আমাদের শ্রীগুরুপরম্পরা :
শ্রীশ্রীল ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ ভগবান্ শ্রীশ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর
              প্রভুপাদ
“শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠে সূর্যাস্ত কখনই হয় না” :
আমাদের মঠের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
 
আমাদের সম্পর্কে শ্রীউপদেশ শ্রীগ্রন্থাগার শ্রীগৌড়ীয় পঞ্জিকা ছবি ENGLISH
 

শ্রীউপদেশ


(২০) পবিত্র জীবন

 

নবদ্বীপ ধাম পরিক্রমায় প্রত্যেক বৎসর আপনারা অনেকেই যান, গিয়ে যদি আচার আচরণ করেন, নিজে নিয়মকানুন পালন করেন, কিছুই ক্ষতি হবে না । আপনারা ভাবেন যে, “আশ্রমে যাব !” আশ্রমে গিয়ে সেখান থেকে দীক্ষা নিয়ে বাড়িতে এসে নিরামিষ খেতে হবে, একাদশী করতে হবে, হরিনাম করতে হবে । এটাই তো জীবন !

চারটা জায়গায় কলি অবস্থান করে—দ্যূত, পান, স্ত্রীয়, সূনা ।

(১) দ্যূত মানে জুয়া খেলা, তাস খেলা, পাশা খেলা । এইটা আমরা বারণ করি । তা আপনারা নিজেরাই বুঝেন । যাঁরা দীক্ষা নেননি, যাঁরা সংসারের মধ্যে আবদ্ধই আছেন, তাঁরা বুঝেন না । যদি বাড়ির কর্তা জুয়া খেলে আর ছেলে জুয়া খেলে, তাহলে এই বাড়ির সংসার থাকবে, বলুন ?

(২) পান বলতে আপনার বাড়িতে সুখ সারাক্ষণ বসে আছেন, পরিশ্রম করছেন, রান্না করছেন, আর আপনার স্বামী বাড়িতে মদ খেয়ে ঢুকছে, ছেলে মদ খেয়ে ঢুকছে । মদ খেয়ে এসে মাতলামো করছে, বউকে পেঠাছে… সেই সংসারে শান্তি আছে, বলুন ? পান হচ্ছে পান, মদ, গাঁজা, ভাং, বিড়ি, সিগারেট—এগুলো শরীরেরও ক্ষতি করে, পয়সাও নষ্ট হয়, সংসারেরও ক্ষতি হয় ।

(৩) স্ত্রীয় বলতে অবৈধ স্ত্রী-সঙ্গ । আপনি বাহিরে কাজ করতে গিয়ে স্ত্রীকে বাড়িতে রেখে গেলেন আর ইতিমধ্যে আপনার স্ত্রী আপনাকে না পেয়ে পর পুরুষের সঙ্গ করছে—সে সংসার ভাল থাকবে ? আর আপনিও বাহিরে গিয়ে পরস্ত্রীর সঙ্গ করছেন—সে সংসার টিকবে, বলুন ? সে হচ্ছে অবৈধ স্ত্রী-সঙ্গ ।

(৪) সূনা বলতে জীব হিংসা, মানে কোন জীবকে হত্যা করা চলবে না । “সর্ব্ব জীবে কৃষ্ণ-অধিষ্ঠান” : সর্ব্ব জীবের মধ্যে ভগবান আছে, একটা পিপীলিকার মধ্যে যেটা আছে আমার মধ্যে একই জিনিস আছে, হাতির মধ্যে একই জিনিস আছে—এ ‘জিনিস’ হচ্ছে আত্মা । একটা আত্মা আরকি ? প্রশ্নটা আমি কে ? আমি অমুক রায়, অমুক চৌধুরী, অমুক মুখার্জী, অমুক ব্রাহ্মণ, অমুক রাজা, অমুক মহারাজ—এ সব পরিচয় নয় !

জীবের ‘স্বরূপ হয়’—কৃষ্ণের ‘নিত্যদাস’ ।
কৃষ্ণের ‘তটস্থা-শক্তি’, ‘ভেদাভেদ-প্রকাশ’ ॥
‘কৃষ্ণ-নিত্যদাস’—জীব তাহা ভুলি’ গেল ।
এই দোষে মায়া তার গলায় বান্ধিল ॥

(শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃত, ২/২০/১০৮ , ২/২২/২৪)

আমরা ভুলে গিয়েছি যে, আমরা কৃষ্ণের চাকর, কৃষ্ণের পুত্র আর এই জন্য আমরা মায়ার মধ্যে পড়ে আছি : মায়ার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি, মায়ার সংসারে ডুবে আছি । “জীব নিত্য কৃষ্ণদাস”—এটা হচ্ছে আমার পরিচয় । “কৃষ্ণের তটস্থা-শক্তি, ভেদাভেদ-প্রকাশ” : ভেদ যোগ অভেদ । ভেদ মানে জীব ভগবান নয় । আমরা বলি, “আমি ভগবান নই” কিন্তু বিভিন্ন আশ্রমে অনেক লোকেরা বলে, “আমি তোমাকে রক্ষা করব !” হে তুমি কে, বাবা ? তুমি রক্ষা করবার কে ? ওরা ভুঁইফোড় ভগবান সাজে ! (ভগবান জমি থেকে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় ?) আবার বড় বড় সাইনবোর্ড লাগায়—“জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর” ! মুখে বলে “জীবে প্রেম” আর খেতে গেলে মুরগির মাংস আর খাসির মাংস—তারা বলে যে, “তারা জীব নয়, সুতরাং সে জীব হত্যা করা হয় ।”

আর আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন, “মহারাজ, আপনারা কি জীবকে হত্যা করেন না ? আমরা ছাগল কেটে জীবকে হত্যা করি কিন্তু আপনিও জীব হত্যা করেন—আপনারা বলেন নিরামিষ খান, নিরামিষ প্রসাদ পান কিন্তু বাগান থেকে ওই কচু শাকগুলো কেটে নিয়ে আসেন, লাউয়ের ডগা, ডাটাগুলো কেটে নিয়ে আসেন—সেগুলোটাও জীব হত্যা হয় !” কী বলুন না ? কি প্রশ্ন আসতে পারে না ? বারবার লোকেরা আমাকে এই প্রশ্ন করেছে । আমিই প্রশ্ন করে দিচ্ছি, তাহলে উত্তরটাও পেয়ে যাবেন । প্রশ্নটা এইভাবেই : আমরা শাক-সবজি কেটে নিয়ে আসি কিন্তু সেটা তো আমরা নিজের খাবার জন্য নিয়ে আসি ? না । সেটা তো আমরা আমাদের খাবার জন্য নিয়ে আসি না । আমরা এগুলো নিয়ে আসি ভগবানের জন্য ; এ সব ভগবানের জন্যই সৃষ্টি হচ্ছে আর আমরা ভগবানকে দিয়েছি । গিতায় ওইটাই বলেছে যে, “আমাকে না দিয়ে খেলে চুরি করে খাওয়া হয়, পাপ ভক্ষণ করা হয় ।” এই জগতে যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে গোবিন্দের সেবার জন্য, আমাদের ভোগের জন্য নয় । আমরা সব গোবিন্দের সেবায় লাগিয়ে দেই…

বাইরের লোক বাজার থেকে ছাগল কিনে যদি কালির কাছে বা কোন অন্য দেবতার কাছে (যারা সেইভাবে পছন্দ হয়) বলি দেন, তাহলে ওই ছাগলটা কিছু মঙ্গল, কিছু সদ্­গতি হয়—দেবতার সেবা করেছে  বলে অনেক জন্ম ছাগলটা পেরিয়ে যাবে । কিন্তু যদি আপনি বাড়িতে গরু পোষেন, সে গরু দুধ দেয়, আর আপনি ওই দুধ থেকে পায়েস করেন, তাহলে ওই গরুটা সুকৃতি পায় । কিংবা বাজারে তো অনেক কিছু বিক্রি হয়, কেউ দুধও বিক্রি করে, সে দুধ যদি কিনে নিয়ে এসেন আপনি বাড়িতে পায়েস করে ভগবানের সেবায় দেন, কার গরু দুধ আপনি তা বুঝতে পারলেন না কিন্তু মাঝখান দিয়ে ওই গরুরটা সুকৃতি হয়ে গেল ।

সেইভাবে, সূনা মানে জীব হিংসা—কোন জীবকে হত্যা করা চলবে না । আপনার যা কিছু আছে গোবিন্দের সেবার জন্য ব্যবহার করেন, গোবিন্দকে ভোগ লাগিয়ে দেন । আপনার তো ভালো জিনিস খেতে ইচ্ছা করছে, তথা বাজারে গেলেন সিঙ্গারা খেতে ইচ্ছা করছে কিংবা কলা বা মিষ্টি খেতে ইচ্ছ করছে—আপনার খেতে গো, বারণ করেনি কিন্তু প্রথমই আপনি নিয়ে আসবেন, বাড়িতে ঠাকুর আছে—তুলসী পাতা দিয়ে ঠাকুরকে ভোগ লাগাবেন আর ভোগ দিয়ে তাঁর প্রসাদ পাবেন ।

“প্রসাদ-সেবা করিতে হয় সকল প্রপঞ্চ জয় ।” মনের মধ্যে অনেক বাসনা আছে : “বাচো-বেগং, মনস-বেগং, ক্রোধ-বেগং, জিহ্বা-বেগং, উদরোপস্থ-বেগং…” বাক্য-বেগ, মানস-বেগ, ক্রোধ-বেগ, জিহ্বা-বেগ, উদর- ও উপস্থ-বেগ—মনের মধ্যে অনেক খুব খারাপ চিন্তা থাকতে পারে প্রভৃতি—এ সব প্রপঞ্চ আছে । এগুলো আপনার সব জয় হয়ে যায় যদি প্রসাদ গ্রহণ করেন । এইজন্য প্রসাদ পাওয়ার সময় কীর্ত্তনে প্রসাদের গুণ গাইতে হয়—

(জয়) মহাপ্রসাদে গোবিন্দে নামব্রহ্মণী বৈষ্ণবে ।
স্বল্পপুণ্যবতাং রাজন বিশ্বাসো নৈব জায়তে ॥
শরীর অবিদ্যা-জাল জড়েন্দ্রিয় তাহে কাল
জীবে ফেলে বিষয় সাগরে ।
তার মধ্যে জিহ্বা অতি লোভময় সুদুর্ম্মতি
তা’কে জেতা কঠিন সংসারে ॥
কৃষ্ণ বড় দয়াময় করিবারে জিহ্বা জয়
স্বপ্রসাদ অন্ন দিল ভাই ।
সেই অন্নামৃত পাও রাধাকৃষ্ণ গুণ গাও
প্রেমে ডাক চৈতন্য নিতাই ॥

“জীবে ফেলে বিষয় সাগরে”—ওই জিহ্বা আপনাকে বিষয়-সাগরের মধ্যে ফেলে দিল । “তার মধ্যে জিহ্বা অতি লোভময় সুদুর্ম্মতি”—ওই জিহ্বা শুধু দুর্ম্মতি নয়, সুদুর্ম্মতি, আরও খারাপ… এই জিহ্বাই কন্ট্রোল (দমন, নিয়ন্ত্রণ) যদি করতে না পারেন, তাহলে আপনার অন্য কিছু কন্ট্রোল (নিয়ন্ত্রিত) হবে না ।

জিহ্বার লালসে যেই ইতি-উতি ধায় ।
শিশ্নোদরপরায়ণ সে কৃষ্ণ নাহি পায় ॥

(শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃত, ৩/৬/২২৭)

যে জিহ্বায় নিয়ন্ত্রিত হয়, সে শিশ্নোদরপরায়ণ হয়ে যায় আর যে শিশ্নে ও উদরে পরায়ণ হয় সে কৃষ্ণকে পায় না ।

সেইভাবে, লোক সাইনবোর্ড লিখে দেয় “জীবে প্রেম” আর ঘরের মধ্যে ছাগল খাচ্ছে, মুরগি খাচ্ছে… এটা জীবে প্রেম ? যেমন আপনি লিখে দেন “অমুখ গ্লাস ফ্যাক্টরী” আর বলেন এখানে গ্লাস (কাচ) তৈরি হয় । আমি সেখানে গিয়ে কিন্তু এক টুকরো গ্লাস খুঁজে পাই না । ওইরকমই আমাদের দেশে বড় বড় সাইনবোর্ড লাগায় অনেকই কিন্তু বুঝতে পারে না—মানুষকেই জীব বুঝায় আর পশু-প্রাণীর জীব নয়, গরু, ছাগল, ভেড়া, বেড়াল জীব নয়, ওগুলোকে তুমি যা খুশি করতে পারো । এটা ভুল ধারণা হয় । “সর্ব্ব জীবে কৃষ্ণ-অধিষ্ঠান,” সেটা বুঝতে হবে । এক বৃক্ষের মধ্যেও জীব আছে । আচ্ছাদিত-চেতন, সঙ্কুচিত-চেতন, মুকুলিত-চেতন, বিকসিত-চেতন, পূর্ণ-বিকসিত-চেতন—এই ভাবে চেতন শক্তি জাগরণ হয় । আপনার চামড়াটা যদি এখানে কেউ টান দিয়ে খোলে আপনি তখন চিৎকার করে বলবেন, “বাবা-মা গো !” তাই না, বলুন ? চিৎকার করে বলবেন । কিন্তু আপনি যদি গাছের ছাল ছাড়িয়ে আপনার হার্টের জন্য তার রস খান—সে গাছটাও চিৎকার করে কিন্তু আপনি সেটা বুঝতে পারছেন না ।

আমাদের এই সিদ্ধান্তগুলো শুনে চলতে হবে ।

 

— • • • —

 

 

← (১৯) আমাদের একমাত্র উপায় (২১) শ্রীহরিনাম দীক্ষা : গুরুপাদপদ্মের দান →

 

সূচীপত্র:
সূচনা : আমাদের একমাত্র কৃত্য
১। ভক্তির অভাব
২। গৃহে আবদ্ধ
৩। মায়ের পেট থেকে মায়ার পেটের মধ্যে
৪। জীবকে সত্য দয়া কি ?
৫। ভোগী নই ত্যাগীও নই
৬। শ্রবণ-কীর্ত্তনে মতি
৭। ভগবানের কৃপা ও আপনার চেষ্টা
৮। ভগবানের চরণে পথ
৯। শান্তির গুপ্ত কথা
১০। শ্রীবামনদেবের কথা
১১। শ্রীনৃসিংহদেবের কথা
১২। পূজনীয় বিসর্জন
১৩। ভক্ত ও নাপিত
১৪। চকচক করলেই সোনা হয় না
১৫। আমি তো সব ব্যবস্থা করি নাকি ?
১৬। দণ্ড মহৎসব
১৭। শিবজী মহারাজ : পরম বৈষ্ণব
১৮। মায়ার চিন্তা বা কৃষ্ণের চিন্তা ?
১৯। আমাদের একমাত্র উপায়
২০। পবিত্র জীবন
২১। শ্রীহরিনাম দীক্ষা : গুরুপাদপদ্মের দান
২২। আমার শোচন
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥