আমাদের শ্রীগুরুপরম্পরা :
শ্রীশ্রীল ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ ভগবান্ শ্রীশ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর
              প্রভুপাদ
“শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠে সূর্যাস্ত কখনই হয় না” :
আমাদের মঠের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
 
আমাদের সম্পর্কে শ্রীউপদেশ শ্রীগ্রন্থাগার শ্রীগৌড়ীয় পঞ্জিকা ছবি ENGLISH
 
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা


ষষ্ঠোঽধ্যায়ঃ

ধ্যানযোগ

 

শ্রীভগবান্ উবাচ—
অনাশ্রিতঃ কর্ম্মফলং কার্য্যং কর্ম্ম করোতি যঃ ।
স সন্ন্যাসী চ যোগী চ ন নিরগ্নির্ন চাক্রিয়ঃ ॥১॥


শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ কহিলেন) যঃ (যে ব্যক্তি) কর্ম্মফলং (কর্ম্মফলের) অনাশ্রিতঃ (অপেক্ষা না করিয়া) কার্য্যং (অবশ্য করণীয়) কর্ম্ম (শান্ত্র বিহিত কর্ম্ম) করোতি (করেন) সঃ চ (তিনিই) সন্ন্যাসী (সন্ন্যাসী) যোগী চ (এবং তিনিই যোগী) ; ন নিরগ্নিঃ (অগ্নিহোত্রাদি কর্ম্মমাত্র পরিত্যাগীও সন্ন্যাসী নহেন) ন চ অক্রিয়ঃ (বা শারীর কর্ম্মমাত্র পরিত্যাগীও যোগী নহেন) ॥১॥


শ্রীভগবান্ বলিলেন—যে ব্যক্তি কর্ম্মফলের অপেক্ষা না রাখিয়া শাস্ত্রবিহিত অবশ্য কর্ত্তব্য কর্ম্ম সকল আচরণ করেন, তাঁহাকেই প্রকৃত সন্ন্যাসী এবং প্রকৃত যোগী বলিয়া জানিবে । যিনি অগ্নিহোত্রাদি কর্ম্মমাত্র পরিত্যাগী তিনিও সন্ন্যাসী নহেন, বা যিনি শারীর কর্ম্মমাত্র পরিত্যাগী তিনিও যোগী হহেন ॥১॥

 

যং সন্ন্যাসমিতি প্রাহুর্যোগং তং বিদ্ধি পাণ্ডব ।
ন হ্যসংন্যস্তসংকল্পো যোগী ভবতি কশ্চন ॥২॥


[হে] পাণ্ডব (হে পাণ্ডব !) [সুধিয়ঃ] (পণ্ডিতগণ) যং (যে নিষ্কাম কর্ম্মযোগকে) সন্ন্যাসম্ ইতি (সন্ন্যাস বলিয়া) প্রাহুঃ (অভিহিত করেন) তম্ [এব] (তাহাকেই) যোগং (অষ্টাঙ্গ যোগ বলিয়া) বিদ্ধি (জানিবে) । হি (যেহেতু) অসংন্যস্তসঙ্কল্পঃ (ফলাসক্তি ত্যাগ [যাহানিষ্কাম কর্ম্মযোগের বৈশিষ্ট্য] না করিয়া) কশ্চন (কেহই) যোগী (জ্ঞানযোগী বা অষ্টাঙ্গ যোগী) ন ভবতি (হন না) ॥২॥


হে অর্জ্জুন ! সুধীগণ যে নিষ্কাম কর্ম্মযোগকে সন্ন্যাস বলিয়া কীর্ত্তন করেন, তাহাকেই তুমি অষ্টাঙ্গ যোগ বলিয়া জানিবে । যেহেতু, ফলাকাঙ্ক্ষা ও বিষয় ভোগ স্পৃহা পরিত্যাগ (যাহানিষ্কাম কর্ম্মযোগের বৈশিষ্ট্য) না করিয়া কেহই জ্ঞানযোগী বা অষ্টাঙ্গ যোগী বলিয়া অভিহিত হইতে পারেন না ॥২॥

 

আরুরুক্ষোর্মুনের্যোগং কর্ম্ম কারণমুচ্যতে ।
যোগারূঢ়স্য তস্যৈব শমঃ কারণমুচ্যতে ॥৩॥


যোগম্ (নিশ্চল ধ্যান যোগ) আরুরুক্ষোঃ (আরোহণেচ্ছু) মুনেঃ (যোগাভ্যাসকারীর) [তদারোহে] (যোগারোহণে) কর্ম্ম (কর্ম্মই) কারণম্ (কারণ বলিয়া) উচ্যতে (অভিহিত হয়) । তস্যৈব যোগারূঢ়স্য (সেই ব্যক্তিই যোগারূঢ় অর্থাৎ ধ্যাননিষ্ঠ হইলে) শমঃ (সর্ব্বকর্ম্মত্যাগ) কারণম্ (কারণ বলিয়া) উচ্যতে (কথিত হয়) ॥৩॥


নিশ্চল ধ্যানযোগে আরোহণেচ্ছু মুনির যোগারোহণে প্রথমতঃ কর্ম্মই কারণ বলিয়া কথিত হয় । সেই ব্যক্তিই পরে ধ্যাননিষ্ট হইলে সর্ব্ব কর্ম্ম ত্যাগই তখন তাঁহার ধ্যানযোগে কারণ বলিয়া অভিহিত হয় ॥৩॥

 

যদা হি নেন্দ্রিয়ার্থেষু ন কর্ম্মস্বনুষজ্জতে ।
সর্ব্বসঙ্কল্পসন্ন্যাসী যোগারূঢ়স্তদোচ্যতে ॥৪॥


যদা হি (যে কালে) [যোগী) (যোগী) ইন্দ্রিয়ার্থেষু (ইন্দ্রিয়ভোগ্য শব্দাদি বিষয়ে) কর্ম্মসু [চ] (এবং তৎসাধন কর্ম্মে) ন অনুষজ্জতে (আসক্তি করেন না) সর্ব্বসঙ্কল্পসন্ন্যাসী [চ ভবতি] (এবং সমস্ত সঙ্কল্প ত্যাগ করেন) তদা (তখনই) যোগারূঢ়ঃ উচ্যতে (যোগারূঢ় শব্দ বাচ্য হন) ॥৪॥


যে সময়ে যোগী ব্যক্তি ইন্দ্রিয় ভোগ্য রূপ রসাদি বিষয় সকলের প্রতি এবং ভোগ সাধন যোগ্য কর্ম্মে আসক্তি করেন না বিশেষতঃ পূর্ণরূপে সমস্ত সঙ্কল্পের পরিত্যাগ আচরণ করেন, তখনই তিনি যোগারূঢ় নামে অভিহিত হইয়া থাকেন ॥৪॥

 

উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ ।
আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ ॥৫॥


আত্মনা (অনাসক্ত মন দ্বারা) আত্মানং (জীবাত্মাকে) উদ্ধরেৎ (সংসার হইতে উদ্ধার করিবে), [আত্মনা] (বিষয়াসক্ত মন দ্বারা) আত্মানম্ (জীবাত্মাকে) ন অবসাদয়েৎ (সংসারে পাতিত করিবে না) । হি (যেহেতু) আত্মা এব (মনই) আত্মনঃ (জীবের) বন্ধুঃ (বন্ধু) আত্মা এব (মনই) আত্মনঃ (জীবের) রিপুঃ (শত্রু) ॥৫॥


বিষয়ে অনাসক্ত মন দ্বারা জীবাত্মাকে সংসারকূপ হইতে উদ্ধার করিবে, কখনও বিষয়াসক্ত মন দ্বারা জীবাত্মাকে সংসারে পাতিত করিবে না । যেহেতু মনই জীবের বন্ধু এবং অবস্থাভেদে আবার সেই মনই শত্রু হইয়া থাকে ॥৫॥

 

বন্ধুরাত্মাত্মনস্তস্য যেনৈবাত্মাত্মনা জিতঃ ।
অনাত্মনস্তু শত্রুত্বে বর্ত্তেতাত্মৈব শত্রুবৎ ॥৬॥


যেন আত্মনা (যে জীবাত্মা কর্ত্তৃক) আত্মা (মন) জিতঃ (বশীকৃত হইয়াছে) তস্য (সেই) আত্মনঃ (জীবাত্মার) আত্মা এব (মনই) বন্ধুঃ (বন্ধু) ; তু (কিন্তু) অনাত্মনঃ (অজিতমনা ব্যক্তির) আত্মা এব (মনই) শত্রুবৎ (শত্রুর ন্যায়) শত্রুত্বে (অপকারে) বর্ত্তেত (প্রবৃত্ত হয়) ॥৬॥


যে জীব নিজের মনকে জয় করিয়াছেন, তাঁহার সেই মনই বন্ধু অর্থাৎ বন্ধুর মত হিতকারী ; কিন্তু অজিতমনা ব্যক্তির সেই মনই শত্রুর ন্যায় সর্ব্বদা অপকারে প্রবৃত্ত হইয়া থাকে ॥৬॥

 

জিতাত্মনঃ প্রশান্তস্য পরমাত্মা সমাহিতঃ ।
শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু তথা মানাপমানয়োঃ ॥৭॥


শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু (শীত-উষ্ণ ও সুখ দুঃখে) তথা মানাপমানয়োঃ (এবং মান ও অপমানে) প্রশান্তস্য (রাগদ্বেষ রহিত) জিতাত্মনঃ (জিতমনা যোগীর) আত্মা (আত্মা) পরম্ (অতিশয়) সমাহিতঃ (সমাধিস্থ) [ভবেৎ) (হয়) ॥৭॥


শীত-উষ্ণ, সুখ-দুঃখ, এবং মান-অপমান প্রভৃতি বিষয়ে রাগ-দ্বেষ শূন্য এবং বিজিতমনা যোগী ব্যক্তির আত্মা বিশেষভাবে সমাধিস্থ হইয়া থাকে ॥৭॥

 

জ্ঞানবিজ্ঞানতৃপ্তাত্মা কূটস্থো বিজিতেন্দ্রিয়ঃ ।
যুক্ত ইত্যুচ্যতে যোগী সমলোষ্ট্রাশ্মকাঞ্চনঃ ॥৮॥


জ্ঞানবিজ্ঞানতৃপ্তাত্মা (শাস্ত্রীয় জ্ঞান ও অপরোক্ষানুভূতি দ্বারা সন্তুষ্ট চিত্ত) কূটস্থঃ (সর্ব্বকাল এক স্বভাবে অবস্থিত) বিজিতেন্দ্রিয়ঃ (জিতেন্দ্রিয়) সমলোষ্ট্রাশ্মকাঞ্চনঃ (এবং মৃত্তিকা, পাষাণ ও সুবর্ণে তুল্য দৃষ্টি) যোগী (যোগী) যুক্তঃ ইতি (আত্ম দর্শন যোগ্য বলিয়া) উচ্যতে (কথিত হন) ॥৮॥


শাস্ত্রীয় জ্ঞান ও সাক্ষাৎ অনুভূতির দ্বারা সর্ব্বদা সন্তুষ্টচিত্ত, সদা চিৎস্বভাবে স্থিত, জিতেন্দ্রিয় ও মৃৎপিণ্ড প্রস্তর অথবা সুবর্ণে তুল্যদৃষ্টিবিশিষ্ট যোগী ব্যক্তি আত্মদর্শনযোগ্য বলিয়া কথিত হন ॥৮॥

 

সুহৃন্মিত্রার্য্যুদাসীনমধ্যস্থদ্বেষ্যবন্ধুষু ।
সাধুষ্বপি চ পাপেষু সমবুদ্ধির্বিশিষ্যতে ॥৯॥


সুহৃম্মিত্রার্য্যুদাসীনমধ্যস্থদ্বেষ্যবন্ধুষু (স্বভাবতবঃ হিতাশংসী, কোনরূপ স্নেহবশতঃ হিতকারী, শত্রু, বিবাদস্থলে উপেক্ষক, বিবাদ সমাধানেচ্ছু দ্বেষপাত্র, বন্ধু) সাধুষু (সাধু) পাপেষু চ অপি (এবং পাপচারী ব্যাক্তি সমূহের প্রতিও) সমবুদ্ধিঃ (তুল্য বুদ্ধি যোগী) বিশিষ্যতে (লোষ্ট্র, পাষাণ ও সুবর্ণে সমদৃষ্টি সম্পন্ন যোগী অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ) ॥৯॥


স্বভাবতঃ হিতকারী, কোনরূপ স্নেহবশতঃ হিতকামী, শত্রু, উপেক্ষক, বিবাদ সমাধানেচ্ছু, দ্বেষ্য, বন্ধু, সাধু ও পাপাচারী প্রভৃতি সমস্ত জীবের প্রতি সমবুদ্ধিশালী যোগী সমলোষ্ট্রাশ্মকাঞ্চন যোগী অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ বলিয়া জানিবে ॥৯॥

 

যোগী যুঞ্জীত সততমাত্মানং রহসি স্থিতঃ ।
একাকী যতচিত্তাত্মা নিরাশীরপরিগ্রহঃ ॥১০॥


যোগী (যোগে আরোহণকারী ব্যক্তি) সততম্ (নিরন্তর) রহসি (নির্জ্জন স্থানে) একাকী (সঙ্গ রহিত) স্থিতঃ (অবস্থান পূর্ব্বক) যতচিত্তাত্মা (সংযত চিত্ত, সংযত দেহ যুক্ত) নিরাশীঃ (নিস্পৃহ) অপরিগ্রহঃ (এবং বিষয় পরিগ্রহ রহিত হইয়া) আত্মানং (মনকে) যুঞ্জীত (সমাধিযুক্ত করিবেন) ॥১০॥


যোগ সাধন আরম্ভকারী ব্যক্তি নিরন্তর সঙ্গরহিত নির্জ্জন স্থানে অবস্থান পূর্ব্বক চিত্ত ও দেহকে সংযত করিয়া এবং আকাঙ্ক্ষা ও বিষয়পরিগ্রহ শূন্য হইয়া মনকে সমাধিযুক্ত করিবেন ॥১০॥

 

শুচৌ দেশে প্রতিষ্ঠাপ্য স্থিরমাসনমাত্মনঃ ।
নাত্যুচ্ছ্রিতং নাতিনীচং চেলাজিনকুশোত্তরম্ ॥১১॥
তত্রৈকাগ্রং মনঃ কৃত্বা যতচিত্তেন্দ্রিয়ক্রিয়ঃ ।
উপবিশ্যাসনে যুঞ্জ্যাদ্­যোগমাত্মবিশুদ্ধয়ে ॥১২॥


শুচৌ (পবিত্র) দেশে (স্থানে) স্থিরম্ (নিশ্চল) ন অত্যুচ্ছ্রিতং (অতি উচ্চ নয়) ন অতিনীচং (অতি নীচ নয়) চেলাজিনকুশোত্তরম্ (ক্রমান্বয়ে কুশ, মৃগচর্ম্মও বস্ত্র দ্বারা রচিত) আত্মনঃ (নিজের) আসনং (আসন) প্রতিষ্ঠাপ্য (সংস্থাপন পূর্ব্বক) তত্র (সেই আসনে) উপবিশ্য (বসিয়া) যতচিত্তেন্দ্রিয়ক্রিয়ঃ (চিত্ত ও ইন্দ্রিয়গণের ক্রিয়া সংযমন পূর্ব্বক) মনঃ (মনকে) একাগ্রং (একাগ্র) কৃত্বা (করিয়া) আত্মবিশুদ্ধয়ে (ব্রহ্ম সাক্ষাৎকারের যোগ্যতা লাভের জন্য) যোগম্ (সমাধি) যুঞ্জ্যাৎ (অভ্যাস করিবেন) ॥১১–১২॥


পবিত্র স্থানে অতি উচ্চ না হয় এবং অতি নীচও না হয় এরূপ কুশোপরিস্থ মৃগচর্ম্মাদির আসনের উপর বস্ত্রদ্বারা রচিত নিজের নিশ্চল আসন সংস্থাপন পূর্ব্বক সেই আসনে উপবেশন করতঃ চিত্ত ও ইন্দ্রিয়গণের ক্রিয়াকে সংযত করিয়া মনকে একাগ্র করতঃ চিত্তশুদ্ধির জন্য সমাধি অভ্যাস করিবেন ॥১১–১২॥

 

সমং কায়শিরোগ্রীবং ধারয়ন্নচলং স্থিরঃ ।
সংপ্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রং স্বং দিশশ্চানবলোকয়ন্ ॥১৩॥
প্রশান্তাত্মা বিগতভীর্ব্রহ্মচারিব্রতে স্থিতঃ ।
মনঃ সংযম্য মচ্চিত্তো যুক্ত আসীত মৎপরঃ ॥১৪॥


কায়শিরোগ্রীবং (শরীর, মস্তকও গলদেশ) সমং (সরল) অচলং (ও নিশ্চলভাবে) ধারয়ন্ (রাখিয়া) স্থিরঃ [সন্] (স্থির হইয়া) স্বং (নিজ) নাসিকাগ্রং (নাসিকার অগ্রভাগ) সংপ্রেক্ষ্য (দর্শন করিয়া অর্থাৎ চক্ষুর্দ্বয়ের মধ্যে দৃষ্টি স্থাপন পূর্ব্বক) দিশঃ চ (ও দিক্ সমূহে) অনবলোকয়ন্ (দৃষ্টি নিক্ষেপ না করিয়া) প্রশান্তাত্মা (অক্ষুব্ধ মন), বিগতভীঃ (নির্ভয়), ব্রহ্মচারিব্রতে স্থিতঃ (ব্রহ্মচর্য্যপরায়ণ) মনঃ সংযম্য (ও মন সংযমন পূর্ব্বক) মচ্চিত্তঃ (চতুর্ভুজ সুন্দরাকৃতি আমাকে চিন্তা করিতে করিতে) মৎপরঃ (আমার প্রতি ভক্তি পরায়ণ) যুক্তঃ (যোগী) আসীত (অবস্থান করিবেন) ॥১৩–১৪॥


দেহ-মধ্যভাগ, মস্তক ও গলদেশকে সরল ও নিশ্চলভাবে রাখিয়া স্থির হইয়া নিজের নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি স্থাপন পূর্ব্বক অন্য কোনও দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করিয়া অক্ষুব্ধ মন, ভয় শূন্য ও ব্রহ্মচর্য্য ব্রতধারী যোগী পুরুষ মনকে সমস্ত জড়ীয় বিষয় হইতে সংযমন পূর্ব্বক চতুর্ভুজ স্বরূপ আমার বিষ্ণুমূর্ত্তি চিন্তা করতঃ আমার প্রতি ভক্তিপরায়ণ হইয়া যোগ অভ্যাস করিবেন ॥১৩–১৪॥

 

যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী নিয়তমানসঃ ।
শান্তিং নির্ব্বাণপরমাং মৎসংস্থামধিগচ্ছতি ॥১৫॥


এবং (উক্ত প্রকারে) সদা (সর্ব্বদা) আত্মানং (মনকে) যুঞ্জন্ (ধ্যান যোগযুক্ত করিয়া) নিয়তমানসঃ (বিষয় নিবৃত্ত চিত্ত) যোগী (যোগী) মৎসংস্থাম্ (আমার জ্যোতিঃ স্বরূপ নির্ব্বিশেষ ব্রহ্মগতা) নির্ব্বাণপরমাং (নির্ব্বাণ প্রধান) শান্তিং (সংসার উপরিত [নাশ] রূপ মুক্তি) অধিগচ্ছতি (প্রাপ্ত হন) ॥১৫॥


এইরূপে সর্ব্বদা মনকে ধ্যানযোগ নিরত করিয়া বিষয়াভিলাষ-নিবৃত্ত-চিত্ত যোগী আমার জ্যোতিঃ স্বরূপ নির্ব্বিশেষ ব্রহ্মগতা যে নির্ব্বাণ মুক্তি বা সংসার নাশরূপ মোক্ষ, তাহা প্রাপ্ত হন ॥১৫॥

 

নাত্যশ্নতস্তু যোগোঽস্তি ন চৈকান্তমনশ্নতঃ ।
ন চাতিস্বপ্নশীলস্য জাগ্রতো নৈব চার্জ্জুন ॥১৬॥


[হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন ! ) অতি অশ্নতঃ তু (অতি ভোজনকারীর) যোগঃ (যোগ অর্থাৎ সমাধি) ন অস্তি (হয় না), একান্তম্ (নিতান্ত) অনশ্নতঃ (অনাহারীর ও) ন চ (হয় না), অতিস্বপ্নশীলস্য (অত্যন্ত নিদ্রালুরও) ন চ (হয় না) জাগ্রতঃ এব ন চ (জাগরণকারীর ও যোগ-সাধন হয় না) ॥১৬॥


হে অর্জ্জুন! অধিক ভোজনকারী বা নিতান্ত অনাহারী, অধিক নিদ্রাপ্রিয় বা নিতান্ত নিদ্রাশূন্য ইঁহাদের মধ্যে কাহারও যোগ-সাধন সম্ভব হয় না ॥১৬॥

 

যুক্তাহারবিহারস্য যুক্তচেষ্টস্য কর্ম্মসু ।
যুক্তস্বপ্নাববোধস্য যোগো ভবতি দুঃখহা ॥১৭॥


যুক্তাহারবিহারস্য (নিয়মিত আহার ও বিহারকারী) কর্ম্মসু (কর্ম্ম সমূহে) যুক্তচেষ্টস্য (নিয়মিত চেষ্টা বিশিষ্ট) যুক্তস্বপ্নাববোধস্য (পরিমিত নিদ্রা ও জাগরণকারী ব্যক্তির) দুঃখহা (দুঃখহরণে যোগ্য) যোগঃ (যোগ) ভবতি (হয়) ॥১৭॥


নিয়মিত ভাবে আহার, নিয়মিত ভাবে বিহার, কর্ম্ম সকলে নিয়মিত চেষ্টাযুক্ত, পরিমিত নিদ্রা ও পরিমিত জাগরণকারী ব্যক্তিদিগেরই ক্রমশঃ চেষ্টা দ্বারা জড়-দুঃখ-নাশী যোগ সম্ভব হইয়া থাকে ॥১৭॥

 

যদা বিনিয়তং চিত্তমাত্মন্যেবাবতিষ্ঠতে ।
নিস্পৃহঃ সর্ব্বকামেভ্যো যুক্ত ইত্যুচ্যতে তদা ॥১৮॥


যদা (যখন) বিনিয়তং (নিরুদ্ধ) চিত্তম্ (চিত্ত) আত্মনি এব (আত্মাতেই) অবতিষ্ঠতে (অবস্থান করে) তদা (তখন) সর্ব্বকামেভ্যঃ (সমস্ত কামনা হইতে) নিস্পৃহঃ (বিরত ব্যক্তি) যুক্তঃ ইতি (যোগযুক্ত বলিয়া) উচ্যতে (কথিত হন) ॥১৮॥


যখন যোগীর চিত্তবৃত্তির বহির্ম্মখতা নিরুদ্ধ হইয়া কেবল আত্মতত্ত্বেই নিশ্চল ভাবে অবস্থান করে, তখন সমস্ত জড় কামনা শূন্য সেই ব্যক্তি যোগযুক্ত বলিয়া কথিত হইয়া থাকেন ॥১৮॥

 

যথা দীপো নিবাতস্থো নেঙ্গতে সোপমা স্মৃতা ।
যোগিনো যতচিত্তস্য যুঞ্জতো যোগমাত্মনঃ ॥১৯॥


যথা (যেরূপ) নিবাতস্থঃ (বায়ু শূন্য স্থানে অবস্থিত) দীপঃ (প্রদীপশিখা) ন ইঙ্গতে (বিচলিত হয় না) আত্মনঃ (আত্ম বিষয়ক) যোগম্ (যোগ) যুঞ্জুতঃ (অভ্যাসকারী) যতচিত্তস্য (একাগ্রচিত্ত) যোগিনঃ (যোগীর) সা (সেই) উপমা (দৃষ্টান্ত) স্মৃতা (কথিত হয়) ॥১৯॥


যেরূপ বায়ু শূন্য স্থানে অবস্থিত প্রদীপ (শিখা) কোন প্রকারে বিচলিত হয় না, আত্মতত্ত্বনিবিষ্ট একাগ্রচিত্ত যোগীর চিত্তের দৃষ্টান্ত সেইরূপ জানিবে ॥১৯॥

 

যত্রোপরমতে চিত্তং নিরুদ্ধং যোগসেবয়া ।
যত্র চৈবাত্মনাত্মানং পশ্যন্নাত্মনি তুষ্যতি ॥২০॥
সুখমাত্যন্তিকং যত্তদ্­বুদ্ধিগ্রাহ্যমতীন্দ্রিয়ম্ ।
বেত্তি যত্র ন চৈবায়ং স্থিতশ্চলতি তত্ত্বতঃ ॥২১॥
যং লব্ধ্বা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ ।
যস্মিন্ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে ॥২২॥
তং বিদ্যাদ্­দুঃখসংযোগবিয়োগং যোগসংজ্ঞিতম্ ।
স নিশ্চয়েন যোক্তব্যো যোগোঽনির্ব্বিণ্ণচেতসা ॥২৩॥


যত্র (যে সমাধি হইলে) যোগসেবয়া (যোগের অভ্যাস দ্বারা) নিরুদ্ধং (নিরোধ প্রাপ্ত) চিত্তং (চিত্ত) উপরমতে (জড়সম্বন্ধ হইতে উপশম প্রাপ্ত হয়), যত্র চ (এবং যে সমাধিতে) আত্মনা (পরমাত্মাকার অন্তঃকরণ দ্বারা) আত্মানং (পরমাত্মাকে) পশ্যন্ (দেখিয়া) আত্মনি (তাঁহাতেই) তুষ্যতি (তুষ্ট হন) । যত্র (যে সমাধি হইলে) অয়ং (এই যোগী) বুদ্ধিগ্রাহ্যম্ (আত্মাকার বুদ্ধি দ্বারা গ্রহণীয়) অতীন্দ্রিয়ম্ (বিষয়েন্দ্রিয় সম্পর্ক রহিত) আত্যন্তিকং (নিত্য) যৎ সুখম্ (যে সুখ) তৎ বেত্তি (তাহা অনুভব করেন), [যত্র] চ (এবং যে সমাধিতে) স্থিতঃ [সন্] (অবস্থিত হইয়া) তত্ত্বতঃ (আত্ম স্বরূপ হইতে) ন চলতি (বিচলিত হন না) । যং লব্ধা (যাহাকে লাভ করিলে) অপরং লাভং (অন্য লাভকে) ততঃ (তাহা হইতে) অধিকং (অধিক) ন মন্যতে (মনে করেন না), যস্মিন্ চ (এবং যাহাতে) স্থিতঃ [সন্] (অবস্থিত হইয়া) গুরুণা (গুরুতর) দুঃখেন অপি (দুঃখ দ্বারাও) ন বিচাল্যতে (বিচলিত হন না) । দুঃখসংযোগবিয়োগং (যাহাতে দুঃখের সংযোগ হইবামাত্র বিয়োগ হয়) তং (তাহাকে) যোগসংজ্ঞিতম্ (যোগসংজ্ঞা প্রাপ্ত সমাধি বলিয়া) বিদ্যাৎ (জানিবে) ; অনির্ব্বিণ্ণচেতসা (অবসাদশূন্যচিত্তে) সঃ যোগঃ (সেই যোগ) নিশ্চয়েন (অধ্যবসায় সহকারে) যোক্তব্যঃ (অভ্যাস করা কর্ত্তব্য) ॥২০–২৩॥


যে সমাধিতে, যোগের অভ্যাস দ্বারা নিরুদ্ধ চিত্ত জড়পদার্থ মাত্রের চিন্তা হইতে বিরতি লাভ করে, এবং যাহাতে পরমাত্মার সহিত মিলনযোগ্য চিত্ত দ্বারা পরমাত্মাকে দেখিয়া তাঁহাতেই পরিতুষ্ট থাকেন ; যে সমাধি হইলে এই যোগী আত্মাকার বুদ্ধি দ্বারা গ্রহণীয়, বিষয় ও ইন্দ্রিয়ের সম্পর্কশূন্য, নিত্য যে সুখ, তাহা অনুভব করেন ; এবং যাহাতে অবস্থিত হইয়া আত্মস্বরূপ হইতে বিচলিত হন না ; যাহাকে (যে সমাধিকে) লাভ করিলে অন্য জড়সম্বন্ধীয় কোনও লাভকে তাহা হইতে অধিক মনে করেন না, এবং যাহাতে অবস্থিত হইয়া দুঃসহ দুঃখ দ্বারাও চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে না ; অতএব যাহাতে দুঃখের সংযোগ মাত্রই বিয়োগ সাধিত হইয়া থাকে, তাহাকেই ‘যোগ’ সংজ্ঞাপ্রাপ্ত সমাধি বলিয়া জানিবে । অবসাদশূন্য চিত্তে দৃঢ়তা সহকারে সেই যোগ সাধন করা কর্ত্তব্য ॥২০–২৩॥

 

সঙ্কল্পপ্রভবান্ কামাংস্ত্যক্ত্বা সর্ব্বানশেষতঃ ।
মনসৈবেন্দ্রিয়গ্রামং বিনিয়ম্য সমন্ততঃ ॥২৪॥


সঙ্কল্পপ্রভবান্ (সঙ্কল্প হইতে জাত) সর্ব্বান্ কামান্ (সমস্ত বিষয়কামনাকে) অশেষতঃ (বাসনার সহিত সম্পূর্ণ রূপে) ত্যক্ত্বা (ত্যাগ করিয়া) মনসা এব (বিষয় দোষদর্শি মনের দ্বারাই) সমন্ততঃ (সর্ব্ব বিষয় হইতে) ইন্দ্রিয়গ্রামং (ইন্দ্রিয় সমূহকে) বিনিয়ম্য (নিবৃত্ত করিয়া) [যোক্তব্যঃ] (সেই যোগ অভ্যাস করিবে) ॥২৪॥


সঙ্কল্প হইতে জাত সমস্ত বিষয়-কামনাকে বাসনার সহিত নিঃশেষভাবে পরিত্যাগ করিয়া, বিষয় বাসনার দোষ-দর্শনকারী মনের দ্বারাই সমস্ত বিষয় হইতে ইন্দ্রিয়সমূহকে নিবৃত্ত করিয়া সেই পূর্ব্বোক্ত যোগ অভ্যাস করিবে ॥২৪॥

 

শনৈঃ শনৈরুপরমেদ্­বুদ্ধ্যা ধৃতিগৃহীতয়া ।
আত্মসংস্থং মনঃ কৃত্বা ন কিঞ্চিদপি চিন্তয়েৎ ॥২৫॥


ধৃতি গৃহীতয়া (ধারণা দ্বারা বশীকৃত) বুদ্ধ্যা (বুদ্ধি দ্বারা) মনঃ (মনকে) আত্মসংস্থং কৃত্বা (আত্মাতে সম্যক্ নিশ্চল করিয়া) শনৈঃ শনৈঃ (ধীরে ধীরে অভ্যাস ক্রমে) উপরমেৎ (বহির্বিষয় হইতে নিবৃত্ত করতঃ সমাধিতে অবস্থান করিবে) কিঞ্চিৎ অপি (অন্য কিছুই) ন চিন্তয়েৎ (চিন্তা করিবে না) ॥২৫॥


ধারণা (যোগাঙ্গ বিশেষ) দ্বারা বশীভূত বুদ্ধির সাহায্যে মনকে আত্মাতে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চল করিয়া ধীরে ধীরে অভ্যাসক্রমে তাহাকে বাহ্য বিষয় হইতে নিবৃত্ত করতঃ সমাধিতে অবস্থান করিবে এবং কিছুমাত্রও চিন্তা করিবে না ॥২৫॥

 

যতো যতো নিশ্চলতি মনশ্চঞ্চলমস্থিরম্ ।
ততস্ততো নিয়ম্যৈতদাত্মন্যেব বশং নয়েৎ ॥২৬॥


চঞ্চলম্ (চঞ্চল) অস্থিরম্ (সুতরাং অস্থির) মনঃ (মন) যতঃ যতঃ (যে যে বিষয়ে) নিশ্চলতি (ধাবিত হয়), ততঃ ততঃ (সেই সেই বিষয় হইতে) এতৎ (এই মনকে) নিয়ম্য (প্রত্যাহার করিয়া) আত্মনি এব (আত্মাতেই) বশং নয়েৎ (বশীভূত করিবে) ॥২৬॥


স্বভাবতঃ চঞ্চল ও অস্থির মন, যে যে বিষয়ের প্রতি ধাবিত হইবে, সেই সেই বিষয় হইতেই যত্নপূর্ব্বক নিবৃত্ত করিয়া তাহাকে আত্মবশীভূত করিতে হইবে ॥২৬॥

 

প্রশান্তমনসং হ্যেনং যোগিনং সুখমুত্তমম্ ।
উপৈতি শান্তরজসং ব্রহ্মভূতমকল্মষম্ ॥২৭॥


শান্তরজসং (রজোগুণের বৃত্তি-নিবৃত্ত) প্রশান্তমনসং (প্রশান্তচিত্ত) অকল্মষম্ (রাগাদিদোষ শূন্য) ব্রহ্মভূতম্ (ও ব্রহ্মভাব সম্পন্ন) এনং (এই) যোগিনং হি (যোগীকেই) উত্তমম্ সুখম্ (আত্মানুভবরূপ মহৎ সুখ) উপৈতি (স্বয়ং বরণ করেন) ॥২৭॥


রজোগুণের ক্রিয়াশূন্য, প্রশান্তচিত্ত, রাগাদিদোষ বর্জ্জিত ও ব্রহ্মভাব সম্পন্ন এই যোগীকে আত্মার স্বরূপ উপলব্ধিরূপ উত্তম সুখ স্বয়ংই আশ্রয় করে ॥২৭॥

 

যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী বিগতকল্মষঃ ।
সুখেন ব্রহ্মসংস্পর্শমত্যন্তং সুখমশ্নুতে ॥২৮॥


এবং (এইরূপে) আত্মানং (স্ব স্বরূপকে) সদা (সর্ব্বদা) যুঞ্জন্ (যোগের দ্বারা অনুভব করতঃ) বিগতকল্মষঃ (সর্ব্বদোষ শূন্য) যোগী (যোগী) সুখেন (অনায়াসে) ব্রহ্মসংস্পর্শম্ (পরমাত্মার অনুভব রূপ) অত্যন্তং সুখম্ (অপরিমিত সুখ) অশ্নুতে (প্রাপ্ত হন অর্থাৎ জীবন্মুক্ত হন) ॥২৮॥


এই প্রকার সর্ব্বদা আত্ম-স্বরূপে যোগানুভব দ্বারা বিগতকল্মষ যোগী অনায়াসে পরমাত্মানুভবরূপ প্রগাঢ় সুখ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন । (ইহাকেই ভক্তি সম্মত যোগ বলা হয়) ॥২৮॥

 

সর্ব্বভূতস্থমাত্মানং সর্ব্বভূতানি চাত্মনি ।
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্ব্বত্র সমদর্শনঃ ॥২৯॥


যোগযুক্তাত্মা (ব্রহ্মের সহিত যুক্ত অর্থাৎ তাদাত্ম্য প্রাপ্ত অন্তঃকরণ) সর্ব্বত্র সমদর্শনঃ (সর্ব্ব জীবে চেতন দর্শনকারী সেই যোগী) আত্মানং (পরমাত্মাকে) সর্ব্বভূতস্থম্ (সর্ব্বভূতে অবস্থিত) সর্ব্বভূতানি চ (এবং ভূত সমুদয়কে) আত্মনি (পরমাত্মাতে) [স্থিতঃ] (অবস্থিত) ঈক্ষতে (দর্শন করেন) ॥২৯॥


বৃহচ্চেতনের সহিত একীভূত চিত্ত ও সর্ব্বজীবে চেতন সন্দর্শনকারী সেই যোগীপুরুষ, পরমাত্মাকে সর্ব্বভূতে অবস্থিত, এবং ভূত সকলকেও পরমাত্মাতে অবস্থিত দর্শন করিয়া থাকেন ॥২৯॥

 

যো মাং পশ্যতি সর্ব্বত্র সর্ব্বঞ্চ ময়ি পশ্যতি ।
তস্যাহং ন প্রণশ্যমি স চ মে ন প্রণশ্যতি ॥৩০॥


যঃ (যিনি) মাং (আমাকে) সর্ব্বত্র (সকল পদার্থে) পশ্যতি (দর্শন করেন), সর্ব্বং চ (এবং সমস্ত প্রপঞ্চ) ময়ি (আমাতে) পশ্যতি (দর্শন করেন) ; অহং (আমি) তস্য (তাঁহার নিকট) ন প্রণশ্যামি (অদৃশ্য হই না) স চ (তিনিও) মে (আমার) ন প্রণশ্যতি (অদৃশ্য হন না অর্থাৎ আমার চিন্তা হইতে কখনও ভ্রষ্ট হন না) ॥৩০॥


যে ব্যক্তি আমাকে সমুদয় পদার্থে দর্শন করেন, এবং আমাতেই সকল প্রপঞ্চ (বস্তু) দেখেন, আমি তাঁহার নিকট অদৃশ্য থাকি না, এবং তিনিও আমার অদৃশ্য হন না অর্থাৎ আমার চিন্তা হইতে কখনও ভ্রষ্ট হন না ॥৩০॥

 

সর্ব্বভূতস্থিতং যো মাং ভজত্যেকত্বমাস্থিতঃ ।
সর্ব্বথা বর্ত্তমানোঽপি স যোগী ময়ি বর্ত্ততে ॥৩১॥


যঃ (যে যোগী) সর্ব্বভূতস্থিতং (সর্ব্ব জীবের হৃদয়ে প্রাদেশ পরিমিত চতুর্ভুজ রূপে পৃথক্ পৃথক্ অবস্থিত) মাং (আমাকে) একত্বম্ (অভিন্ন রূপে) আস্থিতঃ (আশ্রয় পূর্ব্বক) ভজতি (শ্রবণ স্মরণাদি দ্বারা ভজন করেন) সঃ যোগী (সেই যোগী) সর্ব্বথা (সর্ব্ব প্রকারে অর্থাৎ শাস্ত্রোক্ত কর্ম্মানুষ্ঠান করিয়া বা না করিয়া) বর্ত্তমানঃ অপি (অবস্থিত থাকিয়াও) ময়ি [এব] (আমাতেই) বর্ত্ততে (অবস্থিতি করেন) ॥৩১॥


যে যোগী সকল জীবের হৃদয়ে প্রাদেশ প্রমাণ চতুর্ভুজাকার পৃথক্ পৃথক্ অবস্থিত আমাকে অভিন্নরূপে আশ্রয়পূর্ব্বক শ্রবণ, কীর্ত্তন ও স্মরণাদি দ্বারা ভজন করেন, সেই যোগী শাস্ত্রোক্ত কর্ম্মানুষ্ঠান করুন বা না করুন সর্ব্বদা তিনি আমাতেই বর্ত্তমান থাকেন ॥৩১॥

 

আত্মৌপম্যেন সর্ব্বত্র সমং পশ্যতি যোঽর্জ্জুন ।
সুখং বা যদি বা দুঃখং স যোগী পরমো মতঃ ॥৩২॥


[হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন !) যঃ (যে যোগী) আত্মৌপম্যেন (নিজের সাদৃশ্যে) সর্ব্বত্র (সর্ব্বভূতের) সুখং বা যদি বা দুঃখং (সুখ অথবা দুঃখকে) সমং (আপনার [সুখ-দুঃখের] সহিত সমানভাবে) পশ্যতি (দেখেন) সঃ যোগী (সেই যোগী) পরমঃ (সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া) মতঃ (আমার অভিমত) ॥৩২॥


হে অর্জ্জুন! যে যোগী পুরুষ নিজের তুলনায় সমস্ত জীবের সুখ অথবা দুঃখকে সমান দেখেন, অর্থাৎ অন্য জীবের সুখকে নিজ সুখের ন্যায় সুখকর এবং তার দুঃখকেও নিজ দুঃখের ন্যায় দুঃখজনক বলিয়া জানেন, সেই যোগী সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া আমার অভিমত ॥৩২॥

 

অর্জ্জুন উবাচ—
যোঽয়ং যোগস্ত্বয়া প্রোক্তঃ সাম্যেন মধুসূদন ।
এতস্যাহং ন পশ্যামি চঞ্চলত্বাৎ স্থিতিং স্থিরাম্ ॥৩৩॥


অর্জ্জুনঃ উবাচ (অর্জ্জুন বলিলেন) [হে] মধুসূদন ! (হে মধুসূদন !) ত্বয়া (আপনা কর্ত্তৃক) সাম্যেন (স্ব-পর সুখ-দুঃখের সম দর্শন রূপ) অয়ং (এই) যঃ যোগঃ (যে যোগ) প্রোক্তঃ (কথিত হইল), [মনসঃ] (মনের) চঞ্চলত্বাৎ (চাঞ্চল্য বশতঃ) অহং (আমি) এতস্য (এই যোগের) স্থিরাম্ (নিত্য) স্থিতিং (স্থিতি) ন পশ্যামি (দেখিতেছি না) ॥৩৩॥


অর্জ্জুন কহিলেন—হে মধুসূদন ! আপনি নিজের ও পরের সুখ ও দুঃখকে সমদর্শনরূপ এই যে যোগের কথা বলিলেন, মনের চঞ্চলতা বশতঃ আমি এই যোগের নিত্যস্থায়িত্ব দেখিতে পাইতেছি না ॥৩৩॥

 

চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্দৃঢ়ম্ ।
তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্ ॥৩৪॥


[হে] কৃষ্ণ ! (হে কৃষ্ণ !) মনঃ (মন) চঞ্চলং হি (স্বভাবতঃ চঞ্চল), প্রমাথি (বুদ্ধি, শরীর ও ইন্দ্রিয়ের বিক্ষেপ জনক), বলবৎ (বিচার বুদ্ধি দ্বারাও অনিয়ম্য) দৃঢ়ম্ (ও দুর্ভেদ্য) । [অতঃ](অতএব) অহং (আমি) তস্য (তাহার অর্থাৎ মনের) নিগ্রহং (নিরোধ) বায়োঃ ইব (আকাশস্থ বায়ু নিরোধের ন্যায়) সুদুষ্করম্ (অত্যন্ত কঠিন) মন্যে (মনে করি) ॥৩৪॥


হে কৃষ্ণ ! মন স্বভাবতঃই চঞ্চল, বিবেকবতী বুদ্ধি, শরীর ও ইন্দ্রিয়গণের ক্ষোভকর, অজেয় ও অতিশয় দৃঢ় । সুতরাং আকাশস্থ বায়ুকে যেমন কুম্ভকাদি দ্বারা নিরোধ করা যায় না, সেরূপ অষ্টাঙ্গ যোগের দ্বারা সেই চঞ্চল মনের নিরোধও আমি অত্যন্ত কঠিন মনে করি ॥৩৪॥

 

শ্রীভগবান্ উবাচ—
অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্ ।
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেন চ গৃহ্যতে ॥৩৫॥


শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ কহিলেন) [হে] মহাবাহো ! (হে মহাবীর অর্জ্জুন !) মনঃ (মন) দুর্নিগ্রহং (দুঃখে নিগৃহীত হয়) চলম্ (ও চঞ্চল) [ইত্যত্র] (এ বিষয়ে) অসংশয়ম্ (সন্দেহ নাই), তু (কিন্তু) [হে] কৌন্তেয় ! (হে কুন্তীনন্দন !) অভ্যাসেন (সদ্­গুরূপদিষ্ট প্রকারে পরমেশ্বর ধ্যানযোগের পুনঃ পুনঃ অনুশীলন) বৈরাগ্যেন চ (এবং বিষয় বৈরাগ্যের দ্বারা) গৃহ্যতে (বশীকৃত হয়) ॥৩৫॥


শ্রীভগবান্ কহিলেন—হে মহাবীর অর্জ্জুন ! মন অতি কষ্টে নিগৃহীত হয় ও চঞ্চল এবিষয়ে সংশয় নাই ; কিন্তু হে কুন্তীপুত্ত্র ! সদ্­গুরুর উপদেশ মত পরমেশ্বরের ধ্যানযোগের পুনঃ পুনঃ অভ্যাস এবং বিষয়ের প্রতি বৈরাগ্যের দ্বারা সেই মনকে বশীভূত করা যায় ॥৩৫॥

 

অসংযতাত্মনা যোগো দুষ্প্রাপ ইতি মে মতিঃ ।
বশ্যাত্মনা তু যততা শক্যোঽবাপ্তুমুপায়তঃ ॥৩৬॥


অসংযতাত্মনা (অসংযত চিত্ত কর্ত্তৃক) যোগঃ (চিত্তবৃত্তি নিরোধ রূপ যোগ) দুষ্প্রাপঃ (দুর্ল্লভ) ইতি (ইহাই) মে (আমার) মতিঃ (বিচার) । তু (কিন্তু) যততা (যত্নশীল) বশ্যাত্মনা (ও সংযত চিত্ত ব্যক্তি) উপায়তঃ (সাধনা দ্বারা) অবাপ্তুম্ শক্যঃ (ইহাকে লাভ করিতে সমর্থ হন) ॥৩৬॥


অসংযতচিত্ত ব্যক্তির পক্ষে পূর্ব্বোক্ত চিত্তবৃত্তি নিরোধরূপ যোগ, দুষ্প্রাপ্য বলিয়াই আমার বিচার ; কিন্তু যিনি যথার্থ উপায় অবলম্বন পূর্ব্বক মনকে বশীভূত করিতে যত্নশীল হন, তিনি অবশ্যই যোগসিদ্ধ হইয়া থাকেন ॥৩৬॥

 

অর্জ্জুন উবাচ—
অযতিঃ শ্রদ্ধয়োপেতো যোগাচ্চলিতমানসঃ ।
অপ্রাপ্য যোগসংসিদ্ধিং কাং গতিং কৃষ্ণ গচ্ছতি ॥৩৭॥


অর্জ্জুনঃ উবাচ (অর্জ্জুন কহিলেন) [হে] কৃষ্ণ ! (হে কৃষ্ণ !) শ্রদ্ধয়া উপেতঃ (যোগশাস্ত্রে বিশ্বাস বশতঃ যোগাভ্যাসে প্রবৃত্ত) অযতিঃ (অথচ অল্প যত্ন পুরুষ) যোগাৎ চলিতমানসঃ (অভ্যাস ও বৈরাগ্যের অভাবে যোগ হইতে ভ্রষ্ট চিত্ত হইয়া) যোগসংসিদ্ধিং (যোগের সম্যক্ ফল) অপ্রাপ্য (না পাইয়া) কাং গতিং (কি গতি) গচ্ছতি (লাভ করেন ?) ॥৩৭॥


অর্জ্জুন বলিলেন—হে কৃষ্ণ ! যোগশাস্ত্রে বিশ্বাস হেতু যোগাভ্যাসে প্রবৃত্ত হইয়া অল্পযত্নশীল ব্যক্তি, অভ্যাস ও বৈরাগ্যের অভাবে যোগ হইতে বিষয়-প্রবণতা বশতঃ বিচলিত হইয়া নিশ্চয়ই যোগফল প্রাপ্ত হন না মনে করি, তখন তাঁহার কি গতি লাভ হয় ? ॥৩৭॥

 

কচ্চিন্নোভয়বিভ্রষ্টশ্ছিন্নাভ্রমিব নশ্যতি ।
অপ্রতিষ্ঠো মহাবাহো বিমূঢ়ো ব্রহ্মণঃ পথি ॥৩৮॥


[হে] মহাবাহো ! (হে মহাবীর !) ব্রহ্মণঃ পথি (ব্রহ্ম প্রাপ্তির উপায় রূপ পথে) বিমূঢ়ঃ (বিমূঢ়) অপ্রতিষ্ঠঃ (নিরাশ্রয়) উভয়বিভ্রষ্টঃ (কর্ম্মমার্গ ও যোগমার্গ উভয় হইতে বিচ্যুত) [সন্] (হইয়া) ছিন্নাভ্রম্ ইব (খণ্ডিত মেঘের ন্যায়) কচ্চিৎ (কি) [সঃ] (সেই ব্যক্তি) ন নশ্যতি (নষ্ট হয় না ?) ॥৩৮॥


হে মহাবাহো ! ব্রহ্মপ্রাপ্তির উপায়রূপ যোগ সাধন পথে ভ্রষ্ট এই ব্যক্তি নিরাশ্রয় এবং কর্ম্মমার্গ ও যোগমার্গ উভয় হইতে বিচ্যুত হইয়া ছিন্নভিন্ন মেঘের ন্যায় নষ্ট হয় না কি ? ॥৩৮॥

 

এতম্মে সংশয়ং কৃষ্ণ ছেত্তুমর্হস্যশেষতঃ ।
ত্বদন্যঃ সংশয়স্যাস্য ছেত্তা ন হ্যুপপদ্যতে ॥৩৯॥


[হে] কৃষ্ণ ! (হে কৃষ্ণ !) মে (আমার) এতৎ সংশয়ং (এই সন্দেহ) অশেষতঃ (সম্পূর্ণরূপে) ছেত্তুম্ (ছেদন করিতে) [ত্বং] (তুমি) অর্হসি (সমর্থ) । ত্বদন্যঃ (তুমি ভিন্ন) অস্য (এই) সংশয়স্য (সংশয়ের) ছেত্তা (ছেদনকারী) ন হি উপপদ্যতে (আর মিলিবে না) ॥৩৯॥


হে কৃষ্ণ ! আমার এই সংশয় সর্ব্বতোভাবে ছেদন (দূর) করিতে আপনি ভিন্ন অপর কেহ সমর্থ হইবে না । অতএব কৃপাপূর্ব্বক আপনি আমার এই সংশয়টী সম্পূর্ণরূপে ছেদন করুন ॥৩৯॥

 

শ্রীভগবান্ উবাচ—
পার্থ নৈবেহ নামুত্র বিনাশস্তস্য বিদ্যতে ।
ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিদ্­দুর্গতিং তাত গচ্ছতি ॥৪০॥


শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ কহিলেন) [হে] পার্থ ! (হে কুন্তীনন্দন !) তস্য (তাহার) ইহ এব (এই প্রাকৃত লোকে) বিনাশঃ (স্বর্গাদিসুখভ্রংশরূপ বিনাশ) ন বিদ্যতে (নাই) অমুত্র (পরলোকে অর্থাৎ অপ্রাকৃত লোকে) [বিনাশঃ] (পরমাত্মদর্শনভ্রংশরূপ বিনাশ) ন (নাই) । [হে] তাত ! (হে বৎস !) হি (যেহেতু) কল্যাণকৃৎ (শুভ-কার্য্যানুষ্ঠানকারী) কশ্চিৎ (কোন ব্যক্তিই) দুর্গতিং (দুর্গতি) ন গচ্ছতি (প্রাপ্ত হন না) ॥৪০॥


শ্রীভগবান্ কহিলেন—হে কুন্তীনন্দন অর্জ্জুন ! যোগভ্রষ্ট সেই ব্যক্তির এই প্রাকৃত লোকে স্বর্গাদি সুখ হইতে ভ্রংশরূপ বিনাশ নাই, অথবা পরলোকে অর্থাৎ অপ্রাকৃত লোকেও তাহার পরমাত্মদর্শন হইতে ভ্রংশরূপ বিনাশ নাই । হে বৎস ! যেহেতু শুভ-কর্ম্মানুষ্ঠানকারী কোন ব্যক্তিই দুর্গতিপ্রাপ্ত হন না ॥৪০॥

 

প্রাপ্য পুণ্যকৃতাং লোকানুষিত্বা শাশ্বতীঃ সমাঃ ।
শুচীনাং শ্রীমতাং গেহে যোগভ্রষ্টোঽভিজায়তে ॥৪১॥


যোগভ্রষ্টঃ (যোগ হইতে বিচ্যুত পুরুষ) পুণ্যকৃতাং (পুণ্যকারিগণের) লোকান্ (লোক সমূহ) প্রাপ্য (লাভ করিয়া) শাশ্বতীঃ সমা (বহু বর্ষ) [তত্র] (তথায়) উষিত্বা (বাস করিয়া) শুচীনাং (সদাচার পরায়ণ পবিত্র) শ্রীমতাং (ধনিগণের) গেহে (গৃহে) অভিজায়তে (জন্ম গ্রহণ করেন) ॥৪১॥


যোগ হইতে বিচ্যুত সেই ব্যক্তি অশ্বমেধাদি যজ্ঞকারিগণের প্রাপ্য স্বর্গাদি লোকসমূহ লাভ করিয়া বহু বর্ষকাল সেইসব লোকে বাস করতঃ সদাচার পরায়ণ পবিত্র ধনিগণের গৃহে জন্মগ্রহণ করিয়া থাকেন ॥৪১॥

 

অথবা যোগিনামেব কুলে ভবতি ধীমতাম্ ।
এতদ্ধি দুর্ল্লভতরং লোকে জন্ম যদীদৃশম্ ॥৪২॥


অথবা (অথবা) যোগিনাম্ (যোগাভ্যাস নিরত) ধীমতাম্ এব (যোগের উপদেশকারিগণেরই) কুলে (বংশে) ভবতি (জন্মগ্রহণ করেন) । ঈদৃশম্ (এইরূপ) যৎ জন্ম (যে জন্ম) এতৎ হি (ইহা কিন্তু) লোকে (জগতে) দুর্ল্লভতরং (অতি দুর্ল্লভ) ॥৪২॥


অথবা দীর্ঘকাল যোগাভ্যাসের পর যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি যোগাভ্যাস নিরত যোগের উপদেশকারিগণেরই গৃহে বা বংশে জন্মগ্রহণ করেন । এইরূপ স্থানে জন্মলাভ করা দুর্ল্লভতর বলিয়া জানিবে ॥৪২॥

 

তত্র তং বুদ্ধিসংযোগং লভতে পৌর্ব্বদৈহিকম্ ।
যততে চ ততো ভূয়ঃ সংসিদ্ধৌ কুরুনন্দন ॥৪৩॥


[হে] কুরুনন্দন ! (হে কুরুনন্দন অর্জ্জুন !) [সঃ] (সেই যোগভ্রষ্ট পুরুষ) তত্র (উক্ত দুই প্রকার জন্মেই) পৌর্ব্বদৈহিকম্ (পূর্ব্বজন্ম কৃত) তং (সেই) বুদ্ধিসংযোগং (পরমাত্মবিষয়িণী বুদ্ধির সহিত সংযোগ) লভতে (লাভ করেন) ; ততঃ চ (তাহার পর) ভূয়ঃ (পুনর্ব্বার) সংসিদ্ধৌ (পরমাত্মদর্শনরূপ সিদ্ধিলাভের নিমিত্ত) যততে (চেষ্টা করেন) ॥৪৩॥


হে কুরুনন্দন ! সেই যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি, উক্ত দ্বিবিধ জন্মের মধ্যে যে জন্মই লাভ করুন ; পূর্ব্বজন্ম কৃত সেই পরমাত্মার ভজন বিষয়ক বুদ্ধির সহিত সংযোগ লাভ করেন । তাহার পর পুনরায় অধিকতরভাবে পরমাত্মার দর্শনরূপ সিদ্ধিলাভের নিমিত্ত চেষ্টা করেন ॥৪৩॥

 

পূর্ব্বাভ্যাসেন তেনৈব হ্রিয়তে হ্যবশোঽপি সঃ ।
জিজ্ঞাসুরপি যোগস্য শব্দব্রহ্মাতিবর্ত্ততে ॥৪৪॥


হি (যেহেতু) সঃ (তিনি) অবশঃ অপি (কোনও বিঘ্নবশতঃ অনিচ্ছুক হইলেও) তেন (সেই যোগবিষয়ক) পূর্ব্বাভ্যাসেন এব (পূর্ব্বজন্মকৃত বলবান্ অভ্যাস কর্ত্তৃকই) হ্রিয়তে (আকৃষ্ট হন) । যোগস্য (যোগবিষয়ে) জিজ্ঞাসুঃ অপি (জিজ্ঞাসু মাত্র হইয়াও) শব্দব্রহ্ম (বেদোক্ত কর্ম্মমার্গ) অতিবর্ত্ততে (অতিক্রম করেন) ॥৪৪॥


যেহেতু তিনি কোনও অন্তরায় বশতঃ অনিচ্ছুক হইলেও যোগসাধন বিষয়ে পূর্ব্বজন্মকৃত অভ্যাস বশেই তাহাতে আকৃষ্ট হন । তিনি যোগসাধনে প্রবৃত্তমাত্র হইয়াও বেদোক্ত সকাম কর্ম্মমার্গকে অতিক্রম করিয়া থাকেন, অর্থাৎ তদপেক্ষা উৎকৃষ্ট ফল লাভ করেন ॥৪৪॥

 

প্রযত্নাদ্­যতমানস্তু যোগী সংশুদ্ধকিল্বিষঃ ।
অনেকজন্মসংসিদ্ধস্ততো যাতি পরাং গতিম্ ॥৪৫॥


প্রযত্নাৎ (পূর্ব্বকৃত যত্ন অপেক্ষা) যতমানঃ (অধিক প্রযত্নশীল) সংশুদ্ধকিল্বষঃ (সম্যক্ কষায় পরিপাকে বিশুদ্ধচিত্ত) যোগী তু (যোগীও) অনেকজন্মসংসিদ্ধঃ (অনেক জন্মে সিদ্ধি লাভ করেন) । ততঃ (অনন্তর) পরাং গতিম্ (স্ব-পরমাত্মদর্শনরূপ মুক্তি অর্থাৎ মোক্ষ) যাতি (লাভ করেন) ॥৪৫॥


তখন পূর্ব্বকৃত যত্ন অপেক্ষা অধিকতর প্রযত্নশীল, ও কামনা বাসনারূপ কষায়ের সম্যক্ পরিত্যাগে বিশুদ্ধচিত্ত-যোগী অনেক জন্ম যোগ সাধনার ফলে সিদ্ধিলাভ করিয়া তৎপর তিনি পরমাগতি লাভ করেন ॥৪৫॥

 

তপস্বিভ্যোঽধিকো যোগী জ্ঞানিভ্যোঽপি মতোঽধিকঃ ।
কর্ম্মিভ্যশ্চাধিকো যোগী তম্মাদ্­যোগী ভবার্জ্জুন ॥৪৬॥


যোগী (পরমাত্মার উপাসক) তপস্বিভ্যঃ (কৃচ্ছ্রচান্দ্রায়ণাদি তপোনিষ্ঠ অপেক্ষা) অধিকঃ (শ্রেষ্ঠ), জ্ঞানিভ্যঃ অপি (ব্রহ্মের উপাসক অপেক্ষাও) অধিকঃ (শ্রেষ্ঠ) ; যোগী (এবং যোগী) কর্ম্মিভ্যঃ চ (কর্ম্মী অপেক্ষাও) অধিকঃ (শ্রেষ্ঠ) [ইতি মে] (ইহাই আমার) মতঃ (অভিমত) । তস্মাৎ (অতএব) [হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন !) [ত্বং] (তুমি) যোগী ভব (যোগী হও) ॥৪৬॥


পরমাত্মার উপাসনাকারী যোগী কৃচ্ছ্র চান্দ্রায়ণাদি তপোনিষ্ঠ ব্যক্তিগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, ব্রহ্মের উপাসকগণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ ; এবং কর্ম্মিগণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ । ইহাই আমার অভিমত জানিবে । হে অর্জ্জুন ! অতএব তুমি যোগী হও ॥৪৬॥

 

যোগিনামপি সর্ব্বোষাং মদ্গতেনান্তরাত্মনা ।
শ্রদ্ধাবান্ ভজতে যো মাং স মে যুক্ততমো মতঃ ॥৪৭॥


যঃ (যিনি) শ্রদ্ধাবান্ (ভক্তিনিরূপক শাস্ত্রে দৃঢ় বিশ্বাসযুক্ত) মদ্­গতেন (আমাতেই আসক্ত) অন্তরাত্মনা (চিত্তদ্বারা) মাং (আমাকে) ভজতে (শ্রবণ কীর্ত্তনাদিযোগে সেবা করেন), সঃ (সেই ভক্ত) সর্ব্বেষাং (সকলপ্রকার) যোগিনাম্ অপি (যোগিগণের অর্থাৎ কর্ম্ম-জ্ঞান-তপস্যা-অষ্টাঙ্গযোগ-ভক্তি প্রভৃতি উপায় অবলম্বনকারিগণের মধ্যে) যুক্ততমঃ (সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ) [ইতি] (ইহাই) মে (আমার) মতঃ (অভিমত) ॥৪৭॥


যিনি ভক্তিনিরূপক শাস্ত্রে বিশ্বাসযুক্ত এবং আমাতেই আসক্ত মনের দ্বারা আমাকে শ্রবণ কীর্ত্তনাদি যোগে ভজনা করেন ; সেই ভক্ত সকল প্রকার যোগিগণের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, ইহাই আমার অভিমত ॥৪৭॥


 

ইতি শ্রীমহাভরতে শতসাহস্র্যাং সংহিতায়াং বৈয়াসিক্যাং
ভীষ্মপর্ব্বণি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং
যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসংবাদে ধ্যানযোগো
নাম ষষ্ঠোঽধ্যায়ঃ ॥৬॥


ইতি ষষ্ঠ অধ্যায়ের অন্বয় সমাপ্ত ॥


ইতি ষষ্ঠ অধ্যায়ের বঙ্গানুবাদ সমাপ্ত ॥


 

 

—···—

 

 

← ৫ কর্ম্মসন্ন্যাসযোগ ৭ জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ →

 

সূচিপত্র:
মঙ্গলাচরণম্
গ্রন্থ-পরিচয়
প্রকাশকের নিবেদন
১ সৈন্য-দর্শন
২ সাংখ্যযোগ
৩ কর্ম্মযোগ
৪ জ্ঞানযোগ
৫ কর্ম্মসন্ন্যাসযোগ
৬ ধ্যানযোগ
৭ জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ
৮ তারকব্রহ্মযোগ
৯ রাজগুহ্যযোগ
১০ বিভূতিযোগ
১১ বিশ্বরূপ-দর্শনযোগ
১২ ভক্তিযোগ
১৩ প্রকৃতিপুরুষ-বিবেক-যোগ
১৪ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৫ পুরুষোত্তমযোগ
১৬ দৈবাসুরসম্পদ্-বিভাগ যোগ
১৭ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৮ মোক্ষযোগ
গীতামাহাত্ম্যম্
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥