর্তন হয় নি, কোন দেহের শক্ত-টক্ত কিছু হয় নি । যেমন তুলা-তুলা করে নরম, খুব সুন্দর । একবারে তুলার মত নরম । সেটা দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম । এইটা অপ্রাকৃত ভক্তের দেহ ।

সেইভাবে, শ্রীল শ্রীধর মহারাজের সমাধি-মন্দিরের উপরে গুরুদেবকে স্নান করিয়ে তারপর সমাধি বসানো হল । গর্ত বড় হল, সেখানে গর্তের মধ্যে সবাই ভক্তেরা তাঁকে বসাল । আমাকে কোনরকম সবাই বললেন যে, “গুরুদেবের বুকে ব্রহ্মগায়ত্রী এবং শ্রীঅঙ্গে তিলক চন্দন দিয়ে দেওয়ার জন্য আপনাকে নিচে নামতে হবে ।” আমি সেইভাবে নিচে কোনরকম করে নেমে নিজেকে সংগ্রহ করতে পারছিলাম না সেই দিনটাকে… কোনরকম নিচে নেমে তারপর গুরুদেবের দেহটাকে মাটি দেওয়া হল । পুটটা ভর্তি করার পর্যন্ত আমি আর সেখানে থাকতে পারলাম না— একবারে পুটটা মাটি ভরাট করার পর্য্যন্ত আমি একটু দূরে চলে গেলাম, “ওই দৃশ্য আমি আর দেখতে পারব না ।” সেজন্য আমি আর বেশী ক্ষণ কাছে থাকলাম না ।

তারপর গুরুদেবকে ভোগ লাগিয়ে তাঁর আরতি করলাম । মাথার ওপর একটা তুলসী রাখলাম । আর নতুন টিন কিনে নিয়ে চারদিকটা বেড়া দিয়ে তার উপর একটা টিনের ছাউনি করে দিয়েছি ।

তারপর চল্লিশ দিন পরে আমি সমাধি আরম্ভ করে দিয়েছিলাম । ওইটাই নিয়ম যে চল্লিশ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরে সমাধি-মন্দির আরম্ভ করতে পারি । অনেকে এক বছর অপেক্ষা করতে বলেছিল কিন্তু আমি বললাম, “আমি এক বছর যদ না বেঁচে থাকি, তাহলে কে গুরুদেবের সমাধি-মন্দরিটা করবে ?” তাই চল্লিশ দিনের মাথায় গুরুদেবের সমাধি-মন্দির শুরু করে দিয়েছিলাম । তারপর তো সব কথাই আপনাদের জানা…

 

(২) সবকিছু অন্ধকারে ডুবে গেল


আমার মত পতিত-অধম জীবকে গুরুদেবের মহিমা-কীর্ত্তন করার অসম্ভব, তাঁর মহিমা-কীর্ত্তন করবার জন্য আমার কোন গুণ বা যোগ্যতা নেই । কটি মুখ, কটি জিহ্বা দিয়েও গুরুদেবের মহিমা-কীর্ত্তন করবার অসম্ভব তাই আমার মত পতিত জীবকে কি করে সেটা সম্ভব হতে পারে ? কিন্তু গুরুদেব সব সময় আমাদের সঙ্গেই থাকেন । তিনি সব সময় আমাদেরকে দেখাশোনা করে থাকেন । আমি সব সময় দেখতে পাই যে, গুরুদেব আমাকে রক্ষা করে চলছেন । বিপদে-আপদে, সম্পদে-বিপদে যখনই যে অবস্থায় থাকি না কেন গুরুদেবকে স্মরণ করি । গুরুদেব সব সময় আমাদেরকে কৃপা করে থাকেন ।

গুরুদেব এই জগৎ থেকে চলে গিয়েছেন । আমি বুঝতে পারি যে মাথার উপরে একটা ছাতা ছিল কিন্তু এখন এই ছাতাটা চলে গিয়েছে… গুরুদেব যেমন বটবৃক্ষ — যেরকম একটা বটবৃক্ষ সবাইকে ছায়া দেয়, সেরকম গুরুদেবও সবাইকে ছায়া দেন, কোন রকমের কষ্টের আঁচ লাগতে দেন না । যার সঙ্গে গুরুদেবের সম্বন্ধ হয়েছে, সে একমাত্র বুঝতে পারে বিরহের জ্বালা কী । বিরহের জ্বালা কতটা কষ্টকর ! সেটা যার একমাত্র বিরহ হয়েছে, সেই বুঝতে পারে ।

১৯৯১ সাল থেকে গুরুদেবের কাছাকাছি আছি । গুরুদেবের আদেশ পালন করে তাঁর সেবা করার চেষ্টা করেছি মাত্রা । তাঁর শ্রীচরণে এসে আমি সামর্থ্য অনুযায়ী তাঁর আদেশ পালন করতে চেষ্টা করেছি । তাঁর ইচ্ছা পূরণ করলাম কি না, জানি না কিন্তু গুরুদেব আমাকে খুব সহ্য করেছেন । আমি অনেক সময় কাজ করেছি যার দিয়ে গুরুদেবের মনঃপূত হয় নি । তিনি আমাকে বকাঝকা করেছেন, সেটা আমার কাছে খুব ভালো লাগত । গুরুদেব সব সময় বলতেন, “সবাইকে বকাঝকা করলে সবাই আমার কাছ থেকে পালিয়ে যেত, কিন্তু আচার্য্য মহারাজকে বকাঝকা করলে সব সময় সে আমার কাছেই থাকত, কখনও আমার কাছ থেকে চলে যেত না ।” এসব কথাগুলো গুরুদেব সব সময় বলতেন ।

সুখ-দুঃখের কথা গুরুদেবের সঙ্গে আলাপ করতাম । রাত দুটা-আড়াইটা সময় গুরুদেবের কাছে চলে যেতাম । দুটা, তিনটা সময় তিনি আমাকে ডাকতেন । গুরুদেব যখন ডাকতেন আমি গামছা পরার অবস্থায় শুয়ে আছি, তবু রাতের বেলায় তিনটা সময় গুরুদেব ফোন করতেন এবং আমি চলে যেতাম তাঁর কাছে । কাপড় পরার চিন্তাও করি নি । “কখন যে কাপড়টা পরে গুরুদেবের কাছে যাই”—সে সব কোন দিন মনে হয় নি । গুরুদেবকে মনে হত যে তিনি আমার নিজের জন… “জনকাধিক-বৎসল-স্নিগ্ধ-পদং । তিনি আমার কাছে জনকের চাইতে অধিক প্রিয় ।” পিতামাতার কাছ থেকে যা স্নেহ না পেয়েছি, তার চাইতে অনেক স্নেহ আমার গুরুদেবের কাছ থেকে পেয়েছি । যখন গুরুদেব এই জগৎ থেকে চলে গেলেন তখন মনে হচ্ছিল আর বকা দেওয়ার কেউ থাকল না । সুখ-দুঃখের কথা সব সময় গুরুদেবের সঙ্গে আলাপ করতাম আর গুরুদেব যখন এই জগৎ থেকে চলে গেলেন, একটা ছায়া—যেন একটা আবরণ—চলে গেল । কি হচ্ছে, কি হবে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না । মনে হচ্ছিল যে, আমি একা ! কিন্তু যখন অনেক বিদেশি ভক্তহণ আমার কাছে আসল, তখন মনে হল যে, “একা নই আরো । এই সুখ-দুঃখের দিনটা তাদের সবাইকে নিয়ে বহে বেড়াব ।”

গুরুদেবের অনেক অনেক কাজ, অনেক অনেক সেবার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন । অনেক কঠিন কঠিন সেবার দায়িত্ব দিয়েছেন কিন্তু কখনও গুরুদেবকে না কথাটা বলি নি । এবং গুরুদেবের কৃপা নিয়ে সেটা প্রত্যেকটা কাজে সফল হয়েছি । তিনি আমাকে দেশে প্রচারে পাঠিয়েছেন । বিদেশেও গুরুদেবের সঙ্গে অনেক বার গিয়েছি, একাও গিয়েছি—গুরুদেব আমাকে পরীক্ষা করেছেন, “ও পারে কি না ?” কিন্তু সেটা সব সম্ভব ছিল না যদি গুরুদেবের কৃপা না হত । গুরুদেব আমাকে বাংলায় প্রচারে যেতে পাঠিয়েছেন, চাল ও আলু ভিক্ষা করতে পাঠিয়েছিলেন এবং আমি সফল হয়েছি তাঁর কৃপার জন্য । কঠিন কঠিন সেবা গুরুদেব দিয়েছেন—অনেক বছর ধরে নবদ্বীপ-ধাম পরিক্রমা (আমাদের মূল উৎসব), গুরুদেবের আবির্ভাব তিথি, পরমগুরুমহারাজ শ্রীল শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজের আবির্ভাব মহোৎসব আয়োজন করার তিনি আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন । ভ্ক্তগণকে দেখাশোনা করার, অনেক গেস্টহাউস, গোবিন্দ কুণ্ড, অনেক চৈতন্যসারস্বত মঠের শাখা—এই সব দায়িত্ব গুরুদেব আমাকে দিয়েছেন এবং তিনি খুব খুশি ছিলেন । আমার এই সব দায়িত্ব দিয়ে তিনি সব সময় সুখে থাকতেন । সে বাংলায় বা বিদেশে প্রচারই হোক, চাল ভিক্ষায় হোক, আলু ভিক্ষায় হোক বা কোন মঠের গেস্টহাউস করা হোক, গোবিন্দ কুণ্ড সংস্কার করা হোক—সমস্তা কাজ আমাকে দিয়ে তিনি দেখতেন । আমি গুরুদেবের কোন কাজ থেকে পিছপা হই নি ।

গুরুদেব আমাকে বলতেন, “বেরিয়ে যাও এখান থেকে !” আমি বেরিয়ে যেতাম আবার একঘণ্টা পর চলে এসে বলতাম, “আমার দু’লাখ টাকা চায় ।” তিনি বলতেন, “তোমাকে চলে যেতে বলেছি !” আমি বলতাম, “আপনি আমাকে চলে যেতে বলেছেন, আসতে তো বারণ করেন নি ।” এই ভাবে গুরুদেবের কাছে সব সময় আসতাম । যেমন গোরুর কাছে বাছুর সব সময় বসে থাকে চুপচাপ, আমিও বাছুরের মত চুপচাপ গুরুদেবের কাছে বসতাম । যখন সেবা থাকত, সেগুলো করতাম আর বাকি সময় গুরুদেব যখন নবদ্বীপে থাকতেন, আমি তাঁর কাছে গোরুর বাছুরের মত থাকতাম । কোন প্রশ্ন করতাম না । আর সব সময় অপেক্ষা করতাম, “কখন তাঁর আদেশ আসবে ?” চাতক পাখি যেমন একটা বৃষ্টির জলের জন্য বসে থাকে, তেমন আমিও গুরুদেবের আদেশের অপেক্ষায় বসে থাকতাম ।

 

(৩) সেবার দিকে খেয়াল


যখন গুরুদেব কলকাতা থেকে বেরতেন, তিনি আমাকে ফোন করে বলতেন, “যে আমি আসব, কাউকে বলবেন না ।” আমি গোপনে গোপনে দুই-এক জনকে বলতাম যে, “ঘোরটা একটু পরিষ্কার করে রাখা হবে ।” যখন গুরুদেব কৃষ্ণনগরে আসতেন (তিনি সব সময় ওই রাস্তায় যেতেন কারণ ওই সময় কালনা রড় ছিল না), তখন তিনি আমাকে ফোন করে বলতেন, “আমি কৃষ্ণনগরে” এবং আমরা কীর্ত্তনাদি তাঁকে স্বাগত জানাতে সব প্রস্তুতি করতাম । তারপর আমরা সঙ্কীর্ত্তন করতে করতে তাঁকে তাঁর ঘরে পৌঁছিয়ে দিয়ে এসে ও আরতি ইত্যাদি করে আবার চলে আসতাম ।

গুরুদেব কী খেতে পছন্দ করতেন, কী ভালোবাসতেন, আমি সেটা জানতাম । সব বাজার থেকে নিয়ে আসতাম (সব কিছু তাঁর তাঁর রান্নাঘরে প্রস্তুত ছিল : গুরুদেব এসে তাঁর সেবক রান্না করবে) । উনি সব সময় খুব ভোর বেলায় বেরতেন আর নবদ্বীপে নটার মধ্যে চলে আসতেন । আমি সব আগের দিনে বাজার করে তাঁর ঘরে রাখতাম । যেমন গুরুদেব চামরমনি চাল পছন্দ করতেন । আতপ চাল খেতে পারতেন না কারণ সেটা খেয়ে পেটের গন্ডগোল শুরু থাকত । চামরমনি সিদ্ধ চাল খুব ভাল চাল । বেগুন ভাজা খেতেন (যে বেগুনে বিচি নাই, সেই বেগুন কিনতে হত) । এবং খুব ঝাল দিয়ে একটুখানা আলু সিদ্ধ নিতেন । কড়া ঝাল ! দুই-চারটা লঙ্কা দিতে হত (লঙ্কা পুড়িয়ে সেটা কড়া ঝাল) । মাঝে মাঝে ছোলার বা মুগ ডাল পছন্দ করতেন, একটা কোন সবজি নিয়ে । বেশি আইটেম পছন্দ করতেন না । সুগারও থাকত, কিন্তু উনি বলতেন, “আইসক্রিম খাব !” ThumbsUp খেতেন । আর আম পছন্দ করতেন । আমের সুগার বেশি, কিন্তু উনি বলতেন, “সুগার আজকে ১২০, তবে একটা আম খাব !” গুরুদেব এই সব প্রসাদ পছন্দ করতেন । আলু খাওয়া বন্ধ করে দিলেন, কিন্তু আলু পোস্ত খেতেন, খুব পছন্দ করতেন ।

এই ভাবে গুরুদেবের এই সব দিকটা খেয়াল রাখতাম—আমি সব দিকটায় জানতাম কি করে গুরুদেবকে খেয়াল রাখতে হবে ।

যে বিগ্রহ এখানে (শিলিগুড়িতে) দেখেন, সেটা গুরুদেবের পছন্দ করা বিগ্রহ । গুরুদেব আমায় একদিন বললেন, “চলুন, ঘুরি আসি ।” আমি তাঁর সঙ্গে ঘুরতে গেলাম এবং হঠাৎ যেখানে বিগ্রহ তৈরি করা হয়, সেখানে গিয়েছিলাম । মিস্ত্রি বললেন, “এই বিগ্রহটা অনেক দিন ধরে করেছি । ২০০০ সালের বন্যা এটা খেয়েছে কিন্তু কোন অসুবিধা হল না । এটা বিগ্রহ খুব ভালো ।” গুরুদেব আমাকে জিজ্ঞাসাা করলেন, “আপনার এটা পছন্দ ?” আমি বললাম, “হ্যাঁ, গুরুদেব, পছন্দ ।” “তাহলে অর্ডার দিয়ে দেন । নিয়ে চলুন ।” মিস্ত্রি বললেন, “অন্য রঙ করে দিতে হবে, তাই দুই-চার দিন পরে পাঠিয়ে দেব ।” গুরুদেব আমাকে জিজ্ঞাসাা করলে, “কোথায় বিগ্রহটা পাঠাবেন ?” আমি বললাম, “মালয়েশিয়ায় ।” কিন্তু মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয় নি, তারপর এখানে মন্দির হল, তাই এখানে প্রতিষ্ঠা করলাম । এটা গুরুদেবের পছন্দ করাই বিগ্রহ—শ্রীশ্রীগুরু-গৌরাঙ্গ-গান্ধর্ব্বা-গোবিন্দসুন্দর গুরুদেবেরই দাওয়া নাম গুরুদেবই পছন্দ করে দিয়েছিলেন ।

যখন আমি প্রথম শিলিগুড়িতে এসেছি, এখানে মঠটা হয় নি । ওই সময় গুরুদেব বিদেশে আমেরিকায় ছিলেন । আমি দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠে উৎসবে এসেছিলাম, আর ভক্ত দেখে আমার খুব পছন্দ হয়েছিল । তখন গুরুদেবকে বললাম “শিলিগুড়িতে মঠ করব ?” গুরুদেব বললেন, “আমি অসুস্থ, অপারেশন হবে । আপনি যদি ইচ্ছা করেন শিলিগুড়িতে মন্দির করতে, করতে পারেন ।” তিনি আমাকে অনুমতি দিয়েছিলেন । এই মন্দিরের চূড়াটা তিনি দেখে গিয়েছিলেন । চূড়াটা যখন হয়েছিল, তখন উনি ছবি দিয়ে দেখিছেলেন, “চুড়াটা হয়ে গিয়েছিল ।” এই তিনতলার বিল্ডিংটা দেখেন নি, এটা অনেক পরে হয়েছিল । যে একতলা বাড়ি কিনেছিলাম এবং যে এই বিল্ডিংটাও হয়েছে, সেটা তিনি ছবিতে দেখেছেন । আমি যখন এই বিল্ডিংটার উপরে চূড়া করেছি, তখন উনি বললেন, “ভিত কেমন আছে ?” যা ঠাকুরের ইচ্ছা হয়ে যাবে, আজ পর্যন্ত কোন অসুবিধা হয়ে নি । (আমি তিনতলা বিল্ডিং কিনেছিলাম, তার উপরে চূড়াটা করেছিলাম ।)

গুরুদেব এখানে আসতে পারেন নি একটা লোকের জন্য । আপনারা ভালো করেই জানেন । গুরুদেবের ইচ্ছা ছিল এখানে গরম কালে আসতে কিন্তু একটা লোকের betray (বিশ্বাসঘাতকতা) করল । শিষ্য হয়েও সে গুরুদেবের সঙ্গে প্রতারণা করেছিল । মন খারাপ হয়ে গুরুদেব বললেন যে, “দীক্ষা নিয়ে যদি শিষ্যর এইরকম অবস্থা হয়, আমি যাব না । আপনি ওখানে থাকবেন ।” সেইজন্য তিনি রাগ করে আসেন নি । শিষ্য হয়েও গুরুদেবের সঙ্গে এইরকম প্রতারণা করতে পারে ? চিটিংবাজি করতে পারে ? কল্পনা করা যায় না । সেই জন্য গুরুদেব তাকে বলেছিলেন “রক্ত চুষা মশা” । “মশা যেমন মনুষের রক্ত চুষে, সেরকম আমার শিষ্য আমার রক্ত চুষছে ।”

গুরুদেবের এই কথাগুলা অনেক সময় মনে পরে । কথাগুলা সব তো সত্য । গুরুদেবের যদি কৃপা বঞ্চিত হয়, সে কতটা অপরাধী হয়ে যেতে পারে ! রামচন্দর পুরীর কথা শুনেছেন—তিনি বৈষ্ণবের চরণে অপরাধ করে, গুরুদেবের চরণে অপরাধ করে, শেষ পর্যন্ত ভগবানের (মহাপ্রভুর) চরণে অপরাধ করেছেন এবং জগন্নাথ ছাড়া হয়ে গিয়েছে, অর্থাৎ পুরী ছাড়া কোথায় যে চলে গেল তাদের কোন হাজির পাওয়া যায় নি ।

গুরুদেব সব সময় গাছ পছন্দ করতেন । একটা গাছও তিনি কাটতে পছন্দ করতেন না । গরুও ভালোবাসতেন, গাছও ভালোবাসতেন । একসময় বিদেশী মেয়েরা বা কাজের মেয়েরা এসে গাছের তালায় পাতা জোর করে পুড়াছে—গুরুদেব বলছেন তখন, “এই গাছের তলায় তুমি পাতাগুলা পুড়াছো ! গাছটার গায়ে তাপ লাগছে, ভগবান তোমাকে এইরকম তাপ দেবে । তুমি গাছটাকে এত কষ্ট দিচ্ছো !” গোশালায় তিনি একা গরুকেও বিক্রি দিতেন না । তিনি বলেছেন, “গরু বিক্রি করলে মুসলমানরা গরুকে খেয়ে নেবে আর তার যে reactionটা (প্রতিক্রিয়াটা) হবে, সেটা আপনাকে ভোগ করতে হবে । সুতরাং এসব কাজ করবেন না ।” পুকুরের মাছও বিক্রি করতে দিতেন না । এখন, আমার নবদ্বীপ থেকে ছেড়ে আসার পরে, ওরা সব গরু ও মাছ বিক্রি করে দিয়েছে, গাছ কেটে বিক্রি করে দিয়েছে । অপরাধী হলে যা হয় । বড় বড় গাছ সে কেটে বিক্রি করে দিয়েছে ।আমি কঠিন ইট (সক্ত সক্ত ইট) দিয়ে বিল্ডিংগুলা করেছিলাম—ইট ভাঙার যদি চেষ্টা করবে, পারবে না, ইট আসতে বেরবে না । তা না হলে বিক্রি করে খেয়ে নিত । বিছানা, ফ্যান, ফ্রিজ সব বিক্রি করেছে । গুরুদেবের TVও বিক্রি করেছে । এই দশা চলছে । আমি তো কোন অসুবিধায় নেই—তারাই অসুভিধায় পড়েছে বলে তাদের এই দশা হয়েছে ।

 

(৪) সেবার মাইলস্টোনগুলো


গুরুদেব আমাকে মানুষ করেছেন । কামার যেমন একটা লোহাকের পুড়িয়ে হাতুড়ি বা দা বা কাঁচি তৈরি করে, তদ্রূপ আমাকেও গুরুদেব অল্প বয়স থেকে তৈরি করেছিলেন । আমি ত্রিশ বছর নিচে মঠে এসেছি । গুরুদেবের এক কথায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে মঠে চলে এসেছিলাম । মঠ আসার পরেও চাকরিটা ছিল, তবু গুরুদেব বলেছিলেন, “চাকরিটা ছেড়ে দিন ।” তাঁর এক কথায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম । আমার লোভনীয় চাকরি ছিল : কলেজে প্রফেসরি করতাম, ৭০-৮০,০০০ (এখন ২০০,০০০) টাকা মাহিনা । কিন্তু সেটা ছেড়ে দিয়েছিলাম এক কথায় । গুরুদেব আমাকে বলতেন, “বৃহৎ স্বার্থ পেতে হলে ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ আপনাকে ছাড়তে হবে ।” সেই কথা আমি মনে রেখেছি ।

মনে রেখেছিও কি করে বৈষ্ণব-সেবা, ভক্ত-সেবা করতে হয়, কি করে শাসন করতে হয় । সে সব গুরুদেবের কাছ থেকে শিখেছি । আর সহ্য ক্ষমতা গুরুদেব যেভাবে শিখিয়েছেন, সেইভাবে এখন দেখছেন তো কত সহ্য করে আছি ।

মঠে গরু-বাছুরগুলা দেখাশোনা করতাম, বিল্ডিং-কনস্ট্রাকশন দেখাশোনা করতাম । গুরুদেব বলেছিলেন, “এত করবেন কি করে ? যদি পারেন, তাহলে করবেন ।” আর ৫০বিঘা মঠের জমি চাষ করতাম : দুবার করে গম, তিল ও সরিষা করতাম (তিনবার চাষ হত) । তারপর বিভিন্ন মঠের শাখা হয়েছিল । বামুনপাড়ায় ও শিলিগুড়িতে মঠগুলা এবং একচাক্রায় মঠ অর্ধেকটা করেছিলাম গুরুদেবের সময় । তারপর যেগুলো হয়েছে, পরে হয়েছে । গঙ্গাসাগর ও বাঁকুড়া গুরুদেব শুনে গিয়েছিলেন কিন্তু মন্দিরগুলা দেখেন নি । কিন্তু এখম সমাধি বসে বসে তিনি এখান থেকে কৃপা করছেন আর সব কিছু দেখতে পারেন ।

গুরুদেব এখানেও বসে আছেন । আপনারা ভাবছেন, “এটা বিগ্রহ, মুর্ত্তি ।” না । তিনি ভগবান্ আছেন, গুরুদেব বসে আছেন । তিনি সব শুনতে ও দেখতে পারছেন কিন্তু সমাধির মত বসে আছেন, কিছু বলছেন না । এই অনুভূতিটা আমাদের আসতে হবে যে, গুরু জগৎ থেকে কখনও চলে যান নাই । গুরু নিত্য অবস্থান করেন, নিত্য-সেবায় বিরাজ করেন ।

শ্রীল শ্রীধর দেব-গোস্বামী মহারাজের অনেক শিষ্য ছিল, অনেক ত্যাগী-শিষ্য, অনেক ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসী-শিষ্য ছিল, হাজার হাজার শিষ্য ছিল । গুরুদেব গৃহস্থ হলেও শ্রীল শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ তাঁকে গৃহ থেকে টেনে নিয়ে এসে সন্ন্যাস দিয়ে আচার্য্য করেছিলেন । প্রথম ব্রহ্মচার্য্য পালন করেছেন, তারপর গৃহে চলে গিয়েছেন, সংসার ধর্ম্ম পালন করেছেন । তারপর ১৯৮৫ সালে শ্রীল শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ গুরুদেবকে সংসার থেকে টেনে নিয়ে এসে আবার তাঁকে সন্ন্যাস দিয়ে গুরুপদে বসিয়ে দিয়েছেন । শ্রীধর মহারাজ আড়াই বছর ছিলেন আর আগস্টে ১৯৮৮ সালে তিনি এই জগৎ থেকে চলে গিয়েছিলেন ।

আমি জীবনে কোন দিন কঠিন কষ্টেও চোখের জল ফেলি নি, কিন্তু যে গুরুদেব যাওয়ার দিন, সে দিন শুধু চোখের জল ফেলেছি । আর এই গুরুদেবের বিরহ তিথি হলে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না । নিজেকে control (সংযম) করতে পারি না । অনেক জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করেছি, গুরুভাইদের অনেক জ্বালা । আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে ওরা আমাকে জেলে ছুড়ে দিয়েছে, তাও কোন কষ্ট হয় নি । জেলে বসে আমি হরিনাম করতাম, প্রসাদ পেতাম, বই-গ্রন্থ পড়তাম । আমি কোন দিন কষ্ট পাই নি যে কষ্ট আমি পেয়েছিলাম গুরুদেবের কাছে থাকতে ।

যখন যা বলতেন । এক দিন বিকাল বালয় গুরুদেব আমাকে বলছেন, “আমি একটা শিঙ্গাড়া খেতে ইচ্ছা করছি । যান মিষ্টি দোকান থেকে শিঙ্গাড়া কিনে নিয়ে আসুন ।” শিঙ্গাড়া নিয়ে আসলাম । তিনি বলছেন, “এ গাছের বেলগুলা সব পেকে যাচ্ছে ও পড়ছে, একটা বেল তো আমাকে দিচ্ছেন না ? আমাকে বেলের শরবত করে দিন ।”

গুরুদেবের ঘরে বাথরুম থেকে প্লাস্টার খুলে খুলে পড়ছিল । ১৯৯৬ সালে (আমি তখন সন্ন্যাস নেই নি, ব্রহ্মচারী ছিলাম, বিনদ রঞ্জন নাম আমার ছিল) গুরুদেব অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলেন, তার আগে আমি তাঁর ঘরের চাবি আমার কাছে রেখে দিয়েছিলাম । যখন আমি গুরুদেবের বাথরুমটা ঠিক করে যাচ্ছিলাম, আমি ভাবলাম যে, গুরুদেবের ঘরটা খুব ছোট । তাই আমি ঘরটাকে কিছু বিস্তৃত করে দিলাম । একজন লোক গুরুদেবের কাছে নালিশ করেছিলেন বলে গুরুদেব শুনে গিয়েছিলেন যে, আমি তাঁর ঘর ভেঙ্গে দিয়েছিলাম । মন খুব খারাপ হয়ে তিনি আমার সাথে কথা বলতেন না । অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে এসেও তিনি আমার সাথে কথা বলতেন না । তিনি সেবক-কুঞ্জ ভবনে থাকলেন । তারপর একদিন তিনি আগের ঘরটা দেখতে ইচ্ছা করলেন । গিয়ে ঘরটা দেখে তিনি অবাক হয়ে বললেন, “ভালো কাজ হয়েছে ! কালকেই ঘরে ফিরে আসব ।” আমি আরো একটু বেশি খরচ করেছিলাম । যখন গুরুদেব গোশালায় যেতে ইচ্ছা করলেন, তিনি গোশালার পিছনে গিয়ে দেখতে পেলেন যে, আমি পিছনে একটা বড় গোশালা করেছিলাম । “এত বড় গোশালা হয়েছে ? আঃ এখন আমি দেখছি যার জন্য পয়সা খরচ হয়েছিল । এই কাজটা হয়েছে । আমি জানতাম না ।”

আর এক দিন একজন লোক গুরুদেবের কাছে এসে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলেন যে, “আচার্য্য মহারাজ আপনার পয়সা চুরি করছেন !” গুরুদেব বললেন, “হ্যাঁ, আমি জানি উনি পয়সা চুরি করছেন, কিন্তু আপনি বলতে পারেন কোথায় উনি পয়সাটা রেখে দিচ্ছেন ?” পরের দিন কিছু অস্ট্রেলিয়ান ভক্তেরা আমার সঙ্গে বামুনপাড়ায় গিয়েছিলেন আর যে মন্দিরটা ওখানে তৈরি করা হচ্ছিল, তার গোপনে গোপনে কিছু ছবি তুলে নিয়েছিলেন । পরে ওরা গুরুদেবকে ছবিগুলো দেখা দিয়েছিলেন । বামুনপাড়ার ছবিটা দেখে গুরুদেব জিজ্ঞাসা করলেন, “এটা কী ? কোথায় এটা ?” ভক্তেরা বললেন, “বামুনপাড়ায় ।” গুরুদেব অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, “বামুনপাড়ায় ? ওখানে মন্দির করা হচ্ছে ?! আমি ভাবলাম যে, গেস্ট-হাউস করা হচ্ছে ! আমি জানতাম না যে, আচার্য্য মহারাজ ওখানে মন্দির তৈরি করছেন !” তারপর যে লোকটা আমার বিরুদ্ধে গুরুদেবের কাছে নালিশ করতে এসেছিলেন, ওকে ডেকে গুরুদেব কম্পিউটারে ছবিটা দেখালেন ।

“দেখছেন তো ছবিটা ? কী দেখছেন তো ?” গুরুদেব জিজ্ঞাসা করলেন ।

“জানি না সেটা কী ।”

“আপনি নবদ্বীপে থেকেও কিছু জানেন না ! এটা বামুনপাড়ায় ! উনি ওখানে মন্দির তৈরি করছেন ! কালকে আপনি বললেন যে, উনি পয়সা চুরি করেছেন, কিন্তু যা চুরি করেছেন এই জন্য করেছেন ।”

গুরুদেব খুশি ছিলেন ।

 

(৫) সেবা-পরীক্ষা


সেইভাবে গুরুদেব আমাকে গাইড (guide, পরিচালনা) করেছেন ।

আমি কোন দিন কোথাও ঘুরাই নি । যখন বৃন্দাবনে মঠের জমি কিনা হয়েছিল, আমি কিছু জানতাম না (আমি মঠে নতুন ছেলে) কিন্তু এক দিন গুরুদেব আমাকে একটা অ্যাটাচি (ব্রিফকেস) দিয়ে বললেন, “এটা নিয়ে বৃন্দাবনে যেতে পারবেন ?” আমি বললাম, “হ্যাঁ, যাব ।” ভেতর কী ছিল, আমি সেটা জিজ্ঞাসা করলাম না, এটা আমার কাজ নয় । কিন্তু আমি জীবনে কোন দিন বৃন্দাবনে যাই নি (বৃন্দাবন কোথায় সেটাও আমি জানতাম না), হাওড়া স্টেশনেও যাই নি—তাই কি করে বৃন্দাবনে যাব ? যাই হোক হাওড়া স্টেশনে গেলাম । ওখানে এত বড় স্টেশনে এত ভিড় ! দেখে তো মাথা খারাপ হয়ে যাবে ! সেখানে এসে একজন লোককে জিজ্ঞাসা করলাম, “কোন ট্রেনটা বৃন্দাবন যাবে ?” যে ট্রেন লোকটা আমাকে বলল, সে ট্রেনে চেপে বসলাম (আমি একটা এক্সপ্রেস ট্রেনে টিকিট কাটলাম) । টিকিটে সিট ফিক্স নেয় বলে আমি বাথরুমের কাছে বসে থাকলাম : ব্রিফকেসটা নিচে বসিয়ে জুতা ছাড়িয়ে অ্যাটাচির মধ্যে বসে বসে থাকলাম । এইভাবে মুঘলসরাই পর্যন্ত গেলাম (এখন BJP নতুন নাম দিয়েছিল—এখন এটা দীনদয়ালে দীনদয়াল উপাধ্যায় বলা হয়) । মুঘলসরাই স্টেশনে আমি একজন দিদিকে বললাম, “৫০টাকা নিয়ে নিন, আমাকে আপনার সিটটা দিন ।” ও রাজী হল : আমি ৫০টাকা দিলাম, ও আমাকে সিটটাকে বসতে দিল । আর পাওয়া রুটির কলা বসে বসে খাচ্ছিলাম (বাংলাদেশের লোকগুলা পাওয়া রুটির কলা পছন্দ করে) । এই ভাবে দিল্লিকে চলে গেয়ে যে লোকের কাছ থেকে জমিটা গুরুদেব কিনে নিলেন, তাঁর কাছে ব্রিফকেসটা দিয়ে দিলাম । ওই সময় মোবাইল ফোন-টোন ছিল না, তাই ওই লোকটা পুরানো ফোনে গুরুদেবকে ফোন করে জানিয়ে দিলেন যে, “ব্রিফকেসটা পেয়ে গিয়েছি ।” তখন আমি ফিরে এসে ওই দিনকে সঙ্গে সঙ্গে বিকালে বা সন্ধ্যা সময় ট্রেন ধরেছিলাম । পরের দিন কলকাতায় পৌঁছলাম । ওই লোকটা আমাকে বললেন, “থাকবেন না ?” আমি বললাম, “না, আমার এখানে কাজ নেই ।” কোথায় বৃন্দাবনে যাব, কোথায় ঘুরব, কোথায় কী দেখব—ও সব চিন্তা করলাম না । গুরুদেব বলেছেন চলে যেতে, গিয়েছি, অ্যাটাচি দিয়েছি, আবার ওই দিনকে ফিরে চলে এসেছিলাম । যখন আমি এসেছিলাম, গুরুদেব আমাকে বললেন, “বাঃ, দারুণ একটা কাজ করেছেন ! আপনি জানেন অ্যাটাচিতে কী ছিল ? ১৭ লাখ টাকা ছিল । যদি কেউ জানত ওই টাকা ছিল, তাহলে তো চুরি মেরে টাকা নিয়ে চলে যেত ।” এটা টেনে নিয়ে গেলে আমি কী করতাম ? ওই সময় ১৭ লাখ টাকা তো অনেক দাম, না ? এখন এটা বোধহয় ২০ টাকার বেশি । আর আমি গুরুদেবকে জিজ্ঞাসা করি নি, উনিও কিছু বললেন নি এবং যে আমাকে বললেন নি, সেটা ভালোই, তা না হলে আমাকে বললে তার ভয়ে কাঁপতাম ।

তখন, সন্ন্যাস নেওয়ার অনেক পরে, ২০০৪-২০০৫ হবে, এক দিন সকাল বেলা গুরুদেব আমাকে খুব ভোরে ফোন করেছিলেন । উনি বললেন, “বাবা, কালকে সারা রাত ঘুমাতে পারিনি । আমার পুরির মঠটা বোধহয় দখল হয়ে গেল !” আমি বললাম, “সে কী ? পুরির মঠ দখল ?” গুরুদেব বললেন, “হ্যাঁ, ওরা আমাকে ফোন করে জানিয়ে দিল ।” যে লোকটি পুরি মঠে ছিল, ও কোন কথা আমাকে বলেনি—সেটা ঘোড়া ডিঙ্গিয়া ঘাস খাওয়া ! ওর কাজ ছিল আমাকে জানাতে কিন্তু ও আমাকে বাদ দিয়ে গুরুদেবকে জানালেন (গুরুদেবকে জানিয়ে তাঁকে ডিস্টার্ব করলেন—এটা অপরাধ) । ম্যানেজমেন্টটা তো আমি করি । আমি ওই লোককে ফোন করে বললাম, “আমি তোমাকে পুরি পাঠালাম আর তুমি তো আমাকে না জিজ্ঞাসা করে গুরুদেবকে সরাসরি বলছ ।” কী সমস্যা হয়েছে ? মঠের পাঁচিলটা ভেঙ্গে একজন লোক এসে একটা বাঁশ দিয়ে চালার মত ঘর করেছে । তাই গুরুদেব আমাকে বললেন, “ঘুমাতে পারি নি, তোমাকে পুরি যেতে হবে ।” আমি বললাম, “ঠিক আছে, আমি আসছি ।” সকাল বেলা স্নান-টান করে একবারে ট্রেন ধরে হাওড়ায় গিয়েছিলাম আর হাওড়া থেকে ট্যাক্সি দিয়ে কলকাতা মঠে গুরুদেবের কাছে এসেছিলাম (পয়সার নিয়ে চিন্তা করলাম না কারণ বাসে গিয়ে আমি সময় কেন নষ্ট করব  ?) । গুরুদেব আমাকে বললেন, “বাবা, আজকে পুরি চলে যান ।” আমার টিকিট নেই । টিকিট কথায় কিনব ? তাই আমি জেনারেল টিকিট কিনে রেসেরভেশনে বসে দিদিকে কিছু পায়সা দিয়ে সিট নিয়ে চলে গেলাম । পুরি মঠে এসে সকাল বেলায় স্নান-টান করে ওই লোককে দেখতে জগন্নাথের নাম নিয়ে গিয়েছিলাম, “জগন্নাথ, তুমি কৃপা কর !” জগন্নাথ সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন । যে লোকটা ঝামেলা পাঁচিল ভেঙ্গেছিল, সে লোকটা এসে আমাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছে । আমি ভাবলাম, “বাঃ বাঃ ! এ লোকটা জানে আমি তার শত্রু, কিন্তু আমাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছে ?!” তখন আমি ওর সঙ্গে ভালোভাবে কথা বললাম ।

আমি প্রথম রেগে ছিলাম কিন্তু ওর প্রণাম দেখে বললাম, “আচ্ছা, ভাই, তুমি তো উড়িয়া লোক, ভক্ত লোক । তুমি ঠাকুরের জায়গা কেন দখল করছো, বাবা ? তোমার তো অপরাধ, বাবা ।”

“আমি রাগে করেছি ।”

“কীসের রাগ তোমার ?”

“ও আমাকে কাজ থেকে ছেড়ে দিয়েছে ! আমি সেই রাগে এসব করছি । আমি এখানে কাঠের মিস্ত্রি কাজ করি কিন্তু ও আমাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য জনকে লাগিয়েছে ।”

“ওঃ এই রাগে তুমি এই কাজ করেছ ? আজ্ঞে, তুমি পরে কাজ করার চিন্তা কর না, আমি দিয়ে দেব ।”

“না, আমি এখন ছাড়ব না !”

উড়িয়ার লোকটা টাকার লোক, তাই আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কত টাকা চায় তোমার ?”

ও বলল, “৫০,০০০ টাকা চাই !”

“৫০,০০০ টাকা তোমাকে দেব কেন ?”

“আমি কাজ করেছি মঠে ! দেখাশোনা করেছি ! অমুক সমুখ করছি !”

ও দর করতে শুরু করল, লাস্টে ২০,০০০ বলল ।

আমি বললাম, “২০,০০০ পাব না । ৮,০০০ দিতে পারি ।”

এই ভাবে ৮,০০০, তারপর ১০,০০০, তারপর লাস্টে ১৫,০০০ । আমি ৮,০০০ টাকা ওকে দিলাম আর সেখানে একজন মহারাজ ছিলেন, তার কাছ থেকে ৭,০০০ টাকা ধার করে নিয়ে ওই লোককে দিয়ে দিলাম । ওকে বিদায় করেছিলাম । ও কাঠ-বাঁশ ছুড়িয়ে সব নিয়ে চলে গেল । আমি তিন দিন ওখানে থাকলাম : পাঁচিলটা আরো উঁচু করে দিয়ে আর গেটে-মেটে সুন্দর করে দিয়ে তারপর ফিরে চলে আসলাম ।

এই সব কঠিন কঠিন কাজ করেছি । হালকা হয় না কোনো দিন । “এটা হবে না !”—আমার কাছে কোনো দিন সেটা হল না । যে কায়দা করে, যেন-তেন প্রকারে আমি করবই করব । বিল্ডিং করার প্ল্যান, কনস্ট্রাকশন করার প্ল্যান, অমুক সমুক । এমন কি জানেন, গুরুদেব সিঁড়ি দিয়ে দোতালা পর্যন্ত উঠতে পারলেন না, এত অসুস্থ পড়েছেন, ওনাকে ভক্তেরা ওহীলচাইরে মাথায় করে তুলল, কিন্তু তখন কোন দিন মাথা থেকে ফসকায়া যেতে পারে, কার পা ফসকায়া যেতে পারে তাহলে তো বিপদ, না ? সরকারি পারমিশন (অনুমতি) ছাড়া লিফট করতে দেবে না । CPMএর আমলে সুভাষ চক্রবর্তী নামে একজন ছিল । তিনি একটা দানী লোক, ভক্ত লোক । আমি তাঁর কাছে লিফটটার কথা বললাম, উনি বললেন, “আপনি লিফট করতে চান ? ঠিক আছে, আমি চেয়ারম্যানকে লিখে দিচ্ছি ।” চেয়ারম্যানকে বলা হল, “সুভাষ চক্রবর্তী তা বলেছেন, সেটা করতেই হবে ।” কিন্তু সুভাষ চক্রবর্তীর সঙ্গে তার আবার আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক (CPMএর মধ্যে কিছু গ্রুপ থাকে) । তাই চেয়ারম্যান সে চিঠির উত্তরে আমাকে লিখে পাঠাল যে, “আপনার লিফটটা করতে পারমিশন দাওয়া হল না ।” আমি আবার সুভাষ চক্রবর্তীর কাছে গেলাম, “সুভাষদা, আপনার চিঠি ও অগ্রাহ্য করেছে । আপনার চিঠি দেওয়া পরে এই চিঠি লিখে পাঠিয়েছে ।” সুভাষ চক্রবর্তী বললেন, “আপনি লিফটটা করে নিন তো, দেখি । কে আপনাকে আটকায় ? দেখি । কোন পারমিশন লাগবে না !” তারপর আমি এগিয়ে গিয়ে লিফটটা বসিয়ে দিলাম । গুরুদেব বললেন, “ও বলছে লিফট হবে না—দেখছেন তো ? করে দিল !” লিফট করে দিলাম গুরুদেবকে । কেউ বলছেন, “হবে না ! ও লিফট করতে পারমিশন দেয়নি, হবে না ।” কিন্তু আমি করে দিলাম । এরকম বহুত বহুত কঠিন কাজ । ঝামেলার কাজ, মারামারির কাজ । রামদা ধরেছি, রাইফেল পর্যন্ত ধরেছি ।

গুরুদেব আমাকে বললেন, “বন্দুক নেবেন না ! বন্দুকের লাইসেন্স করাবেন না । বন্দুকের লাইসেন্স করালে আপনার হাত খুব sharp (শার্প, ধারালো)—আপনি রাগী, লোককে মার্ডার (খুন) করে দেবেন ! বন্দুক নেবেন না । আমি দেখেছি—গুলি মারলেন, সে হনুমানের গায়ে একবার পড়েছিল (হনুমানের ঘা করে পড়েছিল) ।” আমার পাখি মারার বন্দুকের ছিল । যখন আমি দেখলাম হনুমানটা আম নষ্ট করে যাচ্ছিল, তখন আমি হনুমানের দিকে মেরেছিলাম । কিন্তু আমি বুঝতে পারি নি তো যে, হনুমানের গায়ে পড়বে । একবারে এক শটে হনুমানে ঘা করল । তাই গুরুদেব বললেন, “বলেও বন্দুকের লাইসেন্স করাবেন না, তা না হলে মানুষ মরে যাবে ।” সেই জন্য আমি সেটা করি নি । এইভাবে গুরুদেব আমাকে বলতেন । “মোটরসাইকেল চালাবেন না আর বন্দুকের লাইসেন্স নেবেন না ।” দুটো জিনিস বলেছিলেন, “মোটরসাইকেলে চাপবেন না আর বন্দুকের লাইসেন্স করাবেন না ।” তিনি বললেন, “মোটরসাইকেল কিনবেন না, এটা ভালো নয় ।”

এই সব কথা গুরুদেব উপদেশ দিতেন, আর আমি সব সময় শুনতাম । অনেক কথা শুনতাম : অনেক কথা তাঁর কাছে শিখেছি, অনেক তাঁর কাছ থেকে শুনেছি ।

 

(৬) গুরুদেবের দূরদর্শিতা


আমি অনেক কথা গুরুদেবের কাছে শিখেছি, অনেক তাঁর কাছ থেকে শুনেছি । গুরুদেব খুব দূরদর্শী—অনেক আগে থেকে তিনি সব দেখতে পারেন ।

এক সময় একটা ঘটনা হয়েছিল । মঠে একজন ** প্রভু ছিলেন, উনি শ্রীল শ্রীধর মহারাজের ভজন-কুটিরে নিচের তলায় থাকতেন । সমস্য ছিল যে, উনি মঠের সামনে থেকে সবাইয়ের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতেন । দেখতে একদম ভালো নয় । এক দিন গুরুদেব আমাকে বললেন, “ওই লোকটাকে সেখানে থেকে সরিয়ে দেন !” কিন্তু সেটা কি করে হবে ? আমি জানতাম যে, উনি সেখানে ৫০ বছরের বেশি থেকেছিলেন বলে ঘরটা ছাড়বেন না । কিন্তু গুরুদেব আমাকে বললেন, “ওকে বলবেন যে, আপনি ওর ঘরটাকে সুন্দর করে মেরামত করে নিতে চান, তাহলে ও রাজি হয়ে ঘর থেকে সরিয়ে দিবে ।” আমি তাই করলাম আর যখন আমি মেঝেতে মার্বেল লাগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন গুরুদেব বিদেশ থেকে আমাকে ফোন করে বললেন, “ওর ঘরের বাথরুম বন্ধ করে দেবেন !” গুরুদেবের কত বুদ্ধি ! আমি বাথরুমটা ব্লক করে দিয়ে সেখানে অফিস করেছিলাম । মেরামত শেষ হয়ে ওই প্রভু ঘরে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি তাকে বললাম, “আপনি এখানে কি করে থাকবেন ? এখানে তো বাথরুম নেই ।” উনি ফিরে আসেননি । ওইরকম গুরুদেবের নির্দেশ ছিল । গুরুদেব সব সময় সব কিছু সুকৌশলে পরিচালনা করতেন ।

গুরুদেব আমাকে বললেন যে, শ্রীল শ্রীধর মহারাজ চলে যাওয়ার পরে মঠে শুধু দুই-তিন জন ছিল যারা গুরুদেবকে সহায়তা করত আর অন্য সবাই অসন্তুষ্ট ছিল যে, শ্রীল শ্রীধর মহারাজ গুরুদেবকে তাঁর সেবাইত করেছিলেন । ওই পরিস্থিতি সামলাবার জন্য গুরুদেব কী করেছিলেন ? যারা তাঁর বিরুদ্ধে ছিল, তাদের মধ্যে একজন লোককে গুরুদেব মঠের ম্যানেজার করেছিলেন । তার ফলে ওই লোকটা খুব খুশি হয়ে কখনও গুরুদেবের প্রতি আবার সাক্ষাৎ কিছু করেননি বা বলেননি (গুরুদেবের পিছনে কিছু করতে পারলেন কিন্তু যে গুরুদেব মঠের সেবাইত হয়েছিলেন, তার জন্য প্রকাশ্যে আর কখনও প্রতিবাদ করেননি) । ওই লোকটা গুরুদেবের বিরুদ্ধে ছিলেন কিন্তু গুরুদেব তাকে ম্যানেজার করেছিলেন—দেখতে পারেন কি কোরে গুরুদেব তাকে সমালাতে পেরেছেন !

গুরুদেব আমাকে অনেক কিছু বলেছিলেন : কি রকম শ্রীল শ্রীধর মহারাজের সঙ্গে সবাইয়ের সম্পর্ক ছিল ইত্যাদি । আবার গুরুদেব আমাকে অনকে কিছু শিখিয়েছিলেন : কি রকম দৈন্য হতে হবে, কি রকম সহিষ্ণুতা থাকতে হবে, কি করে সবাইকে সম্মান দিতে হবে । তিনি আমাকে সব কিছু অনেক উপায়ে শিখিয়েছিলেন ।

এক দিন আমি যে কোন জায়গায় ভক্তগণকে নেওয়ার জন্য নয়-দশ বাস আয়োজন করেছিলেন কিন্তু সকাল বেলায় সমস্ত বাসগুলো আসেনি, তাই সবাই অপেক্ষা করছিল । আমি বাস সার্ভিসে ফোন করলাম কিন্তু ওরা ফোন ধরল না । সেইজন্য, যে ভেনেজুয়েলা থেকে এক জন ভক্ত বুলেট-মোটরসাইকেল চলাতে পারলেন, ওকে বললাম, “আমাকে বাস স্ট্যান্ডে নিয়ে যাও ।” হঠাৎ করে রাস্তায় একটা ছাগল মোটরসাইকেলের চাকার নিচে পড়ল । তখন অনেক লোক এসে মারামারি করতে লাগল, আমি পালিয়ে গেলাম । পরে গুরুদেব ­ওই মারা ছাগলের জন্য ২৫০ টাকা জরিমানা পাঠিয়েছিলেন । একজন লোক এসে অভিযোগ করল, “ও আমার ছাগল মেরে ফেলেছে !” গুরুদেব জিজ্ঞাসা করলেন, “ঠিক আছে, কত টাকা চান ?” লোকটা বলল, “২৫০ টাকা চাই” আর গুরুদেব বললেন, “ঠিক আছে, ২৫০ টাকা দিচ্ছি, নিয়ে নেন ।”

আর এক দিন একজন মহিলা চিৎকার করতে করতে গুরুদেবকে অনেক গালাগাল দিচ্ছিল । আমি সেটা সহ্য করতে পারলাম না । একটা বাঁশি ধরে আমি ওকে মেরে হাত ভেঙ্গে ফেললাম ! সমস্যাটা সামলাতে করবার জন্য গুরুদেব ওই মহিলাকে হাসপাতালে পাঠালেন । তারপর ও পুলিশ স্টেশনে গুরুদেবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে যাচ্ছিল কিন্তু গুরুদেব একজন সিকিউরিটি গার্ডকে নিয়ে একটা গাড়ি আয়োজন করে ওকে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন । গুরুদেব বললেন, “যেকোনো জায়গায় ওকে পাঠিয়ে দিন । ওখানে ছেড়ে দিয়ে বলবেন যে, ওই মহিলা এখানে কখনও আবার আসতে পারবে না ।” মাঝে মাঝে আমি ওই মহিলাকে বৃন্দাবনে দেখতে পাই, তার পক্ষাঘাত (প্যারালাইসিস) হয়েছে । এই সময়ও যখন আমি বৃন্দাবনে গিয়েছিলাম, তখন ওকে দেখতে পেলাম (ও ভিক্ষা করছিল) ।

গুরুদেবের অনেক লীলাগুলো আমার সঙ্গে ছিল… এক সময় *** মহারাজ গুরুদেবের কাছে এসেছিলেন । গুরুদেব তাঁর চরিত্রের নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন । সেইজন্য যখন ওই মহারাজ গুরুদেবের কাছে এসেছিলেন কিছু কথা বলবার জন্য, তখন গুরুদেব সঙ্গে সঙ্গে খবরের কাগজ হাতে তুলে উঁচু করে মুখটা ঢেকে দিলেন এবং কাগজটা পড়ার ভান করলেন । আমি গুরুদেবের সামনে তখন বসে ছিলাম । ওই মহারাজ চলে যাওয়ার পরে গুরুদেব আমাকে বললেন, “আপনি জানেন কেন আমি এটা করেছি ? আমি জানি ও কীসের জন্য এসেছে । যা ও বলতে চায়, আমি সেটা সহ্য করতে পারি না । তাই আমি বরং মুখটা ঢেকে দেব যেন ওর কথা শুনতে না পাই ।”

অন্য সময় দামোদর মহারাজ গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন । কৈখালী মঠে একজন ব্রহ্মচারী প্রসাদম্ পরিবেশন করতে করতে তাকে পটল দিয়েছিলেন (ওই সময় চাতুর্মাস্য ছিল, কার্ত্তিক মাস—যে সব কঠোর নিয়ম মানছে, তার কাছে পটল নিষেধ) । থালায় পটল পেয়ে দামোদর মহারাজের মন খারাপ হয়েছিল, সেইজন্য উনি অনশন ঘোষণা করে গুরুদেবের কাছে এসেছিলেন । এসে দেখলেন যে, গুরুদেব বিশ্রাম নিচ্ছেন । অপেক্ষা করে বসেছিলেন । যখন ২:৩০ সময় গুরুদেব উঠেছেন, তখন তাঁর সেবক বললেন যে, “দামোদর মহারাজ অপেক্ষায় দু’ঘণ্টার বেশি বসে আছেন ।” গুরুদেব অবাক হয়ে ভাবলেন, “দু’ঘণ্টা ? বোধহয় কিছু হয়েছিল ।” তখন দামোদর মহারাজ এসেছিলেন ।

“কী হচ্ছে, মহারাজ ?” গুরুদেব তাকে শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করলেন ।

“ওই ছেলেকে বের করে দিন ! তা না হলে আমি কৈখালীতে ফিরে আসব না !”

“কী হচ্ছে ? বলুন, মহারাজ ।”

“ও আমাকে পটল দিয়েছে !”

“তাদের নিয়ে অসুবিধা কী, মহারাজ ? আপনি ঠাকুরকে ভোগ দিচ্ছেন, প্রসাদম্ আসছে আর ও আপনাকে পটল দিয়েছে । আপনি কি পটল খাচ্ছেন ?”

“না, না ! আমি পটল খাচ্ছি না !”

“আমিও পটল খাচ্ছি না—আমি প্রসাদ পাচ্ছি ।”

“না, ওকে বের করে দিতে হবে !”

“মহারাজ,” গুরুদেব তাকে বুঝিয়ে দিলেন, “আপনার সঙ্গে ওখানে শুধু একজন ব্রহ্মচারী । কেউ আপনার সঙ্গে থাকতে পারেন না, তাই আমি ওই ব্রহ্মচারীকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিলাম । যদিও ছেলেটা আপনাকে কোন জ্বালা দেবে বা লাঠি মারবে, আপনাকে সব কিছু সহ্য করতে হবে । কেউ আপনার সঙ্গে থাকতে চায় না কিন্তু ওই ছেলে এখনও মঠে আছে । যদি ও চলে যায়, তাহলে আপনাকে রান্না করতে হবে, পূজাদি করতে হবে । পারবেন ? আমার হেলিকপ্টার নেই যেন আমি কৈখালীতে এসে পূজা করে আবার ফিরে আসব । সব পূজা-রান্নাদি একাই করতে পারবেন ? যদি পারবেন, তাহলে আমি ছেলেকে বলব এখানে আসতে, আমার সঙ্গে থাকতে । পারবেন ?”

“না…”

“তখন ওকে বলবেন যে, ও সেখানে থাকতে পারে ।”

আর তখন গুরুদেব মহারাজকে ভালো পুষ্টি দিয়েছিলেন : তাকে মিষ্টি, বিস্কুট ও চকলেট দিলেন । দামোদর মহারাজ শান্ত হয়ে চলে গেলেন । এই ভাবে গুরুদেব তাকে সমলালেন ।

অনেক কিছু হয়েছিল । গুরুদেব সব সময় বুঝতে পারেন কে মঠে থাকতে পারবে বা পারবে না । এক সময় আমি একজন লোককে গুরুদেবের কাছে নিয়েছিলাম দীক্ষা দেওয়ার জন্য কিন্তু পরে ছেলেটা মঠ ছেড়ে চলে গেল । গুরুদেব আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “নতুন ছেলেটা কোথায় ?” আমি বললাম যে, ছেলেটা চলে গিয়েছিল । তখন গুরুদেব বললেন, “আপনি সব সময় কেরোসিনে ভাজা লুচি পছন্দ করেন । আমি তো জানি ও থাকবে না কিন্তু আপনি ওকে এনেছেন, আমি ওকে দীক্ষা দিয়েছি । আমি জানতাম ও থাকতে পারবে কি না…”

আর আমি দেখেছি গুরুদেবের কত আসক্তি তাঁর গুরু মহারাজ ও ঠাকুরের প্রতি ছিল । এক সময় ভক্তগণ গুরুদেবকে পয়সা দিয়েছিল । কিছু দিন পরে গুরুদেব জানতে পেরেছিলেন যে, তাঁর মা দামি কেওকারপিন তেল কিনেন । গুরুদেব ধনঞ্জয়কে (তাঁর ছোট ভাইকে) অনেক খারাপ ভাষায় গালাগাল দিলেন । “তোমার মা ভিখারিণী হয়ে অন্য লোকের বাড়িতে কাজ করত আর এখন ও রাণী হয়েছে ! মঠে এসে ও ভালো ঘরে থাকে, দুই-তিন জন চাকরবাকর রয়েছে ওর কাছে, আর এখন ও কেওকারপিন তেল লাগাই ! সেটা কী ?! ওই তেলের দাম ২০০ টাকা ! এটা ঠাকুরের পয়সা, গুরুমহারাজের পয়সা ! যদি ও আবার সেটা করবে, ওকে মঠ থেকে চলে যেতে হবে !” এইভাবে গুরুদেব বললেন ।

এক সময় (আমি তখন ব্রহ্মচারী ছিলাম) গুরুদেবের ভাইপো আমাকে অনেক উৎপীড়ন করত । গুরুদেব তা জানতে পেরে ভাইকে বললেন, “যদি তুমি মঠে আসে, আসতে পার কিন্তু আমি তোর মেয়েকে এখানে আসতে অনুমতি দেব না । ও মঠে কখনও আবার আসবে না ।” মেয়েটা মঠ থেকে চলে গিয়েছিল আর দশ বছর আরকি ফিরে আসল না । যখন গুরুদেব অসুস্থ পড়েছেন, ২০০৮-২০০৯ সালে, তখন ও ফিরে এসেছে ; নয়তো ও মন্দিরে মুখ দেখায়নি । এইরকম ব্যাপারে গুরুদেব খুব কড়া ছিলেন ।

 

(৭) গুরুদেবের স্নেহশীল ভালোবাসা


গুরুদেব একদিন পৌল বৈশাখ আমাকে বললেন, “চলুন, আজকে গঙ্গায় স্নান করব !” গুরুদেব গঙ্গাতীরে গিয়ে উত্তরিয়াটা খুলে, খাপর যেভাবে পড়া ছিল, সেইভাবে পড়ে নামলেন । আমিও সেইভাবে নামলাম গঙ্গায় । গুরুদেব গঙ্গা খুব সাঁতার কাটলেন, আমিও সাঁতার কাটলাম । এদিকে গুরুদেবের হাতে হীরা ছিল । বিদেশী ভক্তেরা দিয়েছিল তাই তিনি ওই হীরাটা পড়তেন সব সময় । দামি হীরা—দুই-চার লখ টাকা দাম হবে । তখন সাঁতার কাটার সময় হীরাটা গঙ্গায় হারিয়রে গেল । গুরুদেব আমাকে বললেন, “গঙ্গাদেবী আমার হীরাটা নিয়ে নিল । আজ্ঞে, কি করা যাবে ?” যখন গঙ্গাকে প্রণাম করে গুরুদেব জল থেকে উঠে ফিরে আসছেন, তখন দেখলেন তাঁর পায় এটা কী লেগেছে । গুরুদেব বললেন, “এটা কি ? দেখি ।” আর দেখলেন যে, হীরাটা হাতে ফেলল । “দেখুন, পেয়ে গেলাম ! আবার গঙ্গাদেবী ফেরত দিয়ে দিল ।” এরকম গুরুদেব অনেক সময় অনেক কিছু করেছেন ।

Misconception (অপসিদ্ধান্ত, ভুলধারণা) কখনো পছন্দ করতেন না এবং কখনো সহ্য করতেন না । সব সময় মিতব্যয়ী ছিলেন : যে কোন সময় প্রয়োজন থাকত, তখন খরচ করতেন ; প্রয়োজন ছাড়া খরচ করতেন না । এক দিন আমি গুরুদেবের সঙ্গে হাপানিয়াতে গিয়েছিলাম । গুরুদেব বললেন, “ঠিক আছে, আজকে আমি আমার মঠে হাপানিয়ায় যাব !” রাস্তায় গাড়িটা থামিয়ে তিনি আমাকে ১০০ টাকা দিয়ে বললেন, “দই ও মিষ্টি কিনে নিন ।” আমি একটু দেরি করে ফেললাম । গুরুদেব আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন , “কেন দেরি হল ? দরকষাকষি করেছেন নাকি ? করবেন না, এটা ভালো নয় । ঠাকুরের জন্য কিছু কিনতে গেলে দরকষাকষি করবেন না ।”

মাঝে মাঝে গুরুদেব আমাকে বললেন, “প্রসাদ কি করে পরিবেশন করবেন ? সবাই মুখ দেখে দেখে প্রসাদ পরিবেশন করবেন ।” মুখ দেখে দেখে মানে যে, আপনার কাছের লোক, তাকে বেশি বেশি দেবেন আর ছানা-রস, পনির দেবেন ? না । যে সুগার রোগী, তাকে মিষ্টি দেবেন না আর যে মিষ্টি খেতে চায়, তাকে দুটো চাইতে চারটা দেবেন । সেটাও গুরুদেব আমাকে শিখিয়ে দিলেন । আর বাচ্চা ছেলে পাশে বসবে দেখে দেবেন—বাচ্চা আর মা একসঙ্গে খেতে বসে কিন্তু বাচ্চা অত খেতে পারে না ; যদি একি রকম পরিবেশন করে যান, তাহলে বাচ্চা তো নষ্ট করবে । এভাবে গুরুদেব বলতেন । এসব কথা গুরুদেব সব সময় বলতেন, তিনি অনেক অনেক ধরনের উপদেশ দিতেন ।

অনেক ঐশ্বরিক শক্তি ছিল (উপর থেকে অনেক শক্তি তাঁর ছিল) । তিনি বুঝতে পারেন কী হচ্ছি আর কী হবে । তিনি সব জানেন ।

গুরুদেব খেতে ভালোবাসতেন, অপরকে খাওয়াতে ভালোবাসতেন । বৈষ্ণবদের সঙ্গে একসঙ্গে প্রসাদ পেতে ভালোবাসতেন । আমি দেখেছি, যখন তিনি প্রথমে শ্রীল শ্রীধর মহারাজের তিরোভাব বা আবির্ভাব উৎসব করতেন, তখন তিনি ভক্তদের সঙ্গে প্রসাদ পেতে পছন্দ করতেন । ওই সময় প্রসাদ-হল হয়নি আর তিনি সব সময় ভক্তদের সঙ্গে (সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচাীদের সঙ্গে) প্রসাদ পেতেন । যেখন পুরিও যেতেন, তিনি বৈষ্ণবসেবা আয়োজন করতেন—সমস্ত মঠের বৈষ্ণবগণকে নিমন্ত্রণ করে বৈষ্ণবগণকে প্রসাদ দিতেন । বিভিন্ন মঠ থেকে নিমন্ত্রণ করে পুরিতে বৈষ্ণবসেবা দিতেন ।

গুরুদেব কখনো তাঁর গুরু মহারাজের অপমান সহ্য করতে পারতেন না । তাঁর গুরু মহারাজের অপমান বিষয়ের নিয়ে তাঁর zero tolerance (জিরো টলারেন্স) ছিল । এত সহ্য ক্ষমতা কিন্তু তাঁর গুরু মহারাজের সম্বন্ধে কেউ কিছু বলুক তিনি সেটা সহ্য করতেন না । এইভাবে তিনি গুরুদেবকে ভালোবাসতেন ।

বিভিন্ন উৎসবে যখন আমি অন্যান্য গৌড়ীয় মঠ থেকে বৈষ্ণবগণকে নিমন্ত্রণ করতাম, তিনি সব সময় সুন্দর ভাবে সময় সময় জিজ্ঞাসা করতেন , “কী রান্না করা হচ্ছে ? কত প্রসাদ পরিবেশন করা হচ্ছে ? সবাই প্রসাদ পেয়ে তারা খুশি কিনা ? সব কিছু ঠিক হচ্ছে কিনা ?” সব কিছু তিনি জিজ্ঞাসা করতেন । উপরন্তু তাঁর যে সহযোগী বা সেবক ছিল, তিনি তাকে পাঠিয়ে দিলেন যেন উনি প্রসাদ-হলে গিয়ে পরে তাঁকে report (রিপোর্ট, খবর) করবেন কী ওখানে হচ্ছে : সবাই ঠিক মত প্রসাদ পেয়েছেন কিনা ? তিনি সব সময় এইসব দেখাশোনা করতেন । এভাবে গুরুদেব উৎসব করতেন । পরম-গুরুমহারাজ চৌসা আম পছন্দ করতেন আর গুরুদেব উৎসব দিনে সমস্ত ভক্তগণকে চৌসা আম পরিবেশন করতেন ।

এক সময় গুরুদেব আমাকে বললেন, “আমার সঙ্গে যাবেন ?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কোথায় ?” তিনি বললেন তখন, “এটা 100% শরণাগত নয় ।” এইভাবে গুরুদেবের প্রত্যেকটা কথা আমার মনে হয়… গুরুদেব বলতেন যে, গুরুর বকাটাই হচ্ছে গুরুর আশীর্বাদ । গুরুদেব যে বকাবকি করেন, সেটা হচ্ছে আশীর্বাদ । এটা সব সময় মনে রাখতে হবে । আমি সেটা ক্ষণে ক্ষণে বুঝতে পারি । আমি নিজে বুঝতে পারি যে, গুরুদেবের বকাটা কত প্রিয়, কত প্রয়োজনীয় ! এই জীবনে একমাত্র প্রয়োজন গুরুদেবের বকাবকি । কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করবে, “হরিভজনে কী প্রয়োজন ?” আমি বলব, “গুরুদেবের বকাটাই প্রয়োজন ।” শিবানন্দ সেন সেটা বুঝতে পেরেছিলেন, জগদানন্দ পণ্ডিত সেটা বুঝতে পেরেছিলেন এবং সনাতন গোস্বামী প্রভু সেটা বুঝতে পেরেছিলেন । এই ভক্তি-জগতে গুরু-বৈষ্ণবের আশীর্বাদ কাকে বলে ? আশীর্বাদ হচ্ছে গুরু যদি গালাগালি বা বকাবকি করেন, এইটা হচ্ছে আশীর্বাদ । আমাদেরকে ভালোভাবে তিনি শিখিয়ে দেন, এইটা যেন আমাদের সব সময় থাকে । কিন্তু আমাদের কপাল এইরকম—সেটা আগে ছিল কিন্তু এখন তো আর কে বকাবকি দেবে ? কে গালাগাল দেবে, বলুন ? কিন্তু সে গালাগালটা ছিল সব সময় স্নেহশীল, ভালোবাসা ও প্রীতি…

এক সময়, আমি জানি না গুরুদেব কি করে জানতে পেরেছেন যে, আমি দুধ খেতাম না । কিন্তু আমি গোশালায় খাবার নিতাম, গোশালায় সেবা করতাম । যাইহোক, গুরুদেব আমাকে ছানা দিতেন । আর অন্যান্য ভক্তগণ অবাক হয়ে গেল, “কি ব্যাপার? নতুন ছেলে মঠে এসে, দুমাস হয়ে নি, আর ওর জন্য ছানা ! আমরা দশ-কুড়ি-ত্রিশ বছর মঠে, আমাদের ছানা নেই !” তখন যে পরিবেশন করছে, সে বলছে, “আমার কোন কিছু করার নেই । সেটা উপরআলো অর্ডার (হাই কমান্ডারের অর্ডার) ! ওখান থেকে নির্দেশ এসেছে । কিছু করার নেই ।”

এক সময় কিছু ভক্তগণের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে আমি অপারেশনে গিয়েছিলাম । অনেক বছর ধরে আমার পিত্তথলির পাথর ছিল, আমি ব্যথা সহ্য করলাম, করলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাবলাম, “এটা ভালো নয় ।” তাই ২০০৫ সালে আমি চেন্নাই অপারেশনের জন্য গিয়েছিলাম । অপারেশনটা শেষ হওয়ার পর আমি সরাসরি ফিরে যেতে চেয়েছিলাম কারণ হাসপাতালে থাকার জন্য অনক পয়সা লাগল । আমার কাছে শুধু ১৫,০০০টাকা ছিল কিন্তু ৫০,০০০টাকা লাগল । সেটা জানতে পেয়ে গুরুদেব একজন লোককে বললেন, “যেভাবেই হক, পয়সা ওকে পাঠাও ।” ওই লোকটা কিছু পয়সা আমাকে পাঠালেন । আবার যথেষ্ট নয় । তারপর যে পুরি মঠে শ্রীপদ পুরি মহারাজ থাকতেন (তিনি এখন দেহ ত্যাগ করে চলে গিয়েছেন), তিনিও আমাকে কিছু পয়সা পাঠিয়ে দিলেন । গুরুদেব আমাকে বললেন, “যতটুকু পয়সা দরকার, ফিরবেন না—অপারেশন শেষ হবে, তখন ফিরে আসবেন ।” যখন অপারেশন শেষ হল, আমি তৎক্ষণাৎ ট্রেন ধরে ফিরে এলাম । গুরুদেব অবাক হয়ে গেলেন, “কি একটা অদ্ভুত লোক । কালকে আপনার অপারেশন ছিল, আপনার প্লেনে চলে যেতে হল কিন্তু আপনি ট্রেন ধরে চলে এসেছিলেন !”

“আমি ওখানে কি করব ? ওখানে থেকে থেকে গরম সহ্য করব ? বসে বসে খুব ভালো লাগে থাকতে মঠ ছাড়া ?”

“সেলাই, প্লাস্টার ইত্যাদি বের করা হয়নি আর আপনি চলে গিয়েছিলেন !”

“আমি নিজে বের করব ।” (যখন প্লাস্টারের ভিতরে চুলকানি শুরু হল, তখন আমি নিজে নিজে ওই প্লাস্টার তুলে নিয়েছি ।)

“কিন্তু কালকে তো অপারেশন হয়েছিল আর আজকেই চলে আসতে হবে ?! আর ট্রেনে গিয়ে স্লিপার ক্লাসে ! এটা কি ?”

“কেন আবার পয়সা খরচ করব ? এরোপ্লেনে যাব, A/C টিকিট কিনব—এসব কোন দরকার নেই । আমি খুশিতে এসেছি ।”

“তাই নাকি ? খুশিতে ?”

এই রকম গুরুদেবের স্নেহ, ভালোবাসা ছিল । এভাবে তিনি সব সময় ভালোবাসতেন । তাঁর স্নেহ ও ভালোবাসা কে বুঝতে পারে ? শুধু দীক্ষা নিলে তা হয় না ।

 

(৮) গুরুদেবের মিশনের পোষণ করা


মন্ত্র নিলেই শিষ্য হতে পারে না । গুরুদেবের প্রতি ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা দেখাতে হবে ।

দেখছেন তো এই অস্ট্রেলিয়ান মেয়েটা এখানে বসে আছে, কৃষ্ণসুন্দরী দিদি । ও বয়স্ক লোক, ওর ৭০ বছরের উপরে বয়স । ও পেনশন পেয়ে যে টাকাটা পায় সে টাকাটা পুরোটাই মঠে দিয়ে দেয় । যখন আমি শিলিগুড়িতে আসছি, ও ৪০,০০০টাকা আমাকে দিয়েছে, বলছে, “গুরুদেবের উৎসব ভালো করে করতে হবে ।” আর একজন ওর কাছে ২০,০০০টাকে দিয়েছিল, সেটা ও আমাকে কালকে দিয়েছে । ও আমার কাছে থেকে লোকডাউনের মধ্যে প্রত্যেক মাসে ৪০-৫০,০০০টাকা দিয়ে গিয়েছে আবার বাইরে থেকে কালেকশন করে ও দিয়েছে (কালেকশন মানে বিদেশ থেকে ফোনে ফোনে কালেকশন করেছে) । এরা প্রাণ দিয়ে সেবা করে । দেখছেন তো কত সুন্দর ঠাকুর সাজিয়েছে, কাল রাতে । কত সুন্দর ঠাকুরের ড্রেস (পোষাক) ও মুকুট বৃন্দাবন থেকে নিয়ে এসেছি । একটা ১০ বছরের বাচ্চা ছেলে বলছে, “আমার টিফিনের পয়সা দিয়ে আমি গুরুদেবকে কিছু কিনে নেব ।” টিফিনের পয়সা থেকে একটাকা-দুটাকা করে জমিয়ে জমিয়ে পয়সা এখানে পাঠিয়ে বললেন, “একটা সোনার ঘড়ি কিনে দাও গুরুদেবকে ।” কিন্তু আমি তো ঘড়ি বেশি পরি না, খুব কম (শুধু বাহিরে গেলে একটু টাইমটা দেখি কারণ মোবাইলে টাইমটা ভুল হয়ে যায় মাঝে মাঝে) । এইভাবে এরা প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে ।

আমি বৃন্দাবনে বসে মনে কলাম যে, “শিলিগুড়ি যাব, ঠাকুরের ড্রেস ও মুকুট নিয়ে যাই এবং ঠাকুরের জন্য একটা ময়ূরের পালক নিয়ে যাই । গুরুদেবেরও একটু ড্রেস নিয়ে যাই ।” শ্রীল ভক্তিবিনোর ঠাকুর বলেছেন : “নিজের পোষণ কভু না ভাবিব, রহিব ভাবের ভরে” (শরণাগতি, ১৯) । নিজের পোষণ, নিজের জন্য কখনো চিন্তা করি না—গুরু-বৈষ্ণবের চিন্তা করলে, গুরু-বৈষ্ণবরা আপনাদের জন্য চিন্তা কবেন ।

আমি নৃসিংহপল্লীতে শ্রীপদ নিরীহ মহারাজ, শ্রীপদ বিষ্ণু মহারাজ ও চন্দন প্রভুকে রাত্রে ফোন করে বললাম, “ভোর বেলা উঠে মায়াপুর চলে যাবে । সব মঠে মঠে নিমন্ত্রণ করে এসে বৈষ্ণবদেরকে প্রসাদ দেবে ।” তারক প্রভুকেও বললাম, “ভালো করে রান্না করবে । সুন্দর করে চিলি পনির, পোলাও, পনির রসা, খেজুরের রস, পটলের রসা, সুক্ত, শাক, চাটনি করবে । আবার ছানার কেক করবে ।” ছানার কেক অর্ডার দিয়েছি (মিষ্টি দোকানে ফোন করে বলে দিয়েছি) ।

প্রসাদের ঘরটা আবার কমপ্লিট (সম্পূর্ণ) হয়ে গিয়েছে—শুধু মার্বেলটা বসানো বাকি হচ্ছে । সেখানে একসঙ্গে ৫০০ লোক বসে প্রসাদ পাবে । মন্দিরের পিছনে জায়গা কিনে নিয়ে বড় করে প্রসাদের ঘর করেছি । সব গুরুদেবের কৃপায় আছে । আমার একটা টাকাও ছিল না, আমি শূন্য হাতে চলে এসেছিলাম কিন্তু এখন তো কতগুলো মঠ হয়েছে । প্রচার করে করে, করে করে, এ সব হয়েছে । নৃসিংহচতুর্দশী পরেই উলুবেড়িয়ায় বিগ্রহটা প্রতিষ্ঠা করে দেব । উলুবেড়িয়া মঠটা হয়ে গিয়েছে । রঙের কাজ হয়ে গেছে আর এখন ওরা মার্বেলটা ঘষছে । একজনে মাত্রা ১০-১১ খাদা জায়গা দিয়েছে আর আমি ওখানে মঠ করেছি । গুরুদেবের কৃপা আছে, তাই এইসব হচ্ছে । আমি তো ব্যবসা করি না, স্মাগলিংও (চোরাচালানও) করি না—ভগবান দিচ্ছেন, ভক্তেরা দিচ্ছেন, তাই আমি খরচ করি । এই উৎসবের জন্য ভক্তেরা দুই-তিন লাখ টাকা দিয়ে দিয়েছে, কিন্তু উৎসবটা ছোটো হয়েছে । আমি কালকে বসে চিন্তা করছি, “টাকাটা কি করে খরচ করব ? যে এত টাকাটা দিয়েছে লোকে এই উৎসবের জন্য, এত টাকাটা খরচ হবে না । তাই কি করব ? নাট-মন্দিরটাকে সমান করে দেব আর মার্বেল লাগিয়ে দেব ।” বারবার এই প্লাষ্টিক আনি কিন্তু ছিঁড়ে যায়—একবারে পাথর বা টিলেস লাগিয়ে দেব । আপনাদের কষ্টও হবে না, কিছুই করতে হবে না । সেই ভাবে গুরুদেব তো ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন । নৃসিংহপল্লীতে এখন চারতলা বিরাট বিল্ডিং করেছি । একটা বিল্ডিংয়ে ৭৬খানা রুম : যদি ১০জন করে থাকে, তাও ৭৬০ জন থাকবে এক-একটা রুমে । আর প্রত্যেকটা রুমেই বাথরুম-পায়খানা, কোন অসুবিধা, কিছুই নাই । গুরুদেবের ইচ্ছায় সব হয়েছে । উলুবেড়িয়াতে খুব ভালো জায়গাটা পেয়েছি । আমি একটু গঙ্গায় স্নান করতে ইচ্ছা করি ; গরমের দিনে গঙ্গায় গিয়ে থাকব ওখানে । একটা রুম তো আমার জন্য থাকবে, ওখানে গিয়ে থাকব । কোন অসুবিধা নেই । গুরুদেব তো সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, তাই কোন অসুবিধা, কিছুই নাই । ওদের মত আমার গাছ, গরু বা মাছ বিক্রি করতে হচ্ছে না । গুরুদেবের কৃপাটাই হচ্ছে আসল—যার কৃপা আছে, তার সব আছে আর যার কৃপা নাই, তার কিছু নাই । “শূন্য কলস বাজে বেশি ।” সেইভাবে সাধু সাজলে হবে না তো, সাধু হতে হবে ।

গুরুদেব এই অধমকে রেখে দিয়ে চলে গিয়েছেন । আমি গুরুদেবকে কথা দিয়েছিলাম, “যতই কষ্ট আসুক, যতই বাধা আসুক, আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না ।” সেইজন্য আমি আপনাদেরকে ছেড়ে যাইনি । এখন পর্যন্ত তাঁর ভক্তগণকে ও মঠগুলাকে দেখি । আমি তো ওখান থেকে ইচ্ছা করে আসে নি । ওরা বললেন, “আপনাকে খুন করে দেবে ! আপনি চলে যান ।” আমি বললাম, “ঠিক আছে, যাচ্ছি । কোন চিন্তা নেই । তোমরা ভালো থাক ।” আমার কোন অসুবিধা নেই । এখন ওরা ডাকছে আমাকে, “আসুন !” আমি বললাম, “ওই ঝামেলায় যাব কেন ? যতক্ষণ পর্যন্ত ওরা ওখান থেকে বিদায় না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি ওখানে যাব না ।” যাই হোক, গুরুদেব এই অধমকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন কিন্তু ভগবান সব সময় গুরুদেবের সেবায়, তাঁর সেবায়, ভক্তদের সেবায় যদি আমাকে নিযুক্ত রাখবেন, সেটা আমার পক্ষে যথেষ্ট… আজকে গুরুদেবের তিরোভাব উৎসব । বৈষ্ণবগণ ভগবানের নিজ জন, তাঁরা ভগবানের নির্দেশে আসেন আর ভগবানের নির্দেশে চলে যান ।

যেদিন গুরুদেব চলে যাবে, গুরুদেব সেটা বুঝতে পারলেন কিন্তু আমি তখন বুঝতে পারি নি । গুরুদেব আমাকে ডাকলেন, “এক্ষুনি চলে আসুন” তাই আমি চলে গেলাম কলকাতায় । আমার পরের দিন কথা দেওয়া ছিল যে, মেদিনীপুর যাব, দ্বাদশী দিন (আজকের দিনের দিন) । আমি ভাবলাম, “সকাল অন্ন প্রসাদ পেয়ে পারণ করে চলে যাব মেদিনীপুর ।” একাদশীর আগের দিন গুরুদেব আমাকে ডাকছেন, আমি চলে গেছি । রাতে ওখানে থাকলাম । রাত্রে দুবার-তিনবার গুরুদেবকে দেখেছে । তারপর, পরেরদিন আমি দুপুরে প্রসাদ পেয়ে গুরুদেবের কাছে এসেছি চলে যাওয়ার আগে ।

“প্রসাদ পেয়েছেন ?” গুরুদেব আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন ।

“হ্যাঁ,” বললাম, “পেয়েছি । গুরুদেব, এখন আসছি । আমি তো নবদ্বীপ যাই ।”

“নবদ্বীপ ? আমাকে নিয়ে যাবেন না ?”

“গুরুদেব, আপনি তো অসুস্থ আছেন, আপনি পরে যাবেন ।”

“কালকে আপনি আসবেন ।”

সেটাই যে গুরুদেবকে শেষ দেখা ছিল, আমি তা জানলাম না… জীবনেও কল্পনা করতে পারিনি । সেখান থেকে নবদ্বীপে চলে এসে সন্ধ্যা সময় মঠে রেস্ট-টেস্ট (বিশ্রাম) নিয়ে সকাল বেলা বেরব বলে আমি তাড়াতাড়ি উঠলাম । হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল । “আপনি এক্ষুনি চলে আসুন ।” তখন আমায় খবর দাওয়া হয় নি যে, গুরু মহারাজ চলে গিয়েছেন । ও বলল, “গুরুদেবের শরীরটা খুবই খারাপ, আপনাকে এক্ষুনি আসতে হবে ।” আমি একটু আঁচ করতে পেরেছিলাম । তখন আমি ড্রাইভারকে বললাম, “তাড়াতাড়ি বেরাও, এক্ষুনি চলে যেতে হবে ।” চলে গেলাম । তখন কলকাতায় গিয়ে দেখলাম ওই অবস্থা আর কি… তারপর ওখানে A/C অ্যাম্বুলেন্স ডেকে গুরুদেবকে নবদ্বীপে নিয়েছি । ভিতরে শুধু আমি বসেছিলাম গুরুদেবের কাছে আর সামনে গুরুদেবের বিদেশি (ব্রাজিলিয়ান) সেবক দেববন্ধু প্রভু ও নন্দপ্রিয়া দিদি ছিল । গুরুদেবকে নিয়ে রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্সটা একটু ধারাল পেট্রোল পাম্পে, ওখানে থেকে বসে বসে ওই অবস্থায় । তারপর বিভিন্ন জায়গায় টেলিভিশনে, রেডিওতে ফোন করলাম, বিভিন্ন মঠে খবর দিলাম । আমাকে আচার্য্য হিসেবে গুরুদেবকে স্নান করিয়ে তিলক তিলক করতে হল । তখন, গুরুদেব গর্তের মধ্যে বসালেন । তিনি আমাকে আগে বলেছিলেন যে তাঁর দেহ পরমগুরুমহারাজের কাছে রাখতে হবে, তাই সেখানে আমি তাঁকে রেখেছিলাম  । সবাই আমাকে বলল, “আপনি নিচে নামবেন । আপনি তো আচার্য্য, আপনাকে গায়ত্রীমন্ত্রটা বুকের মধ্যে লিখতে হবে ।” এই দৃশ্যটা, এই গর্তের মধ্যে, আমি সহ্য করতে পারলাম না । তখন তো কোন অবস্থায় বেঁচে আছি না মরে গেছি, আমার কোন চিন্তা ছিল না । কোনোরকম করে গুরুদেবের বুকের মধ্যে গায়ত্রীমন্ত্রটা লিখে দিলাম । তাঁর এত সুন্দর, নরম শরীর । উনি ভোর ৪টা ২০তে দেহ রেখেছেন আর তখন সন্ধ্যা ৭টা বেজে গিয়েছে, তখনও তাঁর কিছু হয়নি । খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিল্লি ও সিঙ্গাপুর থেকে সব ভক্তেরা প্লেনে চেপে চলে এসেছে । তারপর গর্তটা আস্তে আস্তে মাটি দিয়ে ভর্তি ভর্তি বুকটার পর্যন্ত উঠল, আমি বললাম, “মাথা চাপা দাওয়ার পর্যন্ত আমি আর কাছে থাকতে পারব না ।” কেউ আমাকে কোনোরকম করে নিয়ে অন্য জায়গায় দূরে বসিয়ে দিল । তখন ঠাকুর ও গুরুদেবকে ভোগ-আরতি দাওয়া হল । মাথার উপরে একটা তুলসী টপ বসিয়ে দিল । নতুন টিন কিনা আনতে বললাম—সন্তোষ প্রভু ছিলেন, উনি টিনটা এনেছেন । টিনটা দিয়ে একা ঘর করে উপরে ছাউনি করে একটা ছাপর রেখে দিলাম, আর ৪০ দিন পরে সমাধি শুরু করেছিলাম ।

এখন তো গুরুদেব কোন দিন ডাকবেন না… রাত দুটো সময় কেউ ডাকবে না ! কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগরে এসে তখন খবর কেউ দেবেন না যে, “আমি চলে আসছি” । সে আর কেউ বলবেন না । এখনও তাঁর ফোন নম্বর রেখে দিচ্ছি তার স্মৃতি হিসেবে… আর কিছু কিছু স্মৃতি রেখে দিয়েছি ।

গুরুদেব শিলিগুড়ি ভালোবাসতেন, আসতে চাইছিলেন । তিনি বললেন, “আসব” কিন্তু একটা লোকের জন্য তিনি মুখটা ফিরিয়ে দিলেন, বললেন যে, “যে আমার কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে আমার কাছ থেকে বাড়িটা বিক্রি করল, সে শিষ্য হয়ে আমার সঙ্গে প্রতারণা করল, বেট্রায়াল করল ! আমি আর শিলিগুড়ি যাব না ।” সেই দুঃখে তিনি শিলিগুড়ি আসেননি । কিন্তু তিনি মন্দিরের চূড়া করতে আমাকে অনুমতি দিয়েছিলেন । চূড়াটা করেছিলাম আর তিনি দেখেও গিয়েছেন । ছবি দেখেছেন, বললেন, “চূড়াটা খুব ভালো হয়েছে ।” কিন্তু বহু কষ্টে পড়ে তিনি আর আসতে চাননি, বললেন, “আমাকে যে কষ্ট, যে ব্যথা দিয়েছে, আমি সেখানে কি করে যাব ?” এই জন্য তিনি শিলিগুড়ি আসেন নি । তিনি ভাবছিলেন যে, “শিলিগুড়িতে মঠটা করে বৈশাখ মাসে ওখানে গিয়ে থাকব দোলের পরে, গরমের দিনে এখানে থাকলে একটু ঠান্ডা আছে, কষ্টটা কম ।” গুরুদেব তো খুব গরমে কষ্ট পেতেন—কলকাতা বা নবদ্বীপে A/C ছাড়া থাকতেন না । নবদ্বীপে প্রায় কারেন্ট চলে যেত আর জেনারেটরে শব্দ কিন্তু এখানে তো A/C ছাড়াই কোন অসুবিধা হয় না, গরমতা খুব কম ।এইজন্য জায়গাটা ওনার খুব পছন্দ ছিল কিন্তু উনি বললেন, “যাব না ।”

যাকগে, অনেক কথা গুরুদেব বলেছেন । গুরুদেবের পছন্দ করা বিগ্রহ এখানে প্রতিষ্ঠা হয়েছে, গুরুদেবের বিগ্রহও এখানে প্রতিষ্ঠা হয়েছে । আপনারা ভাগ্যবান : এখানে বসেও গুরুদেবের নিত্যসেবা করতে পারছেন । কেউ মালা গাঁথছেন, কেউ বাসন মাজছেন, কেউ মন্দিরটা পরিষ্কার করছেন, কেউ রান্না করছেন । এতে আপনারা ভাগ্যবান । গুরুদেব নিত্য অবস্থান করছেন আর আপনারা তাঁর নিত্যসেবায় নিয়োজিত আছেন । এ সেবা কখনও ছাড়বেন না । এই সেবাটা চালিয়ে যাবেন । কেউ আসতে না পারলে দুটো পয়সা দিয়ে সাহায্য করবেন । যার পয়সা নাই, সে দেহ দিয়ে সেবা করবেন ; যার পয়সা নাই, মন বা হৃদয় দিয়ে সেবা করবেন । যার যেরকম সামর্থ্য, সেই দিয়ে ভগবানের সেবা করতে হয়, গুরুদেবের সেবা করতে হয় । আমি সব চাইতে খুশি হব যদি আপনারা এই গুরুদেবের সেবা করেন, ঠাকুরের সেবা করেন । আপনাদের অনেক বাধাবিপত্তি আসবে—কেউ আপনাদেরকে নিন্দা করবে, কেউ আপনাদেরকে খারাপ কথা বলবে, মঠে আসলে কু-কথা বলবে (বিশেষ করে অল্প বয়সের মেয়েরা যদি মঠে আসে, তাদের লোকের দুই-চারই কথা আজেবাজে কথা বলে) । সেগুলা সহ্য করতে হয় ।

জানেন, এখন নৃসিংহপল্লীতে দুটো অবিবাহিত মেয়ে সেবা করছেন । একটা মেয়ের বিবাহ হয়েছে—চার মাস হয়েছিল, তারপর শাশুড়ির যন্ত্রণায় সে বাড়ি ছেড়ে চলে আসল ; ও BA পাস করেছে । আর একটা মেয়েও BA পাস করেছে, খুবই পরিশ্রমী মেয়ে—বাড়ি থেকে বসে ১৫,০০০টাকা ইনকাম করত শেলাই করে কিন্তু এ সব ছেড়ে দিয়ে আমার কাছে আসল । উভয় এখন মঠে আছে । খুব কড়া ধাঁচের মেয়েরা, কোন ব্রহ্মচারী থেকে ডিস্টার্ব করতে পারবে না । নৃসিংহপল্লীতে ওই দুটো অল্পবয়সী মেয়েরা সেবা করছে । এবং তারাই বলতে গেলে ম্যানেজারের দায়িত্বটা নিয়েছে (ম্যানেজার বলতে ভাণ্ডারের দায়িত্ব, রান্না-বান্না দায়িত্ব, কে কি খাবে না খাবে, সব দেখাশোনা ওরাই করছে) । নৃসিংহপল্লীতে এত বড় মন্দির কিন্তু তারাই সব দেখাশোনা করে । খুব সুন্দর ভাবে সেবা করছে । একজন অবিবাহিত, আমি ওর বিয়ে ঠিক করেছিলাম (একটা ছেলেকে ঠিক করেছিলাম, মনে করলাম বিয়ে দিয়ে দেব—ছেলেটা আমার কাছে শিষ্য হয়েছে, ভালোই আছে) কিন্তু আমি মেয়েটাকে বললাম, “তোমার তো বয়স হয়েছে, ২৪ বছর হয়েছে, তুমি তো ১৮ বছরে নিচে নাও । তুমি ডিসিশন যেটা নেবে, সেটাই করবে ।” বাবা-মা রাজি কিন্তু ওকে করাতে পারেনি, আমিও আর জোরাজোরি করিনি । ও আমাকে বলল, “গুরুদেব, আপনি আমাকে তারিয়ে দেবেন ? আপনি আমাকে আগুনের মধ্যে ফেলে দেবে ?” আমি আর কী বলব, বলুন ? “আমাকে বিয়ে দাওয়া মানে একটা আগুন জ্বালিয়ে তার মধ্যে আমাকে জ্যান্তে ফেলে দেন, আমি রাজি আছি ।” আমি বললাম, “থাক, আমি আর তোমাকে একবারও বলব না বেয়ের সম্বন্ধে ।” ওর বাবা আমাকে ফোন করে বললেন, “আমাদের কথা ও শুনছে না ! আপনি একটু বলুন না বর দিতে ।” আমি বললাম, “আমি বলতে পারব না । আমি যদি আবার বলব, তাহলে আপনার মেয়ে আমাকে দুকথা শুনিয়ে দেবে, বলবে যে মহাপ্রভু কি ভোটে দাঁড়িয়েছে ? আমি তখন কি জবাব দেব? । বরং চাই আমি বর দাওয়ার কথা বলতে পারি না । সেবা করছে, করছে ।” ওরা নিয়মগুলো মানে । ওরা বললে, “যে মঙ্গল-আরতি উঠবে না, তার জলখাবার বন্ধ ।” এখন ভয়ে সবাই মঙ্গল-আরতি আসে ! আগে তো আসত না । আগে পূজারি ঠাকুরের আরতি করত আর সবাই ঘুমিয়ে থাকত । কিন্তু ওরা একম নিয়ম করে দিয়েছে, বাস, এখন সবাই মঙ্গল-আরতি আসে, সকালে কীর্ত্তনে বসে । কড়াকড়ি করতে হচ্ছে ।

যাকগে, আমি এখানে শেষ দিচ্ছি ।

জয় শ্রীল গুরুমহারাজ কি জয় ।
হরিনাম সঙ্কীর্ত্তন কি জয় ।
নিতাই-গৌর প্রেমানন্দে হরিবল ।

 

 

 


 

 

← ফিরে

সম্পূর্ণ পাঠ ডাউনলোড / শুনুন
(16.4 Mb, 40 min)

বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥