আমাদের শ্রীগুরুপরম্পরা :
শ্রীশ্রীল ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ ভগবান্ শ্রীশ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর
              প্রভুপাদ
“শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠে সূর্যাস্ত কখনই হয় না” :
আমাদের মঠের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
 
আমাদের সম্পর্কে শ্রীউপদেশ শ্রীগ্রন্থাগার শ্রীগৌড়ীয় পঞ্জিকা ছবি ENGLISH
 
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা


সপ্তমোঽধ্যায়ঃ

জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ

 

শ্রীভগবান্ উবাচ—
ময্যাসক্তমনাঃ পার্থ যোগং যুঞ্জন্মদাশ্রয়ঃ ।
অসংশয়ং সমগ্রং মাং যথা জ্ঞাস্যসি তচ্ছৃণু ॥১॥


শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ কহিলেন) [হে] পার্থ ! (হে অর্জ্জুন !) ময়ি (পরমেশ্বর আমাতে) আসক্তমনাঃ (অভিনিবিষ্টচিত্ত) মদাশ্রয়ঃ [সন্] (জ্ঞান কর্ম্মাদিনিষ্ঠা পরিত্যাগ পূর্ব্বক একমাত্র আমারই শরণাপন্ন হইয়া) যোগং (আমার সহিত সংযোগ) যুঞ্জন্ (ধীরে ধীরে লাভ করতঃ) অসংশয়ং (নিঃসন্দিগ্ধ হইয়া) সমগ্রং (সাধিষ্ঠান, বিভূতি ও সপরিকর) মাং (আমাকে) যথা (যেরূপভাবে) জ্ঞাস্যসি (জানিতে পারিবে) তৎ (তাহা) শৃণু (শ্রবণ কর) ॥১॥


শ্রীভগবান্ কহিলেন—হে পার্থ ! পরমেশ্বর আমাতে আসক্তচিত্ত হইয়া জ্ঞানকর্ম্মাদি নিষ্ঠা পরিত্যাগ পূর্ব্বক, আমাকে আশ্রয় করিয়া ধীরে ধীরে আমার সহিত সংযোগ লাভ করতঃ নিঃসন্দেহে, অধিষ্ঠান, বিভূতি ও পরিকরাদি সহ আমাকে যে উপায়ে জানিতে পারিবে—তাহা শ্রবণ কর ॥১॥

 

জ্ঞানং তেঽহং সবিজ্ঞানমিদং বক্ষ্যাম্যশেষতঃ ।
যজ্­জ্ঞাত্বা নেহ ভূয়োঽন্যজ্­জ্ঞাতব্যমবশিষ্যতে ॥২॥

অহং (আমি) তে (তোমাকে) সবিজ্ঞানম্ (মাধুর্য্যানুভব সহিত) ইদং জ্ঞানং (এই ঐশ্বর্য্যময় জ্ঞানের কথা) অশেষতঃ (সম্পূর্ণরূপে) বক্ষ্যামি (বলিব), যৎ (যাহা) জ্ঞাত্বা (জানিলে পর) ইহ (এই শ্রেয়ঃপথে অবস্থিত) [তব] (তোমার) ভূয়ঃ (পুনরায়) অন্যৎ (অন্য) জ্ঞাতব্যম্ (জানিবার বিষয়) ন অবশিষ্যতে (অবশিষ্ট থাকিবে না) ॥২॥


আমি তোমাকে মাধুর্য্যানুভবের সহিত এই ঐশ্বর্য্যময় জ্ঞানের কথা সমগ্রভাবে বলিব, যাহা জানিবার পর এই শ্রেয়স্কর পথে অবস্থিত তোমার পুনরায় আর কিছুই জানিবার বাকি থাকিবে না ॥২॥

 

মনুষ্যাণাং সহস্রেষু কশ্চিদ্­যততি সিদ্ধয়ে ।
যততামপি সিদ্ধানাং কশ্চিন্মাং বেত্তি তত্ত্বতঃ ॥৩॥


মনুষ্যাণাং সহস্রেষু (সহস্র সহস্র মনুষ্যের মধ্যে) কশ্চিৎ (কেহ) সিদ্ধয়ে (স্ব-পরাত্মদর্শন নিমিত্ত) যততি (যত্ন করেন) যততাম্ (তাদৃশ বহু যত্নকারী) সিদ্ধানাং অপি (স্ব-পরাত্মদর্শী সহস্র সহস্র ব্যক্তির মধ্যেও) কশ্চিৎ (কেহ) মাং (শ্যামসুন্দরাকার আমাকে) তত্ত্বতঃ (সাক্ষাৎ) বেত্তি (অনুভব করেন) ॥৩॥


অসংখ্য জীবগণের মধ্যে কখন কেহ কেহ মনুষ্য হয়, সহস্র সহস্র মনুষ্যের মধ্যে কেহ কেহ স্ব-পরাত্ম অর্থাৎ জীবাত্মা ও পরমাত্মার দর্শন নিমিত্ত যত্ন করেন ; তাদৃশ যত্নশীল স্ব-পরাত্মদর্শী সহস্র সহস্র ব্যক্তির মধ্যেও কেহ কেহ মাত্র শ্যামসুন্দরাকার আমাকে সাক্ষাৎ অনুভব করেন ॥৩॥

 

ভূমিরাপোঽনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ ।
অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা ॥৪॥


ভূমিঃ (পৃথিবী) আপঃ (জল) অনলঃ (তেজ) বায়ুঃ (বায়ু) খং (আকাশ) মনঃ (মন) বুদ্ধিঃ (বুদ্ধি) অহঙ্কারঃ এব চ (এবং অহঙ্কার) ইতি (এই প্রকারে) ইয়ং (এই) মে (আমার) প্রকৃতিঃ (মায়াশক্তি) অষ্টধা (অষ্টপ্রকারে) ভিন্না (বিভক্তা) ॥৪॥


ক্ষিতি, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার এই প্রকারে আমার এই মায়াশক্তি অষ্টধা বিভক্ত ॥৪॥*

*নোট—এই শ্লোকটি বলার তাৎপর্য্য ভক্তিমতে ভগবৎ-ঐশ্বর্য্যজ্ঞানকেই জ্ঞান বলে,—জ্ঞানিদের মত দেহাদি ব্যতিরিক্ত আত্মজ্ঞান—জ্ঞান নহে । অতএব স্বীয় ঐশ্বর্য্যজ্ঞান নিরূপনার্থ স্ব-স্বরূপ ও স্বশক্তিগত ভেদপ্রকার এবং তদ্বৈশিষ্ট্য দেখাইতেছেন । স্ব-স্বরূপগত ভেদ—ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবান্ । “তন্মধ্যে ব্রহ্ম আমার শক্তিগত একটী নির্ব্বিশেষ ভাবমাত্র কোনও স্বরূপ নাই । পরমাত্মাও আমার শক্তিগত আবির্ভাব বিশেষ, (জগৎ সম্বন্ধীয় তত্ত্ববিশেষ) তাহারও কোন নিত্যস্বরূপ নাই । সুতরাং আমার ভগবৎস্বরূপই ‘নিত্য’, ঐ ভগবৎস্বরূপে আমার নিত্যশক্তিও তিন প্রকার অন্তরঙ্গা বা চিচ্ছক্তি, বহিরঙ্গা বা মায়াশক্তি ও তটস্থা বা জীবশক্তি” । অন্মধ্যে এই শ্লোকটীতে মায়াশক্তির প্রকারভেদ বর্ণন করিতেছেন ॥৪॥

 

অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্ ।
জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্য্যতে জগৎ ॥৫॥


[হে] মহাবাহো (হে মহাবীর !) ইয়ম্ (বহিরঙ্গাখ্যা প্রকৃতি) অপরা (নিকৃষ্টা) তু (কিন্তু) ইতঃ (ইহা হইতে) অন্যাং (অন্য একটী) জীবভূতাং (জীবস্বরূপা) মে (আমার) প্রকৃতিং (তটস্থাশক্তিকে) পরাম্ (শ্রেষ্ঠা) বিদ্ধি (জানিবে), যয়া (যে চেতনাশক্তি দ্বারা) ইদং জগৎ (এই জগৎ) ধার্য্যতে (স্ব কর্ম্ম দ্বারা ভোগার্থ গৃহীত হয়) ॥৫॥


হে মহাবীর অর্জ্জুন ! এই বহিরঙ্গা নামক প্রকৃতি নিকৃষ্টা, কিন্তু ইহা হইতে ভিন্ন জীবস্বরূপ আমার তটস্থা শক্তিকে উৎকৃষ্টা বলিয়া জানিবে । যে চেতনা শক্তিদ্বারা এই জগৎ নিজ নিজ কর্ম্মদ্বারা ভোগার্থ গৃহীত হইয়া থাকে । আমার অন্তরঙ্গাশক্তি নিঃসৃত চিজ্জগৎ ও বহিরঙ্গাশক্তি নিঃসৃত জড়জগৎ, এই উভয় জগতের মধ্যবর্ত্তী বা উপযোগী বলিয়া এই জীবশক্তিকে তটস্থাশক্তি বলা যায় ॥৫॥

 

এতদ্­যোনীনি ভূতানি সর্ব্বাণীত্যুপধারয় ।
অহং কৃৎস্নস্য জগতঃ প্রভবঃ প্রলয়স্তথা ॥৬॥


সর্ব্বাণি ভূতানি (স্থাবরজঙ্গমরূপ ভূত সমুদয়) এতদ্­যোনীনি (এই ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞরূপ প্রকৃতিদ্বয় হইতে উৎপন্ন) ইতি (ইহা) উপধারয় (অবগত হও) । অহং (আমি) কৃৎস্নস্য (সমগ্র) জগতঃ (জগতের) প্রভবঃ (স্রষ্টা) তথা প্রলয়ঃ (ও সংহর্ত্তা) ॥৬॥


স্থাবরজঙ্গমরূপ সমস্ত ভূতগণ এই ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞরূপ প্রকৃতিদ্বয় হইতে উৎপন্ন হইয়াছে, এইরূপ জ্ঞাত হও ; আমিই সমস্ত জগতের উৎপত্তির কারণ এবং সংহারের কারণ জানিবে ॥৬॥

 

মত্তঃ পরতরং নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয় ।
ময়ি সর্ব্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব ॥৭॥


[হে] ধনঞ্জয় ! (হে ধনঞ্জয় !) মত্তঃ (আমা হইতে) পরতরং (শ্রেষ্ঠ) অন্যৎ (অন্য) কিঞ্চিৎ (কিছু) ন অস্তি (নাই) । সূত্রে মণিগণাঃ ইব (সূত্রে গ্রথিত মণিগণের ন্যায়) ময়ি (আমাতে) ইদং সর্ব্বং (এই সমস্ত জগৎ) প্রোতং (গ্রথিত আছে) ॥৭॥


হে অর্জ্জুন ! আমা হইতে শ্রেষ্ঠ আর কিছু নাই, সূত্রে গ্রথিত মণিসমূহের ন্যায় এই সমগ্র জগৎ আমাতে গ্রথিত আছে ॥৭॥

 

রসোঽহমপ্সু কৌন্তেয় প্রভাস্মি শশিসূর্য্যয়োঃ ।
প্রণবঃ সর্ব্ববেদেষু শব্দঃ খে পৌরুষং নৃষু ॥৮॥


[হে] কৌন্তেয় ! (হে কুন্তীপুত্ত্র !) অহম্ (আমি) অপ্সু (জলমধ্যে) রসঃ (রসতন্মাত্ররূপবিভূতি দ্বারা রসের আশ্রয়রূপে অবস্থিত) শশিসূর্য্যয়োঃ (চন্দ্র ও সূর্য্যে) প্রভা (প্রভারূপ বিভূতিদ্বারা অবস্থিত) সর্ব্ববেদেষু (সমস্ত বেদে) প্রণবঃ (তন্মূলভূত ওঙ্কার) খে (আকাশে) শব্দঃ (শব্দতন্মাত্র) নৃষু (মনুষ্যে) পৌরুষং (উদ্যমরূপে) অস্মি (বর্ত্তমান আছি) ॥৮॥


হে কুন্তীনন্দন ! আমি জলের মধ্যে রসতন্মাত্ররূপ বিভূতি দ্বারা রসের আশ্রয়রূপে অবস্থিত, চন্দ্র ও সূর্য্যে প্রভারূপ বিভূতি দ্বারা অবস্থিত, সমগ্র বেদে তাহার মূলীভূত ওঙ্কাররূপে, আকাশে শব্দতন্মাত্ররূপে এবং নরগণের মধ্যে পুরুষাকাররূপে অবস্থিত আছি ॥৮॥

 

পুণ্যো গন্ধঃ পৃথিব্যাঞ্চ তেজশ্চাস্মি বিভাবসৌ ।
জীবনং সর্ব্বভূতেষু তপশ্চাস্মি তপস্বিষু ॥৯॥


[অহং] (আমি) পৃথিব্যাং চ (পৃথিবীতে) পুণ্যঃ গন্ধঃ (অবিকৃত গন্ধ) বিভাবসৌ চ (এবং অগ্নিতে) তেজঃ (তেজোরূপে) অস্মি (অবস্থান করিতেছি) । সর্ব্বভূতেষু (সর্ব্বভূতে) জীবনং (আয়ুরূপে) তপস্বিষু চ (এবং তপস্বিগণের মধ্যে) তপঃ (দ্বন্দ্বসহনাদিরূপে) অস্মি (বর্ত্তমান আছি) ॥৯॥


আমি পৃথিবীর মধ্যে পবিত্র গন্ধরূপে, এবং অগ্নিতে তেজোরূপে অবস্থান করিয়া থাকি । সমগ্র ভূতের মধ্যে আয়ুরূপে এবং তপস্বিগণের মধ্যে শীতোষ্ণাদি দ্বন্দ্ব সহনরূপে বর্ত্তমান রহিয়াছি ॥৯॥

 

বীজং মাং সর্ব্বভূতানাং বিদ্ধি পার্থ সনাতনম্ ।
বুদ্ধির্বুদ্ধিমতামস্মি তেজস্তেজস্বিনামহম্ ॥১০॥


[হে] পার্থ ! (হে অর্জ্জুন !) মাং (আমাকে) সর্ব্বভূতানাং (সর্ব্বভূতের) সনাতনম্ (নিত্য) বীজং (প্রধানাখ্য কারণ বলিয়া) বিদ্ধি (জানিবে) । অহম্ (আমি) বুদ্ধিমতাম্ (বুদ্ধিমান্গণের) বুদ্ধিঃ (বুদ্ধি) তেজস্বিনাম্ (এবং তেজস্বিগণের) তেজঃ (তেজরূপে) অস্মি (বর্ত্তমান আছি)॥১০॥


হে পার্থ ! আমাকে সমস্ত ভূতের প্রধানাখ্য সনাতন কারণ বলিয়া জানিবে । আমি বুদ্ধিমান্দিগের বুদ্ধিস্বরূপে এবং তেজস্বিদিগের তেজস্বরূপে বর্ত্তমান আছি ॥১০॥

 

বলং বলবতাং চাহং কামরাগবিবর্জ্জিতম্ ।
ধর্ম্মাবিরুদ্ধো ভূতেষু কামোঽস্মি ভরতর্ষভ ॥১১॥


[হে] ভরতর্ষভ ! (হে ভরতবংশ শ্রেষ্ঠ !) অহং (আমি) বলবতাং (বলবান্গণের) কামরাগবিবর্জ্জিতম্ (স্বজীবিকাদির অভিলাষ ও অধিক তৃষ্ণা শূন্য) বলম্ (সাত্ত্বিক স্বধর্ম্মানুষ্ঠান সামর্থ্য) চ (এবং) ভূতেষু (প্রাণি সমূহে) ধর্ম্মাবিরুদ্ধঃ (ধর্ম্মপত্নীতে পুত্রোৎপত্তিমাত্রে উপযোগী) কামঃ (কামরূপে) অস্মি (বর্ত্তমান আছি) ॥১১॥


হে অর্জ্জুন ! আমি বলবান্দিগের স্বার্থ ও আসক্তি বর্জ্জিত বল, এবং প্রাণিসমুদয়ের মধ্যে ধর্ম্ম সম্মত কামরূপে অবস্থিত আছি ॥১১॥

 

যে চৈব সাত্ত্বিকা ভাবা রাজসাস্তামসাশ্চ যে ।
মত্ত এবেতি তান্ বিদ্ধি ন ত্বহং তেষু তে ময়ি ॥১২॥


যে এব (আরও যে সকল) সাত্ত্বিকাঃ (সাত্ত্বিক) রাজসাঃ চ (রাজসিক) যে চ (এবং যে সকল) তামসাঃ (তামসিক) ভাবাঃ (পদার্থ) [সন্তি] (আছে) তান্ [সর্ব্বান্] (সেই সকলকে) মত্তঃ এব (আমা হইতেই জাত) ইতি (এরূপ) বিদ্ধি (জানিবে)। তেষু (তাহাদিগের মধ্যে) অহং ন [বর্ত্তে] (আমি অবস্থান করি না) তু (কিন্তু) তে (তাহারা) ময়ি (আমাতে) [বর্ত্তন্তে] (অবস্থান করে) ॥১২॥


আরও যে সকল সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক পদার্থ আছে, সেই সমুদয়ও আমা হইতেই জাত বলিয়া জানিবে । তথাপি সেই সকলের মধ্যে আমি নাই, কিন্তু তাহারা আমার আধীন হইয়া আমাতে বর্ত্তমান আছে ॥১২॥

 

ত্রিভির্গুণময়ৈর্ভাবৈরেভিঃ সর্ব্বমিদং জগৎ ।
মোহিতং নাভিজানাতি মামেভ্যঃ পরমব্যয়ম্ ॥১৩॥


এভিঃ (এই) ত্রিভিঃ (ত্রিবিধ) গুণময়ৈঃ (গুণময়) ভাবৈঃ (ভাবের দ্বারা) ইদং (এই) সর্ব্বম্ (সমুদয়) জগৎ (জীবজগৎ) মোহিতং (বিমোহিত রহিয়াছে) । [অতএব] এভ্যঃ পরম্ (এই ত্রিগুণের অতীত) অব্যয়ম্ (নির্ব্বিকার) মাম্ (কৃষ্ণস্বরূপ আমাকে) ন অভিজানাতি (কেহই জানে না) ॥১৩॥


এই তিনটী গুণময় ভাবের দ্বারা এই সকল জীবজগৎ সম্পূর্ণ মোহিত রহিয়াছে । সুতরাং এই সকল ভাব হইতে শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ নির্গুণ নির্ব্বিকার ভগবৎস্বরূপ আমাকে কেহই জানিতে পারে না ॥১৩॥

 

দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া ।
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে ॥১৪॥


এষা (এই) গুণময়ী (ত্রিগুণাত্মিকা) দৈবী (অলৌকিকী) মম (আমার) মায়া (বহিরঙ্গাশক্তি) দুরত্যয়া (দুস্তরা) হি (সুনিশ্চিত), [তথাপি] (তাহা হইলেও) যে (যাঁহারা) মাম্ এব (একমাত্র আমাকেই) প্রপদ্যন্তে (আশ্রয় করেন অর্থাৎ আমাতে শরণাগত হন) তে (তাঁহারাই) এতাং (এই দুরতিক্রমণীয়া) মায়াম্ (মায়াকে) তরন্তি (অতিক্রম করিতে পারেন) ॥১৪॥


এই ত্রিগুণময়ী অলৌকিকী (বিমুখমোহিনী) আমার মায়াশক্তি অতীব দুরতিক্রমণীয়া, তথাপি যাঁহারা একমাত্র আমারই শরণাগত হন, তাঁহারাই এই দুস্তরা মায়াকে অতিক্রম করিতে পারেন ॥১৪॥

 

ন মাং দুষ্কৃতিনো মূঢ়াঃ প্রপদ্যন্তে নরাধমাঃ ।
মায়য়াপহৃতজ্ঞানা আসুরং ভাবমাশ্রিতাঃ ॥১৫॥


মূঢ়াঃ (কর্ম্মিগণ), নরাধমাঃ (ভক্তি আশ্রয় করিয়া পরে অনুপযোগিতা জ্ঞানে ভক্তি পরিত্যাগী নরাধমগণ), [শাস্ত্রজ্ঞানসত্ত্বে] মায়য়া (মায়া কর্ত্তৃক) অপহৃতজ্ঞানাঃ (যাহাদের জ্ঞান আবৃত হইয়াছে অর্থাৎ যাহারা নারায়ণ মূর্ত্তিই ভজনীয় ও কৃষ্ণ রামাদি মূর্ত্তি মানুষী মনে করে), আসুরং ভাবম্ আশ্রিতাঃ (এবং জরাসন্ধ প্রভৃতি অসুরগণের ন্যায় কুতর্কশরে আমার বিগ্রহ খণ্ডনকারী মায়াবাদিগণ), দুষ্কৃতিনঃ (এই চতুর্ব্বিধ দুষ্কৃতিগণ অর্থাৎ কুপণ্ডিতগণই) মাং (আমাতে) ন প্রপদ্যন্তে (প্রপন্ন হয় না) ॥১৫॥


মূঢ় অর্থাৎ পশুতুল্য কর্ম্মিগণ, নরাধম অর্থাৎ ভক্তি আশ্রয় করিয়া পরে অনুপযোগিতা জ্ঞানে ভক্তি পরিত্যাগী নরাধমগণ, শাস্ত্রজ্ঞান সত্ত্বে মায়া কর্ত্তৃক অপহৃত জ্ঞান অর্থাৎ যাহারা নারায়ণ মূর্ত্তিই ভজনীয় ও কৃষ্ণ রামাদি মূর্ত্তি মানুষী মনে করে, এবং যাহারা আসুরিক ভাবাপন্ন অর্থাৎ জরাসন্ধ প্রভৃতি অসুরগণের ন্যায় কুতর্কশরে আমার বিগ্রহ খণ্ডনকারী মায়াবাদিগণ এই চতুর্ব্বিধ দুষ্কৃতিগণই আমার শরণাগত হয় না ॥১৫॥

 

চতুর্ব্বিধা ভজন্তে মাং জনাঃ সুকৃতিনোঽর্জ্জুন ।
আর্ত্তো জিজ্ঞাসুরর্থার্থী জ্ঞানী চ ভরতর্ষভ ॥১৬॥


[হে] ভরতর্ষভ ! (হে ভরতবংশাবতংশ !) [হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন !) আর্ত্তঃ (রোগাদি বিপদ্­গ্রস্ত), জিজ্ঞাসুঃ (আত্মজ্ঞানার্থী বা শাস্ত্রজ্ঞানার্থী), অর্থার্থী (ভোগাভিলাষী), জ্ঞানী চ (ও বিশুদ্ধান্তঃকরণ আত্মবিৎ) [ইতি] চতুর্ব্বিধাঃ জনাঃ (এই চারি প্রকার ব্যক্তি) সুকৃতিনঃ [সন্তঃ] (ভক্তিপ্রভাব যুক্ত হইয়া ) মাং (আমাকে) ভজন্তে (ভজনা করেন, অর্থাৎ ইহারা কর্ম্মমিশ্র ও জ্ঞানমিশ্র ভক্ত) ॥১৬॥


হে ভরত শ্রেষ্ঠ ! অর্জ্জুন ! ক্লেশ-সন্তপ্ত, জ্ঞানান্বেষী, ঐহিক পারত্রিক সুখভোগার্থী ও বিশুদ্ধান্তঃকরণ আত্মজ্ঞ এই চারিপ্রকার ব্যক্তিই ভক্তিপ্রভাবযুক্ত হইয়া আমার ভজন করেন ॥১৬॥

 

তেষাং জ্ঞানী নিত্যযুক্ত একভক্তির্বিশিষ্যতে ।
প্রিয়ো হি জ্ঞানিনোঽত্যর্থমহং স চ মম প্রিয়ঃ ॥১৭॥


তেষাং (তাঁহাদিগের মধ্যে) নিত্যযুক্তঃ (আমাতে সমাহিত চিত্ত) একভক্তিঃ (ঐকান্তিক ভক্ত) জ্ঞানী (এতাদৃশ জ্ঞানী ব্যক্তি) বিশিষ্যতে (উৎকৃষ্ট) । হি (যেহেতু) অহম্ (শ্যামসুন্দরাকার আমি) জ্ঞানিনঃ (এতাদৃশ জ্ঞানীর) অত্যর্থম্ (অত্যন্ত) প্রিয়ঃ (প্রিয়), সঃ চ (সেও) মম (আমার) প্রিয়ঃ (প্রিয়) ॥১৭॥


এই চারিপ্রকার ভক্ত মধ্যে আমাতে সমাহিতচিত্ত ঐকান্তিক ভক্ত—জ্ঞানী উৎকৃষ্ট । যেহেতু শ্যামসুন্দরাকার আমি এই জ্ঞানীর অত্যন্ত প্রিয়, সুতরাং তিনিও আমার প্রিয় হইয়া থাকেন ॥১৭॥

 

উদারাঃ সর্ব্ব এবৈতে জ্ঞানী ত্বাত্মৈব মে মতম্ ।
আস্থিতঃ স হি যুক্তাত্মা মামেবানুত্তমাং গতিম্ ॥১৮॥


এতে (ইহারা) সর্ব্বে এব (সকলেই) উদারাঃ (ভোগাদি-সঙ্কীর্ণতা-মুক্তচিত্ত—প্রিয়) তু (কিন্তু) জ্ঞানী (শুদ্ধ জ্ঞানবান্ ব্যক্তি) আত্মা এব (আত্মস্বরূপ-চিদাত্ম-স্বরূপানুভূতি বশতঃ আত্মভূত অর্থাৎ অতিপ্রিয়) [ইতি] (ইহা) মে (আমার) মতম্ (অভিমত), হি (যেহেতু) সঃ (সেই জ্ঞানী) যুক্তাত্মা [সন্] (মদর্পিত চিত্ত হইয়া) মাম্ এব (শ্যামসুন্দরাকার আমাকেই) অনুত্তমাং (সর্ব্বোত্তম) গতিম্ (প্রাপ্য বলিয়া) আস্থিতঃ (নিশ্চয় করিয়াছেন) ॥১৮॥


ইহারা সকলেই ভোগাদি-সঙ্কীর্ণতামুক্তচিত্ত, অতএব আমার প্রিয়, কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তি চিদাত্মস্বরূপানুভূতি বশতঃ আত্মভূত অতএব অতি প্রিয়—ইহাই আমার মত । যেহেতু সেই জ্ঞানী ব্যক্তি আমাতে অর্পিতচিত্ত হইয়া শ্যামসুন্দরাকার আমাকেই সর্ব্বোত্তম প্রাপ্য বলিয়া নিশ্চয় করিয়াছেন ।

 

বহূনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান্ মাং প্রপদ্যতে ।
বাসুদেবঃ সর্ব্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্ল্লভঃ ॥১৯॥


বহূনাং (বহু) জন্মনাম্ (জন্মের) অন্তে (পরে) জ্ঞানবান্ (জ্ঞানী ব্যক্তি) সর্ব্বম্ বাসুদেবঃ (সমস্তই বাসুদেবময়) ইতি (এইরূপ জ্ঞান যুক্ত হইয়া) [ভাগ্যক্রমে সাধুসঙ্গবশতঃ] মাং প্রপদ্যতে (আমাতে শরণাগত হন) । সঃ (সেই প্রকার) মহাত্মা (মহাত্মাও) সুদুর্ল্লভঃ (অত্যন্ত দুর্ল্লভ) ॥১৯॥


বহু বহু জন্মের পরে জ্ঞানী ব্যক্তি (যদৃচ্ছাক্রমে তাদৃশ কোনও সাধুসঙ্গের ফলে) সমগ্র চরাচর বিশ্বই বাসুদেবময় বা বাসুদেবাধীন এরূপ জ্ঞানযুক্ত হইয়া আমাতে শরণাগত হন । সেরূপ মহাত্মা অতি দুর্ল্লভ জানিবে ॥১৯॥

 

কামৈস্তৈস্তৈর্হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেঽন্যদেবতাঃ ।
তং তং নিয়মমাস্থায় প্রকৃত্যা নিয়তাঃ স্বয়া ॥২০॥


তৈঃ তৈঃ (ভোগ ত্যাগ বিষয়ক সেই সেই) কামৈঃ (কামনা সমূহ দ্বারা) হৃতজ্ঞানাঃ (নষ্ট বুদ্ধি ব্যক্তিগণ) তং তং (সেই সেই প্রকার) নিয়মম্ (উপবাসাদি নিয়ম) আস্থায় (অবলম্বন পূর্ব্বক) স্বয়া প্রকৃত্যা (স্বীয় স্বভাব দ্বারা) নিয়তাঃ [সন্তঃ] (বশীভূত হইয়া) অন্যদেবতাঃ (অন্য সূর্য্যাদি দেবতার) প্রপদ্যন্তে (ভজনা করে) ॥২০॥


ভোগ-ত্যাগাদিবিষয়ক সেই সেই কামনাসমূহে নষ্টবুদ্ধি ব্যক্তিগণ, সেই সেই উপবাসাদি নিয়ম স্বীকার পূর্ব্বক স্বকীয় প্রকৃতির বশীভূত হইয়া অন্যান্য সূর্য্যাদি নানা দেবতার ভজন করিয়া থাকে ॥২০॥

 

যো যো যাং যাং তনুং ভক্তঃ শ্রদ্ধয়ার্চ্চিতুমিচ্ছতি ।
তস্য তস্যাচলাং শ্রদ্ধাং তামেব বিদধাম্যহম্ ॥২১॥


যঃ যঃ (যে যে) ভক্তঃ (ভক্ত) যাং যাং (যেই যেই) তনুং (দেবতারূপ মদীয়া মূর্ত্তিকে) শ্রদ্ধয়া (শ্রদ্ধার সহিত) অর্চ্চিতুম্ (পূজা করিতে) ইচ্ছতি (ইচ্ছা করে) তস্য তস্য (সেই সেই ভক্তের) তাম্ (সেই মূর্ত্তি বিষয়িণী) অচলাং (দৃঢ়) শ্রদ্ধাং (শ্রদ্ধা) অহম্ এব (অন্তর্য্যামি স্বরূপ আমিই) বিদধামি (বিধান করিয়া থাকি) ॥২১॥


যে যে ভক্ত যেই যেই দেবতারূপ আমার মূর্ত্তিকে শ্রদ্ধার সহিত আরাধনা করিতে ইচ্ছা করে, সেই সেই ভক্তের সেই সেই মূর্ত্তি বিষয়িণী দৃঢ়শ্রদ্ধাকে অন্তর্য্যামিস্বরূপ আমিই বিধান করিয়া থাকি ॥২১॥

 

স তয়া শ্রদ্ধয়া যুক্তস্তস্যারাধনমীহতে ।
লভতে চ ততঃ কামান্ ময়ৈব বিহিতান্ হি তান্ ॥২২॥


সঃ (সেই ভক্ত) তয়া শ্রদ্ধয়া (সেই দৃঢ় শ্রদ্ধার সহিত) যুক্তঃ [সন্] (যুক্ত হইয়া) তস্যাঃ (সেই দেবতা মূর্ত্তির) আরাধনম্ (আরাধনা) ঈহতে (করিয়া থাকেন) । ততঃ চ (এবং সেই দেবমূর্ত্তি হইতে) ময়া এব (তত্তৎ দেবতান্তর্য্যামিরূপ আমা কর্ত্তৃকই) হি (নিশ্চিত) বিহিতান্ (বিহিত) তান্ কামান্ (সেই সেই কাম্যফল) লভতে (লাভ করেন)॥২২॥


সেই ভক্ত মৎপ্রদত্ত সেই দৃঢ় শ্রদ্ধার সহিত যুক্ত হইয়া সেই দেবতা মূর্ত্তির আরাধনা করিতে থাকে, এবং সেই দেবতামূর্ত্তি হইতে তাঁহাদেরও অন্তর্য্যামিরূপ আমা কর্ত্তৃকই বিহিত সেই সেই কাম্যবিষয় সকল লাভ করিয়া থাকে ॥২২॥

 

অন্তবত্তু ফলং তেষাং তদ্ভবত্যল্পমেধসাম্ ।
দেবান্ দেবযজো যান্তি মদ্ভক্তা যান্তি মামপি ॥২৩॥


তু (কিন্তু) অল্পমেধসাম্ (অল্প বুদ্ধি) তেষাং (সেই দেবতান্তরযাজিগণের) তৎ ফলং (সেই ফল) অন্তবৎ (বিনাশী) ভবতি (হয়) । দেবযজঃ (দেব পূজকগণ) দেবান্ (সেই সেই দেবতাগণকে) যান্তি (প্রাপ্ত হন), মদ্ভক্তাঃ অপি (এবং আমার ভক্তগণ) মাম্ (আমাকে) যান্তি (প্রাপ্ত হন) ॥২৩॥


কিন্তু পরিচ্ছিন্ন দৃষ্টি সেই সেই দেবতান্তর পূজকগণের সেই প্রাপ্ত ফল বিনাশশীল হয় এবং সেই দেবপূজকগণ সেই সেই দেবতাগণকেই প্রাপ্ত হন, কিন্তু আমার ভক্তগণ আমাকে প্রাপ্ত হন ॥২৩॥

 

অব্যক্তং ব্যক্তিমাপন্নং মন্যন্তে মামবুদ্ধয়ঃ ।
পরং ভাবমজানন্তো মমাব্যয়মনুত্তমম্ ॥২৪॥


অবুদ্ধয়ঃ (অবোধ ব্যক্তিগণ) মম (আমার) অব্যয়ম্ (নিত্য) অনুত্তমম্ (সর্ব্বোত্তম) পরং (মায়ার অতীত) ভাবম্ (স্বরূপ-জন্ম-গুণ-কর্ম্ম-লীলাদি) অজানন্তঃ (না জানিতে পারিয়া) অব্যক্তং (প্রপঞ্চাতীত নিরাকার ব্রহ্মই) ব্যক্তিম্ (মায়িক আকারে বসুদেব গৃহে ইদানীং জন্ম) আপন্নং (প্রাপ্ত বলিয়া) মাম্ (আমাকে) মন্যন্তে (মনে করে) ॥২৪॥


অবোধ মানবগণ আমার নিত্য সর্ব্বোৎকৃষ্ট মায়ার অতীত স্বরূপ-জন্ম-গুণ-কর্ম্ম ও লীলাদির তত্ত্ব জানিতে না পারিয়া প্রপঞ্চাতীত নিরাকার ব্রহ্মই মায়িক আকারে বসুদেব গৃহে ইদানীং জন্মপ্রাপ্ত হইয়াছি বলিয়া আমাকে মনে করে ॥২৪॥

 

নাহং প্রকাশঃ সর্ব্বস্য যোগমায়াসমাবৃতঃ ।
মূঢ়োঽয়ং নাভিজানাতি লোকো মামজমব্যয়ম্ ॥২৫॥


অহম্ (আমি) যোগমায়া সমাবৃতঃ (যোগমায়া দ্বারা সম্যক্ আচ্ছাদিত থাকায়) সর্ব্বস্য (সকলের নিকট) প্রকাশঃ (প্রকাশিত) ন [ভবামি] (নহি) [অতঃ] (এইজন্য) অয়ং (এই) মূঢ়ঃ লোকঃ (মূঢ় লোকগণ) মাম্ (শ্যামসুন্দরাকার বসুদেবাত্মজ আমাকে) অজম্ (মায়িক জন্মাদি শূন্য) অব্যয়ম্ (ও নিত্য-স্বরূপ বলিয়া) ন অভিজানাতি (জানিতে পারে না) ॥২৫॥


আমি যোগমায়া দ্বারা সমাচ্ছাদিত থাকায় সকল লোকের নিকট প্রকাশিত হই না । সুতরাং এই সকল মূঢ়লোক শ্যামসুন্দরাকার বসুদেবাত্মজ আমাকে মায়িক জন্মাদি শূন্য ও সনাতন-স্বরূপ বলিয়া ঠিক্ জানিতে পারে না ॥২৫॥

 

বেদাহং সমতীতানি বর্ত্তমানানি চার্জ্জুন ।
ভবিষ্যাণি চ ভূতানি মান্তু বেদ ন কশ্চন ॥২৬॥


[হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন !) অহং (আমি) সমতীতানি (সমস্ত অতীত) বর্ত্তমানানি (বর্ত্তমান) ভবিষ্যাণি চ (ও ভবিষ্যৎ এই ত্রিকালবর্ত্তি) ভূতানি (স্থাবর-জঙ্গম-প্রাণিবর্গকে) বেদ (জানি), তু (কিন্তু) কশ্চন (মায়া ও যোগমায়া দ্বারা জ্ঞানের আবরণ হেতু প্রাকৃত বা প্রকৃতির অতীত কেহই) মাম্ (আমাকে) ন চ বেদ (সমগ্র রূপে জানিতে পারে না) ॥২৬॥


হে অর্জ্জুন ! আমি সমস্ত অতীত, বর্ত্তমান ও ভবিষ্যৎ এই ত্রিকালস্থ স্থাবর জঙ্গমাত্মক সমুদয় বস্তুই জানি । কিন্তু আমার মায়াশক্তি ও যোগমায়া শক্তির দ্বারা তাহাকের জ্ঞান আচ্ছাদনহেতু প্রাকৃত মানব বা প্রকৃতির অতীত কেহই আমাকে যথাযথ ভাবে জানিতে পারে না ॥২৬॥

 

ইচ্ছাদ্বেষসমুত্থেন দ্বন্দ্বমোহেন ভারত ।
সর্ব্বভূতানি সম্মোহং সর্গে যান্তি পরন্তপ ॥২৭॥


[হে] ভারত ! [হে] পরন্তপ ! (হে শত্রুতাপন অর্জ্জুন !) সর্গে (জগৎ সৃষ্টির আরম্ভেই) সর্ব্বভূতানি (যাবতীয় প্রাণী) ইচ্ছাদ্বেষসমুত্থেন (ইন্দ্রিয়ানুকূল বিষয়ে ইচ্ছা ও প্রতিকূল বিষয়ে দ্বেষ হইতে সম্যক্ জাত) দ্বন্দ্বমোহেন (সুখ দুঃখাদিরূপ অজ্ঞান দ্বারা) সম্মোহং (সম্যক্ রূপে মোহকে) যান্তি (প্রাপ্ত হয়) ॥২৭॥


হে শত্রুতাপন অর্জ্জুন ! জগৎ সৃষ্টির প্রারম্ভেই সমস্ত প্রাণিগণ নিজ নিজ ইন্দ্রিয়ের অনুকূল বিষয়ে ইচ্ছা ও প্রতিকূল বিষয়ে দ্বেষ হইতে সমুদ্­ভূত সুখ-দুঃখাদি দ্বন্দ্বজ অজ্ঞান দ্বারা অত্যন্ত মোহ প্রাপ্ত হয় ॥২৭॥

 

যেষান্ত্বন্তগতং পাপং জনানাং পুণ্যকর্ম্মণাম্ ।
তে দ্বন্দ্বমোহনির্মুক্তা ভজন্তে মাং দৃঢ়ব্রতাঃ ॥২৮॥


তু (কিন্তু) যেষাং (যে সকল) পুণ্যকর্ম্মণাম্ (পুণ্যকর্ম্মের আচরণকারী) জনানাং (ব্যক্তিদিগের) পাপং (পাপ) অন্তগতং (যাদৃচ্ছিক মদ্ভক্ত সঙ্গবশতঃ সম্যক্ নষ্ট হইয়াছে), তে (সেই সকল) দ্বন্দ্বমোহনির্মুক্তাঃ (সুখ দুঃখাদির মোহশূন্য) দৃঢ়ব্রতাঃ (নিষ্ঠা প্রাপ্ত ব্যক্তিগণ) মাং (আমাকে) ভজন্তে (ভজনা করেন) ॥২৮॥


কিন্তু যে সকল পুণ্যাচরণকারী ব্যক্তিগণের পাপ যদৃচ্ছাক্রমে আমার কোনও ভক্তসঙ্গের দ্বারা নষ্ট হইয়াছে, সেই সকল সুখ দুঃখাদি দ্বন্দ্বজ মোহশূন্য নিষ্ঠাপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ আমার ভজন করেন ॥২৮॥

 

জরামরণমোক্ষায় মামাশ্রিত্য যতন্তি যে ।
তে ব্রহ্ম তদ্বিদুঃ কৃৎস্নমধ্যাত্মং কর্ম্ম চাখিলম্ ॥২৯॥


যে (যাঁহারা) জরামরণমোক্ষায় (জরামরণ হইতে মুক্তির কামনায়) মাম্ (আমাকে) আশ্রিত্য (আশ্রয় পূর্ব্বক) যতন্তি (সাধন করেন), তে (তাঁহারা) তৎ (সেই) ব্রহ্ম (ব্রহ্মকে) কৃৎস্নম্ (সমস্ত) অধ্যাত্মং (জীবাত্মাকে) অখিলম্ কর্ম্ম চ (এবং নানাবিধ কর্ম্ম জন্য জীবের সংসারকে) বিদুঃ (অবগত হন) ॥২৯॥


যাঁহারা জরামরণরূপ সংসার দুঃখ হইতে মুক্তি লাভার্থ আমাকে আশ্রয় করিয়া ভজনা করেন, তাঁহারা সেই ব্রহ্মকে, সমগ্র জীবাত্মাকে এবং নানাবিধ কর্ম্মজন্য পুনঃ পুনঃ জীবের সংসার দুঃখকে জানিতে পারেন ॥২৯॥

 

সাধিভূতাধিদৈবং মাং সাধিযজ্ঞঞ্চ যে বিদুঃ ।
প্রয়াণকালেঽপি চ মাং তে বিদুর্যুক্তচেতসঃ ॥৩০॥


যে চ (আর য়াঁহারা) সাধিভূতাধিদৈবং (অধিভূত ও অধিদৈবের সহিত) সাধিযজ্ঞং চ (এবং অধিযজ্ঞের সহিত) মাম্ (আমাকে) বিদুঃ (জানেন), তে (সেই সকল) যুক্তচেতসঃ (আমাতে আসক্ত চিত্ত ব্যক্তিগণ) প্রয়াণকালে অপি (মৃত্যু কালেও) মাং (আমাকে) বিদুঃ (জানিতে পারেন) ॥৩০॥


আর যাঁহারা অধিভূত ও অধিদৈবের সহিত এবং অধিযজ্ঞের সহিত আমাকে জানেন আমাতে আসক্তিচিত্ত সেই ব্যক্তিগণ মরণ সময়েও আমাকে জানিতে পারেন, অর্থাৎ মৃত্যুভয়ে ব্যাকুল হইয়া আমাকে বিস্মৃত হন না ॥৩০॥

 

ইতি শ্রীমহাভারতে শতসাহস্র্যাং সংহিতায়াং বৈয়াসিক্যাং
ভীষ্মপর্ব্বণি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং
যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুন-সংবাদে জ্ঞানবিজ্ঞান-
যোগো নাম সপ্তমোঽধ্যায়ঃ ॥৭॥


ইতি সপ্তম অধ্যায়ের অন্বয় সমাপ্ত ॥


ইতি সপ্তম অধ্যায়ের বঙ্গানুবাদ সমাপ্ত ॥


 

 

—···—

 

 

← ৬ ধ্যানযোগ ৮ তারকব্রহ্মযোগ →

 

সূচিপত্র:
মঙ্গলাচরণম্
গ্রন্থ-পরিচয়
প্রকাশকের নিবেদন
১ সৈন্য-দর্শন
২ সাংখ্যযোগ
৩ কর্ম্মযোগ
৪ জ্ঞানযোগ
৫ কর্ম্মসন্ন্যাসযোগ
৬ ধ্যানযোগ
৭ জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ
৮ তারকব্রহ্মযোগ
৯ রাজগুহ্যযোগ
১০ বিভূতিযোগ
১১ বিশ্বরূপ-দর্শনযোগ
১২ ভক্তিযোগ
১৩ প্রকৃতিপুরুষ-বিবেক-যোগ
১৪ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৫ পুরুষোত্তমযোগ
১৬ দৈবাসুরসম্পদ্-বিভাগ যোগ
১৭ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৮ মোক্ষযোগ
গীতামাহাত্ম্যম্
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥