আমাদের শ্রীগুরুপরম্পরা :
শ্রীশ্রীল ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ ভগবান্ শ্রীশ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর
              প্রভুপাদ
“শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠে সূর্যাস্ত কখনই হয় না” :
আমাদের মঠের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
 
আমাদের সম্পর্কে শ্রীউপদেশ শ্রীগ্রন্থাগার শ্রীগৌড়ীয় পঞ্জিকা ছবি ENGLISH
 

শ্রীউপদেশ (চতুর্থ খণ্ড)


শ্রীশ্রীবলদেব-প্রসঙ্গ

 

পরমারাধ্যতম শ্রীল গুরুবর্গের শ্রীপাদপদ্মের কৃপা প্রার্থনা ক’রে শ্রীশ্রীবলদেব প্রভুর ভুবনমঙ্গলময়ী আবির্ভাব – তিথিতে শ্রীশ্রীকৃষ্ণের ঝুলন-যাত্রা মহোৎসবে ভগবৎ-কথা শ্রবণ করছি ।

“সঙ্কর্ষণঃ কারণতোয়শায়ী গর্ভোদশায়ী চ পয়োব্ধিশায়ী ।
শেষশ্চ যস্যাংশকলাঃ স নিত্যানন্দাখ্যরামঃ শরণং মমাস্তু।।”

(শ্রীচৈ চ আ ১।৭)

শ্রীবলদেবই বলরাম, বলভদ্র ইত্যাদি নামে অভিহিত। সঙ্কর্ষণ, কারণতোয়শায়ী, গর্ভোদশায়ী, পয়োব্ধিশায়ী ও শেষবিষ্ণু – সেই বলভদ্র প্রভুর অংশ ও কলা। শ্রীল কবিরাজ গোস্বামীপাদ সেই নিত্যানন্দাখ্য-রামের শ্রীপাদপদ্মে শরণ নিয়ে তাঁর বন্দনা করেছেন। শ্রীবলদেব-তত্ত্বকে প্রণাম জানাতে গিয়ে স্তব করেছেন,—

“হলায়ুধ নমোহস্তু তে নমস্তে মুষলায়ুধ ।
নমস্তে রেবতীকান্ত নমস্তে ভক্তবৎসল ॥
বলিনাং শ্রেষ্ঠ নমস্তে নমস্তে ধরনীধর ।
প্রলম্বারে নমোহস্তু তে ত্রাহি মাং কৃষ্ণপূর্বজ ॥”

শ্রীবলদেব কৃষ্ণের দ্বিতীয় বিগ্রহ হয়েও
কৃষ্ণের সেবাবিগ্রহ

যাঁকে হলায়ুধ বলেছেন—এঁর আয়ুধ শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম নয় —ইনি হলধর মুষলধর। ইনি প্রলম্বাসুরের নিধনকারী । ইনি কৃষ্ণ– জগন্নাথ-জগদীশ। যিনি জগন্নাথ, তিনিই বলভদ্র। ইনি শ্রীক্ষেত্রে দুটি মূর্তি ধরে পাশাপাশি বসেছেন। “কেশবধৃত–হলধররূপ জয় জগদীশ হরে।” কৃষ্ণই কেশব। কেশবই বলদেব। ইনি কৃষ্ণের দ্বিতীয় রূপ—দ্বিতীয় বিগ্রহ। ইনি কোন দেবতত্ত্ব বা জীবতত্ত্ব নন; ইনি কৃষ্ণের প্রকাশ-বিগ্রহ–বিলাস-বিগ্রহ। আর একটি মজার কথা এই–ইনি সেবা-বিগ্রহ এবং নিজে নিজেরই সেবা করছেন। নিজেই সেব্য ও সেবক অর্থাৎ সেব্য-সেবক একই ব্যক্তি। যেমন নিজে নিজেরই মাথা টিপছে। কৃষ্ণের দ্বিতীয় বিগ্রহ হয়েও, কৃষ্ণ হয়েও ইনি কৃষ্ণের সেবা-বিগ্রহ রূপ ধরেছেন। কৃষ্ণের এটি অদ্ভুত লীলা। কৃষ্ণ নিজেই অন্যরূপ ধরেছেন। লীলার পুষ্টিসাধনের জন্য তিনি বলদেবকে পৃথকভাবে প্রকট করেছেন। তাই কৃষ্ণাভিন্ন বলদেব। কৃষ্ণ তাঁর ঐ দেহে বিলাস করেন। আর তিনি কৃষ্ণের সেবাবিগ্রহ—তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ সেবা-বিধানকারী।

দ্বাপরে কৃষ্ণ-লীলায় যিনি শ্রীবলদেব, ত্রেতাতে শ্রীরামলীলায় তিনি লক্ষ্মণ। শ্রীরামচন্দ্র যখন ত্রেতায় অবতীর্ণ হলেন, তখন লক্ষ্মণ তাঁর অনুজ হয়ে এলেন। লক্ষ্মণ শ্রীরামচন্দ্রের দ্বিতীয় বিগ্রহ – বলদেব প্রভুর মত তিনিও জীবকোটি নন, তিনি বিষ্ণুকোটি। বলদেব ও লক্ষ্মণ উভয়েই সেবাবিগ্রহ। লক্ষ্মণ শ্রীরামচন্দ্রের সেবাপরায়ণতার মূর্ত বিগ্রহ। অনুজের জীবন অগ্রজের সেবায় উৎসর্গীকৃত। কিন্তু শ্রীরামচন্দ্রের সেবা করতে গিয়ে তিনি মাঝে মাঝে বাধা পেলেন। তাই সেবায় তাঁর স্ফূর্তি হলো না। অবশ্য সেবার ফলটা সেব্যই পান। সেব্যের সুখবিধান ও তাঁর ইন্দ্রিয় তর্পণই সেবার উদ্দেশ্য। সেবাটা যদি না হয়, তাহলে সেবকের মনে গভীর ব্যথা জাগে। সেবাবৃত্তির পূর্ণ চরিতার্থ হয় না বলেই সেবকের হৃদয়ে অতৃপ্তি থেকে যায়। তিনি চান কায়মনোবাক্যে প্রভুকে নন্দিত করতে। যদি তা না পারেন, তাহলে ভীষণ অসুবিধা। তিনি অনুজ। ছোট ভাইকে বড় ভাই-এর আদেশ মেনে চলতে হয়। নীতির বিচারে – ছোট ভাই বড় ভাই-এর কথা অমান্য করতে পারে না।

নীতি-পালন, নীতি–সংরক্ষণ, সত্য-রক্ষা ও প্রজানুরঞ্জনই
রামলীলার মুখ্য উদ্দেশ্য

এই রামলীলায় নীতি-পালন, নীতি-সংরক্ষণ অন্যতম উদ্দেশ্য। সত্য-পালন—প্রজানুরঞ্জনও তাঁর নীতি। নীতিকে কোথাও violate (ভাওলেট-লঙ্ঘন) করেন নি । Ethical Principle (ইথিক্যাল প্রিন্সিপ্যাল—নৈতিক নিয়ম) এবং morality (মরালীটি-নীতি) সুষ্ঠুভাবে পালন করবার জন্য, নৈতিকতার আদর্শ স্থাপন করা রামলীলার নিগূঢ় উদ্দেশ্য। অযোধ্যায়, লংকায়, দণ্ডকারণ্যে, তাড়কা-নিধনে – যেখানে যত লীলা করেছেন, কোথাও নীতির লঙ্ঘন প্রকাশিত হয়নি। জগতে নীতি—পালনের প্রয়োজনীয়তা স্থাপন করবার জন্য তিনি অবতীর্ণ। জীব-কল্যাণের জন্য ইহার প্রয়োজন আছে। এই লীলার পুষ্টি-সাধনের জন্য লক্ষ্মণকেও নীতির কাছে নতি-স্বীকার করতে হয়েছে। এইজন্য তাঁর সেবাতে বিঘ্ন বা বাধা উপস্থিত করলেও, সেবায় অতৃপ্তিবোধ করলেও মূলনীতি-পালনের জন্য তাঁকেও কঠোর নিয়মানুবর্তিতা মানতে হয়েছে। তা না হলে শ্রীরামচন্দ্রের লীলাপুষ্টি হয় না। লক্ষ্মণ যদি অন্যভাবে চলেন, তাহলে সেবা ঠিক হলো না। শ্রীরামচন্দ্রের আদেশ পালন করতে গিয়ে লক্ষ্মণকে হৃৎপিণ্ড উপড়ে ফেলতে হয়েছে। তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কাজ করতে হয়েছে। অগ্রজ রামচন্দ্র অনুজকে যে আদেশ করেন, তা লঙ্ঘন করলে নীতি থাকে না। তাতে হয়ত সেবার সৌষ্ঠব হয়, প্রীতির উৎকর্ষ বাড়ে; কিন্তু নীতি রক্ষিত হয় না। প্রীতিকে বড় করা রামলীলার উদ্দেশ্য নয়। লক্ষ্মণ তাঁর প্রতিময়ী সেবায় প্রীতির স্ফুর্তির ব্যাঘাত দেখলেও নীতির প্রাধান্য দিয়েছেন। সীতাদেবী নিরপরাধা, তাঁর চরিত্র নির্দোষ ও নিষ্কলঙ্ক। তথাপি প্রজানুরঞ্জনের জন্য শ্রীরামচন্দ্র তাঁকে বনে বিসর্জন দিয়েছেন। বনে ছেড়ে আসার ভার পড়লো লক্ষ্মণের উপর। প্রেমের দিক দিয়ে বিচার করলে এই বিরহ বা এই বিসর্জন অন্যায়। প্রীতির দিক দিয়ে এর কোন justification (জাস্টিফিকেসান – ন্যায্যতা) নেই। কিন্তু নীতির দিক দিয়ে বিচার করলে এটা ঠিক। কারণ শ্রীরামচন্দ্র রাজা। তাঁর চরিত্র দেখে প্রজাগণ কটাক্ষ করবে কিংবা দুর্নীতির প্রশ্রয় নেবে —এ হতেই পারে না। প্রীতির দিক দিয়ে অবিচার হলেও রাজ্যে নীতি-সংরক্ষণের জন্য শ্রীরামচন্দ্র সীতাকে নিরপরাধা জেনেও বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছেন। সীতাদেবীও কোন প্রকার revolt (রিভোল্ট – বিদ্রোহ) করেননি। তিনি শ্রীরামচন্দ্রকে বলতে পারতেন, —“তুমি ত আমাকে অগ্নিপরীক্ষা করিয়ে আমার পবিত্রতার পরিচয় পেয়েছ, আবার বনবাস কেন?” কিন্তু তিনি তা বলেননি।

এ সব সীতাদেবী জানেন, লক্ষ্মণও জানেন; সব চেয়ে ভাল জানেন শ্রীরামচন্দ্র। সব জেনেও বনবাস। যে লীলা করবার জন্য অবতীর্ণ হয়েছেন; সেদিক থেকে ঠিকই হয়েছে। লক্ষ্মণ তাঁর প্রাণের রক্ত দিয়ে রামচন্দ্রের সেবা করেছেন। রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের সময়ে কৈকেয়ী চেয়ে বসলেন চৌদ্দ বছর বনবাস। দশরথ ‘না’ বলতে পারেন না। কেননা দশরথের নীতি বা প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘিত হয়। রামচন্দ্রের সঙ্গে সীতাদেবীও বনে গেলেন। কিন্তু কৈকেয়ী তো লক্ষ্মণের বনবাস চাননি। লক্ষ্মণ তাঁর আরাধ্যদেবের সেবার জন্য বনবাসে স্বেচ্ছায় গেলেন। শ্রীরামচন্দ্র ও সীতাদেবীর এই বনবাস লক্ষ্মণের বুকে শেলের মত বিঁধেছে। সবচেয়ে বেশী ব্যাথা লেগেছে দশরথের বুকে। এই নিদারুণ ব্যথা সহ্য করতে না পেরে দশরথ দেহত্যাগ করলেন। কিন্তু তিনি নীতি ত্যাগ করলেন না। রামচন্দ্র সিংহাসন ত্যাগ করলেন, কিন্তু পিতৃ-বাক্য ত্যাগ করলেন না।

সেবাধর্মের পক্ষে কখনও নীতি বাধাদায়ক। নীতি অত্যন্ত নিম্নস্তরের জিনিষ। যেখানে প্রেম, সেখানে ethical principle (এথিকাল প্রিন্সিপ্যাল – নৈতিক শিক্ষা বা morality (মরালিটি – নীতি)-র দাম কতটুকু? প্রেম-সেবার কাছে নীতিগুলো কিছু নয়। রামের আদেশে সীতাদেবী বনে কেন যাবেন ? না—নীতি পালনের জন্য । রামচন্দ্র অনুজ লক্ষ্মণকে ডেকে বললেন­—“আমি যে জন্য অবতীর্ণ হয়েছি, তুমি তো তা জানো। তোমাকেই সীতাদেবীকে বনে দিয়ে আসতে হবে।” অগ্রজের এই সুকঠিন আদেশে তাঁর হৃদয় ভেঙে গেছে, চোখে অশ্রুর বন্যা নেমে এসেছে। তথাপি সীতাদেবীকে বাল্মীকির তপোবনে দিয়ে এসেছেন। কিন্তু তিনি নীতিপরায়ণতার বিরুদ্ধে যেতে পারেননি । এ ব্যথা লক্ষ্মণ ভুলতে পারেননি ।

ত্রেতায় যিনি অনুজ লক্ষ্মণ,
দ্বাপরে তিনিই অগ্রজ বলদেব

দ্বাপরে তুমি কৃষ্ণ হয়ে যাচ্ছো, আমিও সঙ্গে যাচ্ছি। হে ঠাকুর! এবার আর আমি অনুজ হয়ে যাচ্ছি না। তোমার অগ্রজ অর্থাৎ পূর্বজ হয়ে যাচ্ছি। অনুজ হয়ে এলে অসুবিধা। ত্রেতায় অনুজ হয়ে এসে তোমার নীতিপরায়ণতার প্রতি বিদ্রোহ করতে পারিনি। আমাকে যে রকম ব্যথা দিয়েছ, এতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু সীতাদেবীকেও অন্যায় আদেশ-পালনে বাধ্য করিয়েছ। এবার আমার কথা শুনতে হবে। আমার কথামত তোমাকে চলতে হবে। তাই দ্বাপরে লক্ষ্মণ “দাদা” হয়ে এলেন। ব্রজবাসীদের স্নেহের ডাক দাউজী। তিনি এবার সকলের “দাদা”। তিনি সেবাবিগ্রহ – সেবা সৌষ্ঠবের জন্য এবার তিনি অগ্রজ। অগ্রজের কথা অনুজকে মানতে হয়।

জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা—তিনজন রথে যাবেন। কিন্তু বলরাম বললেন,—“আমি আগে যাই, তুমি অপেক্ষা করো।“ এ কিরূপ সেবা? প্রভুকে পিছনে রেখে দাস আগে যায় কেন ? কেননা পথে যদি কোন কাঁটা থাকে, যদি কোন বিপদ আসে; তাহলে তা আমার উপর দিয়েই যাবে। এইজন্য বলদেবের রথ আগে যায় । এইভাবে বলরাম অগ্রজ হয়ে কৃষ্ণের উপর আদেশ জারি করলেন । তোমার আগে আমি যাবো। আমার কথা শুনবে না, তোমায় শুনতেই হবে। এই যে আদেশ—এটি কৃষ্ণের সুখ-বিধানের জন্য, নিজের প্রভুত্ব বিস্তারের জন্য নয়। যখন কৃষ্ণ রুক্মিণী হরণ করবেন, তখন বলদেব অগ্রসর হয়ে এলেন এবং বললেন, —“ওকে নিয়ে তুমি চলে যাও, আমি আছি । “বিপদ এলো—লড়াই শুরু হলো। বিবাহ-যাত্রায় মঙ্গল সানাই বাজবার কথা, কিন্তু বেজে উঠলো রণভেরী। বলদেব একে স্তব্ধ করলেন। কংস ডেকেছেন কৃষ্ণকে মল্লযুদ্ধে যোগদান করতে। বলাইকে গতিরোধ করে কে ? বলদেব বললেন,—“কংস পছন্দ করুক না করুক, আমি যাবোই । “কংসবধ-যাত্রার পথে কন্টক দূর করলেন বলাই। তিনি সর্বত্রই সেবার ভিতরে আছেন এবং সেবাবিগ্রহ হয়ে কৃষ্ণলীলায় পুষ্টি বিধান করছেন ।

কৃষ্ণের প্রেমের বাঁশী সুষ্ঠুভাবে বাজানোর জন্যই
বলদেব বাজান শিঙ্গা

কৃষ্ণ বাঁশী বাজায়, কৃষ্ণ ধেনুবৎসগুলিকে নিয়ে বনে যায়। মা যশোদার চিন্তার অন্ত নেই। বনের মাঝে কখন কোন অসুর কি বিপদ ঘটায় কে জানে। বলাই তখন এগিয়ে এসে মা যশোদাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, — “মা!তোমায় চিন্তা করতে হবে না, আমি তো সঙ্গে যাচ্ছি—ভয় কি? বলাইর শিঙ্গা বেজে উঠে—এর ভিতরে কোন মধুর ভাব নেই । মা যশোদা বললেন,—“তুমি যাচ্ছো, আমি এবার নিশ্চিন্ত।” ধেনুর পাল নিয়ে কানাই আর বলাই বনে যায়। বলাই-এর শিঙ্গা শুনলে দুষ্ট সবাই ভয়ে ত্রস্ত ।

Announce (এনাউন্স – ঘোষণা) করছে—যে যেখানে আছ —সাবধান। দুষ্টামি করলে তোমাদের রক্ষে নেই । অসুরগণ হুঁশিয়ার হও। যদি বিপদ ঘটাও, তবে তোমাদের মৃত্যু অনিবার্য। ইনি কৃষ্ণের মত নবনীত কোমল নন; ইনি বীর – “বলিনাং শ্রেষ্ঠ”। বলাই কৃষ্ণকে সুখে রাখেন, কৃষ্ণ-লীলায় কোন রকম যেন ব্যাঘাত না হয়; - কৃষ্ণের বাঁশী যেন সুষ্ঠুভাবে বাজতে পারে। এমন কি শৃঙ্গার-রসের লীলায়ও আড়ালে থেকে তিনি ব্যাঘাত দূর করেন। দ্বারোয়ানের মত gate (গেট – প্রবেশদ্বার)-এ শিঙ্গা নিয়ে, হল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কৃষ্ণ ধরেছেন বাঁশী, যেন মধূরভাবে বাজতে পারে। বলাই তাই বাজান রণভেরী, কৃষ্ণের বাঁশী বাজানো কালে যেন কোন রসভঙ্গ বা ব্যাঘাত না ঘটে। এইজন্যই তাঁর বীরত্ব, এইজন্যই তিনি হলধর ও মুষলধর। আমি থাকতে কৃষ্ণের সুখের ব্যাঘাত হবে না। এইজন্যই বলদেব প্রভু সেবাবিগ্রহ। অগ্রজ হয়েও লীলার পুষ্টি সাধন করছেন।

ত্রেতায় যিনি লক্ষ্মণ, দ্বাপরে তিনিই বলদেব ও
কলিতে তিনিই নিত্যানন্দ

ত্রেতায় যিনি লক্ষ্মণ, দ্বাপরে তিনি বলদেব এবং কলিতে তিনিই নিতাই। কৃষ্ণ উদার মূর্তি ধারণ করে গৌররূপে ভূলোকে এলেন । পাপী, তাপী ও অপরাধী সকলকে উদ্ধার করবার জন্য কৃষ্ণ ঔদার্যলীলা করলেন শ্রীগৌরসুন্দররূপে । তখন বলাই তো আর চুপ করে থাকতে পারেন না । তুমি যখন যাচ্ছ, আমাকে যেতেই হবে। যিনি বলাই, তিনিই এবার নিতাই । এবারও অনুজ নয়, অগ্রজ হয়েই এলেন ।

“ব্রজেন্দ্রনন্দন যেই, শচীসূত হৈল সেই,
বলরাম হইল নিতাই।”

ব্রজেন্দ্রনন্দন শচী-নন্দন হলেন, আর এদিকে রোহিনীনন্দন পদ্মাবতী- নন্দন হলেন। এবার নিতাই ঠাকুর অনেক আগে এলেন। ঠাকুর অনেক কিছু লীলা করবেন। তাঁর এই জীবোদ্ধার-লীলায় পিছনে তিনি থাকলেন না। কিন্তু শ্রীগৌরসুন্দর আত্মপ্রকাশ না করা পর্যন্ত নিতাই ঠাকুর অনেক আগে এলেও চুপ করে রইলেন। শ্রীগৌরসুন্দরের আগে এসেও তিনি আত্মপ্রকাশ করলেন না । তখনও তিনি পরিব্রাজক-বেশে তীর্থদর্শন করছেন। এটা তাঁর ছদ্মলীলা । কিন্তু শ্রীনবদ্বীপ-ধামে শ্রীবাস-অঙ্গনে যেই খোল বেজে উঠেছে এবং কীর্তন শুরু হয়েছে, তখনই নিতাই ঠাকুর তীর্থভ্রমণ ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গে শ্রীনবদ্বীপ–ধামে ছুটে এসেছেন। নাম-প্রেম-বিতরণলীলা সুষ্ঠুভাবেই করিয়ে দিতে হবে। পাপী, তাপী, বিষয়ী, পতিত ও অধম সকলকে এবার ‘নামপ্রেম’ দান করে উদ্ধার করতে হবে। প্রভু যদি কখনও এই কাজে পিছিয়ে পড়েন, তখনই অগ্রজ নিতাই এগিয়ে যান, তঁাকে লঙ্ঘন করতে নয়—তাঁর মহিমা প্রকাশ করতে এবং প্রস্ফুটিত করতে। যেখানে যত মাতাল, লম্পট, পাপী ও অসৎ আছে—সেখানে আগেই নিতাই ঠাকুর ছুটে যান। এ গৌরলীলায় উভয়েই দয়ার অবতার। এই লীলায় তাঁরা অস্ত্রধারণ করেননি। কিন্তু যখন নিতাই ঠাকুরের ললাটের রক্তে নবদ্বীপের মাটি ভিজে যায়, তখন আত্মভোলা শ্রীগৌরসুন্দর সুদর্শনচক্রকে আহ্বান করেন। তিনি হুঙ্কার করে বলে উঠেন,—“এদের শিরচ্ছেদ করো” । তখন নিতাই ঠাকুর তাঁর গতিরোধ ক’রে বললেন,—“হে ঠাকুর! তুমি কি এবার চক্র ধরবার জন্য এসেছ নাকি ? তুমি কত বীর, কত নিহত করতে পারো, এইটা এবার দেখাতে এসেছ নাকি?” এই বলে তিনি চক্রকে রোধ করলেন। বড় ভাই ছাড়া শ্রীগৌরসুন্দরের চক্র কে রোধ করতে পারে? শ্রীগৌরসুন্দর সন্ন্যাস গ্রহণ ক’রে নীলাচলের দিকে যাত্রা করেছেন। নিতাই ঠাকুর তাঁর দণ্ড তিন টুকরো ক’রে ভেঙে দিলেন। আমার প্রভু দণ্ড বয়ে বেড়াবেন—এ হতেই পারে না। আমার কথা তোমায় শুনতেই হবে। গৌরসুন্দর যখন দণ্ড চাইলেন, তখন নিতাই ঠাকুর এগিয়ে এসে বললেন,—“আমি তোমার দণ্ড ভেঙে দিয়েছি, কি শাস্তি দেবে দাও।” শ্রীগৌরসুন্দর বললেন,—“আমি সন্ন্যাসী, আমার হাতে দণ্ড না দেখলে লোকে হাসবে, বিদ্রূপ করবে। তুমি কি লোক হাসাতে চাও?” নিতাই ঠাকুর বললেন,—“তোমার ওসব কথা রাম অবতারে অনেক শুনেছি, অনেক পালন করেছি। আর লোকে যদি হাসে, তবে আমাকে লক্ষ্য করেই হাসবে । কেননা আমি তোমার দণ্ড ভেঙে দিয়েছি। তোমার নিষ্কলঙ্ক চরিত্র, তুমি পাকা বৈরাগী অর্থাৎ তুমি সন্ন্যাসধর্ম নিখুঁতভাবেই পালন করছো । তোমাকে কেউ ঠাট্টা করবে না । “গৌরসুন্দরের দণ্ড কে ভাঙতে পারে ? নিতাই ‘দাদা’ বলেই ভাঙতে পেরেছেন ।

লক্ষ্মণ ও বলদেব উভয়েই সেবাবিগ্রহ, কিন্তু বলদেবে
সেবার পরাকাষ্ঠা প্রস্ফুটিত

যিনি লক্ষ্মণ, তিনি বলদেব এবং তিনিই নিতাই । শ্রীরামচন্দ্র অখিল-রসামৃতসিন্ধু নন, তিনি বহুজনবল্লভ নন, তিনি একপত্নীধর – নীতিপরায়ণ । পারকীয় রস-বৈশিষ্ট্য এঁর লীলায় নেই এবং রাসলীলাও নেই। বামন, নৃসিংহ ও বরাহলীলায় এই বৈশিষ্ট্য নেই । কৃষ্ণই শ্রীরামচন্দ্র, বলদেবই লক্ষ্মণ। বলদেব আর লক্ষ্মণ দুজনেই সেবাবিগ্রহ। কিন্তু এই সেবার ঔজ্জল্য লক্ষ্মণে যেরূপ ফুটেছে, বলরামে তার অনন্তকোটি বেশী ফুটেছে। এটা একটা দল-বিশেষের দোলো কথা নয়। প্রেম-সেবা-রসের দিক দিয়ে নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে দু’এর তুলনাই হয় না । কৃষ্ণ রসময় ও রসিকশেখর। এই দিক দিয়ে কৃষ্ণের সঙ্গে শ্রীরামচন্দ্রের তুলনাই হয় না । কৃষ্ণ অখিলরসামৃত-মূর্তি, কৃষ্ণলীলায় লক্ষ্মণ ভাবের পরাকাষ্ঠা বলদেব প্রভু। কলিযুগেও গৌর ও কৃষ্ণ একই । কৃষ্ণই ঔদার্যলীলায় গৌর-মূর্তি । মধুর লীলায় গৌরাঙ্গই শ্রীকৃষ্ণ । মধুর গৌরাঙ্গ কৃষ্ণ, উদারকৃষ্ণ গৌর । মাধুর্যলীলায় ও ঔদার্য-লীলায় বলরাম ও নিত্যানন্দ উভয়েই সেবাবিগ্রহ । নিতাই ঠাকুর প্রকটিত হয়ে গৌরসুন্দরের ঔদার্যলীলাকে সুষ্ঠুভাবে প্রকাশিত করেছেন । গৌরসুন্দরের নাম-প্রেম-প্রচার-লীলায় তিনি প্রধান প্রচারক সেনাপতির ভূমিকা গ্রহণ করেন। তাঁর মহাদানশীলতায় জগৎ মুগ্ধ ।

বলদেব – নিত্যানন্দের ধারা গুরুরূপে চিরপ্রবহমান

ত্রেতায় লক্ষ্মণের লীলা, দ্বাপরে বলদেবপ্রভুর লীলা, কলিতে নিতাই ঠাকুরের লীলা হয়ে গেছে। এটা একটা past history । কলিকালে পাঁচশ বছরেরও বেশী আগে নিতাই ঠাকুরের আবির্ভাব। সবই অতীত ঘটনা – historical fact (হিষ্টোরিক্যাল ফ্যাক্ট—ঐতিহাসিক সত্য)। আজকে শ্রীবলদেব প্রভুর আবির্ভাব–লীলা কি ভাবে হচ্ছে? লক্ষ্মণ অপ্রকট হননি, বলরামরূপে এসেছেন। বলরাম অপ্রকট হননি, নিতাইরূপে এসেছেন। নিতাই অপ্রকট হননি গুরুরূপে এসেছেন। বলাই–এর লীলাই হচ্ছে, কিন্তু দেখতে এক রকম নয়। ভঙ্গীটা বদলে গিয়েছে। যেমন বলাই আর নিতাই-এর ভঙ্গী এক নয়। তাই বলদেব প্রভুর আবির্ভাব-লীলা শেষ হয়ে যায়নি, আজও চলেছে—অচ্ছেদ্য ও অব্যাহত গতিতে ।

“অদ্যাপিহ সেই লীলা করে গৌর-রায় ।
কোন কোন ভাগ্যবান দেখিবারে পায় ॥”

নিতাই ঠাকুরের আবির্ভাব-লীলা কি ভাবে হচ্ছে ? নিতাই ঠাকুরের গুরুরূপে আবির্ভাব হচ্ছে। গুরুদেবই অভিন্ন নিত্যানন্দ। নিতাই ঠাকুরের শক্তি নিয়ে গুরুদেবের আবির্ভাব নিত্য । এখন বলদেব প্রভুর আবির্ভাব নেই, নিতাই ঠাকুরের প্রাকট্য নেই । তাদের লীলা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে,—একথা সত্য নয়। গুরুদেবই বলদেব-রূপে, নিত্যানন্দ-রূপে এসে আশ্রিতজনকে গৌরসুন্দরের সঙ্গে মিলিয়ে দেন । গুরুরূপে তাঁর নিত্য আবির্ভাব-লীলা হচ্ছে । ভাগ্যবান শিষ্যের কাছে ও শরণাগত জীবের চিত্তে এই নিত্যলীলা স্ফুরিত হয়। সকলেই এই নিত্যলীলার রসাস্বাদন করতে পারে না । রামলীলা, কৃষ্ণলীলা যেমন সবাই দেখতে পায়নি, তেমনি গুরুদেবই যে নিত্যানন্দ—এই লীলা সবাই উপলব্ধি করতে আজও পারবে না। বলদেবাভিন্ন গুরুদেবের প্রাকট্যশক্তির খেলা আজও চলছে, নিত্যকাল চলতেই থাকবে ।—এ ধারা কোনদিন রুদ্ধ হবে না – ইহা সিদ্ধান্ত ।

“গুরু কৃষ্ণরূপ হন শাস্ত্রের প্রমাণে ।
গুরুরূপে কৃষ্ণ কৃপা করেন ভক্তগণে ॥”

(শ্রীচৈ চ আ ১।৪৫)

“নিতাইর করুণা হবে, ব্রজে রাধা-কৃষ্ণ পাবে,
ধর নিতাই- চরণ দু’খানি।।”

(শ্রীল নরোত্তম-গীতি)

সদগুরুরূপে এই ধারা চির-প্রবহমান। গুরুদেব—সেবাবিগ্রহ। ভগবানের সেবা কি ঠান্ডা হয়ে রুদ্ধ হয়ে যাবে? না—সেবা চলতেই থাকবে। সেবা চালাবে কে ? ভগবানের সেবাবিগ্রহ শ্রীগুরুদেব এই সেবা প্রকাশ করে থাকেন। জীবহৃদয়ে তিনি এই কৃষ্ণ-সেবাবুদ্ধি জাগ্রত করেন। যদি গুরুজন কেউ না থাকে, সেবক না থাকে, তাহলে সেবাকে কে জানাবে ? সেবা নিত্য, সেবক নিত্য। শ্রীগুরুদেব ভগবানের সেবা সর্বক্ষণ করছেন।

“সাক্ষাদ্ধরিত্বেন সমস্তশাস্ত্রৈরুক্তস্তথা ভাব্যত এব সদ্ভিঃ ।
কিন্তু প্রভোর্যঃ প্রিয় এব তস্য বন্দে গুরোঃ শ্রীচরণারবিন্দম ॥”

(শ্রীগুর্ব্বাষ্টক—৭)

গুরুদেব ভগবৎপ্রেষ্ঠ ও নিত্যানন্দ-শক্তি,
গুরুদেব কৃষ্ণের সেবাবিগ্রহ

শ্রীগুরুদেব ভগবানের প্রিয়তম—ভগবৎ-প্রেষ্ঠ । তাঁর ভিতর দিয়েই সেব্য প্রকাশিত হন । তাই গুরুদেবের প্রাকট্যই নিত্যানন্দের প্রাকট্য—ইহাই আবার বলদেব—প্রাকট্য সেই নিত্যানন্দ শক্তি গুরুদেবের ভিতরে প্রকাশিত হয়ে সেই ব্যাপার নিত্য চালিয়ে যাচ্ছেন। যাঁকে গুরুদেব বলছি, তাঁর সঙ্গে যদি বলদেব নিত্যানন্দের সম্বন্ধ না থাকে অর্থাৎ তিনি যদি বলদেব শক্তি না হন, তাতে গুরুত্ব আসবে কোথা থেকে? তুমি তাঁকে গুরু বলছ কি ক’রে? যেখানে গুরুত্ব নেই, সেখানে মন্ত্রগ্রহণ বা দীক্ষা দান হতে পারে, কিন্তু নিত্যানন্দ-শক্তির আবির্ভাব হবে না। যেখানে বলদেবের শক্তি ফুটে ওঠেনি, সেখানে গুরুত্বের অভাব। আর যেখানে যথার্থ সদগুরু, সেখানে নিত্যানন্দের শক্তি প্রকাশিত হন। এ কথা কবির কল্পনা নয় বা বক্তৃতার কথা নয়; এটা একটা সিদ্ধান্ত। বলদেবের আবির্ভাব নিত্য, গুরুদেবের আবির্ভাবও নিত্য। এই যে তাঁর আবির্ভাব, তা অনুগত শিষ্যের হৃদয়ে উপলব্ধির বিষয় হয় এবং কৃষ্ণকে প্রকাশিত করেন। নিত্যানন্দের আবির্ভাবের সঙ্গে গুরুদেবের অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ। নিতাই ঠাকুর গৌর দেওয়া ঠাকুর। তিনি আছেন বলেই জীব হরিসেবা পেতে পারবে। কৃষ্ণ তাঁর নিজ-জনকে নিত্য প্রকট রাখেন – ভক্তি-যোগ সংরক্ষণের জন্য এবং তাঁর সেবার ঔজ্জ্বল্য বিস্তারের জন্য। গুরুদেব তাঁরই প্রকাশবিগ্রহ বা সেবাবিগ্রহ। এটা কৃষ্ণের স্বার্থ। কেননা গুরুদেব না থাকলে তাঁর সেবা পরিচালনা করবে কে? গুরুদেবের নিত্য আবির্ভাব থাকে বলে জীব সিদ্ধিলাভ করতে পারে এবং দৈবী মায়ার বন্ধন থেকে তার মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

বলদেবাভিন্ন গুরুদেবই মায়ার গ্রাস থেকে
জীবকে উদ্ধার করতে সমর্থ

বলদেবাভিন্ন গুরুদেব শিষ্যের মায়ার দৌরাত্ম্য নাশ করেন । এ কথা শিষ্যেরা অনেক সময় বুঝতে পারে না। কখনও কখনও তিনি কৃপা-পরবশ হয়ে ইহা শিষ্যদের জানিয়ে দেন। তখন কোন কোন ভাগ্যবান শিষ্য ইহা বুঝতে পারে। আবার কেউ কেউ তাঁকে বুঝতে পারে না। শিশু যেমন মাতা কি উপকার করে, তা বুঝতে না পেরে পদাঘাত করে, কোলে প্রস্রাব ক’ের দেয়। কিন্তু মা স্নেহের আতিশয্যে সবই সহ্য করেন। গুরুদেবও সেইরূপ স্নেহময়ী ও প্রেমময়ী মাতার ন্যায় কাজ করে থাকেন। মায়ার শক্তি নেই গুরুদেবের সঙ্গে বিরোধ করে।

“ইহারে (মায়ারে) করিয়া জয় ছাড়ান না যায় ।
সাধু (গুরু)-কৃপা বিনা আর নাহিক উপায় ॥”

(শ্রীল নরোত্তম-গীতি)

গুরুপাদপদ্মের কৃপা ও সেবা ছাড়া হরিভজন অসম্ভব

গুরুদেব যাঁকে কৃপা করবেন তাঁকে মায়াবৈভব বাধা দিতে পারবে না। গুরুপাদপদ্ম ইচ্ছা করলেই জীবকে উদ্ধার করতে পারেন। যত পাপ, অপরাধ ও অনর্থ থাকুক না কেন, গুরুদেব তাঁর অহৈতুকী কৃপায় তা নাশ ক’রে দেন। ভক্তিপথ যিনি নিষ্কপটে গ্রহণ করেছেন, তাঁর যত কিছু দোষ-পাপ অপরাধ থাকুক না কেন – সব তিনি ক্ষমা করেন। ক্ষমার সঙ্গে দয়ার সম্পর্ক আছে। যার দোষ বা অপরাধ আছে, তাকে ক্ষমা করা যায়; ক্ষমা করে তাকে দয়া করা যায়। নিতাই ঠাকুর যদি দোষ ক্ষমা না করতেন, তাহলে কেউ উদ্ধার হতে পারতো না। নিতাইর ক্ষমা আছে কার প্রতি? রাবণ, কংস ও শিশুপালের মত বিরোধীর প্রতি নহে। যে জীব দূর্বল, অনুতপ্ত, দুঃখী অথচ ভক্তিসাধন করতে চায়, সেখানে গুরুদেবের ক্ষমা। গুরুদেব দীন-দয়াল, তাই সেখানে ক্ষমা না করলে চলে না। শিষ্য বহু চেষ্টা করছে ভক্তিপথে চলতে, কিন্তু পারছে না। প্রাক্তন বায়ুর বেগ সহ্য করতে পারে না। এরূপ শিষ্যকে গুরুপাদপদ্ম নিশ্চয়ই ক্ষমা করেন এবং কৃপাও করেন। যেখানে মতলব খারাপ, বিদ্বেষ মনোভাব – সেখানে ক্ষমার প্রকাশ নেই। বল দেবাভিন্ননিত্যানন্দ গুরুদেব ক্ষেত্র বিশেষে নিষ্ঠুর হন, কিন্তু স্বভাবতঃই তাঁর হৃদয় কুসুমের চেয়েও কোমল। রাবণ, কংস, জরাসন্ধ প্রভৃতির মত যারা দ্রোহী, তারা গুরুপাদপদ্মের কৃপা বুঝতে পারে না। কিন্তু গুরুপাদপদ্মের কৃপা না হলে জীবের চলে না। যে গুরুদেবের গুরুত্ব দর্শন করছে না, সে বঞ্চিত আছে। যে গুরুকে মানে না, সে ঠকছে। তার জীবনটাই বৃথা। যাঁর হৃদয়ে নিত্যানন্দ বিরাজ করছে, তাঁকে না মানা, অবমাননা করা নিতান্ত দুর্ভাগ্যের কথা। গুরুদেবের প্রতি যাদের ভালবাসা নেই, প্রীতি নেই, সেবা নেই, যারা মানে না, স্বীকার করে না এবং অসূয়া পোষণ করে; তাদের কখনও হরিভজন হবে না। যার এরূপ কোন বাধা নেই বা দৌরাত্ম্য নেই, তার কখনও পতন নেই, স্খলন নেই – ভক্তিপথ থেকে বিচ্যুতি নেই ।

 

— • • • —

 

 

Main page-এ ফিরে
গ্রন্থাগারে ফিরে

 

বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥