| |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
|
|||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
দ্বিতীয়োঽধ্যায়ঃ সসাংখ্যযোগ
সঞ্জয়ঃ উবাচ (সঞ্জয় বলিলেন) তথা (তথাবিধ) কৃপয়া আবিষ্টম্ (কৃপাপরবশ) অশ্রুপূর্ণাকুলেক্ষণম্ (অশ্রুপূর্ণাকুলনয়ন) বিষীদন্তং তং (বিষণ্ণ বদন অর্জ্জুনকে) মধুসূদনঃ (শ্রীকৃষ্ণ) ইদং বাক্যম্ (এই বাক্য) উবাচ (বলিলেন) ॥১॥ সঞ্জয় কহিলেন—মধুসূদন তখন সেই অশ্রুপূ্র্ণ আকুল নয়ন কৃপাবিষ্ট বিষণ্ণানন অর্জ্জুনকে এই কথা বলিলেন ॥১॥
শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ বলিলেন) [হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন ! ) কুতঃ (কি হেতু) বিষমে (এই সংগ্রাম-সংকটে) অনার্য্যজুষ্টম্ (আর্য্যগণের অযোগ্য) অস্বর্গ্যম্ (স্বর্গ-প্রতিবন্ধক) অকীর্ত্তিকরম্ (এবং অযশস্কর) ইদং কশ্মলম্ (এই মোহ) ত্বা (তোমার) সমুপস্থিতম্ (উপস্থিত হইল) ॥২॥ শ্রীভগবান্ বলিলেন—হে অর্জ্জুন ! এই বিষম যুদ্ধ সময়ে কি জন্য তোমার অনার্য্যোচিত, অস্বর্গকর ও কীর্ত্তি নাশক এই মোহ উপস্থিত হইল ? ॥২॥
[হে] পার্থ ! (হে কুন্তীপুত্ত্র !) ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ (কাতরতাপ্রাপ্ত হইও না) এতৎ (এই কাতরতা) ত্বয়ি (তোমাতে) ন উপপদ্যতে (শোভা পায় না) । [হে] পরন্তপ ! (হে শত্রু তাপন !) ক্ষুদ্রং হৃদয়-দৌর্ব্বল্যম্ (ক্ষুদ্র মানসিক দুর্ব্বলতা) ত্যক্ত্বা (পরিত্যাগ করিয়া) উত্তিষ্ঠ (উঠ, যুদ্ধার্থ উত্থিত হও) ॥৩॥ হে পার্থ ! কাতরতা ত্যাগ কর, কাতরতা তোমার উপযুক্ত নহে । হে পরন্তপ ! ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্ব্বল্য পরিত্যাগ করিয়া যুদ্ধার্থ উত্থিত হও ॥৩॥
অর্জ্জুনঃ উবাচ (অর্জ্জুন কহিলেন) [হে] অরিসূদন ! মধুসূদন ! (হে শত্রু নাশক মধুসূদন !) অহং (আমি) পূজার্হৌ (পূজনীয়) ভীষ্মং দ্রোণঞ্চ (ভীষ্ম ও দ্রোণকে) [লক্ষীকৃত্য] (লক্ষ্য করিয়া) কথং (কি প্রকারে) সংখ্যে (যুদ্ধে) ইষুভিঃ (বাণ দ্বারা) প্রতিযোৎস্যামি (প্রতি যুদ্ধ করিব) ॥৪॥ অর্জ্জুন কহিলেন—হে অরিনিসূদন মধুসূদন ! যুদ্ধে আমি কি প্রকারে পূজনীয় পিতামহ ভীষ্ম ও আচার্য্য দ্রোণের সহিত বাণের দ্বারা প্রতিযুদ্ধ করিব ॥৪॥
মহানুভাবান্ গুরূন্ (মহানুভাব গুরুদিগকে) অহত্বা হি (বধ না করিয়া) ইহ লোকে (এই জগতে) ভৈক্ষ্যম্ অপি ভোক্তুং (ভিক্ষালব্ধ অন্ন ভোজন করাও) শ্রেয়ঃ (ভাল) । তু (কিন্তু) গুরূন্ হত্বা (গুরুবর্গকে বধ করিয়া) ইহ এব (ইহলোকেই) রুধিরপ্রদিগ্ধান্ (শোণিত লিপ্ত) অর্থ কামান্ ভোগান্ (অর্থ ও কামাদি ভোগ্য বস্তুসকল) ভুঞ্জীয় (আমাকে ভোগ করিতে হইবে) ॥৫॥ মহানুভাব গুরুজনদিগকে হত্যা না করিয়া ইহলোকে ভিক্ষান্ন ভক্ষণ করাও মঙ্গলজনক, কিন্তু গুরুজনদিগকে হত্যা করিলে এই জগতেই তাহাদের রুধিরাক্ত অর্থ ও কামাদি ভোগ্যসমূহ আমাকে ভোগ করিতে হইবে ॥৫॥
যদ্ধা (যদিই) [বয়ং] (আমরা) জয়েম (জয় করি) যদি বা (কিংবা) [এতে] (ইহারা) নঃ জয়েয়ুঃ (আমাদিগকে জয় করুক) নঃ (আমাদের সম্বন্ধে) এতৎ কতরৎ (ইহার মধ্যে কোন্টি) গরীয়ঃ (অধিক শ্রেয়স্কর) ন চ বিদ্মঃ (তাহা বুঝিতেছি না) যান্ হত্বা (যাহাদিগকে বধ করিয়া) ন জিজীবিষামঃ এব (বাঁচিতেই ইচ্ছা করি না) তে ধার্ত্তরাষ্ট্রাঃ (সেই ধৃতরাষ্ট্র পুত্ত্রগণ) প্রমুখে (যুদ্ধার্থ সম্মুখে) অবস্থিতাঃ (উপস্থিত রহিয়াছে) ॥৬॥ কোন্টি কোনটি আমাদের অধিক শ্রেয় তাহা বুঝিতেছি না । কেন না, জয় পরাজয় যাহাই হউক, যাহাদিগকে বধ করিয়া আমরা বাঁচিতেও ইচ্ছা করি না, সেই ধৃতরাষ্ট্র পুত্ত্রগণ যুদ্ধার্থ পুরোভাগে অবস্থিত রহিয়াছে ॥৬॥
কার্পণ্যদোষোপহতস্বভাবঃ (চিত্তের দীনতা ও কুলক্ষয়জনিত দোষদ্বারা অভিভূত স্বভাব) [তথা] (এবং) ধর্ম্মসংমূঢ়চেতাঃ (ধর্ম্মাধর্ম্মনিশ্চয়বিষয়ে সন্দিগ্ধচিত্ত) [অহং] (আমি) ত্বাং (আপনাকে) পৃচ্ছামি (জিজ্ঞাসা করিতেছি) মে (আমার পক্ষে) যৎ (যাহা) নিশ্চিতং শ্রেয়ঃ (যথার্থ মঙ্গলজনক) তৎ (তাহা) [ত্বম্] ব্রূহি (আপনি বলুন) । অহং (আমি) তে (আপনার) শিষ্যঃ (শাসনার্হ) [অতঃ] (অতএব) ত্বাং প্রপন্নম্ (আপনার শরণাগত) মাং (আমাকে) শাধি (শিক্ষা দান করুন) ॥৭॥ এক্ষণে কার্পণ্যদোষে আমার স্বভাব অভিভূত হওয়ায় ধর্ম্মবিষয়ে বিমূঢ়চিত্ত আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি যে, আমার পক্ষে যাহা শ্রেয়স্কর তাহা আপনি নিশ্চয় করিয়া বলুন । আমি আপনার শিষ্য, অতএব আপনার শরণাপন্ন আমাকে শিক্ষা প্রদান করুন ॥৭॥
ভূমৌ (পৃথিবীতে) অসপত্নম্ (নিষ্কণ্টক) ঋদ্ধং (সমৃদ্ধ) রাজ্যং (রাজ্য) সুরাণামপি (এবং দেবতাগণেরও) আধিপত্যং চ অবাপ্য (আধিপত্য প্রাপ্ত হইয়া) যৎ (যে কর্ম্ম) ইন্দ্রিয়াণাম্ (ইন্দ্রিয়গণের) উচ্ছোষণম্ অতি শোষণ কর) মম (আমার) শোকম্ (শোক) অপনুদ্যাৎ (দূর করিবে) তৎ (তাহা) [অহং] (আমি) ন হি প্রপশ্যামি (দেখিতে পাইতেছি না) ॥৮॥ পৃথিবীর কণ্টকশূন্য সমৃদ্ধিশালী রাজ্য ও স্বর্গের আধিপত্য, আমি এমন কোন উপায় দেখিতেছি না যাহা আমার ইন্দ্রিয়শোষণকারী এই শোক অপনোদন করিতে পারে ॥৮॥
সঞ্জয়ঃ উবাচ (সঞ্জয় বলিলেন) পরন্তপঃ (শক্র মর্দ্দনকারী) গুড়াকেশঃ (জিতনিদ্র অর্জ্জুন) হৃষীকেশম্ (শ্রীকৃষ্ণকে) এবম্ উক্ত্বা (এরূপ বলিবার পর) [অহং] (আমি) ন যোৎস্যে (যুদ্ধ করিব না) ইতি (ইহা) গোবিন্দম্ (গোবিন্দকে) উক্ত্বা (বলিয়া) তূষ্ণীং (মৌনী) বভূব হ (হইয়া রহিলেন) ॥৯॥ সঞ্জয় কহিলেন—ইন্দ্রিয়াধিপতি শ্রীকৃষ্ণকে এই কথা বলিবার পর, জিতনিদ্র শত্রুতাপন অর্জ্জুন গোবিন্দকে ‘আমি যুদ্ধ করিব না’ এই বলিয়া মৌনী হইয়া রহিলেন ॥৯॥
[হে] ভারত ! (হে ধৃতরাষ্ট্র!) হৃষীকেশঃ (হৃষীকেশ) প্রহসন্ ইব (প্রসন্ন বদন হইয়া) উভয়োঃ সেনয়োঃ মধ্যে (দুই পক্ষের সৈন্যমধ্যে ) বিষীদন্তম্ (বিষাদগ্রস্ত) তম্ (অর্জ্জুনকে) ইদং বচঃ (এই কথা) উবাচ (বলিলেন) ॥১০॥ হে ভারত ! অনন্তর ভগবান্ হৃষীকেশ উভয় সেনার মধ্যস্থলে বিষাদগ্রস্ত পার্থকে হাস্যযুক্ত প্রসন্ন বদনে এইকথা বলিলেন ॥১০॥
শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ বলিলেন) ত্বম্ (তুমি) অশোচ্যান্ (যাহাদের জন্য শোক করা অনুচিত তাহাদের জন্য) অন্বশোচঃ (শোক করিতেছ) প্রজ্ঞাবাদান্ চ ভাষসে (পণ্ডিতের ন্যায় কথাও বলিতেছ) [কিন্তু] পণ্ডিতাঃ (পণ্ডিতগণ) গতাসূন্ (মৃত) অগতাসূন্ চ (ও জীবিত বন্ধুদিগের জন্য) ন অনুশোচন্তি (অনুশোচনা করেন না) ॥১১॥ শ্রীভগবান্ বলিলেন—হে অর্জ্জুন ! তুমি যে বিষয়ে শোক করা অনুচিত সেই বিষয়ে শোক করিতেছ আর পাণ্ডিত্যপূর্ণ বাক্য বলিতেছ । কিন্তু পণ্ডিতগণ কি জীবিত, কি মৃত কাহারও নিমিত্ত শোক করেন না ॥১১॥
অহং (আমি) জাতু (কদাচিৎ অর্থাৎ ইতঃপূর্ব্বে) ন আসম্ (ছিলাম না) ইতি তু ন এব (ইহা কিন্তু নহে) ত্বং ন (তুমি যে ছিলে না) [ইতি] (ইহাও) ন (নহে), ইমে জনাধিপাঃ (এই সকল নৃপতিগণ) ন (ছিলেন না) [ইতি] (ইহাও) ন (নহে) অতঃপরম্ চ (এবং অতঃপর) সর্ব্বে বয়ং (আমরা সকলে) ন ভবিষ্যামঃ (থাকিব না) [ইতি] (ইহাও) ন এব (নহে) ॥১২॥ পূর্ব্বে যে আমি কখনও ছিলাম না তাহা নহে । তুমিও যে ছিলে না এমনও নয় । এই রাজন্যবর্গও যে ছিল না তাহাও নহে । অর্থাৎ আমরা যেমন এখন আছি সেইরূপ পূর্ব্বেও ছিলাম এবং পরেও থাকিব ॥১২॥
যথা (যেমন) দেহিনঃ (দেহাভিমানী জীবের) অস্মিন্ দেহে (এই স্থূলদেহে) কৌমারং (কৌমার) যৌবনং (যৌবন) জরা (ও জরা) [ভবতি] (ঘটে) তথা (তেমন) দেহান্তর-প্রাপ্তিঃ (অন্য দেহ লাভও) [ভবতি] (ঘটে) ধীরঃ (ধীর ব্যাক্তি) তত্র (তাহাতে) ন মুহ্যতি (মোহপ্রাপ্ত হন না) ॥১৩॥ যেমন দেহধারী জীবের বর্ত্তমান দেহে ক্রমান্বয়ে কৌমার, যৌবন ও জরা প্রাপ্তি ঘটে সেইরূপ অপর দেহ প্রাপ্তিও ঘটিয়া থাকে । কিন্তু তাহাতে পণ্ডিতগণ কখনও মোহ প্রাপ্ত হন না ॥১৩॥
[হে] কৌন্তেয় ! (হে কুন্তীপুত্ত্র অর্জ্জুন !) মাত্রাস্পর্শাঃ তু (বিষয়ের সহিত মিলিত ইন্দ্রিয়বৃত্তি সকল ) শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ (শীত, উষ্ণ, সুখ ও দুঃখাদি প্রদানকারী) [তে] (তাহারা) আগমাপায়িনঃ (উৎপত্তি-বিনাশ-শীল) অনিত্যাঃ (ও অনিত্য) [অতএব] [হে] ভারত ! (হে অর্জ্জুন !) তান্ (তাহাদিগকে ) তিতিক্ষস্ব (সহ্য কর) ॥১৪॥ হে কৌন্তেয় ! ইন্দ্রিয়বৃত্তির সহিত বিষয়ের সংযোগই শীতগ্রীষ্ম, সুখদুঃখ, দান করিয়া থাকে । কিন্তু উহারা গমনাগমনশীল, অনিত্য । অতএব হে ভারত ! তাহা সহ্য কর ॥১৪॥
[হে] পুরুষর্ষভ ! (হে পুরুষশ্রেষ্ঠ !) এতে (এই সকল) [মাত্রাস্পর্শাঃ] (বিষয়ের সহিত মিলিত ইন্দ্রিয় বৃত্তি) সমদুঃখসুখং (দুঃখ-সুখে সমভাবাপন্ন) যং ধীরং পুরুষং (যে বিবেকী ব্যক্তিকে) ন ব্যথয়ন্তি (বিচলিত করিতে পারে না) সঃ হি (তিনিই) অমৃতত্বায় (মোক্ষলাভে) কল্পতে (যোগ্য হন) ॥১৫॥ হে পুরুষশ্রেষ্ঠ ! সুখে দুঃখে সমভাবাপন্ন যে ধীর ব্যক্তিকে এই সকল মাত্রাস্পর্শ (অর্থাৎ ইন্দ্রিয় বৃত্তির দ্বারা বিষয়ানুভব) ব্যথিত করিতে পারে না ; তিনি মোক্ষ লাভের যোগ্য হন ॥১৫॥
অসতঃ (অনিত্য বস্তুর) ভাবঃ (বিদ্যমানতা) ন বিদ্যতে (নাই) সতঃ (নিত্য বস্তুর) অভাবঃ (নাশ) ন বিদ্যতে (নাই) । তত্ত্বদর্শিভিঃ (তত্ত্বদর্শিগণ কর্ত্তৃক) অনয়োঃ উভয়োঃ অপি (এই দুইয়েরই) তু (কিন্তু) অন্তঃ (শেষ) দৃষ্টঃ (পর্য্যালোচিত হইয়াছে) ॥১৬॥ অসৎ অর্থাৎ পরিণামশীল দেহাদি নশ্বর বস্তুর নিত্য স্থায়িত্ব নাই ; এবং সৎ অর্থাৎ নিত্যবস্তু আত্মার কখনও পরিণতি বা বিনাশ নাই । অত্ত্বদর্শীগণের দ্বারা এইরূপে (পৃথক্ করিয়া) সৎ ও অসতের তত্ত্ব বিচারিত হইয়াছে ॥১৬॥
যেন (যাঁহার দ্বারা) ইদং সর্ব্বম্ (এই সকল শরীর) ততম্ (ব্যাপ্ত) তৎ (সেই জীবাত্মাকে) তু (কিন্তু) অবিনাশি (বিনাশ রহিত) বিদ্ধি (জানিবে) । কশ্চিৎ (কেহই) অব্যয়স্য অস্য (নাশরহিত এই জীবাত্মার) বিনাশং কর্ত্তুম্ (বিনাশ করিতে) ন অর্হতি (সমর্থ হন না) ॥১৭॥ যিনি এই সর্ব্বশরীর ব্যাপিয়া আছেন সেই আত্মাকে অবিনাশী বলিয়া জানিও । তিনি অব্যয় অর্থাৎ নিত্য, সেই আত্মাকে কেহ বিনাশ করিতে পারে না ॥১৭॥
নিত্যস্য (সদা একরূপ) অনাশিনঃ (নাশ রহিত) অপ্রমেয়স্য (অতি সূক্ষ্ম হেতু পরিমাণের অতীত) শরীরিণঃ (জীবাত্মার) ইমে দেহাঃ (এই সকল দেহ) অন্তবন্তঃ (নাশশীল) উক্তাঃ (বলিয়া কথিত হয়) । [হে] ভারত ! (হে অর্জ্জুন !) তস্মাৎ (সেই হেতু) যুধ্যস্ব (যুদ্ধ কর) ॥১৮॥ নিত্য, নাশরহিত, অপ্রমেয় যে জীবাত্মা তাহার এই দেহগুলিই নাশশীল । অতএব হে ভারত ! তুমি স্বধর্ম্ম পরিত্যাগ না করিয়া যুদ্ধ কর ॥১৮॥
যঃ (যে ব্যক্তি) এনং (এই জীবাত্মাকে) হন্তারং (বিনাশ কর্ত্তা) বেত্তি (মনে করে) যশ্চ এনং (এবং ব্যক্তি ইহাকে) হতং ( বিনষ্ট) মন্যতে (মনে করে), তৌ উভৌ (তাহারা উভয়েই) ন বিজানীতঃ (অজ্ঞ) [যষ্মাৎ] (যেহেতু) অয়ং (এই জীবাত্মা) ন হন্তি (কাহাকেও বধ করে না) ন হন্যতে (এবং কাহার দ্বারা নিহতও হয় না) ॥১৯॥ যে ব্যক্তি এই আত্মাকে হননকর্ত্তা মনে করে এবং যে ব্যক্তি ইহাকে হত মনে করে, তাহারা উভয়েই আত্মার স্বরূপ সম্বন্ধে কিছুই জানে না । যেহেতু আত্মা কাহাকেও হনন করে না বা কাহার দ্বারা হত হয় না ॥১৯॥
অয়ং (এই জীবাত্মা) কদাচিৎ (কখনও) ন জায়তে (জন্মে না) বা ন ম্রিয়তে (কিম্বা মরে না) ভূত্বা বা (অথবা উৎপন্ন হইয়া) ভূয়ঃ (পুনর্ব্বার) ন ভবিতা (উৎপন্ন হইবে না) । অয়ং অজঃ (এই জীবাত্মা জন্মবিহীন) নিত্যঃ (সর্ব্বদা সমভাবেস্থিত) শাশ্বতঃ (অপক্ষয়শূন্য) পুরাণঃ (ষড়্বিকার রহিত) [অপি চ] (অথচ) শরীরে হন্যমানে (দেহ বিনষ্ট হইলেও) অয়ং (জীবাত্মা) ন হন্যতে (বিনষ্ট হয় না) ॥২০॥ এই আত্মা কখনও জন্মে না বা কখনও মরে না । অথবা পুনঃ পুনঃ তাহার উৎপত্তি বৃদ্ধি হয় না । কারণ আত্মা জন্মরহিত, নিত্য, অপক্ষয়রহিত অর্থাৎ নিত্য নবীন অথচ পুরাতন ; জন্ম-মরণশীল শরীর বিনষ্ট হইলেও আত্মার বিনাশ নাই ॥২০॥
[হে] পার্থ ! (হে অর্জ্জুন !) যঃ (যে ব্যক্তি) এনং (এই জীবাত্মাকে) নিত্যং (বৃদ্ধিশূন্য) অজম্ (জন্মাদি রহিত) অব্যয়ম্ (ক্ষয়শূন্য) অবিনাশিনং (এবং ধ্বংসশূন্য) বেদ (জানেন), সঃ পুরুষঃ (সেই ব্যক্তি) কথং (কি প্রকারে) কং (কাহাকে) ঘাতয়তি (বধ করান ?) [বা] কং (অথবা কাহাকে) হন্তি (বধ করেন ?) ॥২১॥ হে পার্থ ! যে ব্যক্তি জীবাত্মাকে অবিনাশী, নিত্য, অজ ও ক্ষয়রহিত অব্যয় বলিয়া জানেন, সে পুরুষ কি রূপে কাহাকে হত্যা করায় বা হত্যা করে ॥২১॥
নরঃ (মনুষ্য) যথা (যেমন) জীর্ণানি বাসাংসি (ছিন্ন বস্ত্র সকল) বিহায় (পরিত্যাগ করিয়া) অপরাণি নবানি (অন্য নূতন বস্ত্র সমূহ) গৃহ্ণাতি (ধারণ করে) তথা (তদ্রূপ) দেহী (আত্মা) জীর্ণানি (জরাগ্রস্থ) শরীরাণি (শরীর সকল) বিহায় (পরিত্যাগ করিয়া) অন্যানি নবানি (অন্য নূতন শরীর সমূহ) সংযাতি (পরিগ্রহ করে) ॥২২॥ মানুষ, যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া অপর নববস্ত্র গ্রহণ করে, সেইরূপ দেহী (জীবাত্মা) ও জীর্ণ দেহ পরিত্যাগ করিয়া পুনরায় নূতন একটি শরীর ধারণ করিয়া থাকে ॥২২॥
শস্ত্রাণি (অস্ত্র সকল) এনম্ (এই আত্মাকে) ন ছিন্দন্তি (ছেদন করিতে পারে না) পাবকঃ (অগ্নি) এনং (এই আত্মাকে) ন দহতি (দগ্ধ করিতে পারে না) আপঃ (জল) এনং (এই আত্মাকে) ন ক্লেদয়ন্তি (আর্দ্র করিতে পারে না) চ (এবং) মারুতঃ (বায়ু) ন শোষয়তি (শুষ্ক করিতে পারে না) ॥২৩॥ এই আত্মাকে শস্ত্রাদি ছেদন করিতে পারে না ; অগ্নি দগ্ধ করিতে পারে না ; জল সিক্ত করিতে পারে না ; এবং বায়ু ইহাকে শুষ্ক করিতে পারে না ॥২৩॥
অয়ম্ (এই আত্মা) অচ্ছেদ্যঃ (ছেদনের অযোগ্য) অয়ম্ (এই আত্মা) অদাহ্যঃ (দাহনের অযোগ্য) অয়ম্ (এই আত্মা) অক্লেদ্যঃ (সিক্ত হইবার অযোগ্য) অশোষ্য এব চ (এবং অশোষনীয়) । অয়ম্ (এই আত্মা) নিত্যঃ (চিরকাল বর্ত্তমান) সর্ব্বগতঃ (স্বকর্ম্মবশে দেবাদি সর্ব্ব দেহে গমন যোগ্য) স্থাণুঃ (স্থিরস্বভাব) অচলঃ (অচল) সনাতনঃ (অনাদি) । অয়ম্ (এই আত্মা) অব্যক্তঃ (অতি সূক্ষ্মত্বহেতু চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়ের অগ্রাহ্য) অয়ম্ (এই আত্মা) অচিন্ত্যঃ (অতর্ক্য) অয়ম্ (এই আত্মা) অবিকার্য্যঃ (জন্মাদি ষড়্ভাব বিকারশূন্য) উচ্যতে (বলিয়া কথিত হন), তস্মাৎ (অতএব) এনম্ (এই আত্মাকে) এবং (এইরূপ) বিদিত্বা (জানিয়া) অনুশোচিতুম্ ন অর্হসি (তদ্ধেতু শোক প্রকাশ করা উচিৎ নহে) ॥২৪–২৫॥ এই জীবাত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য, এবং অশোষ্য । ইনি নিত্য, সর্ব্বত্রগামী, স্থির ও অবিচলিত এবং সনাতন অর্থাৎ সদাবিদ্যমান । এই আত্মা অব্যক্ত, অচিন্ত্য এবং জন্মাদি ষড়্বিকার* রহিত বলিয়া কথিত হন । অতএব এই জীবাত্মাকে এইপ্রকার অবগত হইয়া তুমি আর শোক করিতে পার না ॥২৪–২৫॥ *ষড়্বিকার যথা—জন্ম, অস্তিত্ব, বৃদ্ধি, পরিণতি, অপক্ষয় ও বিনাশ
[হে] মহাবাহো ! (হে বীরশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুন !) অথ চ (আর যদিও) এনং (এই আত্মাকে) নিত্যজাতং (সতত উৎপন্ন) বা (অথবা) নিত্যং মৃতম্ (সতত বিনাশশীল) মন্যসে (মনে কর) তথাপি (তাহা হইলেও) ত্বং (তুমি) এনং (ইহার জন্য) শোচিতুং ন অর্হসি (শোক করিও না) ॥২৬॥ হে মহাবাহো ! যদি জীবাত্মাকে নিত্যজাত ও নিত্যমৃত বলিয়া মনে কর, তথাপিও তুমি ইহার জন্য শোক করিতে পার না ॥২৬॥
হি (যেহেতু) জাতস্য (জাত ব্যক্তির) মৃত্যুঃ (মৃত্যু) ধ্রুবঃ (নিশ্চিত) মৃতস্য চ (মৃত ব্যক্তিরও) জন্ম (কর্ম্মফলভোগের জন্য জন্ম) ধ্রুবং (নিশ্চিত) তস্মাৎ (অতএব) অপরিহার্য্যে অর্থে (অবশ্যম্ভাবী বিষয়ে) ত্বং (তুমি) শোচিতুং (শোক করিতে) ন অর্হসি (পার না) ॥২৭॥ যেহেতু জাত ব্যক্তির মরণ সুনিশ্চিত এবং মৃত্যু হইলে কর্ম্মফল ভোগের জন্য পুনরায় জন্মও সুনিশ্চিত । সুতরাং এই অপরিহার্য্য বিষয়ে তোমার শোক করা অনুচিত ॥২৭॥
[হে] ভারত ! (হে অর্জ্জুন !) ভূতানি (প্রাণিগণের) অব্যক্তাদীনি (জন্মের পূর্ব্বাবস্থা অজ্ঞাত) ব্যক্তমধ্যানি (জন্মবধি মৃত্যু পর্য্যন্ত মধ্যকাল জ্ঞাত) অব্যক্তনিধনানি এব (এবং মৃত্যুর পরবর্ত্তী কালও অজ্ঞাত) তত্র (তদ্বিষয়ে) কা পরিদেবনা (শোকের কারণ কি আছে ?) ॥২৮॥ হে ভারত ! যখন ভূতসকল উৎপত্তির পূর্ব্বে অপ্রকাশিত ; ও জন্ম হইতে মরণ পর্য্যন্ত প্রকাশিত । এবং নিধন প্রাপ্ত হইলেই আবার অপ্রকাশিত বা অব্যক্ত হইয়া থাকে, তখন তার জন্য পরিবেদনা কি আছে ? (যদিও উক্ত মতটি সাধু সস্মত নহে তথাপি বিচার স্থলে স্বীকার করিলেও তোমার পক্ষে স্বধর্ম্ম রক্ষার জন্য যুদ্ধ করাই কর্ত্তব্য) ॥২৮॥
কশ্চিৎ (কেহ কেহ) এনম্ (এই আত্মাকে) আশ্চর্য্যবৎ (বিস্মিতভাবে) পশ্যতি (দর্শন করেন) তথা এব (তদ্রূপ) অন্যঃ চ (অপরেও) এনম্ (এই আত্মাকে) আশ্চর্য্যবৎ (বিস্ময়জনকভাবে) বদতি (বর্ণনা করেন) অন্য চ (ও অপর ব্যক্তি) এমন্ (ইহাকে) আশ্চর্য্যবৎ (বিস্মিত হইয়া) শৃণোতি (শ্রবণ করেন) কশ্চিৎ চ (কেহও) শ্রুত্বা অপি (শুনিয়াও) এনং (এই আত্মাকে) ন বেদ (জানিতে পারেন না) ॥২৯॥ কেহ কেহ জীবাত্মাকে আশ্চর্য্যবৎ দর্শন করেন কেহ কেহ আশ্চর্য্য ভাবে বর্ণনা করেন, এবং কেহ কেহ আশ্চর্য্যজ্ঞানে শ্রবণ করেন, আর কেহ কেহ শুনিয়াও তাঁহাকে বুঝিতে পারেন না ॥২৯॥
[হে] ভারত ! (হে অর্জ্জুন !) অয়ং দেহী (এই আত্মা) সর্ব্বস্য (সকল প্রাণীর) দেহে (শরীরে) নিত্যম্ (সর্ব্বদা) অবধ্যঃ (অবধ্যরূপে বিরাজিত) । তস্মাৎ (অতএব) ত্বং (তুমি) সর্ব্বাণি ভূতানি (সকল ভূতের নিমিত্ত) শোচিতুং ন অর্হসি (শোক করিতে পার না) ॥৩০॥ হে ভারত ! বস্তুতঃ সর্ব্বপ্রাণীর দেহস্থিত দেহধারী এই জীবাত্মা সর্ব্বদা অবধ্য । অতএব তুমি কোন প্রাণীর জন্যই শোক করিতে পার না ॥৩০॥
অপি (এমন কি ) স্বধর্ম্মং (ক্ষাত্ত্রিধর্ম্ম) অবেক্ষ্য চ (পর্য্যালোচনা করিয়াও) বিকম্পিতুম্ (ভয় করিতে) ন অর্হসি (পার না) । হি (যেহেতু) ক্ষত্ত্রিয়স্য (ক্ষত্ত্রিয়ের পক্ষে) ধর্ম্ম্যাৎ যুদ্ধাৎ (ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ অপেক্ষা) অন্যৎ শ্রেয়ঃ (অপর শ্রেয়স্কর কর্ম্ম) ন বিদ্যতে (নাই) ॥৩১॥ আর স্বধর্ম্মের* প্রতি লক্ষ্য করিলেও তোমার বিকম্পিত হইবার কিছুই নাই । কেননা ক্ষত্ত্রিয়ের ধর্ম্মযুদ্ধাপেক্ষা শ্রেয়স্কর ধর্ম্ম আর নাই ॥৩১॥ *মন্তব্য— স্বধর্ম্ম জীবের মুক্ত ও বদ্ধ দশা ভেদে দ্বিবিধ । মুক্তাবস্থায়, স্বধর্ম্ম-উপাধি রহিত ; বদ্ধাবস্থায়, স্বধর্ম্ম উপাধিযুক্ত । মুক্ত জীব সর্ব্বোতোভাবে ভগবৎ-সেবন-চেষ্টারূপ ধর্ম্মনিরত এবং তাহাই শুদ্ধ-স্বধর্ম্ম । আর বদ্ধজীব যখন কর্ম্মফলে চুরাশী লক্ষ যোনি ভ্রমণ করিতে করিতে পুণ্যবলে মনুষ্যদেহ প্রাপ্ত হয়, তখন মুক্তাবস্থার শুদ্ধ স্বধর্ম্ম সাধনানুকূলে দৈব বর্ণাশ্রম ধর্ম্মে থাকিয়া যে নিজ নিজ স্বভাব ও চেষ্টা প্রকাশ করে ; তাহাকে স্থূলভাবে স্বধর্ম্ম বলা হইয়া থাকে । অর্থাৎ ধূম্রাবৃত বহ্নিকে যে প্রকার বহ্নি বলা হয়, তদ্রূপ নিরুপাধিক আত্মার স্বধর্ম্ম—যে স্বল্প উপাধিযুক্ত অবস্থায় অনুভূত হইতে পারে তাহাকেই বর্ণাশ্রম বিচারে স্বধর্ম্ম সংজ্ঞায় সংজ্ঞিত করা হয় ॥৩১॥
[হে] পার্থ ! (হে অর্জ্জুন !) সুখীনঃ (সৌভাগ্যবান্) ক্ষত্ত্রিয়াঃ (ক্ষত্ত্রিয়গণ) যদৃচ্ছয়া (অপ্রার্থিতভাবে) উপপন্নম্ (উপস্থিত) অপাবৃতম্ স্বর্গদ্বারম্ চ (এবং উদ্ ঘাটিত স্বর্গদ্বাররূপ) ঈদৃশম্ (এরূপ) যুদ্ধম্ (যুদ্ধ) লভন্তে (লাভ করে) ॥৩২॥ হে পার্থ ! যদৃচ্ছাক্রমে উপস্থিত উন্মুক্ত স্বর্গদ্বার স্বরূপ এইরূপ যুদ্ধ, সৌভাগ্যবান্ ক্ষত্ত্রিয়গণেরই লভ্য হইয়া থাকে ॥৩২॥
অথ (পক্ষান্তরে) চেৎ (যদি) ত্বম্ (তুমি) ইমং ধর্ম্ম্যং সংগ্রামং (এই ধর্ম্ম সঙ্গত যুদ্ধ) ন করিষ্যসি (না কর) ততঃ (তাহা হইলে) স্বধর্ম্মং কীর্ত্তিং চ (ক্ষত্ত্রিয় ধর্ম্ম ও কীর্ত্তি) হিত্বা (ত্যাগ করিয়া) পাপম্ (পাপ) অবাপ্স্যসি (লাভ করিবে) ॥৩৩॥ প্রকৃত পক্ষে তুমি যদি এই ধর্ম্মযুদ্ধ না কর তবে স্বধর্ম্ম ও কীর্ত্তি ভ্রষ্ট হইয়া পাপগ্রস্ত হইবে ॥৩৩॥
ভূতানি চ (সকল লোকও) তে (তোমার) অব্যয়াম্ (চিরস্থায়িনী) অকীর্ত্তিম্ অপি (অকীর্ত্তিও) কথয়িষ্যন্তি (বলিবে) । সম্ভাবিতস্য চ (সম্মানিত ব্যক্তির কিন্তু ) অকীর্ত্তিঃ (অখ্যাতি) মরণাৎ (মৃত্যু অপেক্ষা) অতিরিচ্যতে (অধিক হয়) ॥৩৪॥ আর লোকে চিরদিন তোমার অকীর্ত্তি ঘোষণা করিবে । সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির অপযশ মৃত্যু অপেক্ষাও অধিক ॥৩৪॥
মহারথাঃ (দুর্য্যোধনাদি মহারথগণ) ত্বাং (তোমাকে) ভয়াৎ (ভয়হেতু) রণাৎ (যুদ্ধ হইতে) উপরতং (বিরত) মংস্যন্তে (মনে করিবে) । চ (এবং) ত্বং (তুমি) যেষাং (যাহাদিগের) বহুমতঃ ভূত্বা (বহু সম্মানের পাত্র হইয়াছ) [তেষাং] (তাহাদিগের নিকট) লাঘবম্ যাস্যসি (অশ্রদ্ধার পাত্র হইবে) ॥৩৫॥ যাহারা তোমাকে বহুমানন করিয়া থাকেন সেই মহারথগণ ‘তুমি ভয়ে যুদ্ধ করিতেছ না’ এই মনে করিয়া তোমাকে অত্যন্ত লঘু জ্ঞান করিবেন ॥৩৫॥
তব অহিতাঃ (তোমার শত্রুগণ) তব সামর্থ্যং (তোমার সামর্থ্যের) নিন্দন্তঃ (নিন্দা করতঃ) বহূন্ অবাচ্য বাদান্ চ (বহুবিধ অকথ্য বাক্য সমূহও) বদিষ্যন্তি (কহিবে) । নু (ওহে অর্জ্জুন !) ততঃ (তাহা অপেক্ষা) দুঃখতরং (অধিক দুঃখকর) কিম্ (কি হইতে পারে ?) ॥৩৬॥ তোমার শত্রুপক্ষ তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করিয়া বহুপ্রকার কটূক্তি করিবে, তাহা হইতে অধিক দুঃখতর আর কি আছে ? ॥৩৬॥
হতঃ বা (যদি যুদ্ধে হত হও) স্বর্গং প্রাপ্স্যসি (স্বর্গ লাভ করিবে) জিত্বা বা (কিম্বা জয়লাভ করিয়া) মহীং (পৃথিবী) ভোক্ষ্যসে (ভোগ করিবে) । [হে] কৌন্তেয় ! (হে অর্জ্জুন !) তস্মাৎ (অতএব) যুদ্ধায় (যুদ্ধার্থে) কৃতনিশ্চয়ঃ [সন্] (কৃতনিশ্চয় হইয়া) উত্তিষ্ঠ (উত্থিত হও) ॥৩৭॥ হে কৌন্তেয় ! যদি তুমি হত হও, স্বর্গ লাভ করিবে, আর বিজয়ী হও, পৃথিবী ভোগ করিবে । অতএব কৃতনিশ্চয় হইয়া যুদ্ধার্থে উত্থিত হও ॥৩৭॥
সুখদুঃখে (সুখ ও দুঃখ) লাভালাভৌ (লাভ ও অলাভ) জয়াজয়ৌ [চ] (এবং জয় ও পরাজয়) সমে (সমান) কৃত্বা (করিয়া অর্থাৎ তুল্য দৃষ্টিতে দেখিয়া) ততঃ (তৎপরে) যুদ্ধায় (যুদ্ধার্থ) যুজ্যস্ব (প্রবৃত্ত হও) এবং (এই প্রকারে) পাপং (পাপ) ন অবাপ্স্যসি (প্রাপ্ত হইবে না) ॥৩৮॥ সুখ ও দুঃখ, লাভ ও অলাভ, জয় ও পরাজয়কে সমান জ্ঞান করিয়া যুদ্ধ কর, তাহা হইলে পাপভাগী হইবে না ॥৩৮॥
[হে] পার্থ ! (হে কুন্তীপুত্ত্র !) সাংখ্যে (আত্মতত্ত্ব বিষয়ে) এষা বুদ্ধিঃ (এই জ্ঞান) তে অভিহিতা (তোমাকে কহিলাম) । যোগে তু (ভক্তি যোগেও) ইমাং (এই বুদ্ধি) শৃণু (শ্রবণ কর) । যয়া বুদ্ধ্যা যুক্তঃ [সন্] (যে ভক্তি-যোগবিষয়িণী বুদ্ধি দ্বারা যুক্ত হইলে) কর্ম্মবন্ধং (কর্ম্ম বন্ধনরূপ সংসারকে) প্রহাস্যসি (প্রকৃষ্টরূপে ত্যাগ করিতে পারিবে) ॥৩৯॥ ইহা বস্তুতত্ত্ব জ্ঞান-সম্বন্ধিনী বুদ্ধির কথা তোমাকে বলিলাম । এখন ভক্তিযোগ সম্বন্ধিনী বুদ্ধির কথা শ্রবণ কর । হে পার্থ ! যে বুদ্ধিযুক্ত হইলে তুমি কর্ম্মবন্ধন সম্পূর্ণ ছেদন করিতে পারিবে ॥৩৯॥ * *মন্তব্য—“পরে প্রদর্শিত হইবে যে, বুদ্ধি-যোগ একটি মাত্র ; যখন সেই বুদ্ধি-যোগ কর্ম্মের অবধিকে সীমা করিয়া লক্ষিত হয় তখন তাহাকে ‘কর্ম্ম-যোগ’ বলে ; যখন কর্ম্মসীমাকে অতিক্রম করিয়া জ্ঞান সীমার অবধি পর্য্যন্ত ব্যাপ্তি লাভ করে, তখন তাহাকে ‘জ্ঞান-যোগ’ বা ‘সাংখ্য-যোগ’ বলে ; যখন তদুভয় সীমা অতিক্রম করতঃ ভক্তিকে স্পর্শ করে, তখন তাহাকে ‘ভক্তি-যোগ’ বা ‘বিশুদ্ধ ও সম্পূর্ণ বুদ্ধি-যোগ’ বলে ।” —শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর ॥৩৯॥
ইহ (এই ভক্তি-যোগে) অভিক্রমনাশঃ (আরম্ভের নাশ) ন অস্তি (নাই) প্রত্যবায়ঃ [চ] (প্রত্যবায়ও) ন বিদ্যতে (নাই) অস্য ধর্ম্মস্য (এই ভক্তি-যোগের) স্বল্পমপি (কিঞ্চিৎমাত্র অনুষ্ঠানও) মহতঃ ভয়াৎ (মহাভয়জনক সংসার হইতে) ত্রায়তে (পরিত্রাণ করে) ॥৪০॥ এই ভক্তিযোগের আরম্ভমাত্র করিলেও বিফল হয় না । ইহাতে প্রত্যবায়ও নাই । এই ভক্তিযোগের কিঞ্চিৎমাত্র অনুষ্ঠানও সংসারাদি মহাভয় হইতে পরিত্রাণ করে ॥৪০॥
[হে] কুরুনন্দন ! (হে কুরুবংশধর অর্জ্জুন !) ইহ (এই ভক্তি-যোগ বিষয়ে) ব্যবসায়াত্মিকা (নিশ্চয়াত্মিকা) বুদ্ধিঃ (বুদ্ধি) একা [এব] (একটী মাত্র), [কিন্তু] অব্যবসায়িনাং (কামী ব্যক্তিদের) বুদ্ধয়ঃ (বুদ্ধি সকল) অনন্তাঃ (অসংখ্য) বহুশাখাঃ চ (এবং বহু শাখাযুক্ত) হি (সুনিশ্চিত) ॥৪১॥ হে কুরুনন্দন ! অনন্য ভক্তিযোগ সম্বন্ধিনী বুদ্ধি নিশ্চয়াত্মিকা । আমিই তাহার একমাত্র লক্ষ্য, অতএব তাহা একনিষ্ঠ । কিন্তু মদেকনিষ্ঠতা-রহিত অব্যবসায়িগণের বুদ্ধি কাম্যকর্ম্ম বিষয়িণী হওয়ায় তাহা অনেক বিষয়-নিষ্ঠত্বহেতু বহু শাখাময়ী ও অনন্ত-কামনা-লক্ষিণী ॥৪১॥
[হে] পার্থ ! (হে অর্জ্জুন !) অবিপশ্চিতঃ (মুর্খ সকল) বেদ-বাদরতাঃ (বেদের অর্থবাদে আসক্ত) অন্যৎ (পশু অন্ন পুত্ত্র স্বর্গাদি ব্যতীত অন্য ঈশ্বর তত্ত্ব) ন অস্তি (নাই) ইতি বাদিনঃ (এই রূপ উক্তিকারী) কামাত্মানঃ (কামাকুলিত চিত্ত) স্বর্গপরাঃ (স্বর্গকেই প্রধান পুরুষার্থ জ্ঞানকারী) জন্ম-কর্ম্মফল-প্রদাম্ (জন্ম-কর্ম্মফল প্রদানকারী) ভোগৈশ্বর্য্যগতিং প্রতি (ভোগ ও ঐশ্বর্য্য সাধক) ক্রিয়াবিশেষবহুলাং (নানাবিধ ক্রিয়া বিশেষ বৃদ্ধিকারী) যাম্ ইমাং (যে সকল) পুষ্পিতাং (আপাতকর্ণ সুখকর) বাচং (বাক্য) প্রবদন্তি (এই বেদ বাক্যগুলিই সর্ব্বপ্রকারে শ্রেষ্ঠ এরূপ বলে) তয়া (সেই পুষ্পিত বাক্যের দ্বারা) অপহৃতচেতসাং (বিমোহিত চিত্ত) ভোগৈশ্বর্য্যপ্রসক্তানাং (ভোগ ও ঐশ্বর্য্যে আসক্ত ব্যক্তিদিগের) ব্যবসায়াত্মিকা (নিশ্চয়াত্মিকা) বুদ্ধিঃ (বুদ্ধি) সমাধৌ (পরমেশ্বরে) ন বিধীয়তে (একনিষ্ঠতা লাভ করে না) ॥৪২–৪৪॥ হে পার্থ ! সেই অব্যবসায়ী অনভিজ্ঞগণ সর্ব্বদা বেদের মুখ্য তাৎপর্য্য যে পরমার্থ, তাহা না জানিয়া কেবল গৌণ অর্থবাদে রত থাকিয়া ‘ইহা ছাড়া জ্ঞাতব্য আর নাই’ এইরূপ বলিয়া থাকে । যাহার কাম্যকর্ম্মের ফলাকাঙ্ক্ষী, স্বর্গপ্রার্থী, যে মূঢ়গণ ভোগ ও ঐশ্বর্য্য সাধক জন্ম-কর্ম্মফল প্রদানকারী কর্ম্মকাণ্ডীয় যজ্ঞাদি ক্রিয়া-বাহুল্যবিশিষ্ট বেদের আপাত রমণীয় (পরিণাম বিষময়) বাক্যে অনুরক্ত, তাদৃশ ভোগ ও ঐশ্বর্য্য প্রসক্ত পুষ্পিত বাক্যে হৃতচিত্ত সেই অবিবেকিগণের বুদ্ধি সমাধিতে অর্থাৎ ভগবানে একনিষ্ঠতা লাভ করে না ॥৪২–৪৪॥
[হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন !) বেদাঃ (বেদ সকল) ত্রৈগুণ্যবিষয়াঃ (ত্রিগুণাত্মক) [ত্বং] (তুমি) নির্দ্বন্দ্বঃ (গুণময় মানাপমানাদি রহিত) নিত্যসত্ত্বস্থঃ (নিত্যপ্রাণিদিগের অর্থাৎ মদ্ভক্তের সহিত অবস্থিত) নির্যোগক্ষেমঃ (অলব্ধ বস্তুর লাভ ‘যোগ’ তাহার রক্ষা ‘ক্ষেম’ তদ্ রহিত) আত্মবান্ [চ] (এবং মদ্দত্ত বুদ্ধিযোগে যুক্ত) [সন্) (হইয়া) নিস্ত্রৈগুণ্যঃ (জ্ঞান কর্ম্ম হইতে বিরত হইয়া বেদোক্ত ভক্তি বিধিমাত্রের অনুষ্ঠাতা) ভব (হও) ॥৪৫॥ হে অর্জ্জুন ! কর্ম্মজ্ঞানাদির প্রতিপাদক বেদ ত্রিগুণাত্মক । কর্ম্মজ্ঞানাবৃত বুদ্ধি অজ্ঞগণ তাহাতেই নিষ্ঠাযুক্ত হওয়ায় বেদের যে মুখ্য উদ্দিষ্ট নির্গুণ তত্ত্ব তাহা জানে না । কিন্তু তুমি দ্বন্দ্বশূন্য এবং নিত্যসত্ত্বস্থ হইয়া যোগক্ষেমানুসন্ধান পরিত্যাগ পূর্ব্বক, বুদ্ধিযোগ সহকারে সেই নির্গুণ তত্ত্বরূপ উদ্দিষ্টতত্ত্ব লাভ করিয়া নিস্ত্রৈগুণ্য হও, অর্থাৎ জ্ঞান কর্ম্ম হইতে বিরত হইয়া বেদোক্ত ভক্তিবিধি মাত্র অনুষ্ঠান কর ॥৪৫॥
উদপানে (ক্ষুদ্র জলাশয়ে বা কূপে) যাবান্ অর্থঃ (যে যে প্রয়োজন) সর্ব্বতঃ (সকল কূপ হইতে) [সিধ্যতি] (সিদ্ধি হয়), সংপ্লুতোদকে (মহাজলাশয়ে বা সরোবরে) তাবান্ [এব অর্থঃ] (সেই সমস্ত কার্য্যই) [ততোঽপি বৈশিষ্ট্যেন] (তাহা হইতে বিশেষ ভাবে) [সিধ্যতি] (সিদ্ধ হইয়া থাকে) [এবং] সর্ব্বেষু বেদেষু (এই প্রকার সকল বেদোক্ত তত্তৎ দেবতারাধনে) [যাবান্ অর্থঃ সিধ্যতি] (যে সকল প্রয়োজন সিদ্ধ হয়) ব্রাহ্মণস্য বিজানতঃ (বেদ তাৎপর্য্য ভক্তিকেই বিশেষ ভাবে যিনি অবগত হইয়াছেন তাদৃশ ব্রাহ্মণের) [তাবান্ অর্থঃ ভগবদারাধনে এব] (সেই সকল প্রয়োজন একমাত্র ভগবদারাধনেই) [সিধ্যতি] (সিদ্ধ হয়) ॥৪৬॥ যেমন উদপান অর্থাৎ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলাশয়ে বা কূপে যে সকল প্রয়োজন সিদ্ধি হয়, একমাত্র সুবৃহৎ জলাশয়ে সেই সমস্ত প্রয়োজনই কুপোদক হইতেও বিশেষভাবে সিদ্ধি হইয়া থাকে ; তেমনি বেদশাস্ত্রের একদেশে লিখিত এক একটি দেবতার উপাসনার দ্বারা যে ফল লাভ হয়, বেদের একমাত্র উদ্দিষ্ট আমার ভজনা দ্বারা সেই সমস্ত ফলই তাহা হইতেও বিশেষভাবে লাভ হইয়া থাকে । এইরূপ বেদতাৎপর্য্যবিৎ ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তির সমস্ত প্রয়োজন একমাত্র ভগবদারাধনেই সিদ্ধি হইয়া থাকে ॥৪৬॥
তে (তোমার) কর্ম্মণি এব (কর্ম্মেই) অধিকারঃ (অধিকার) কদাচন (কখনও যেন) ফলেষু (ফলে) [আকাঙ্ক্ষা] মা [ভূঃ] (হয় না) । [ত্বং] (তুমি) কর্ম্মফলহেতুঃ (কর্ম্মফলের কামনাযুক্ত) মা ভূঃ (হইও না) অকর্ম্মণি (স্বধর্ম্মের অননুষ্ঠানে) তে (তোমার) সঙ্গঃ (আসক্তি) মা অস্তু (না হউক) ॥৪৭॥ এক্ষণে নিষ্কাম কর্ম্মযোগ বলিতেছেনঃ—স্বধর্ম্ম বিহিত কর্ম্মেই তোমার অধিকার, কিন্তু কোন কর্ম্মফলে তোমার অধিকার নাই । তুমি কর্ম্মফলাকাঙ্ক্ষী হইয়া কর্ম্ম করিও না । তাই বলিয়া যেন স্বধর্ম্ম অকরণেও তোমার আসক্তি না হয় ॥৪৭॥
[হে] ধনঞ্জয় ! (হে অর্জ্জুন !) যোগস্থং (চিত্ত সমাধান পূর্ব্বক) সঙ্গং (কর্ত্তৃত্বাভিনিবেশ) ত্যক্ত্বা (ত্যাগ করিয়া) সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ (জয়-পরাজয়ে) সমঃ ভূত্বা (তুল্য বুদ্ধি হইয়া) কর্ম্মাণি (কর্ম্ম সকল) কুরু (কর) । [যতঃ] (যেহেতু) সমত্বং (জয় পরাজয়ে সম বুদ্ধিই) যোগঃ (যোগ বলিয়া) উচ্যতে (কথিত হয়) ॥৪৮॥ হে ধনঞ্জয় ! ফলকামনা পরিত্যাগপূর্ব্বক ভক্তিযোগস্থ হইয়া সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে তুল্য ভাবাপন্ন হইয়া স্বধর্ম্মবিহিত কর্ম্মাচরণ কর । কর্ম্মের ফলসিদ্ধি ও ফলের অসিদ্ধি বিষয়ে যে সমবুদ্ধি তাহাকেই যোগ বলে ॥৪৮॥
[হে] ধনঞ্জয় ! (হে ধনঞ্জয় !) হি (যেহেতু) বুদ্ধিযোগাৎ (সমত্বরূপ নিষ্কাম কর্ম্মযোগ হইতে) কর্ম্ম (কাম্য কর্ম্ম) দূরেণ অবরম্ (অতি নিকৃষ্ট) । [অতঃ] (অতএব) বুদ্ধৌ (নিষ্কাম-কর্ম্মযোগের) শরণম্ (আশ্রয়) অন্বিচ্ছ (প্রার্থনা কর) । ফলহেতবঃ (ফলকামী) কৃপণাঃ (দীন) ॥৪৯॥ হে ধনঞ্জয় ! কাম্যকর্ম্ম, বুদ্ধিযোগ হইতে অত্যন্ত নিকৃষ্ট । যাহারা ফলকামী তাহারা কৃপণ অর্থাৎ দীন (অভাব ময়) । অতএব তুমি নিষ্কাম কর্ম্মলক্ষণা বুদ্ধির আশ্রিত হও ॥৪৯॥
বুদ্ধিযুক্তঃ (নিষ্কাম কর্ম্মী) সুকৃত-দুষ্কৃতে (পুণ্য বা পাপ) উভে (উভয় কর্ম্মকে) ইহ (এই জন্মেই) জহাতি (পরিত্যাগ করে) । তস্মাৎ (অতএব) যোগায় (নিষ্কাম কর্ম্মযোগের জন্য) যুজ্যস্ব (যত্ন কর) । কর্ম্মসু (সকাম-নিষ্কাম কর্ম্মের মধ্যে) যোগঃ (নিষ্কামভাবে কর্ম্ম করাই) কৌশলম্ (নৈপুণ্য) ॥৫০॥ নিষ্কাম বুদ্ধিযুক্ত ব্যক্তি সংসার অবস্থাতেই পাপ-পূণ্য উভয়ই পরিত্যাগ করেন । সুতরাং তুমি নিষ্কাম কর্ম্মযোগে যুক্ত হও । যেহেতু বুদ্ধিযোগই কর্ম্মের কৌশল ॥৫০॥
হি (যেহেতু) বুদ্ধিযুক্তাঃ (সমত্ব বুদ্ধিবিশিষ্ট) মনীষিণঃ (মনীষিগণ) কর্ম্মজং (কর্ম্মজাত) ফলং (ফল) ত্যক্ত্বা (ত্যাগ করিয়া) জন্মবন্ধ-বিনির্ম্মুক্তাঃ [সন্তঃ] (জন্ম বন্ধন হইতে বিনির্ম্মুক্ত হইয়া) অনাময়ম্ (সর্ব্বোপদ্রবরহিত) পদং (পরমপদ) গচ্ছন্তি (লাভ করেন) ॥৫১॥ বুদ্ধিযুক্ত মনীষিগণ কর্ম্মজাত ফল ত্যাগ দ্বারা জন্মবন্ধ-বিনির্ম্মুক্ত হইয়া ভক্তদিগের লভ্য অবস্থা অর্থাৎ পরাশান্তি লাভ করেন ॥৫১॥
যদা (যখন) তে (তোমার ) বুদ্ধিঃ (অন্তঃকরণ) মোহকলিলং (দেহাত্মবোধরূপ দুর্গম মোহকে) ব্যতিতরিষ্যতি (অতিক্রম করিবে) তদা (তখন) [ত্বং] (তুমি) শ্রোতব্যস্য (পরে শ্রবণযোগ্য) শ্রুতস্য চ (এবং পূর্ব্বে শ্রুত বিষয়ে) নির্ব্বেদং (বৈরাগ্য) গন্তাসি (প্রাপ্ত হইবে) ॥৫২॥ এইরূপে যখন তোমার বুদ্ধি মোহরূপ গহনকে সম্পূর্ণ অতিক্রম করিবে, তখন তুমি শ্রোতব্য ও শ্রুত বিষয়ের তুচ্ছ ফলে নির্ব্বেদ লাভ করিবে ॥৫২॥
যদা (যে সময়ে) তে (তোমার) অচলা (অবিচলিত) বুদ্ধিঃ (বুদ্ধি) শ্রুতিবিপ্রতিপন্না [সতী] (বেদের নানারূপ অর্থবাদ দ্বারা বিরক্ত হইয়া) সমাধৌ (পরমেশ্বরে) নিশ্চলা (অচঞ্চলা) স্থাস্যতি (থাকিবে), তদা (তখনই) যোগম্ (তত্ত্বজ্ঞান বা ভক্তিযোগ) অবাপ্স্যসি (লাভ করিবে) ॥৫৩॥ অতঃপর যখন তোমার বুদ্ধি শ্রুতির বিভিন্নার্থে আর বিচলিত হইবে না, তখন সহজ সমাধিতে উহা অচলা হইয়া বিশুদ্ধ-ভক্তিযোগ লাভ করিবে ॥৫৩॥
অর্জ্জুনঃ উবাচ (অর্জ্জুন বলিলেন) [হে] কেশব ! (হে কেশব !) স্থিতপ্রজ্ঞস্য (অচলা বুদ্ধি বিশিষ্ট) সমাধিস্থস্য (সমাধিস্থ ব্যক্তির) কা ভাষা ( কি লক্ষণ ?) স্থিতধীঃ (স্থির বুদ্ধি ব্যক্তি) কিং প্রভাষেত (সুখ দুঃখাদি সমুপস্থিত হইলে স্পষ্ট বা স্বগত কি বলেন) কিমাসীত ব্রজেত কিম্ (ইন্দ্রিয় সকলের বাহ্যবিষয়ে গমন-ভাব কিরূপ ?) ॥৫৪॥ অর্জ্জুন কহিলেন—হে কেশব ! স্থিতপ্রজ্ঞ, সমাধিস্থ বা স্থিতধীগণের লক্ষণ কি ? তাঁহারা কিরূপ বলেন ; বাহ্য বিষয় ভোগ-সম্বন্ধে কি প্রকারই বা আচরণ করেন, তাহাদের গমন-ভাব অর্থাৎ চেষ্টাই বা কিরূপ তাহা জানিতে ইচ্ছা করি ? ॥৫৪॥
শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন) [হে] পার্থ ! (হে কুন্তীনন্দন !) [জীবঃ] (জীব) যদা (যখন) সর্ব্বান্ (সমস্ত) মনোগতান্ (মনোগত) কামান্ (কাম সকল) প্রজহাতি (পরিত্যাগ করেন), আত্মনি (ও প্রত্যাহৃত মনে) আত্মনা এব (প্রাপ্ত যে আনন্দ তদ্দ্বারাই) তুষ্টঃ (তুষ্ট অর্থাৎ আত্মারাম) [ভবতি] (হন), তদা (তখন) [সঃ] (সেই জীব) স্থিতপ্রজ্ঞঃ (‘স্থিতপ্রজ্ঞ’ বলিয়া) উচ্যতে (কথিত হন) ॥৫৫॥ শ্রীভগবান্ বলিলেন—হে পার্থ ! যখন জীব মনোগত কাম সমূহ পরিত্যাগ করিয়া প্রত্যাহৃত মনে আনন্দস্বরূপ আত্ম-দর্শনে পরিতৃপ্ত হন, তখন তাঁহাকে স্থিতপ্রজ্ঞ বলা হইয়া থাকে ॥৫৫॥
দুঃখেষু (শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ক্লেশ উপস্থিত হইলেও) অনুদ্বিগ্নমনাঃ (যাঁহার মন উদ্বিগ্ন হয় না), সুখেষু (তত্তৎ বিষয়ে সুখ উপস্থিত হইলেও) বিগতস্পৃহঃ (যাঁহার তাহাতে স্পৃহা হয় না) [চ] (এবং) বীতরাগভয়ক্রোধঃ (যিনি অনুরাগ, ভয় ও ক্রোধ হইতে বিমুক্ত) মুনিঃ (আত্ম-মননশীল) [সঃ এব] (তিনিই) স্থিতধীঃ (স্থিতপ্রজ্ঞ বলিয়া) উচ্যতে (কথিত হন) ॥৫৬॥ যিনি আধ্যত্মিকাদি সমুদ্ভূত দুঃখাদিতে অনুদ্বিগ্নচিত্ত, সুখাদিতেও স্পৃহাহীন, যিনি অনুরাগ, ভয় ও ক্রোধ হইতে বিমুক্ত তিনিই স্থিতধী বা স্থিতপ্রজ্ঞ ॥৫৬॥
যঃ (যিনি) সর্ব্বত্র (সমস্ত জড় বিষয়ে) অনভিস্নেহঃ (ঔপাধিক স্নেহশূন্য) তত্তৎ (সেই সেই) শুভাশুভম্ (সন্মান-ভাজনাদি বা অনাদর-প্রহরাদি) প্রাপ্য (লাভ করিয়া) ন অভিনন্দতি (প্রশংসা করেন না) ন দ্বেষ্টি (অভিসম্পাতও করেন না) তস্য (তাঁহারই) প্রজ্ঞা (বুদ্ধি) প্রতিষ্ঠিতা (সমাধিতে অবস্থিত অর্থাৎ তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ) ॥৫৭॥ যিনি সর্ব্বত্র মায়িক স্নেহশূন্য ; জড়ীয় শুভাশুভ প্রাপ্তিতে অনুরাগ বা বিদ্বেষহীন, তাঁহারই প্রজ্ঞা সমাধিতে প্রতিষ্ঠিত ॥৫৭॥
যদা চ (যখন) অয়ং (এই যোগী) কূর্ম্মঃ অঙ্গানি ইব (কচ্ছপের অঙ্গ সমূহ চালনের ন্যায়) ইন্দ্রিয়ার্থেভ্যঃ (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় শব্দাদি হইতে) ইন্দ্রিয়াণি (চক্ষু, কর্ণাদিকে) সর্ব্বশঃ সংহরতে (সম্যক্রূপে প্রত্যাহার করেন) [তদা] (তখন) তস্য (তাঁহারই) প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা (অর্থাৎ তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ) ॥৫৮॥ কচ্ছপ যেমন স্বীয় অঙ্গ সমূহ স্বেচ্ছানুসারে দেহাভ্যন্তরে গ্রহণ করে, সেইরূপ ইনি যখন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় হইতে ইন্দ্রিয়গণকে ইচ্ছামত নিয়ন্ত্রণ করেন তখন তাঁহার প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত ॥৫৮॥
নিরাহারস্য (ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিষয়-অগ্রহণকারী) দেহিনঃ (দেহাভিমানী অজ্ঞ ব্যক্তির) বিষয়াঃ (বিষয় সকল) বিনিবর্ত্তন্তে (উপবাসাদি হেতু নিবৃত্ত হয় বটে) [কিন্তু] রসবর্জ্জং (তাহা কেবল বাহ্য ত্যাগ মাত্র, বিষয়-তৃষ্ণা নিবৃত্ত হয় না) । রসঃ অপি (বিষয় পিপাসাও) অস্য (এই স্থিতপ্রজ্ঞের) [তু] (কিন্তু) পরং (পরমাত্মাকে) দৃষ্ট্বা (দেখিয়া) নিবর্ত্ততে (নিবৃত্ত হয়) ॥ ৫৯॥ বাহ্যতঃ বিষয়বর্জ্জনকারী দেহিগণের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়গুলি দূরে থাকিলেও অন্তরের বিষয় পিপাসার নিবৃত্তি হয় না । কিন্তু স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি পরমতত্ত্বের সৌন্দর্য্য দর্শন পূর্ব্বক তাহাতে আকৃষ্ট হওয়ায়, তাঁহার আভ্যন্তরীণ বিষয়াসক্তি স্বতঃই নিবৃত্ত হইয়া থাকে ॥৫৯॥
[হে] কৌন্তেয় ! (হে অর্জ্জুন !) হি (যেহেতু) যততঃ (মোক্ষার্থে যত্নবান্) বিপশ্চিতঃ পুরুষস্য অপি (বিবেকী ব্যক্তিরও) প্রমাথীনি (মনের ক্ষোভকারী) ইন্দ্রিয়াণি (ইন্দ্রিয় সকল) প্রসভং (বল পূর্ব্বক) মনঃ (মনকে) হরন্তি (হরণ করে) ॥৬০॥ হে কৌন্তেয় ! মনঃক্ষোভকর ইন্দ্রিয় সকল মোক্ষার্থ যত্নশীল বিবেকী পুরুষেরও মন বলপূর্ব্বক হরণ করে (কিন্তু আমাতে আকৃষ্ট চিত্তের সে সম্ভাবনা নাই) ॥৬০॥
তানি সর্ব্বাণি (সেই সকল ইন্দ্রিয়কে) সংযম্য (সংযত করিয়া) মৎপরঃ (ভগবন্নিষ্ঠ) [সন্] (হইয়া) যুক্তঃ আসীত (একাগ্রচিত্তে থাকা উচিত) । হি (যেহেতু) যস্য (যাঁহার) ইন্দ্রিয়াণি (ইন্দ্রিয় সকল) বশে (বশীভূত) তস্য (তাঁহার) প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা (অর্থাৎ তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ) ॥৬১॥ ভক্তিযোগী আমার প্রতি উত্তমা ভক্তি আচরণ করতঃ ইন্দ্রিয় সকলকে যথাস্থানে নিয়ন্ত্রিত করেন । ইন্দ্রিয়গণ যাহার বশীভূত তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ ॥৬১॥
বিষয়ান্ (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় সকল) ধ্যায়তঃ (চিন্তা করিতে করিতে) পুংসঃ (পুরুষের) তেষু (ঐ সকল বিষয়ে) সঙ্গঃ (আসক্তি) উপজায়তে (জন্মে), সঙ্গাৎ (আসক্তি হইতে) কামঃ (অভিলাষ) সংজায়তে (সমুৎপন্ন হয়), কামাৎ (কাম হইতে) ক্রোধঃ (ক্রোধ) অভিজায়তে (উপস্থিত হয়) ॥৬২॥ পক্ষান্তরে ভক্তিশূন্য বৈরাগ্য মার্গের বৈরাগ্য চেষ্টায় যে সময় পুরুষের বিষয়ধ্যান উপস্থিত হয়, তখন ক্রমশঃ বিষয়ে সঙ্গ অর্থাৎ স্পৃহ্যা জন্মে । সঙ্গ হইতে কামনা সঞ্জাত হয়, এবং কামনা প্রতিহত হইলেই ক্রোধ আসিয়া উপস্থিত হয় ॥৬২॥
ক্রোধাৎ (ক্রোধ হইতে) সম্মোহঃ (কার্য্যাকার্য্য-বিবেকাভাব) ভবতি (উপস্থিত হয়), সম্মোহাৎ (সম্মোহ হইতে) স্মৃতিবিভ্রমঃ (শাস্ত্রোপদিষ্ট নিজ স্বার্থের বিস্মৃতি ) [ভবতি] (হয়) । স্মৃতিভ্রংশাৎ (স্মৃতিভ্রষ্ট হইতে) বুদ্ধিনাশঃ (সৎ ব্যবসায়ের নাশ) বুদ্ধিনাশাৎ (বুদ্ধি নাশ হইতে) [পুমান্] (মনুষ্য) প্রণশ্যতি (সংসার কূপে পতিত হয়) ॥৬৩॥ ক্রোধ হইতে মোহ, মোহ প্রবল হইলে স্মৃতি-বিভ্রম, স্মৃতি-বিভ্রম হইতে বুদ্ধিনাশ, এবং বুদ্ধিনাশ হইতে সর্ব্বনাশ হয় ॥৬৩॥
রাগদ্বেষবিমুক্তৈঃ (আসক্তি ও বিদ্বেষ শূন্য) আত্মবশ্যৈঃ (আত্মবশীভূত) ইন্দ্রিয়ৈঃ (ইন্দ্রিগণের দ্বারা) বিষয়ান্ (বিষয় সকল) চরন্ (গ্রহণ করিয়াও), বিধেয়াত্মা (বচনানুরূপ কার্য্যকারী) তু (কিন্তু) প্রসাদম্ (চিত্ত-প্রসন্নতা) অধিগচ্ছতি (লাভ করেন) ॥৬৪॥ কিন্তু যুক্তবৈরাগ্য অবলম্বনকারী রাগদ্বেষ ত্যাগ-পূর্ব্বক আত্মবশীভূত ইন্দ্রিয়গণের দ্বারা জড়বিষয় গ্রহণ করিয়াও চিত্তপ্রসাদ লাভ করেন ॥৬৪॥
প্রসাদে [সতি] (চিত্ত প্রসাদ লাভ হইলে) অস্য (ইহার অর্থাৎ নিগৃহীত-চিত্ত ব্যক্তির) সর্ব্বদুঃখানাং (আধ্যাত্মিকাদি সকল দুঃখের) হানিঃ (অবসান) উপজায়তে (হয়), হি (যেহেতু) প্রসন্নচেতসঃ (প্রসন্নচিত্ত পুরুষের) বুদ্ধিঃ (বুদ্ধি) আশু (শীঘ্রই) পর্য্যবতিষ্ঠতে (স্বাভীষ্টের প্রতি সর্ব্বতোভাবে স্থির হইয়া থাকে) ॥৬৫॥ চিত্ত প্রসাদ লাভ হইলে সর্ব্বপ্রকার দুঃখ নাশ হয় । প্রসন্নচেতারই বুদ্ধি শীঘ্রই স্বীয় অভীষ্টের প্রতি সর্ব্বতোভাবে স্থিরা হয় । অতএব ভক্তিদ্বারাই চিত্ত প্রসাদ সম্ভব ॥৬৫॥
অযুক্তস্য (অবশীকৃত-চিত্তের) বুদ্ধিঃ (আত্মবিষয়িণী প্রজ্ঞা) ন অস্তি (নাই), অযুক্তস্য (তাদৃশ প্রজ্ঞা রহিতের) ভাবনা চ (পরমেশ্বর ধ্যানও) ন [অস্তি] (নাই), অভাবয়তঃ (অকৃতধ্যান ব্যক্তির) শান্তিঃ চ (শান্তিও) ন [অস্তি] (নাই), অশান্তস্য (শান্তি রহিত ব্যক্তির) সুখম্ (সুখ) কুতঃ (কোথায় ? অর্থাৎ সুখও নাই) ॥৬৬॥ অজিতেন্দ্রিয়ের বিচার শক্তি নাই ভাবধারাও অর্থশূন্য, শুদ্ধভাবধারা শূন্য ব্যক্তির শান্তি লাভ হয় না । অশান্ত ব্যক্তির পরম সুখ লাভের আশা কোথায় ? ॥৬৬॥
হি (যেহেতু) বায়ুঃ (প্রতিকূল বায়ু) অম্ভসি (সমুদ্রে) নাবম্ ইব (যেমন নৌকাকে) [হরতি] (বিচালিত করে), [তদ্বৎ] (সেইরূপ) চরতাং (স্ব স্ব বিষয়ে বিচরণকারী) ইন্দ্রিয়াণাং (ইন্দ্রিয়গণের মধ্যে) যৎ (যে একটি ইন্দ্রিয়) মনঃ (মনকে) অনুবিধীয়তে (অনুগমন করে) তৎ (সেই একটী ইন্দ্রিয়ই) অস্য (এই মনের বা অজিতেন্দ্রিয় পুরুষের) প্রজ্ঞাং (বুদ্ধিকে) হরতি (হরণ করে অর্থাৎ বিষয়ে আকৃষ্ট করে) ॥৬৭॥ যেহেতু সমুদ্রস্থিত নৌকাকে প্রতিকূল বায়ু যেরূপ ইতস্ততঃ সঞ্চালিত করে, সেইরূপ বিষয়ে বিচরণশীল ইন্দ্রিয়ের পশ্চাৎধাবনকারী মনও অযুক্ত পুরুষের প্রজ্ঞাকে হরণ করে ॥৬৭॥
[হে] মহাবাহো ! (হে শত্রু নিগ্রহকারী !) তস্মাৎ (সেই হেতু) যস্য (যাঁহার) ইন্দ্রিয়াণি (ইন্দ্রিয়গণ) ইন্দ্রিয়ার্থেভ্যঃ (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় হইতে) সর্ব্বশঃ (সর্ব্বপ্রকারে) নিগৃহীতানি (নিগৃহীত হইয়াছে), তস্য (তাঁহারই) প্রজ্ঞা (বুদ্ধি) প্রতিষ্ঠিতা (প্রতিষ্ঠিত বলিয়া জানিবে) ॥৬৮॥ অতএব হে মহাবাহো যাহার ইন্দ্রিয় সকল যুক্তবৈরাগ্য দ্বারা বিষয় হইতে সর্ব্বতোভাবে নিগৃহীত হইয়াছে তাহারই প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত জানিবে ॥৬৮॥
সর্ব্বভূতানাং যা নিশা (বুদ্ধি দুই প্রকার—আত্ম-প্রবণা ও বিষয়-প্রবণা—যে আত্মা-প্রবণা বুদ্ধি সর্ব্বভূতের নিশা স্বরূপ, জড়মুগ্ধ জীবসকল ঐ রাত্রিতে নিদ্রিত থাকায় তাহাতে প্রাপ্য বস্তুর জ্ঞান লাভ করিতে পারে না) । তস্যাং (সকল প্রাণীর আত্মা-প্রবণ বুদ্ধিরূপ রাত্রিতে) সংযমী (স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি) জাগর্ত্তি (জাগ্রত থাকেন অর্থাৎ আত্মবুদ্ধিনিষ্ঠ আনন্দকে সাক্ষাৎ অনুভব করেন) । যস্যাং (যে বিষয়-প্রবণা বুদ্ধিতে) ভূতানি (সর্ব্বপ্রাণী) জাগ্রতি (জাগ্রত থাকে অর্থাৎ বিষয়নিষ্ঠ সুখ-দুঃখ, শোক-মোহাদি অনুভব করে), সা (সেই বিষয়-প্রবণা বুদ্ধিই) পশ্যতঃ (সংসারী-লোকের বিষয়নিষ্ঠতার পরিণামদর্শী) মুনেঃ (স্থিতপ্রজ্ঞের) নিশা (রাত্রি অর্থাৎ বিষয়নিষ্ঠ সুখ-দুঃখাদিতে তিনি উদাসীন থাকেন) ॥৬৯॥ জড়মুগ্ধ জীবের আত্মনিষ্ঠ-বুদ্ধিরূপ নিশাতে স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি জাগ্রত থাকেন অর্থাৎ আত্মবুদ্ধিনিষ্ঠ আনন্দ সাক্ষাৎ অনুভব করেন ; পক্ষান্তরে যে বিষয়-প্রবণ বুদ্ধিতে জড়মুগ্ধ জীবগণ জাগ্রত থাকে, স্থিতপ্রজ্ঞের তাহা রাত্রিস্বরূপ অর্থাৎ তাহাতে তিনি সম্পূর্ণ উদাসীন । স্থিতপ্রজ্ঞ জড়ে উদাসীন কিন্তু চিদ্বিলাসী, আর সাধারণ জীব জড়বিলাসী কিন্তু চিদানন্দহীন । (ইহাই ভাবার্থ) ॥৬৯॥
আপূর্য্যমাণম্ (নানা নদ-নদী দ্বারা নিয়ত পরিপূর্ণ হইলেও) অচলপ্রতিষ্ঠং (অচলভাবে অবস্থিত) সমুদ্রম্ (সমুদ্র মধ্যে) যদ্বৎ (যেমন) আপঃ (অন্য বর্ষার জলরাশি) প্রবিশন্তি (প্রবেশ করে, কিন্তু তাহার বেলাভূমি অতিক্রম করিতে পারে না) । তদ্বৎ (তদ্রূপ) সর্ব্বে কামাঃ (সমস্ত ভোগ্য বিষয়) যং প্রবিশন্তি (ভোগার্থ যে মুনির নিকট আসে, কিন্তু তাঁহার চিত্তের ক্ষোভ জন্মাইতে পারে না) ; সঃ (তিনিই) শান্তিম্ (শান্তি) আপ্নোতি (লাভ করেন) । [তু] (কিন্তু) কাম-কামী (ভোগ-কামনাশীল ব্যক্তি) ন [আপ্নোতি] (সেই শান্তি প্রাপ্ত হয় না) ॥৭০॥ যেমন বহু নদনদী স্বয়ং পরিপূর্ণ ও গম্ভীর সমুদ্রে প্রবিষ্ট হয় কিন্তু ক্ষোভিত করিতে পারে না, তদ্রূপ কাম্য বিষয়সমূহ স্থিরপ্রজ্ঞ পুরুষে প্রবিষ্ট হয় কিন্তু ক্ষোভ জন্মাইতে পারে না । অতএব তিনিই শান্তি লাভ করেন । কিন্তু কামকামী কখনই শান্তি পায় না ॥৭০॥
যঃ পুমান্ (যে ব্যক্তি) সর্ব্বান্ কামান্ (সমস্ত কামনা) বিহায় (পরিত্যাগ করিয়া) নিস্পৃহঃ (স্পৃহাশূন্য) নিরহঙ্কারঃ নির্ম্মমঃ (স্বদেহ এবং দেহ সম্বন্ধীয় স্ত্রী-পুত্ত্রাদিতে অহংতা ও মমতাশূন্য হইয়া) চরতি (বিচরণ করেন) সঃ (তিনিই) শান্তিম্ (শান্তি) অধিগচ্ছতি (লাভ করেন) ॥৭১॥ যিনি ভোগবাসনাসমূহ পরিত্যাগ পূর্ব্বক সকল বিষয়ে অনাসক্ত, অহঙ্কারশূন্য ও মমতাহীনভাবে অর্থাৎ পরতত্ত্ব সম্বন্ধযুক্ত হইয়া বিচরণ করেন তিনিই শান্তি লাভ করেন ॥৭১॥
[হে] পার্থ ! (হে অর্জ্জুন !) এষা ব্রাহ্মী স্থিতিঃ (এই প্রকার স্থিতিকেই ব্রাহ্মীস্থিতি অর্থাৎ ব্রহ্ম-প্রাপিকা জ্ঞাননিষ্ঠা বলে) এনাং প্রাপ্য (ইহাকে প্রাপ্ত হইলে) [নরঃ] (মানব) ন বিমুহ্যতি (পুনরায় সংসার-মোহ প্রাপ্ত হয় না), অন্তকালে অপি (মৃত্যু সময়েও) অস্যাং (এই ব্রাহ্মী নিষ্ঠাতে) স্থিত্বা (অবস্থিত হইয়া) ব্রহ্ম নির্ব্বাণম্ (ব্রহ্মনির্ব্বাণ অর্থাৎ জড় মুক্তি) ঋচ্ছতি (লাভ করেন) ॥৭২॥ হে পার্থ ! ইহাকে ব্রাহ্মীস্থিতি কহে । ইহা লাভ করিলে আর সংসার মোহ প্রাপ্ত হইতে হয় না । মৃত্যুকালেও এই অবস্থা ক্ষণকাল লাভ করিলে চিম্ময়ধাম লব্ধ হয় ॥৭২॥
ইতি দ্বিতীয় অধ্যায়ের অন্বয় সমাপ্ত ॥ ইতি সাংখ্যযোগ নামক দ্বিতীয় অধ্যায় সমাপ্ত ।
—···—
|
সূচিপত্র: মঙ্গলাচরণম্ গ্রন্থ-পরিচয় প্রকাশকের নিবেদন ১ সৈন্য-দর্শন ২ সাংখ্যযোগ ৩ কর্ম্মযোগ ৪ জ্ঞানযোগ ৫ কর্ম্মসন্ন্যাসযোগ ৬ ধ্যানযোগ ৭ জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ ৮ তারকব্রহ্মযোগ ৯ রাজগুহ্যযোগ ১০ বিভূতিযোগ ১১ বিশ্বরূপ-দর্শনযোগ ১২ ভক্তিযোগ ১৩ প্রকৃতিপুরুষ-বিবেক-যোগ ১৪ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ ১৫ পুরুষোত্তমযোগ ১৬ দৈবাসুরসম্পদ্-বিভাগ যোগ ১৭ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ ১৮ মোক্ষযোগ গীতামাহাত্ম্যম্ |
||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥ | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
© Sri Chaitanya Saraswat Math, Nabadwip, West Bengal, India. For any enquiries please visit our contact page. |