আমাদের শ্রীগুরুপরম্পরা :
শ্রীশ্রীল ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ ভগবান্ শ্রীশ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর
              প্রভুপাদ
“শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠে সূর্যাস্ত কখনই হয় না” :
আমাদের মঠের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
 
আমাদের সম্পর্কে শ্রীউপদেশ শ্রীগ্রন্থাগার শ্রীগৌড়ীয় পঞ্জিকা ছবি ENGLISH
 

শ্রীউপদেশ


(১৫) আমি তো সব ব্যবস্থা করি নাকি ?

 

ভগবানের চরণে সবসময় সমর্পণ করতে হবে, কৃষ্ণনাম করতে হবে :

দিন যায় মিছা কাজে নিশা নিদ্রাবশে ।
নাহি ভাবি মরণ নিকটে আছে বসে ॥

আমাদের দিন বিভিন্ন ভাবে চলে যায়—“দিন যায় মিছা কাজে নিশা নিদ্রাবশে” । কালী-পূজা করলে লক্ষ্মী-পূজা করতে হয় না, লক্ষ্মী-পূজা করলে সরস্বতী-পূজা করতে হয় না কিন্তু

একলা ঈশ্বর কৃষ্ণ, আর সব ভৃত্য ।
যারে যৈছে নাচায়, সে তৈছে করে নৃত্য ॥

(শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃত, ১/৫/১৪২)

কৃষ্ণের পূজা করলে সব দেব-দেবতারার পূজা হয়ে যায় । এইজন্য সবটাকে ভগবানের সেবায় লাগাতে হবে । যেমন বাড়িতে একটা নারিকেল-গাছ লাগিয়েছেন বা একটা আম-গাছ লাগিয়েছেন কিন্তু গাছের আমটা খেতে পারেন ? আপনারা ভাবেন যে, “আম-গাছটা আমি লাগিয়েছি, আমি আমটা খাব !” কিন্তু না—আপনি গাছটা লাগাতে পারেন কিন্তু আপনি তার ফল খেতে পারেন না, কেননা আপনি গাছে প্রাণ দিতে পারেন না । গাছের মালিক হচ্ছেন ভগবান, আপনি সব ভগবানকে নিবেদন করে তাঁর প্রসাদ গ্রহণ করতে হবে । এইটা হচ্ছে নিয়ম আর এই নিয়ম অনুসারে চলতে হবে । গীতায়ও বলেছেন : “আমাকে না দিয়ে খেলে চুরি করে খাওয়া হয়, পাপ ভক্ষণ করা হয় ।” আর আপনি ভাবছেন, “আমি সবকিছু করছি, আমি সবকিছু ভক্ষণ করব ।”

আমি একটা কথা বলব, তখন ব্যাপারটা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবেন ।

এক যে ছিল ব্রাহ্মণ, তাঁর নাম ছিল অর্জ্জুন মিশ্র । তিনি প্রত্যেক দিন গীতা-পাঠ করতেন আর প্রত্যেক দিন ভিক্ষায় বেরিয়ে যেতেন । এক দিন তিনি গীতা-পাঠ করে, পড়তে পড়তে, এই শ্লোকটা দেখতে পেলেন,

অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্য্যুপাসতে ।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্ ॥

(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ৯/২২)

“যারা অন্য চিন্তা বাদ দিয়ে আমার শরণাপন্ন হয়, তাদের খাবারটা আমি বয়ে এনে দেই ।” এটা শ্লোকটা পড়ে অর্জ্জুন মিশ্র ভাবলেন, “আমি প্রত্যেক দিন ভিক্ষায় যাই, লোকেরা যা চাল, ডাল, তরি-তরকারি দেয়, তা দিয়ে আমার স্ত্রী রান্না করে, আমি ভোগ লাগিয়ে দেই । আমরা তারপর দুইজনে প্রসাদ পাই আর যা থাকে লোককে খাবার দিয়ে দেই । কই, ঠাকুর তো বয়ে দেয় না !” এসব মনে মনে ভেবে শ্লোকটা তিনি কেটে দিলেন আর লিখলেন “করাম্যহম্”—”আমি নিজেই করি” ।

গীতার মাহাত্ম্যমে কী লেখা আছে ? ভগবান বলছেন, “গীতা আমার হৃদয়, গীতা আমার উত্তম স্থান, গীতাই আমার পরম গৃহ, গীতা আমার উত্তম সার-স্বরূপ” ইত্যাদি । সুতরাং গীতা-গ্রন্থে যে আঘাত করে, সে ভগবানের শ্রীঅঙ্গে আঘাত লাগে ।

তাই অর্জ্জুন মিশ্র যখন গীতার শ্লোকটি কেটে দিলেন, তখন ভগবানকে ব্যাথা দিলেন আর ওই সময় সঙ্গে সঙ্গে নারায়ণ চিৎকার করলেন, “উঃ ! আমার লেগে গেল !”

লক্ষ্মীদেবী নারায়ণের পা টিপে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হচ্ছে গো ?”

নারায়ণ বললেন, “আমার ভক্ত তো অসুবিধায় পড়েছে, এই পৃথিবীতে আমাকে আসতে হবে ।”

তখন ভগবান কী করলেন ? সে বারো বছরের বালক সেজে মর্ত্যে চলে আসলেন আর মাথার মধ্যে চাল, ডাল, তরি-তরকারি, ফল, মূল, সব বোঝা করে নিয়ে ব্রাহ্মণের বাড়ির সামনে এসে হাজির হলেন । ব্রাহ্মণ ওই সময় ভিক্ষায় বেরিয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁর স্ত্রী (ব্রাহ্মণী) বাড়িতে একাই ছিলেন ।

বালকটা বাড়িতে এসে ডাকলেন, “হে ব্রাহ্মণী, ব্রাহ্মণী ! ধরো ! ধরো ! আমি আর পাচ্ছি না ! আমার মাথা ভেঙে যাচ্ছে !”

ব্রাহ্মণী দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কে ?”

বালকটা সব বোঝা মাথা থেকে নেমে বললেন, “এই তো !”

“তুমি এগুলো আনিলে কেন?”

“কী করব ? এগুলো ব্রাহ্মণ, তোমার স্বামী, দিয়ে দিল । আমি তাকে বললাম পারব না কিন্তু সে আমাকে থাপ্পড় মারল—দেখ, আমার পিঠে দাগ পড়ে আছে । “

“সে আবার বৈষ্ণব হচ্ছে, তার তো কোন রাগ নেই আর সে তোমাকে মারল ?”

“এই বোঝাগুলো খালি করে নিয়ে এসো ।”

ব্রাহ্মণী বোঝাগুলো খালি করতে ভিতরে গেলেন আর এদিকে ভগবান অন্তর্ধান হলেন । ফিরে এসে ব্রাহ্মণী তাকে দেখতে পারছেন না, “ছেলেটা কোথায় ? কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না—বাড়িতে নেই, ওদিকে নেই, এদিকে নেই…”

তখন ব্রাহ্মণী রান্না রান্না করলেন কিন্তু দেখলেন যে, ব্রাহ্মণটা আসছেন না ।

এদিকে ব্রাহ্মণটা ভিক্ষায় গিয়েছেন । ও প্রথম বাড়ি গেলেন, লোকটা বলল, “কি গো ? আজ তো বৃহস্পতিবার, ভিক্ষায় এসছো ?” দ্বিতীয় বাড়ি গেলেন, লোকটা বলল, “আমার বাড়িতে মামা মরে গেছে, ভিক্ষা দেব না…” তৃতীয় বাড়ি গেলেন, লোকটা বলল, “বাড়িতে অসুস্থ, ভিক্ষা হবে না ।” চতুর্থ বাড়ি গেলেন, বাড়িটা তালাবদ্ধ, আবার ভিক্ষা পেলেন না । এই সব বাড়ি বাড়ি পাড়ায় ঘুরে বেড়ালেন কিন্তু এক মুষ্টি চালও মিললেন না । তিনটা সময় এসে কাঁদতে কাঁদতে ব্রাহ্মণীর কাছে ফিরে এলেন ।

ব্রাহ্মণী তাঁকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কাঁদছো কেন ? তোমার কি হয়েছে ?!”

“আজকে ঠাকুরের উপবাস থাকতে হবে, আমদেরও উপবাস থাকতে হবে… আমি আজকে কিছু ভিক্ষা পেলাম না ।”

“সে কী ? তুমি তো সকালে একটা ছেলেকে দিয়ে এক ঝুরি চাল, ডাল, ফল, মূল পাঠিয়ে দিয়েছো, এমন কি তাকে মেরেছো !”

“আমি কাউকে মারিনি ! আমি কাউকে পাঠাইনি ! কি বলছো তুমি ?”

“আরে দেখো তো—কত চাল, ডাল আছে ! কত সবজি আছে, কত ফল, মূল আছে !”

“সে কী ? আমি কাউকেই পাঠাই নি ! তোমার কী ব্যবস্থা হল ? তুমি কী করলে ?”

তখন ব্রাহ্মণের খেয়াল হল যে, গীতাটা নিচে পড়ে আছে । তিনি ব্রাহ্মণীকে জিজ্ঞেস করল, “হে ব্রাহ্মণী, তুমি গীতা-পাঠ করেছো নাকি ?”

“না, আমি তো পাঠ করি নি ।”

“আমি তো গীতা-পাঠ করার পরে বইটা উপরে রাখলাম । তবে কে পাঠ করেছে ?”

অর্জ্জুন মিশ্রের বাড়িতে ঠাকুরের বিগ্রহ ছিল (বিগ্রহটা সাক্ষাদ ব্রজেন্দ্রনন্দন !) আর ভগবান এখানে এসে লিখে দিয়ে গেলেন : “তুমি শ্লোকটা কেটে দিলে, এটা কিন্তু ভুল । দেখলে তো ? আজকে তুমি ভিক্ষায় গেলে কিছুই পেলে না । তুমি বললে করাম্যহম্ (আমি সবকিছু নিজেই করি), এখন দেখো কে করে !”

ভগবানের ইচ্ছা বিনা কেউ এক পা চলতে পারবে না । আপনি ভাবছেন যে, কালকে ওফিসে যাবেন, কালকে রান্না করে খাবেন কিন্তু ভগবান যদি ব্যবস্থা করেন আপনার তখন কোন ক্ষমতাই থাকবে না । আমরা বলি, “আমি করি, আমি সবকিছু করি, আমরা সবকিছু ব্যবস্থা করি,” কিন্তু এসব ভুল ধারণা ! “অহঙ্কারে মত্ত হৈঞা নিতাই-পদ পাসরিয়া অসত্যেরে সত্য করি’ মানি”—আমি অসত্যকে সত্য মানি । আমার ইচ্ছা সব ভুল । যদি আপনি ভগবানে বলেন, “আমি তোমাকে চাই,” তাহলে গাড়ি হবে, বাড়ি হবে, টাকাও হবে, সব হবে, আর যদি ভগবানকে কেউ বলে, “ভগবান, আমি গাড়ি চাই, টাকা চাই,” তাহলে কী হবে ?

কৃষ্ণ যদি ছুটে ভক্তে ভুক্তি মুক্তি দিয়া ।
কভু ভক্তি না দেন রাখেন লুকাইয়া ॥

(শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃত, ১/৮/১৮)

যখন বাবা কাজে বেরিয়ে যায়, তখন তার ছেলে খুব কাঁদে বলছে, “বাবা, আমি তোমার সঙ্গে যাব !” বাবা কী করবে ? একটা চকলেট, একটা খেলনার জিনিস দিয়ে দেবে আর ছেলেকে ভুলিয়ে রেখে যাবে, তখন বাবাটা কাজে চলে যাবে । ভগবানও সেইরকম—আমাররা সন্তানের মত ভগবানের কাছে যদি ভগবানকে পাওয়ার পরিবর্তে কিছু চাই, “ভগবান, আমি গাড়ি চাই,” “বাড়ি চাই,” “টাকা চাই” ইত্যাদি, ভগবান তখন ওগুলো দিয়ে দেবেন আর মাঝখান থেকে ভক্তিটা নিয়ে চলে যাবেন—আমাদের ভক্তি পাওয়া যাবে না । যদি অন্য কিছু চাই, সব আমরা পেতে পারি কিন্তু ভক্তি নষ্ট হয়ে যাবে আর শুধু ভুক্তি থাকবে ।

কৃষ্ণ যদি ছুটে ভক্তে ভুক্তি মুক্তি দিয়া ।
কভু ভক্তি না দেন রাখেন লুকাইয়া ॥

(শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃত, ১/৮/১৮)

এটা সবসময় মনে রাখতে হবে ।

 

— • • • —

 

 

← (১৪) চকচক করলেই সোনা হয় না (১৬) দণ্ড মহৎসব →

 

সূচীপত্র:
সূচনা : আমাদের একমাত্র কৃত্য
১। ভক্তির অভাব
২। গৃহে আবদ্ধ
৩। মায়ের পেট থেকে মায়ার পেটের মধ্যে
৪। জীবকে সত্য দয়া কি ?
৫। ভোগী নই ত্যাগীও নই
৬। শ্রবণ-কীর্ত্তনে মতি
৭। ভগবানের কৃপা ও আপনার চেষ্টা
৮। ভগবানের চরণে পথ
৯। শান্তির গুপ্ত কথা
১০। শ্রীবামনদেবের কথা
১১। শ্রীনৃসিংহদেবের কথা
১২। পূজনীয় বিসর্জন
১৩। ভক্ত ও নাপিত
১৪। চকচক করলেই সোনা হয় না
১৫। আমি তো সব ব্যবস্থা করি নাকি ?
১৬। দণ্ড মহৎসব
১৭। শিবজী মহারাজ : পরম বৈষ্ণব
১৮। মায়ার চিন্তা বা কৃষ্ণের চিন্তা ?
১৯। আমাদের একমাত্র উপায়
২০। পবিত্র জীবন
২১। শ্রীহরিনাম দীক্ষা : গুরুপাদপদ্মের দান
২২। আমার শোচন
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥