![]() |
|||||||
| |||||||
|
|||||||
শ্রীউপদেশ (৮) ভগবানের চরণে পথ
দিন যায় মিছা কাজে নিশা নিদ্রাবশে । (শ্রীলভক্তিবিনোদ ঠাকুর) দিন তো চলে যাবে । সময় ফুরিয়ে আসবে, তখন চলে যেতে হবে কিন্তু কতটা ভগবানের সেবা করতে পারলাম ? কতটা গুরু-বৈষ্ণবের সেবা করতে পারব আর পরলাম ? কতটা ভগবানের সেবার দিকে নিজেকে নিযুক্ত করতে পারলাম । সেইটা সবসময় চিন্তা করতে হবে ।
জীবে দয়া, নামে রুচি, বৈষ্ণব সেবা । কৃষ্ণ-বহির্মুখ জীবকে এই পথে কি করে আনতে হয় ? কৃষ্ণ-বহির্মুখ জীবের জন্য ভক্তগণ চেষ্টা করেন যেন লোক এই পথে এসে হরি-গুরু-বৈষ্ণবের সেবা করতে পারবে । সবাই মুখে কৃষ্ণনাম আসতে পারেন না—“কৃষ্ণনাম করে অপরাধের বিচার, কৃষ্ণ বলিলে অপরাধীর না হয় বিকার ।” (শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃত, ১/৮/২৪) অপরাধীরা (যারা নাম-অপরাধ করে) হরিনাম শুনলে, তাদের চিত্তে কখনও বিকার আসে না । এইজন্য সেবা-অপরাধ, বৈষ্ণব-অপরাধ, নাম-অপরাধ দূরে বিসর্জন করতে হয় । সবসময় সকল বেলা উঠে কীর্ত্তন করি :
ভক্তি-অনুকূল মাত্র কার্য্যের স্বীকার । ভক্তি-অনুকূল, ভক্তি-প্রতিকূল মানে কী ? অত্যাহার, প্রয়াসশ্চ, প্রজল্প, নিয়মাগ্রহ, লৌল্যঞ্চ, জনসঙ্গঞ্চ । অত্যাহার মানে বেশি খাওয়া ; প্রয়াসশ্চ—বেশি সঞ্চয় করা ; প্রজল্প মানে কৃষ্ণকথা বাদ দিয়ে অন্য কিছু চিন্তা, অন্য ভাবনা করা, অন্য লোকর সঙ্গে প্রজল্প করা ; নিয়মাগ্রহ মানে যেটা ভক্তির অনুকূল সেইটা করা, ভক্তির প্রতিকূলটা বিসর্জন না করা । আর জনসঙ্গঞ্চ মানে কৃষ্ণবহির্মুখ লোকের সঙ্গ করা । কৃষ্ণবহির্মুখ লোকের সঙ্গ করতে নেই । এইগুলো “ষড়ভির ভক্তির বিনশ্যতি”—এই ছয়টা ভক্তির বাধা দিয়ে দেয় । যেটা ভক্তির প্রতিকূল লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলা, তাদের সঙ্গ করা আপনাকে বিসর্জন করতে হবে, বর্জ্জন করতে হবে । না করলে ভক্তি আস্তে আস্তে বিনষ্ট হয়ে যাবে । ভগবানকে পেতে হলে, ভগবানকে জানতে হলে, তাহলে ভক্তের সেবা করতে হবে । যদি কৃষ্ণকে পেতে হয়, যশোদা মা, নন্দ মহারাজের সেবা করতে হবে—তাঁদের সেবা করলেই, কৃষ্ণকে পাওয়া যাবে । আপনি কৃষ্ণকে নিমন্ত্রণ করলে, কৃষ্ণ চলে আসবেন না কিন্তু যশোদা মাকে নিমন্ত্রণ করলে, তিনি কৃষ্ণকে কোলে তুলে নিয়ে চলে আসবেন । সেইরকম ভগবানের ভক্তকে সেবা করলে ভগবানকে পাওয়া যায় । ভগবান নিজে বলেছেন, “যদি কেউ বলে আমি কৃষ্ণভক্ত, সে আমার ভক্ত নয় কিন্তু যদি কেউ বলে আমি কৃষ্ণভক্তের ভক্তের ভক্তের ভক্ত, সেই আমার ভক্ত ।” “ছাড়িয়া বৈষ্ণব সেবা নিস্তার পায়েছে কেবা”—বৈষ্ণব-সেবা ছেড়ে দিয়ে কেউ নিস্তার পেতে পারে না । চৌষট্টির প্রকার ভক্ত্যঙ্গ আছে, তার মধ্যে ন’টা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ, ন’টার মধ্যে মুখ্য আরও পাঁচটা (সাধু-সঙ্গ, নাম-সঙ্কীর্ত্তন, ভাগবত-শ্রবণ, মথুরা-বাস, শ্রীমূর্ত্তির শ্রদ্ধায় সেবন), আর তার মধ্যে মূল শ্রেষ্ঠ হচ্ছে নাম-সঙ্কীর্ত্তন । “নিরপরাধে নাম লইলে পায় কৃষ্ণপ্রেমধন”—নিরপরাধে নাম নিলে তবে কৃষ্ণ-প্রেম-ধন লাভ করতে পারব । কিন্তু নিরপরাধে নাম নিতে হবে, অপরাধ যুক্ত হয়ে হরিনাম করলে কাজ হবে না ।
অসাধুসঙ্গে ভাই কৃষ্ণনাম নাহি হয় । (শ্রীশ্রীপ্রেমবিবর্ত্ত, ৭/১) দুধ খেলে পুষ্টি হয় কিন্তু দুধের মধ্যে সাপ যদি মুখ দেয় সে দুধ খেলে লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয় । হরিনাম শুনলে লোকের মঙ্গল হয় কিন্তু অবৈষ্ণবের মুখে হরিনাম, হরিকথা শুনলে, আমাদের পরম ক্ষতি হয়ে যাবে । এইজন্যে সাধু-সঙ্গে কৃষ্ণনাম করতে হয় । আপনি সেই হরিনাম মহামন্ত্র নিয়েছেন কিন্তু সেই মন্ত্রে ক্রীড়া করবেন না । হরি-গুরু-বৈষ্ণবের চরণে শরণাপন্ন হলে (হরি-গুরু-বৈষ্ণবের চরণে শরণ নিলে) তবে সংসারের মধ্যে আবদ্ধই থাকে না । সংসারে বসবাস করতে হবে অতিথি হয়ে, গৃহে আসক্তি-চিত্ত নয় । বাড়িটা আমি তৈরি করতে পারি কিন্তু আমি চির জীবন সেখানে থাকব না । যদি আমার নিজের ঘর, বাড়িতে আসক্তি-চিত্ত আছে, তাহলে অন্ধতমঃ তামসীক যোনিতে প্রবেশ করতে হবে । গৃহ তৈরি করে লোক ভাবনা করছে, “হায়, আমার বৃদ্ধ পিতা-মাতা, শিশু-সন্তান, ভার্যা, আমার বিনা সব অনাথ ও দুঃখিত হয়ে যাবে ! জীবনযাপন কি ভাবে করবে ?” এই প্রকার গৃহ অভিলাষে অতৃপ্তচিত্ত, অসন্তুষ্ট ও মন্দ বুদ্ধি ব্যক্তি পুত্র-কন্যা সর্ব্বদা ধ্যান করে এবং মৃত্যুর পর অন্ধতমঃ অতিতামসীক যোনিতে প্রবেশ করে । এটা ভাগবতের কথা, কিন্তু যাওয়াটা তো মুশকিল । গুরুমহারাজ বলতেন শীতকালে আপনি এক পুকুরের কাছে আসেন স্নান করবার জন্য আর মনে মনে ভাবছেন, “পুকুরে ডুব দেব ? না ! ঠাণ্ডা লাগছে, স্নান করব না !” পুকুর ঘিরে হেঁটে গিয়ে ভাবছেন, “নামব কি ? নামব না । নামব কি ? নামব না…” যদি আপনি গামছাটা জলে ছুড়ে ফেলে দেন, তখন গামছাটা ধরার জন্য পুকুরের মধ্যে লাফ দিয়ে পড়তে হয় । এখানেও এরকম হচ্ছে—মনটাকে ছুড়ে ফেলে দিতে হবে । এই জন্মে মানুষ-জন্ম লাভ করে কিন্তু কত কষ্ট মানুষ করছে—“বুড়ো কালে আমাকে কে দেখবে ? বুড়ো কালে আমার কী হবে ? আমার এ সব সহ্য হয় না । খাওয়া-দাওয়া কে দেবে ?” এ সব চিন্তা ছেড়ে দিয়ে গুরু-বৈষ্ণবের সেবা করতে হবে । আমার মঙ্গল যদি আমি না দেখি, আমার মঙ্গলটা অন্যজন কে দেখবে ? আমার উপকার যদি আমি করতে না পারি, আমার উপকার অন্য কে করতে পারে ? নিজেই নিজের বন্ধু, নিজেই নিজের শত্রু । আমি বলি না যে, যাদের ছেলে-মেয়ে বড় হয় নি, ছেলে-মেয়ে ছেড়ে দিতে হবে,—তাদেরকে ছেড়ে দিয়ে যাওয়া যায় না, আপনি বাড়িতে হরিনাম করতে পারেন । কিন্তু যাদের ছেলে-মেয়ে বড় হয়েছে তাদের সংসারে আবদ্ধ হয়ে থাকার কোন প্রয়োজনই নেই । গুরুদেব কত আশ্রম তৈরি করে রেখে গিয়েছেন, তবু আমরা সেই গৃহমেধী হয়ে, সংসারে আবদ্ধ হয়ে পড়ে থাকব আর কি…
মায়াজালে বদ্ধ হ’য়ে, আছ মিছে কাজ ল’য়ে । মায়া জালের মধ্যে বদ্ধ হয়ে নিজের মিছে কাজ করে বসে আছি, তখন মৃত্যুর পরে ওই অন্ধতমঃ অতিতামসীক যোনিতে প্রবেশ করতে হবে । আমার কথা যদি বিশ্বাস না করেন, বই নিয়ে এসেছি—শ্রীমদ্ভাগবত থেকে উদ্ধৃত করে বলে দিচ্ছি । “স্ত্রী, পুত্র, দারা, পরিবার, এ দেহ পতন হলে কী হবে আমার ?” এই দেহ পতন হয়ে গেলে আমার কি থাকবে আর, বলুন ? সেইজন্য বারবার সাধু-গুরু-বৈষ্ণবগণ আপনাদের বাড়িতে আসেন । কত ভাগ্য আপনাদের । আপনারা কীর্ত্তন করেন, “কর মরে আত্মসাথ”—“প্রভু, আমাকে আত্মসাথ করে নিয়ে যাও ।” সাধুরা (যদি সেটা প্রকৃত সাধু হয়) আপনাদের টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত নিতে আসেন না, আপনাদের আত্মসাথ করে নিতে আসেন আর গুরু-গোবিন্দের সেবায় লাগিয়ে দেন । সেই চিন্তা-ভাবনা করতে হবে ।
— • • • —
|
সূচীপত্র: সূচনা : আমাদের একমাত্র কৃত্য ১। ভক্তির অভাব ২। গৃহে আবদ্ধ ৩। মায়ের পেট থেকে মায়ার পেটের মধ্যে ৪। জীবকে সত্য দয়া কি ? ৫। ভোগী নই ত্যাগীও নই ৬। শ্রবণ-কীর্ত্তনে মতি ৭। ভগবানের কৃপা ও আপনার চেষ্টা ৮। ভগবানের চরণে পথ ৯। শান্তির গুপ্ত কথা ১০। শ্রীবামনদেবের কথা ১১। শ্রীনৃসিংহদেবের কথা ১২। পূজনীয় বিসর্জন ১৩। ভক্ত ও নাপিত ১৪। চকচক করলেই সোনা হয় না ১৫। আমি তো সব ব্যবস্থা করি নাকি ? ১৬। দণ্ড মহৎসব ১৭। শিবজী মহারাজ : পরম বৈষ্ণব ১৮। মায়ার চিন্তা বা কৃষ্ণের চিন্তা ? ১৯। আমাদের একমাত্র উপায় ২০। পবিত্র জীবন ২১। শ্রীহরিনাম দীক্ষা : গুরুপাদপদ্মের দান ২২। আমার শোচন |
||||||
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥ | |||||||
© Sri Chaitanya Saraswat Math, Nabadwip, West Bengal, India. For any enquiries please visit our contact page. |