| |||||||||||||||||||||||||||||
|
|||||||||||||||||||||||||||||
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
অষ্টমোঽধ্যায়ঃ তারকব্রহ্মযোগ
অর্জ্জুনঃ উবাচ (অর্জ্জুন বলিলেন) [হে] পুরুষোত্তম ! (হে পুরুষোত্তম !) তৎ (সেই) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম) কিং ? (কি ?) অধ্যাত্মং কিম্ ? (অধ্যাত্ম কি ?) কর্ম্ম কিং ? (কর্ম্ম কি ?), অধিভূতং চ (এবং অধিভূত) কিং প্রোক্তম্ ? (কাহাকে বলে ?) কিম্ চ (কাহাকেই বা) অধিদৈবং (অধিদৈব) উচ্যতে ? (বলা যায় ?) । [হে] মধুসূদন ! (হে মধুসূদন !) অত্র দেহে (এই দেহে) অধিযজ্ঞঃ কঃ ? (অধিয়জ্ঞ কে ?) অস্মিন্ [দেহে] (এবং এই দেহে) কথং (কি প্রকারে) [স্থিতঃ ?] (অবস্থান করেন ?)প্রয়াণকালে চ (এবং মরণ কালে) নিয়তাত্মভিঃ (সমাহিত চিত্ত পুরুষগণ কর্ত্তৃক) [ত্বং] (তুমি) কথং (কিরূপে) জ্ঞেয়ঃ অসি ? (জ্ঞেয় হও ?) ॥১–২॥ অর্জ্জুন বলিলেন—হে পুরুষোত্তম ! সেই ব্রহ্ম কি ? অধ্যাত্ম কি ? কর্ম্ম কি ? এবং অধিভূত কাহাকে বলে ? কাহাকেই বা অধিদৈব বলা যায় ? হে মধুসূদন ! এই দেহে অধিযজ্ঞ কে ?এবং এই দেহে কি প্রকারে অবস্থিত আছেন ? এবং মরণকালে সংযতচিত্ত মানবগণকর্ত্তৃক তুমি কি প্রকারে জ্ঞেয় হও ? ॥১–২॥
শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ বলিলেন) পরমং অক্ষরং (পরম নিত্য-তত্ত্বই) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম), স্বভাবঃ (শুদ্ধজীব) অধ্যাত্মম্ (অধ্যাত্ম বলিয়া) উচ্যতে (কথিত হয়) । ভূতভাবোদ্ভবকরঃ (স্থূলসূক্ষ্মভূতদ্বারা মনুষ্যাদি দেহের জনক) বিসর্গঃ (দেবোদ্দেশে ত্যাগ) কর্ম্মসংজ্ঞিতঃ (কর্ম্ম শব্দে কথিত হয়) ॥৩॥ শ্রীভগবান্ কহিলেন—বিনাশ-রহিত এবং অবস্থান্তর-শূন্য তত্ত্বই ব্রহ্ম, শুদ্ধজীব অধ্যাত্ম বলিয়া কথিত হয় । স্থূলসূক্ষ্ম ভূতের দ্বারা মনুষ্যাদি দেহের জনক দেবতা উদ্দেশে ত্যাগ অর্থাৎ দান যজ্ঞাদিই কর্ম্মনামে অভিহিত হয় ॥৩॥
[হে] দেহভৃতাং বর ! (হে প্রাণিশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুন !) ক্ষরঃ (বিনাশী) ভাবঃ (পদার্থ) অধিভূতং (অধিভূত শব্দে কথিত), পুরুষঃ (আদিত্যাদি দেবতার অধিষ্ঠাতা সমষ্টি বিরাট্ পুরুষ) অধিদৈবতম্ (সমস্ত দেবতার অধিপতি বলিয়া অধিদৈবত শব্দ বাচ্য), অহম্ এব চ (এবং আমিই) অত্র দেহে (এই দেহে) অধিযজ্ঞঃ (অন্তর্যামিরূপে যজ্ঞাদি কর্ম্মপ্রবর্ত্তক ও তৎ ফল দাতা বলিয়া অধিযজ্ঞ ) ॥৪॥॥ হে জীবশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুন ! ক্ষণভঙ্গুর দেহাদি পদার্থকে অধিভূত বলা যায়, আদিত্যাদি দেবতার অধিষ্ঠাতা সমষ্টি বিরাট্ পুরুষই সমস্ত দেবতার অধিপতি বলিয়া অধিদৈবত নামে অভিহিত হন । এবং আমিই এই সকল জীবদেহে অন্তর্যামিরূপে যজ্ঞাদি কর্ম্ম প্রবর্ত্তকও তৎফলদাতা বলিয়া অধিযজ্ঞ নামে কথিত হই ॥৪॥
অন্তকালে চ (মরণ সময়ে ও) যঃ (যিনি) মাম্ এব (আমাকেই) স্মরন্ (চিন্তা করিয়া) কলেবরম্ (শরীর) মুক্ত্বা (পরিত্যাগ করিয়া) প্রয়াতি (প্রস্থান করেন), সঃ (তিনি) মদ্ভাবং (আমার স্বভাব) যাতি (প্রাপ্ত হন) । অত্র (এই বিষয়ে) সংশয়ঃ (সন্দেহ) নাস্তি (নাই) ॥৫॥॥ মৃত্যুকালেও আমাকেই চিন্তা করিতে করিতে শরীর পরিত্যাগ পূর্ব্বক যিনি প্রয়াণ করেন, তিনিই আমার স্বভাব লাভ করেন । ইহাতে কোনও সংশয় নাই ॥৫॥
[হে] কৌন্তেয় ! (হে কুন্তীনন্দন !) [যঃ] (যিনি) যং যং বা অপি (যেই যেই) ভাবং (পদার্থ) স্মরন্ (স্মরণ করিয়া) অন্তে (মৃত্যুকালে) কলেবরম্ (দেহ) ত্যজতি (ত্যাগ করেন), সদা (সর্ব্বদা) তদ্ভাবভাবিতঃ (সেই সেই পদার্থের ভাবনায় তন্ময় চিত্ত হইয়া) তং তম্ এব (সেই সেই পদার্থই) এতি (প্রাপ্ত হন) ॥৬॥॥ হে কুন্তীপুত্ত্র ! মরণকালে যে ব্যক্তি যেই যেই পদার্থকে চিন্তা করিতে করিতে কলেবর ত্যাগ করেন, সর্ব্বদা সেই পদার্থের ভাবনায় তন্ময়চিত্ত হেতু তিনি সেই সেই পদার্থকেই প্রাপ্ত হইয়া থাকেন ॥৬॥
তস্মাৎ (অতএব) সর্ব্বেষু কালেষু (সকল সময়ে) মাম্ (আমাকে) অনুস্মর (নিরন্তর স্মরণ কর), যুধ্য চ (এবং স্বধর্ম্ম যুদ্ধ কর) । ময়ি (আমাতে) অর্পিতমনোবুদ্ধিঃ (মন বুদ্ধি অর্পণ করিয়া) মাম্ এব (আমাকেই) এষ্যসি (পাইবে) [অত্র] (এ বিষয়ে) অসংশয়ঃ (কোনও সংশয় নাই) ॥৭ অতএব সর্ব্বকালে আমাকে স্মরণ কর, এবং স্বধর্ম্ম যুদ্ধ কর । আমাতে মন ও বুদ্ধি অর্পণ পূর্ব্বক কার্য্য করিলে আমাকেই প্রাপ্ত হইবে, এবিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই ॥৭॥
[হে] পার্থ ! (হে পার্থ !) অভ্যাসযোগযুক্তেন (অভ্যাসরূপ যোগযুক্ত) ন অন্যগামিনা (অনন্যগামী) চেতসা (মনের দ্বারা) দিব্যং (জ্যোতির্ম্ময়) পরমং পুরুষং (পরম পুরুষকে) অনুচিন্তয়ন্ (অনুক্ষণ চিন্তা করিয়া) [যোগী] (যোগী) [তমেব] (সেই পরম পুরুষকেই) যাতি (প্রাপ্ত হন) ॥৮ হে পার্থ ! অভ্যাসরূপ যোগযুক্ত অনন্যগামী মনের দ্বারা জ্যোতির্ম্ময় পরম পুরুষকে নিরন্তর চিন্তা করিতে করিতে যোগী ব্যক্তি সেই পরম পুরুষকেই লাভ করিয়া থাকেন ॥৮॥
যঃ (যিনি) কবিং (সর্ব্বজ্ঞ) পুরাণম্ (অনাদি) অনুশাসিতারম্ (কৃপাপূর্ব্বক স্বভক্তিশিক্ষক) অণোঃ অণীয়াংসম্ (অণু হইতেও অতি সূক্ষ্ম) সর্ব্বস্য ধাতারম্ (সমস্ত বস্তুর ধারক অর্থাৎ পরমমহৎ পরিমাণ) অচিন্ত্যরূপম্ (অপ্রাকৃত রূপবিশিষ্ট অর্থাৎ মধ্যম পরিমাণ) আদিত্যবর্ণং (সূর্য্যবৎ স্ব-পরপ্রকাশক স্বরূপবিশিষ্ট) তমসঃ পরস্তাৎ (প্রকৃতির অতীত) [পুরুষং] (পরম পুরুষকে) প্রয়াণকালে (মৃত্যুকালে) যোগবলেন (যোগাভ্যাস বলে) অচলেন মনসা (অচঞ্চল মনের দ্বারা) ভক্ত্যা যুক্তঃ (নিরন্তর স্মরণরূপ ভক্তিযুক্ত হইয়া) ভ্রুবোঃ মধ্যে চ (এবং ভ্রুদ্বয়ের মধ্যে) প্রাণম্ (প্রাণকে) সম্যক্ আবেশ্য (স্থিরভাবে স্থাপন করিয়া) অনুস্মরেৎ (চিন্তা করেন) সঃ (তিনি) তং (সেই) দিব্যম্ (জ্যোতির্ম্ময়) পরং (পরম) পুরুষম্ এব (পুরুষকেই) উপৈতি (প্রাপ্ত হন) ॥৯–১০ যিনি সর্ব্বজ্ঞ, অনাদি, কৃপাপূর্ব্বক নিজভক্তি-শিক্ষাদানকারী, অণুপরিমাণ হইতেও অতি সূক্ষ্ম, তৎসত্ত্বেও সমস্ত পদার্থের ধারক অর্থাৎ সর্ব্ব বৃহৎ পরিমাণ ; অপ্রাকৃতরূপশালী অর্থাৎ মধ্যম পরিমাণ, তাহা হইলেও আদিত্যের মত স্ব-পরপ্রকাশক-স্বরূপ-বিশিষ্ট এবং মায়াতীত স্বরূপ সেই পরমপুরুষকে মরণ সময়ে যোগাভ্যাস বলে নিশ্চল মনের দ্বারা নিরন্তর স্মরণরূপভক্তিযুক্ত হইয়া এবং ভ্রূদ্বয়ের মধ্যে (আজ্ঞাচক্রে) প্রাণকে সম্যক্রূপে স্থাপন পূর্ব্বক অনুস্মরণ (চিন্তা) করেন, তিনি জ্যোতির্ম্ময় সেই পরম পুরুষকেই প্রাপ্ত হইয়া থাকেন ॥৯–১০॥
বেদবিদঃ (বেদবেত্তা পণ্ডিতগণ) যৎ (যাঁহাকে) অক্ষরং (ব্রহ্মের বাচক ওঁকার) বদন্তি (বলেন), বীতরাগাঃ (বিষয়বাসনাহীন) যতয়ঃ (যতিগণ) যৎ (অক্ষর বাচ্য যাঁহাতে) বিশন্তি (প্রবেশ করেন) যৎ (যাঁহাকে) ইচ্ছন্তঃ (পাইবার জন্য) [ব্রহ্মচারিণঃ] (ব্রহ্মচারিগণ) ব্রহ্মচর্য্যং (ব্রহ্মচর্য্য) চরন্তি (পালন করেন) তৎ (সেই) পদং (প্রাপ্য বস্তুর কথা) তে (তোমাকে) সংগ্রহেণ (উপায়ের সহিত) প্রবক্ষ্যে (বলিতেছি) ॥১১ বেদবিৎ পণ্ডিতেরা যাঁহাকে ব্রহ্মের বাচক ওঙ্কার বলিয়া থাকেন, নিস্পৃহ যতি সকল অক্ষর বাচ্য যাঁহাতে প্রবেশ করেন, যাঁহাকে প্রাপ্ত হইবার ইচ্ছায় ব্রহ্মচারিগণ ব্রহ্মচর্য্য ব্রত পালন করেন, সেই প্রাপ্য বস্তুর বিষয় তোমাকে উপায়ের সহিত বলিতেছি ॥১১॥
সর্ব্বদ্বারাণি (সমস্ত ইন্দ্রিয়রূপ দ্বারাসমূহ) সংযম্য (বিষয় হইতে প্রত্যাহৃত করিয়া) মনঃ (মনকে) হৃদি (হৃদয়ে) নিরুধ্য (নিরোধ পূর্ব্বক) মূর্দ্ধ্নি (ভ্রদ্বয়-মধ্যে) প্রাণম্ (প্রাণকে) আধায় (স্থাপন করিয়া) আত্মনঃ (আত্মবিষয়ক) যোগধারণাম্ আস্থিতঃ (সমাধি অবলম্বন পূর্ব্বক) ওম্ ইতি (ওম্ এই) একাক্ষরং (একাক্ষর) ব্রহ্ম (ব্রহ্মবাচক শব্দ) ব্যাহরন্ (উচ্চারণ করিতে করিতে) মাম্ (আমাকে) অনুস্মরন্ (অনুক্ষণ স্মরণ করতঃ) দেহং ত্যজন্ (দেহ ত্যাগ করিয়া) যঃ (যিনি) প্রয়াতি (প্রয়াণ করেন) সঃ (তিনি) পরমাং গতিম্ (আমার সালোক্য) যাতি (প্রাপ্ত হন) ॥১২–১৩ সমস্ত ইন্দ্রিয়রূপ দ্বার সকলকে বিষয় গ্রহণ হইতে সংযত করিয়া, মনকে হৃদয়ে নিরোধ পূর্ব্বক, ভ্রূদ্বয়ের মধ্যে প্রাণকে স্থাপন ও আত্মবিষয়ক সমাধি অবলম্বন করতঃ ওম্ এই একাক্ষর ব্রহ্ম বাচক শব্দ উচ্চারণ করিতে করিতে, আমাকে অনুক্ষণ স্মরণপূর্ব্বক দেহত্যাগ করেন, তিনি আমার সালোক্য প্রাপ্ত হইয়া থাকেন ॥১২-১৩॥
[হে] পার্থ ! (হে পার্থ !) অনন্যচেতাঃ (কর্ম্মজ্ঞানাদি সাধন বা স্বর্গাপবর্গাদি সাধ্যে নিস্পৃহচিত্ত হইয়া) যঃ (যিনি) সততং (দেশকালাদি শুদ্ধি নিরপেক্ষভাবে) নিত্যশঃ (সর্ব্বদা) মাং (আমাকে) স্মরতি (স্মরণ করেন) তস্য (সেই) নিত্যযুক্তস্য (নিত্যমদ্যোগাভিলাষী) যোগিনঃ (দাস্য সখ্যাদি সম্বন্ধবিশিষ্ট ব্যাক্তির পক্ষে) অহং (আমি) সুলভঃ (সুখ লভ্য হই) ॥১৪ হে পার্থ ! কর্ম্মজ্ঞানাদি সাধন বা স্বর্গাপবর্গাদি সাধ্যে স্পৃহাশূন্য চিত্ত হইয়া, যিনি দেশকালাদির শুদ্ধি অশুদ্ধি বিচার-নিরপেক্ষভাবে সর্ব্বদা আমাকে স্মরণ করেন, সেই নিত্যমদ্যোগাভিলাষী দাস্য সখ্যাদি সম্বন্ধবিশিষ্ট ভক্তের পক্ষে আমি সুখলভ্যই হইয়া থাকি ॥১৪॥
পরমাং সংসিদ্ধিং (আমার লীলার পরিকরত্ব) গতাঃ (প্রাপ্ত) মহাত্মানঃ (মহাত্মগণ) মাম্ (আমাকে) উপেত্য (লাভ করিয়া) পুনঃ (পুনরায়) দুঃখালয়ম্ (দুঃখপূর্ণ) অশাশ্বতম্ (অনিত্য) জন্ম (জন্ম) ন আপ্নুবন্তি (পরিগ্রহ করেন না) ॥১৫ আমার লীলার পরিকরত্ব প্রাপ্ত মহাত্মা ভক্তগণ আমাকে প্রাপ্ত হইয়া পুনর্ব্বার দুঃখের নিলয়স্বরূপ অনিত্য জন্ম কখনও গ্রহণ করেন না ॥১৫॥
[হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন !) আব্রহ্মভুবনাৎ (ব্রহ্মলোক হইতে আরম্ভ করিয়া অধস্তন) লোকাঃ (সমস্ত লোক বা লোকবাসীই) পুনঃ আবর্ত্তিনঃ (পুনঃ পুনঃ আবর্ত্তনশীল), তু (কিন্তু) [হে] কৌন্তেয় ! (হে কুন্তীপুত্ত্র !) মাম্ (আমাকে) উপেত্য (আশ্রয় করিলে) পুনঃ জন্ম (পুনর্জন্ম) ন বিদ্যতে (থাকে না) ॥১৬ হে অর্জ্জুন ! ব্রহ্মলোক হইতে আরম্ভ করিয়া অধস্তন সমস্ত লোক অথবা লোকবাসী জীবগণই পুনরাবৃত্তিশীল, কিন্তু হে কৌন্তেয় ! আমাকে প্রাপ্ত হইলে পুনরায় জন্ম হয় না ॥১৬॥
সহস্রযুগপর্য্যন্তম্ (চতুর্যুগ সহস্র পরিমিত) ব্রহ্মণঃ (ব্রহ্মার) যৎ অহঃ (যে দিন) যুগসহস্রান্তাং (এবং চতুর্যুগ সহস্র পরিমিত) রাত্রিং (রাত্রি) [যে] (যাঁহারা) বিদুঃ (অবগত আছেন) তে (সেই সকল) জনাঃ (ব্যক্তিগণ) অহোরাত্রবিদঃ (দিবারাত্রিবিৎ) ॥১৭
সহস্র চতুর্যুগ পর্য্যন্ত ব্রহ্মার একদিন এবং সেইরূপ সহস্র চতুর্যুগ পরিমিত কাল ব্রহ্মার রাত্রি বলিয়া যাঁহারা অবগত আছেন সেই সকল ব্যক্তিগণই প্রকৃত অহোরাত্রবেত্তা ॥১৭॥*
অহরাগমে (ব্রহ্মার দিন সমুপস্থিত হইলে) অব্যক্তাৎ (নিদ্রা হইতে উত্থিত ব্রহ্মা হইতে) সর্ব্বাঃ ব্যক্তয়ঃ (শরীর-ইন্দ্রিয়-ভোগ্যবিষয়-ভোগস্থান প্রভৃতির সহিত সমস্ত প্রজা) প্রভবন্তি (উৎপন্ন হয়), [পুনঃ] (পুনরায়) রাত্র্যাগমে (রাত্রিকাল সমাগত হইলে) অব্যক্তসংজ্ঞকে (অব্যক্ত সংজ্ঞক) তত্র এব (সেই ব্রহ্মাতেই) প্রলীয়ন্তে (লয় পায়) ॥১৮ ব্রহ্মার দিন সমুপস্থিত হইলে সুপ্তোত্থিত সেই ব্রহ্মা হইতে শরীর-ইন্দ্রিয়-ভোগ্যবিষয়-ভোগস্থান প্রভৃতির সহিত সমস্ত প্রজাগণ উৎপন্ন হয়, পুনরায় রাত্রিকাল সমাগত হইলে অব্যক্ত সংজ্ঞক সেই ব্রহ্মাতেই সমস্ত লয়প্রাপ্ত হয় ॥১৮॥
d [হে] পার্থ (হে পার্থ !) সঃ এব (সেই) অয়ং (এই) ভূতগ্রামঃ (প্রাণিগণ) অবশঃ [সন্] (কর্ম্মপরতন্ত্র হইয়া) অহরাগমে (ব্রহ্মার দিবসাগমনে) ভূত্বা ভূত্বা (পুনঃ পুনঃ উৎপন্ন হইয়া) রাত্র্যাগমে (রাত্রির আগমনে) প্রলীয়তে (লয় প্রাপ্ত হয়) [পুনঃ অহরাগমে] (পুনরায় দিবস আগত হইলে) প্রভবতি (উৎপন্ন হয়) ॥১৯ হে পার্থ ! সেই এই প্রাণিসকলই কর্ম্মপরতন্ত্র হইয়া ব্রহ্মার দিবসাগমনে পুনঃ পুনঃ উৎপন্ন হইয়া আবার ব্রহ্মার রাত্রির আগমনে প্রলীন হয় । আবার ব্রহ্মার দিবস উপস্থিত হইলে উৎপন্ন হইয়া থাকে ॥১৯॥
তু (পরন্তু) তস্মাৎ অব্যক্তাৎ (সেই অব্যক্ত [হিরণ্যগর্ভ] হইতে) পরঃ (শ্রেষ্ঠ) অন্যঃ (তদ্বিলক্ষণ) অব্যক্তঃ (চক্ষুরাদির অগোচর) সনাতনঃ (অনাদি) যঃ (যে) ভাবঃ (পদার্থ) [অস্তি] (আছেন), সঃ (তিনি) সর্ব্বেষু ভূতেষু (হিরণ্যগর্ভ পর্য্যন্ত সমস্ত প্রাণী) নশ্যৎসু (নষ্ট হইলেও) ন বিনশ্যতি (নষ্ট হন না) ॥২০ কিন্তু সেই অব্যক্ত ব্রহ্মা হইতেও শ্রেষ্ঠ অন্য, চক্ষু-কর্ণাদি জীবেন্দ্রিয়ের অগোচর সনাতন যে পদার্থ আছেন, তিনি—হিরণ্যগর্ভ ব্রহ্মা পর্য্যন্ত সমুদয় প্রাণী নষ্ট হইলেও বিনষ্ট হন না ॥২০॥
[সঃ] (সেই) অব্যক্তঃ অক্ষরঃ ইতি [চ] উক্তঃ (অব্যক্ত অক্ষর শব্দে কথিত হন) তম্ (তাঁহাকে) পরমাং গতিম্ (পরম প্রাপ্য) আহুঃ (বলা হয়) । যং প্রাপ্য (যাঁহাকে পাইয়া) [জীবাঃ] (জীবগণ) ন নিবর্ত্তন্তে (সংসারে পুনঃ প্রত্যাবৃত্ত হয় না) তৎ (তাহাই) মম (আমার) পরমং ধাম (পরম ধাম বলিয়া) [বিদ্ধি] (জানিবে) ॥২১ সেই অব্যক্ত অক্ষর বলিয়া উক্ত হন, (বেদান্ত সকল) তাঁহাকে পরমগতি বলিয়া থাকেন । যাঁহাকে পাইলে সংসারে পুনরায় আসিতে হয় না তাহাই আমার পরমধাম জানিবে ॥২১॥
[হে] পার্থ ! (হে পার্থ !) ভূতানি (সমস্ত ভূতগণ) যস্য (যাঁহার) অন্তঃস্থানি (অভ্যন্তরে অবস্থিত) যেন (যাঁহার দ্বারা) ইদং (এই) সর্ব্বম্ (সমস্ত জগৎ) ততম্ (পরিব্যাপ্ত), সঃ (সেই) পরমঃ পুরুষঃ (পরম পুরুষ) [অহং] (আমি) অনন্যয়া (কর্ম্ম জ্ঞান যাগাদি সম্পর্ক রহিত ঐকান্তিকী) ভক্ত্যা তু (ভক্তি দ্বারাই) লভ্যঃ [ভবামি] (লভ্য হইয়া থাকি) ॥২২ হে পার্থ ! সমুদয় ভূতগণ যাঁহার অভ্যন্তরে অবস্থান করিতেছে, এবং যাঁহার দ্বারা এই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড পরিব্যাপ্ত, সেই পরম পুরুষ আমি কর্ম্ম জ্ঞান যোগাদির সম্পর্কশূন্য একমাত্র ঐকান্তিকী ভক্তি-দ্বারাই লভ্য হইয়া থাকি ॥২২॥
[হে] ভরতর্ষভ ! (হে ভরতশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুন !) যত্র কালে তু (যে কালোপলক্ষিত মার্গে) প্রয়াতাঃ (গমন করিলে অর্থাৎ মৃত্যু হইলে) যোগিনঃ (যোগিগণ ও কর্ম্মিগণ) অনাবৃত্তিম্ (অনাবৃত্তি) আবৃত্তিং চ (ও আবৃত্তি) যান্তি (লাভ করেন) [অহং] (আমি) তং কালং এব (সেই কালই) বক্ষ্যামি (বলিতেছি) ॥২৩ হে ভরতর্ষভ ! যে কালোপলক্ষিত মার্গে গমনকারী অর্থাৎ মৃত যোগিগণ বা কর্ম্মিগণ জন্ম নিবৃত্তি ও পুনর্জন্ম প্রাপ্ত হন, আমি তোমাকে সেই কালদ্বারা উপলক্ষিত মার্গের কথা বলিতেছি ॥২৩॥
[যত্র] (যে মার্গে) অগ্নিঃ জ্যোতিঃ (অগ্নি ও জ্যোতিঃ শব্দে অর্চ্চির অভিমানিনী দেবতা), অহঃ (দিবসাভিমানিনী দেবতা), শুক্লঃ (শুক্লপক্ষাভিমানিনী দেবতা) উত্তরায়ণম্ ষণ্মাসাঃ (ছয়মাসপরিমিত উত্তরায়ণাভিমানিনী দেবতা) [অবস্থিতঃ] (অবস্থান করেন) তত্র (সেই মার্গে) প্রয়াতাঃ (গমনকারী অর্থাৎ দেহত্যাগকারী) ব্রহ্মবিদঃ জনাঃ (ব্রহ্মবিৎ পুরুষগণ) ব্রহ্ম (ব্রহ্মকে) গচ্ছন্তি (প্রাপ্ত হন) ॥২৪ অগ্নি বা সূর্য্যাদি জ্যোতিযুক্ত দিবাভাগে শুক্লপক্ষে উত্তরায়ণকালে দেহত্যাগকারী জ্ঞানিগণ ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হইয়া থাকেন ॥২৪॥
[যত্র] (যে মার্গে) ধূমঃ (ধূমাভিমানিনী দেবতা) রাত্রিঃ (রাত্র্যভিমানিনী দেবতা) কৃষ্ণঃ (কৃষ্ণপক্ষাভিমানিনী দেবতা) তথা (এবং) দক্ষিণায়নম্ যণ্মাসাঃ (ছয়মাস পরিমিত দক্ষিণায়নাভিমানিনী দেবতা) [অবস্থিতঃ] (অবস্থিত) তত্র (সেইমার্গে) [প্রয়াতঃ] (গমনকারী অর্থাৎ দেহ পরিত্যাগকারী) যোগী (কর্ম্মিপুরুষ) চান্দ্রমসং জ্যোতিঃ (স্বর্গলোক) প্রাপ্য (লাভ করিয়া) নিবর্ত্ততে (পুনরাবৃত্ত হইয়া থাকেন) ॥২৫ অন্ধকারযুক্ত রাত্রিকালে, কৃষ্ণপক্ষেও দক্ষিণায়নকালে দেহত্যাগকারী কর্ম্মযোগী স্বর্গলোক প্রাপ্ত হইয়া পুনরাবর্ত্তন করেন ॥২৫॥
জগতঃ (জগতের জ্ঞানকর্ম্মাধিকারী ব্যক্তিগণের) এতে (এই) শুক্লকৃষ্ণে (শুক্ল ও কৃষ্ণ) গতী (পথদ্বয়) শাশ্বতে হি (নিত্য বলিয়াই) মতে (প্রসিদ্ধ আছে) । একয়া (একটীর দ্বারা) অনাবৃত্তিম্ (মোক্ষ) যাতি (প্রাপ্ত হয়) অন্যয়া (অন্যটীর দ্বারা) পুনঃ আবর্ত্ততে (পুনঃ পুনঃ সংসারে আসে) ॥২৬ জগতস্থ জ্ঞানকর্ম্মাধিকারী ব্যক্তিগণের সম্বন্ধে এই শুক্লমার্গ ও কৃষ্ণমার্গ নামক পথ দুইটী নিত্য বলিয়াই সর্ব্ববাদি সম্মত । শুক্লমার্গ দ্বারা অনাবৃত্তি লাভ করেন, কৃষ্ণমার্গ দ্বারা পুনরায় সংসারে জন্ম হইয়া থাকে ॥২৬॥
[হে] পার্থ ! (হে পার্থ !) এতে (এই) সৃতী (মার্গদ্বয়) জানন্ (অবগত হইয়া) কশ্চন যোগী (কোনও ভক্তিযোগী) ন মুহ্যতি (মোহ প্রাপ্ত হন না) । তস্মাৎ (অতএব) [হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন !) সর্ব্বেষু কালেষু (সর্ব্বদা) [ত্বং] (তুমি) যোগযুক্তঃ (সমাহিত চিত্ত) ভব (হও) ॥২৭ হে পার্থ ! এই শুক্ল-কৃষ্ণ-পথদ্বয় অবগত হইয়া কোনও ভক্তিযোগী মোহপ্রাপ্ত হন না । সুতরাং হে অর্জ্জুন ! তুমি সর্ব্বদা সেই মার্গদ্বয়ের অতীত অনন্য ভক্তিযোগ অবলম্বন কর ॥২৭॥
বেদেষু (বেদে) যজ্ঞেষু (যজ্ঞে) তপঃসু (তপস্যায়) দানেষু চ এব (এবং দানে) যৎ (যেই) পুণ্যফলং (পুণ্যফল) প্রদিষ্টম্ (উক্ত হইয়াছে), যোগী (ভক্তিমান্ ব্যক্তি) ইদং (আমার ও আমার ভক্তির মাহাত্ম্য) বিদিত্বা (অবগত হইয়া) তৎসর্ব্বম্ (সেই সকল ফল) অত্যেতি (অতিক্রম করেন) চ (এবং) পরং (উৎকৃষ্ট) আদ্যম্ (অপ্রাকৃত) স্থানম্ (স্থান) উপৈতি (প্রাপ্ত হন) ॥২৮ বেদে, যজ্ঞে, তপস্যায় এবং দানে যে সকল পুণ্যফল উক্ত হইয়াছে, ভক্তিমান্ পুরুষ আমার ও আমার প্রতি ভক্তির বৈশিষ্ট্য বিদিত হইয়া সেই সমস্ত ফল অতিক্রম করিয়া তাহা হইতে শ্রেষ্ঠ অপ্রাকৃত আমার ধাম প্রাপ্ত হইয়া থাকেন ॥২৮
ইতি অষ্টম অধ্যায়ের অন্বয় সমাপ্ত ॥ ইতি অষ্টম অধ্যায়ের বঙ্গানুবাদ সমাপ্ত ॥
—···—
|
সূচিপত্র: মঙ্গলাচরণম্ গ্রন্থ-পরিচয় প্রকাশকের নিবেদন ১ সৈন্য-দর্শন ২ সাংখ্যযোগ ৩ কর্ম্মযোগ ৪ জ্ঞানযোগ ৫ কর্ম্মসন্ন্যাসযোগ ৬ ধ্যানযোগ ৭ জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ ৮ তারকব্রহ্মযোগ ৯ রাজগুহ্যযোগ ১০ বিভূতিযোগ ১১ বিশ্বরূপ-দর্শনযোগ ১২ ভক্তিযোগ ১৩ প্রকৃতিপুরুষ-বিবেক-যোগ ১৪ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ ১৫ পুরুষোত্তমযোগ ১৬ দৈবাসুরসম্পদ্-বিভাগ যোগ ১৭ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ ১৮ মোক্ষযোগ গীতামাহাত্ম্যম্ |
||||||||||||||||||||||||||||
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥ | |||||||||||||||||||||||||||||
© Sri Chaitanya Saraswat Math, Nabadwip, West Bengal, India. For any enquiries please visit our contact page. |