আমাদের শ্রীগুরুপরম্পরা :
শ্রীশ্রীল ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ ভগবান্ শ্রীশ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর
              প্রভুপাদ
“শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠে সূর্যাস্ত কখনই হয় না” :
আমাদের মঠের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
 
আমাদের সম্পর্কে শ্রীউপদেশ শ্রীগ্রন্থাগার শ্রীগৌড়ীয় পঞ্জিকা ছবি ENGLISH
 
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা


পঞ্চমোঽধ্যায়ঃ

কর্ম্মসন্ন্যাসযোগ

 

অর্জ্জুন উবাচ—

সন্ন্যাসং কর্ম্মণাং কৃষ্ণ পুনর্যোগঞ্চ শংসসি ।
যচ্ছ্রেয় এতয়োরেকং তন্মে ব্রূহি সুনিশ্চিতম্ ॥১॥


অর্জ্জুন উবাচ (অর্জ্জুন কহিলেন) [হে] কৃষ্ণ ! (হে কৃষ্ণ !) [ত্বং] (তুমি) কর্ম্মণাং (কর্ম্মসমূহের) সন্ন্যাসং (ত্যাগ, উপদেশ করিয়া) পুনঃ (পুনরায়) যোগং চ (নিষ্কাম কর্ম্মযোগও) শংসসি (বলিতেছ) ; এতয়োঃ (এই দুইটীর মধ্যে) যৎ (যাহা) মে (আমার পক্ষে) শ্রেয়ঃ (মঙ্গলকর) তৎ (সেই) একং (একটী) সুনিশ্চিতম্ (নিশ্চয় করিয়া) ব্রূহি (বল) ॥১॥


অর্জ্জুন কহিলেন—হে কৃষ্ণ ! তুমি কর্ম্ম সকলের পরিত্যাগ উপদেশ করিয়া আবার নিষ্কাম কর্ম্মযোগও উপদেশ করিতেছ ; সুতরাং এই দুইটীর মধ্যে যেটী আমার পক্ষে মঙ্গলপ্রদ সেই একটীই নিশ্চয় করিয়া আমাকে বল ॥১॥

 

শ্রীভগবান্ উবাচ—

সন্ন্যাসঃ কর্ম্মযোগশ্চ নিঃশ্রেয়সকরাবুভৌ ।
তয়োস্তু কর্ম্মসন্ন্যাসাৎ কর্ম্মযোগো বিশিষ্যতে ॥২॥


শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ বলিলেন) সন্ন্যাসঃ কর্ম্মযোগঃ চ (সন্ন্যাস এবং কর্ম্মযোগ) উভৌ (উভয়ই) নিঃশ্রেয়সকরৌ (পরম কল্যাণকর) তু (কিন্তু) তয়োঃ (এই উভয়ের মধ্যে) কর্ম্মসন্ন্যাসাৎ (কর্ম্মত্যাগ অপেক্ষা) কর্ম্মযোগঃ (নিষ্কাম কর্ম্মযোগই) বিশিষ্যতে (অধিকতর প্রশংসনীয়) ॥২॥


শ্রীভগবান্ কহিলেন—সন্ন্যাস ও কর্ম্মযোগ উভয়ই পরম মঙ্গলপ্রদ তথাপি এই উভয়ের মধ্যে কর্ম্মত্যাগ অপেক্ষা নিষ্কাম কর্ম্মযোগই শ্রেষ্ঠ বলিয়া জানিবে ॥২॥

 

জ্ঞেয়ঃ স নিত্যসন্ন্যাসী যো ন দ্বেষ্টি ন কাঙ্ক্ষতি ।
নির্দ্বন্দ্বো হি মহাবাহো সুখং বন্ধাৎ প্রমুচ্যতে ॥৩॥


[হে] মহাবাহো ! (হে মহাবীর !) যঃ (যিনি) ন দ্বেষ্টি (কর্ম্মফলের প্রতি দ্বেষ করেন না) ন কাঙ্ক্ষতি (আকাঙ্ক্ষাও করেন না) সঃ (তিনি) নিত্যসন্ন্যাসী (নিত্য অর্থাৎ কর্ম্মানুষ্ঠানকালেও সন্ন্যাসী) জ্ঞেয়ঃ (জানিবে) । হি (যেহেতু) নির্দ্বন্দ্বঃ (দ্বন্দ্ব-রহিত সেই পুরুষই) বন্ধাৎ (সংসার বন্ধন হইতে) সুখং (অনায়াসে) প্রমুচ্যতে (মুক্ত হন) ॥৩॥


হে মহাবীর অর্জ্জুন ! যিনি রাগ দ্বেষাদি দ্বন্দ্ব শূন্য এবং কর্ম্মফলের প্রতি দ্বেষ বা আকাঙ্ক্ষা করেন না, তিনি কর্ম্মানুষ্ঠান কালেও সন্ন্যাসী জানিবে । যেহেতু তিনিই পরমসুখে কর্ম্মবন্ধন সংসার হইতে মুক্তিলাভ করেন ॥৩॥

 

সাংখ্যযোগৌ পৃথগ্বালাঃ প্রবদন্তি ন পণ্ডিতাঃ ।
একমপ্যাস্থিতঃ সম্যগুভয়োর্বিন্দতে ফলম্ ॥৪॥


বালাঃ (বালকবৎ অজ্ঞগণ) সাংখ্যযোগৌ (সন্ন্যাস এবং কর্ম্মযোগকে) পৃথক্ (পৃথক্) প্রবদন্তি (বলিয়া থাকে), তু (কিন্তু) পণ্ডিতাঃ (পণ্ডিতগণ) ন [বদন্তি] (তাহা বলেন না) । একম্ অপি (একটীও) সম্যক্ আস্থিতঃ (উত্তম রূপে আচরণকারী ব্যক্তি) উভয়োঃ (সেই উভয়েরই) ফলম্ (ফল) বিন্দতে (লাভ করেন) ॥৪॥


বালকের মত মূঢ় মীমাংসকগণই সাংখ্যযোগ ও কর্ম্মযোগকে পৃথক্ পৃথক্ পদ্ধতি বলিয়া প্রকাশ করে, কিন্তু পণ্ডিতগণ সেরূপ বলেন না । এই সাংখ্যযোগ বা কর্ম্মযোগ মধ্যে যে কোন একটী সুষ্ঠুরূপে আচরণ করিলেই উভয়ের ফল লাভ করিবে ॥৪॥

 

যৎ সাংখ্যৈঃ প্রাপ্যতে স্থানং তদ্­যোগৈরপি গম্যতে ।
একং সাংখ্যঞ্চ যোগঞ্চ যঃ পশ্যতি স পশ্যতি ॥৫॥


সাংখ্যৈঃ (সন্ন্যাস দ্বারা) যৎস্থানং (যেস্থান) প্রাপ্যতে (লাভ হয়), যোগৈঃ অপি (নিষ্কাম কর্ম্মযোগ দ্বারাও) তৎ [স্থানং] (সেই স্থানেই) গম্যতে (গতি হয়) । সাংখ্যং যোগং চ (সন্ন্যাস ও কর্ম্মযোগকে) যঃ (যিনি) [বিবেকেন] (বিচারপূর্ব্বক) একং পশ্যতি (এক বলিয়া জানিতে পারেন) সঃ পশ্যতি (তিনিই তত্ত্বদর্শী) ॥৫॥


সন্ন্যাস আচরণ দ্বারা যে স্থান লাভ করা যায়, নিষ্কাম কর্ম্মযোগ দ্বারাও সেই স্থানেই গতি হইয়া থাকে । যিনি সাংখ্য যোগ ও কর্ম্মযোগকে বিচার পূর্ব্বক এক বলিয়া জানেন, তিনিই তাহাদের যথার্থ তত্ত্ব জানেন ॥৫॥

 

সন্ন্যাসস্তু মহাবাহো দুঃখমাপ্তুমযোগতঃ ।
যোগযুক্তো মুনির্ব্রহ্ম ন চিরেণাধিগচ্ছতি ॥৬॥


[হে] মহাবাহো ! (হে বীর শ্রেষ্ঠ !) অযোগতঃ (নিষ্কাম কর্ম্মযোগ ব্যতিরেকে) সন্ন্যাসঃ (সন্ন্যাস) দুঃখম্ আপ্তুম্ (দুঃখ প্রাপ্তির কারণ) [ভবতি] (হয়) তু (কিন্তু) যোগযুক্তঃ (নিষ্কামকর্ম্মানুষ্ঠানকারী) মুনিঃ [সন্] (জ্ঞানী হইয়া) ন চিরেণ (শীঘ্রই) ব্রহ্ম (ব্রহ্মকে) অধিগচ্ছতি (লাভ করিতে পারেন) ॥৬॥


হে মহাবীর ! নিষ্কাম কর্ম্মযোগ ব্যতিরেকে কেবল কর্ম্মত্যাগরূপ সন্ন্যাস দুঃখেরই কারণ হইয়া থাকে, নিষ্কাম কর্ম্মানুষ্ঠানকারী জ্ঞানী হইয়া শীঘ্রই ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হইয়া থাকেন ॥৬॥

 

যোগাযুক্তো বিশুদ্ধাত্মা বিজিতাত্মা জিতেন্দ্রিয়ঃ ।
সর্ব্বভূতাত্মভূতাত্মা কুর্ব্বন্নপি ন লিপ্যতে ॥৭॥


যোগযুক্তঃ (পূর্ব্বোক্ত যোগযুক্ত) বিশুদ্ধাত্মা (বিজিতবুদ্ধি) বিজিতাত্মা (বিশুদ্ধচিত্ত) জিতেন্দ্রিয়ঃ (ও জিতেন্দ্রিয় এই ত্রিবিধ জ্ঞানী গৃহস্থ) সর্ব্বভূতাত্মভূতাত্মা [সন্] (সর্ব্বভূতের প্রেমাস্পদীভূতদেহ হইয়া) কুর্ব্বন্ অপি (কর্ম্মাচরণ করিয়াও) ন লিপ্যতে (তাহাতে লিপ্ত হন না) ॥৭॥


পূর্ব্বোক্ত যোগযুক্ত জ্ঞানী গৃহস্থ তিন প্রকার—বিশুদ্ধবুদ্ধি, বিজিত-চিত্ত ও জিতেন্দ্রিয় । ইহাদের সাধন তারতম্যে পূর্ব্ব পূর্ব্বের উৎকর্ষত্ব জানিবে । ইহারা সকলেই সর্ব্বজীবের অনুরাগ ভাজন হইয়া থাকেন । তাহারা সমস্ত কর্ম্মাচরণ করিয়াও তাহাতে লিপ্ত হন না ॥৭॥

 

নৈব কিঞ্চিৎ করোমীতি যুক্তো মন্যেত তত্ত্ববিৎ ।
পশ্যন্ শৃণ্বন্ স্পৃশন্ জিঘ্রন্নশ্নন্ গচ্ছন্ স্বপন্ শ্বসন্ ॥৮॥
প্রলপন্ বিসৃজন্ গৃহ্ণন্নুম্মিষন্নিমিষন্নপি ।
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেষু বর্ত্তন্ত ইতি ধারয়ন্ ॥৯॥


তত্ত্ববিৎ (তত্ত্বজ্ঞ) যুক্তঃ (কর্ম্মযোগী) পশ্যন্ (দর্শন) শৃণ্বন্ (শ্রবণ) স্পৃশন্ (স্পর্শ) জিঘ্রন্ (ঘ্রাণ) অশ্নন্ (ভোজন) গচ্ছন্ (গমন) স্বপন্ (শয়ন) শ্বসন্ (নিশ্বাস গ্রহণ) প্রলপন্ (কথন) বিসৃজন্ (মূত্র) পুরীষ ত্যাগ) গৃহ্নন্ (গ্রহণ) উন্মিষন্ (উন্মীলন) নিমিষন্ অপি (ও নিমীলন প্রভৃতি কার্য্য করিয়াও) ইন্দ্রিয়াণি (চক্ষুঃ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গণই) ইন্দ্রিয়ার্থেষু (স্ব স্ব রূপাদি বিষয়ে) বর্ত্তন্তে (প্রবর্ত্তিত আছে), ইতি (ইহা) ধারয়ন্ (নিশ্চয় করিয়া) [অহম্] (আমি) কিঞ্চিৎ এব (কিছুই) ন করোমি (করি না) ইতি (এইরূপ) মন্যেত (মনে করেন) ॥৮–৯॥


পূর্ব্বোক্ত তত্ত্বজ্ঞ কর্ম্মযোগী দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ, ঘ্রাণ, ভোজন, গমন, নিদ্রা, নিশ্বাস গ্রহন, কথন, মুত্র পুরীষ ত্যাগ, গ্রহণ, উম্মীলন ও নিমীলন প্রভৃতি কার্য্য করিয়াও ‘আমার চক্ষু কর্ণাদি ইন্দ্রিয়গণই তাহাদের নিজ নিজ বিষয় রূপাদিতে প্রবর্ত্তিত আছে’ ইহা ধারণা করিয়া ‘আমি কিছুই করিতেছি না’ এইরূপ মনে করেন ॥৮–৯॥

 

ব্রহ্মণ্যাধায় কর্ম্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা করোতি যঃ ।
লিপ্যতে ন স পাপেন পদ্মপত্রমিবাম্ভসা ॥১০॥


যঃ (যিনি) ব্রহ্মণি (পরমেশ্বরে) কর্ম্মাণি (কর্ম্ম সমুদয়) আধায় (সমর্পণ করিয়া) সঙ্গং (আসক্তি) ত্যক্ত্বা (ত্যাগ পূর্ব্বক) করোতি (কর্ম্ম করেন), সঃ (তিনি) অম্ভসা (জলের দ্বারা) পদ্মপত্রম্ ইব (পদ্ম পত্রের মত) পাপেন (পাপ-পূণ্যের দ্বারা) ন লিপ্যতে (লিপ্ত হন না) ॥১০॥


যিনি পরমেশ্বরে সমস্ত কর্ম্ম সমর্পণ করিয়া ফলাসক্তি পরিত্যাগ পূর্ব্বক কর্ম্মাচরণ করেন, পদ্মপত্র যেমন জলে থাকিয়াও জলে লিপ্ত হয় না, সেইরূপ তিনিও সমস্ত কর্ম্মাচরণ করিয়াও কর্ম্মজনিত পাপ বা পুণ্যে লিপ্ত হন না ॥১০॥

 

কায়েন মনসা বুদ্ধ্যা কেবলৈরিন্দ্রিয়ৈরপি ।
যোগিনঃ কর্ম্ম কুর্ব্বন্তি সঙ্গং ত্যক্ত্বাত্মশুদ্ধয়ে ॥১১॥


যোগিনঃ (কর্ম্মযোগিগণ) আত্মশুদ্ধয়ে (মনঃ শুদ্ধির জন্য) সঙ্গং (কর্ম্মফলে আসক্তি) ত্যক্ত্বা (ত্যাগ করতঃ) কায়েন (শরীর), মনসা (মন) বুদ্ধ্যা (বুদ্ধি) কেবলৈঃ অপি ইন্দ্রিয়ৈঃ (ও মনঃ সংযোগ রহিত কেবল ইন্দ্রিয়গণ দ্বারা) কর্ম্ম কুর্ব্বন্তি (কর্ম্ম করিয়া থাকেন) ॥১১॥


কর্ম্মযোগিগণ চিত্তশুদ্ধির নিমিত্ত কর্ম্মফলের আসক্তি পরিত্যাগ পূর্ব্বক শরীর-মন-বুদ্ধি দ্বারা অথবা কখনও মনঃসংযোগ রহিত কেবল ইন্দ্রিয়গণের দ্বারা কর্ম্ম করিয়া থাকেন ॥১১॥

 

যুক্তঃ কর্ম্মফলং ত্যক্ত্বা শান্তিমাপ্নোতি নৈষ্ঠিকীম্ ।
অযুক্তঃ কামকারেণ ফলে সক্তো নিবধ্যতে ॥১২॥


যুক্তঃ (নিষ্কাম কর্ম্মযোগী) কর্ম্মফলং (কর্ম্মফল) ত্যক্ত্বা (ত্যাগ করিয়া) নৈষ্ঠিকীম্ (নিষ্ঠাপ্রাপ্ত) শান্তিম্ (শান্তি অর্থাৎ মোক্ষ) আপ্নোতি (প্রাপ্ত হন), [কিন্তু] অযুক্তঃ (সকাম কর্ম্মী) কামকারেণ (কামনা পূর্ব্বক প্রবৃত্ত হওয়ায়) ফলে (কর্ম্মফলে) সক্তঃ [সন্] (আসক্ত হইয়া) নিবধ্যতে (বদ্ধ হন) ॥১২॥


নিষ্কাম কর্ম্মযোগী কর্ম্মফলাসক্তি পরিত্যাগ পূর্ব্বক কর্ম্ম করায় নৈষ্ঠিকী শান্তি অর্থাৎ কর্ম্ম মোক্ষ প্রাপ্ত হন । কিন্তু সকাম-কর্ম্মী ফল কামনা পূর্ব্বক কর্ম্মে প্রবৃত্ত হওয়াতে ঐ কর্ম্মফলে আসক্ত হইয়া কর্ম্মবন্ধন প্রাপ্ত হন ॥১২॥

 

সর্ব্বকর্ম্মাণি মনসা সংন্যস্যাস্তে সুখং বশী ।
নবদ্বারে পুরে দেহী নৈব কুর্ব্বন্নকারয়ন্ ॥১৩॥


বশী (জিতেন্দ্রিয়) দেহী (জীব) মনসা (মনের দ্বারা) সর্ব্বকর্ম্মাণি (সমুদয় কর্ম্ম) সংন্যস্য (ত্যাগ করিয়া) নবদ্বারে (নবদ্বার বিশিষ্ট) পুরে (পুরবৎ অহং ভাব শূন্য দেহে) [কুর্ব্বন্ অপি] (কর্ম্ম করিয়াও) ন এব কুর্ব্বন্ (কর্ত্তৃত্বাভিমান রহিত) [কারয়ন্ অপি] (অন্যের দ্বারা কর্ম্ম করাইয়াও) ন কারয়ন্ (প্রযোজকত্বাভিমান রহিত হইয়া) সুখং (সুখে) আস্তে (অবস্থান করেন) ॥১৩॥


জিতেন্দ্রিয়, দেহরূপপুরে অবস্থিত জীব (জীবাত্মা) মনের দ্বারা সমস্ত কর্ম্ম পূর্ব্বোক্ত রীতিক্রমে ত্যাগ করিয়া নবদ্বারযুক্ত দেহে বাহ্যে সমুদয় কর্ম্ম করিয়াও কর্ত্তৃত্বাভিমান শূন্য, অন্যের দ্বারা করাইয়াও প্রযোজকত্বাভিমান রহিত হইয়া সুখে বাস করেন ॥১৩॥

 

ন কর্ত্তৃত্বং ন কর্ম্মাণি লোকস্য সৃজতি প্রভুঃ ।
ন কর্ম্মফলসংযোগং স্বভাবস্তু প্রবর্ত্ততে ॥১৪॥


প্রভুঃ (পরমেশ্বর) লোকস্য (জীবগণের) কর্ত্তৃত্বং (কর্ত্তৃত্ব) ন [সৃজতি] (উৎপাদন করেন না), কর্ম্মাণি (কর্ম্ম সমূহ) ন সৃজতি (সৃষ্টি করেন না), কর্ম্মফলসংযোগং (কর্ম্মফলের সংযোগও) ন [সৃজতি] (সৃষ্টি করেন না) । তু (কিন্তু) স্বভাবঃ (জীবের স্বভাব অনাদি অবিদ্যাই) প্রবর্ত্ততে (কর্ত্তৃত্বাদিরূপে প্রবৃত্ত হইয়া থাকে) ॥১৪॥


পরমেশ্বর জীবগণের কোনও কর্ত্তৃত্ব উৎপাদন করেন না, কর্ম্মসমূহ সৃষ্টিও করেন না অথবা কর্ম্মফলের সংযোগও সৃজন করেন না । কিন্তু জীবের অনাদি অবিদ্যাই কর্ত্তৃত্বাদিরূপে প্রবৃত্ত হইয়া থাকে ॥১৪॥

 

নাদত্তে কস্যচিৎ পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভুঃ ।
অজ্ঞানেনাবৃতং জ্ঞানং তেন মুহ্যন্তি জন্তবঃ ॥১৫॥


বিভুঃ (পূর্ণকাম পরমেশ্বর) কস্যচিৎ (কাহারও) পাপং (পাপ) ন আদত্তে (গ্রহণ করেন না) সুকৃতং চ ন এব (বা পুণ্যও গ্রহণ করেন না), অজ্ঞানেন (তদীয় অবিদ্যা শক্তি দ্বারা) জ্ঞানং (জীবের জ্ঞান) আবৃতং (আবৃত) [ভবতি] (হয়) তেন (সেই জন্য) জন্তবঃ (জীব সমূহ) মুহ্যন্তি (মোহিত হয়) ॥১৫॥


পূর্ণকাম পরমেশ্বর কাহারও সুকৃতি বা দুষ্কৃতি গ্রহণ করেন না । জীব স্বাভাবিক জ্ঞানস্বরূপ ; ঈশ্বরের অবিদ্যাশক্তি কর্ত্তৃক জীবের সেই স্বরূপ আবৃত হওয়ায় জীবগণ দেহাত্মাভিমানরূপ মোহপ্রাপ্ত হয় ॥১৫॥

 

জ্ঞানেন তু তদজ্ঞানং যেষাং নাশিতমাত্মনঃ ।
তেষামাদিত্যবজ্­জ্ঞানং প্রকাশয়তি তৎ পরম্ ॥১৬॥


তু (কিন্তু) আত্মনঃ (জীব বিষয়ক) জ্ঞানেন (জ্ঞানের অর্থাৎ তদীয় বিদ্যাশক্তির দ্বারা) যেষাং (যাহাদের) তৎ অজ্ঞানং (সেই অজ্ঞান অর্থাৎ অবিদ্যা) নাশিতম্ (নাশ প্রাপ্ত হইয়াছে), তেষাং (সেই সকল জীবের) তৎ জ্ঞানং (সেই জ্ঞান) আদিত্যবৎ (তমোনাশকারী সূর্য্যের ন্যায়) পরম্ (অপ্রাকৃত স্বরূপকে) প্রকাশয়তি (প্রকাশ করে) ॥১৬॥


জ্ঞান দুইপ্রকার—প্রাকৃত ও অপ্রাকৃত । যাহাকে প্রাকৃত বা জড়-প্রকৃতি-সম্বন্ধী জ্ঞান বলি, তাহাই জীবের অজ্ঞান বা অবিদ্যা, অপ্রাকৃত জ্ঞানই বিদ্যা । যে সকল জীবের অপ্রাকৃত জ্ঞানোদয়ে প্রাকৃত জ্ঞান নষ্ট হইয়াছে, তাহাদের নিকট সূর্য্যের মত পরম জ্ঞানরূপ অপ্রাকৃত জ্ঞান উদিত হইয়া অপ্রাকৃত সেই পরম তত্ত্বকে প্রকাশ করে ॥১৬॥

 

তদ্বুদ্ধয়স্তদাত্মানস্তন্নিষ্ঠাস্তৎপরায়ণাঃ ।
গচ্ছন্ত্যপুনরাবৃত্তিং জ্ঞাননির্ধূতকল্মষাঃ ॥১৭॥


জ্ঞাননির্ধূতকল্মষাঃ (জ্ঞান দ্বারা পূর্ব্বে যাঁহাদের সমস্ত কল্মষ অর্থাৎ অবিদ্যা নষ্ট হইয়াছে তাঁহারা) তদ্বুদ্ধয়ঃ (পরমেশ্বর মনন পর) তদাত্মানঃ (তাঁহারই ধ্যান রত) তন্নিষ্ঠাঃ (একমাত্র তাঁহাতেই নিষ্ঠাযুক্ত) তৎপরায়ণাঃ [সন্তঃ] (এবং তদীয় শ্রবণ কীর্ত্তন পর হইয়া) অপুনরাবৃত্তিং (মোক্ষ) গচ্ছন্তি (লাভ করেন) ॥১৭॥


জ্ঞান দ্বারা পূর্ব্বে যাঁহাদের সমুদয় অবিদ্যা দূর হইয়াছে, তাঁহারা পরমেশ্বর আমারই মনন পর, ধ্যান নিরত ও আমাতেই নিষ্ঠাযুক্ত হইয়া মদীয় শ্রবণ কীর্ত্তনের প্রিয় হইয়া পড়েন । তখন তাঁহারা অপুনরাবৃত্তি রূপ মোক্ষ লাভ করিয়া থাকেন ॥১৭॥

 

বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি ।
শুনি চৈব শ্বপাকে চ পণ্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ ॥১৮॥


বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে (বিদ্যা বিনয় যুক্ত) ব্রাহ্মণে (ব্রাহ্মণ) গবি (গো) হস্তিনি (হস্তী) শুনি (কুক্কুর) শ্বপাকে চ (এবং চণ্ডাল প্রভৃতি প্রকৃতি বিষম পদার্থে) সমদর্শিনঃ এব (গুণাতীত ব্রহ্ম দর্শনকারিগণই) পণ্ডিতাঃ [কথ্যতে] (পণ্ডিত অর্থাৎ যথার্থ জ্ঞানী বলিয়া কথিত হন) ॥১৮॥


অপ্রাকৃত গুণকে লাভ করিয়াছেন এরূপ জ্ঞানিসকল জগতে প্রাকৃত গুণ দ্বারা উত্তম, মধ্যম ও অধম রূপ যে বৈষম্য আছে তাহা পরিত্যাগ পূর্ব্বক বিদ্যা ও বিনয় যুক্ত ব্রাহ্মণ, গো, হস্তী, কুক্কুর ও চণ্ডাল প্রভৃতি সমস্ত জীবেই গুণাতীত ব্রহ্ম দর্শন করিয়া থাকেন, তজ্জন্য তাঁহারা পণ্ডিত সংজ্ঞা লাভ করেন ॥১৮॥

 

ইহৈব তৈর্জিতঃ সর্গো যেষাং সাম্যে স্থিতং মনঃ ।
নির্দ্দোষং হি সমং ব্রহ্ম তস্মাদ্­ব্রহ্মণি তে স্থিতাঃ ॥১৯॥


যেষাং (যাঁহাদের) মনঃ (মন) সাম্যে (ব্রহ্ম ধর্ম্মে) স্থিতং (অবস্থিত) তৈঃ (তাঁহাদিগকর্ত্তৃক) ইহ এব (ইহ লোকেই) সর্গঃ (সংসার) জিতঃ (পরাভূত হইয়াছে), হি (যেহেতু) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম) সমং (সর্ব্বত্র সমভাবাপন্ন) নির্দ্দোষং (রাগ দ্বেষাদি রহিত) তস্মাৎ (সেই হেতু) তে (তাঁহারা) ব্রহ্মণি স্থিতাঃ (প্রপঞ্চে বর্ত্তমান থাকিয়াও ব্রহ্মেই অবস্থিত আছেন) ॥১৯॥


যাঁহাদের মন সাম্যে অবস্থিত হইয়াছে, তাঁহারা এজগতে বর্ত্তমান থাকিয়াই সংসার জয় করিয়াছেন ; যেহেতু তাঁহারা ব্রহ্ম সমত্ব প্রযুক্ত রাগদ্বেষাদি শূন্য । সুতরাং তাঁহারা এই প্রপঞ্চে বর্ত্তমান থাকিলেও সর্ব্বদা ব্রহ্মেই অবস্থিত ॥১৯॥

 

ন প্রহৃষ্যেৎ প্রিয়ং প্রাপ্য নোদ্বিজেৎ প্রাপ্য চাপ্রিয়ম্ ।
স্থিরবুদ্ধিরসংমূঢ়ো ব্রহ্মবিদ্­ধ্রহ্মণি স্থিতঃ ॥২০॥


ব্রহ্মণি স্থিতঃ (ব্রহ্ম নিষ্ঠ) স্থিরবুদ্ধিঃ (স্থিরবুদ্ধি সম্পন্ন) অসংমূঢ়ঃ (দেহাদিতে অহং বুদ্ধি রহিত) ব্রহ্মবিৎ (ব্রহ্ম জ্ঞানী) প্রিয়ং প্রাপ্য (প্রিয় বস্তু লাভে) ন প্রহৃষ্যেৎ (হর্ষে প্রফুল্ল হন না) অপ্রিয়ং প্রাপ্য চ (অপ্রিয় বস্তু লাভেও) ন উদ্বিজেৎ (উদ্বিগ্ন হন না) ॥২০॥


ব্রহ্মনিষ্ঠ, স্থিরবুদ্ধি সম্পন্ন ও দেহাদিতে অহংবুদ্ধি শূন্য—ব্রহ্মজ্ঞানী প্রিয় বস্তুর লাভে হর্ষে উৎফুল্ল হন না এবং অপ্রিয় বস্তু লাভ করিয়াও তজ্জন্য বিচলিত হন না ॥২০॥

 

বাহ্যস্পর্শেষ্বসক্তাত্মা বিন্দত্যাত্মনি যৎ সুখম্ ।
স ব্রহ্মযোগযুক্তাত্মা সুখমক্ষয়মশ্নুতে ॥২১॥


বাহ্যস্পর্শেষু (বিষয় সুখে) অসক্তাত্মা (অনাসক্ত চিত্ত) সঃ (সেই পুরুষ) আত্মনি [অনুভূয়মানে] স্ব স্বরূপের অনুভবে) যৎ সুখম্ (যে সুখ) [তৎ আদৌ) (তাহা প্রথমে) বিন্দতি (লাভ করেন) [ততঃ] (অনন্তর) ব্রহ্মযোগযুক্তাত্মা (ব্রহ্মে যোগযুক্ত হইয়া) অক্ষয়ম্ (অক্ষয়) সুখম্ (সুখ) অশ্নুতে (ভোগ করেন) ॥২১॥


ইন্দ্রিয়ার্থরূপ বিষয়সুখে অনাসক্তচিত্ত সেই ব্রহ্মবিৎপুরুষ স্বস্বরূপের অনুভব দ্বারা যে সুখ তাহা প্রথমে লাভ করেন, তদনন্তর তিনি ব্রহ্মে যোগযুক্ত হইয়া অক্ষয় সুখ ভোগ করিয়া থাকেন ॥২১॥

 

যে হি সংস্পর্শজা ভোগা দুঃখযোনয় এব তে ।
আদ্যন্তবন্তঃ কৌন্তেয় ন তেষু রমতে বুধঃ ॥২২॥


[হে] কৌন্তেয় ! (হে অর্জ্জুন !) যে ভোগাঃ (যে সুখ সমূহ) সংস্পর্শজাঃ (বিষয়েন্দ্রিয় সংযোগ জনিত) তে হি (তাহারা) দুঃখযোনয়ঃ এব (দুঃখেরই জনক) আদ্যন্তবন্তঃ (উৎপত্তি বিনাশশীল) [অতঃ] (অতএব) বুধঃ (বিবেকি ব্যক্তি) তেষু (সেই বিষয় সুখে) ন রমতে (রত হন না) ॥২২॥


হে কৌন্তেয় ! যে সকল সুখ, বিষয় ও ইন্দ্রিয়ের সংযোগ হইতে উৎপন্ন হয় সেই সমস্ত সুখই দুঃখের জনক এবং উৎপত্তি-বিনাশশীল, নিত্য নহে । বিবেকী ব্যক্তি সেই সকল সুখে কখনও প্রীতি অনুভব করেন না ॥২২॥

 

শক্লোতীহৈব যঃ সোঢ়ুং প্রাক্ শরীরবিমোক্ষণাৎ ।
কামক্রোধোদ্ভবং বেগং স যুক্তঃ স সুখী নরঃ ॥২৩॥


যঃ (যে ব্যক্তি) শরীরবিমোক্ষণাৎ (শরীর ত্যাগের) প্রাক্ (পূর্ব্ব পর্য্যন্ত) কামক্রোধোদ্ভবং বেগং (কাম ক্রোধ জনিত মনোনেত্রাদি বিক্ষোভকে) ইহ এব (উদ্ভবের সময়েই) সোঢ়ুং (নিরোধ করিতে) শক্লোতি (পারেন) সঃ (তিনি) যুক্তঃ (আত্ম সমাহিত), সঃ নরঃ (সেই মনুষ্যই) সুখী (প্রকৃত সুখী) ॥২৩॥


যিনি জড়দেহ ত্যাগের পূর্ব্ব পর্য্যন্ত নিষ্কাম কর্ম্মযোগ দ্বারা কাম ও ক্রোধের বেগকে উদ্ভব সময়েই সহ্য করিতে সমর্থ হন, তিনিই যথার্থ যোগযুক্ত, এবং সেই মনুষ্যই প্রকৃত সুখী জানিবে ॥২৩॥

 

যোঽন্তঃ সুখোঽন্তরারামস্তথান্তর্জ্যোতিরেব যঃ ।
স যোগী ব্রহ্মনির্ব্বাণং ব্রহ্মভূতোঽধিগচ্ছতি ॥২৪॥


যঃ (যিনি) অন্তঃ সুখঃ (অন্তর্ব্বর্ত্তি আত্মাতেই সুখানুভব করেন) অন্তরারামঃ (অন্তর্ব্বর্ত্তি আত্মাতেই রত) তথা যঃ অন্তর্জ্জ্যোতিঃ এব (সেইরূপ যিনি অন্তর্ব্বর্ত্তি আত্মাতেই দৃষ্টি বিশিষ্ট) সঃ যোগী (সেই নিষ্কাম কর্ম্মযোগী) ব্রহ্মভূতঃ (শুদ্ধ জৈব স্বরূপ লাভ করিয়া) ব্রহ্মনির্ব্বাণং (মোক্ষরূপ পরমাত্মাকে) অধিগচ্ছতি (লাভ করেন) ॥২৪॥


যিনি অন্তরাত্মাতেই সুখী, অন্তরাত্মাতেই রত এবং অন্তরাত্মাতেই দৃষ্টিবিশিষ্ট, সেই নিষ্কাম কর্ম্মযোগী নিজের শুদ্ধ জৈবস্বরূপ লাভ করিয়া ব্রহ্ম-নির্ব্বাণরূপ মুক্তি (ব্রহ্মপুর প্রবেশ) প্রাপ্ত হন ॥২৪॥

 

লভন্তে ব্রহ্মনির্ব্বাণমৃষয়ঃ ক্ষীণকল্মষাঃ ।
ছিন্নদ্বৈধা যতাত্মানঃ সর্ব্বভূতহিতে রতাঃ ॥২৫॥


ক্ষীণকল্মষাঃ (নিষ্পাপ), ছিন্নদ্বৈধাঃ (নষ্ট সংশয়), যতাত্মানঃ (সংযত চিত্ত), সর্ব্বভূতহিতে রতাঃ (ও সর্ব্বভূতের হিতে রত) ঋষয়ঃ (তত্ত্বদর্শিগণ) ব্রহ্মনির্ব্বাণম্ (মোক্ষ) লভন্তে (লাভ করেন) ॥২৫॥


নিষ্পাপ, সংশয়শূন্য, সংয়তচিত্ত এবং সকল জীবের হিতকার্য্যে রত তত্ত্বদর্শিগণ এই ব্রহ্মনির্ব্বাণ লাভ করিয়া থাকেন ॥২৫॥

 

কামক্রোধবিমুক্তানাং যতীনাং যতচেতসাম্ ।
অভিতো ব্রহ্মনির্ব্বাণং বর্ত্ততে বিদিতাত্মনাম্ ॥২৬॥


কামক্রোধবিমুক্তানাং (কাম ক্রোধ হীন) বিদিতাত্মনাম্ (ত্বং পদার্থ জ্ঞানী) যতীনাং (যতিগণের) যতচেতসাম্ [সতাম্] (চিত্তোপলক্ষিত লিঙ্গশরীর ক্ষয় হইলে) অভিতঃ (জীবনে ও মরণে সর্ব্বতোভাবে) ব্রহ্মনির্ব্বাণং (ব্রহ্ম নির্ব্বাণ) বর্ত্ততে (হইয়া থাকে) ॥২৬॥


কামক্রোধহীন আত্মস্বরূপ জ্ঞানী যতিগণের চিত্তোপলক্ষিত লিঙ্গ শরীর ক্ষয় হইলে জীবনে ও মরণে সর্ব্বতোভাবেই ব্রহ্মনির্ব্বাণ লাভ হইয়া থাকে ॥২৬॥

 

স্পর্শান্ কৃত্বা বহির্ব্বাহ্যাংশ্চক্ষুশ্চৈবান্তরে ভ্রুবোঃ ।
প্রাণাপানৌ সমৌ কৃত্বা নাসাভ্যন্তরচারিণৌ ॥২৭॥
যতেন্দ্রিয়মনোবুদ্ধির্মুনির্মোক্ষপরায়ণঃ ।
বিগতেচ্ছাভয়ক্রোধো যঃ সদা মুক্ত এব সঃ ॥২৮॥


যঃ (যে পুরুষ) [মনঃ প্রবিষ্টান্] (মনে প্রবিষ্ট) বাহ্যান্ স্পর্শান্ (বাহ্য শব্দাদি বিষয়কে) বহিঃ কৃত্বা (মন হইতে বহিষ্কৃত করিয়া) চক্ষুঃ চ এব (চক্ষুকেও) ভ্রুবোঃ (ভ্রদ্বয়ের) অন্তরে (মধ্যে) [কৃত্বা] (স্থাপন পূর্ব্বক) নাসাভ্যন্তরচারিণৌ (নাসিকা মধ্যে বিচরণকারী) প্রাণাপানৌ (প্রাণও অপান বায়ুকে) সমৌ (কুম্ভক দ্বারা সমতা বিধান) কৃত্বা (করিয়া) যতেন্দ্রিয়মনোবুদ্ধিঃ (ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি-সংযমকারী) মোক্ষপরায়ণঃ (মোক্ষ পরায়ণ) বিগতেচ্ছাভয়ক্রোধঃ (ইচ্ছা, ভয় ও ক্রোধ রহিত) মুনিঃ (এবং আত্ম মননশীল) সঃ (সেই পুরুষ) সদা (সর্ব্বদা) মুক্ত এব (মুক্তই) ॥২৭–২৮॥


যে ব্যক্তি মনে প্রবিষ্ট শব্দাদি বাহ্য বিষয় সকলকে মন হইতে বহিষ্কৃত করিয়া চক্ষুকে ভ্রূদ্বয়ের মধ্যবর্ত্তী রাখিয়া নাসিকা মধ্যে বিচরণকারী প্রাণ ও অপান বায়ুকে কুম্ভক দ্বারা সমতা বিধান করতঃ ইন্দ্রিয় মন ও বুদ্ধিকে জয় পূর্ব্বক মোক্ষ পরায়ণ, এবং ইচ্ছা, ভয় ও ক্রোধ দূর করিতে পারিয়াছেন, আত্মমননশীল সেই পুরুষই সর্ব্বদা অর্থাৎ জীবিতাবস্থায়ও মুক্তই জানিবে ॥২৭–২৮॥

 

ভোক্তারং যজ্ঞতপসাং সর্ব্বলোকমহেশ্বরম্ ।
সুহৃদং সর্ব্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিমৃচ্ছতি ॥২৯॥


যজ্ঞতপসাং (কর্ম্মিগণ কৃত যজ্ঞ ও জ্ঞানিগণ কৃত তপস্যার) ভোক্তারং (পালক অর্থাৎ কর্ম্মী ও জ্ঞানীর উপাস্য) সর্ব্বলোকমহেশ্বরম্ (সর্ব্বলোকের নিয়ন্তা ও উপাস্য—নারায়ণ) সর্ব্বভূতানাং (সমস্ত জীবের) সুহৃদং (কৃপা পূর্ব্বক স্বভক্ত দ্বারা স্বভক্তি উপদেশ দানে হিতকারী অর্থাৎ ভক্তগণের আরাধ্য বান্ধব কৃষ্ণ) মাং (আমাকে) জ্ঞাত্বা (জানিয়া) [জীবঃ] (জীব) শান্তিম্ (স্বরূপানন্দ) ঋচ্ছতি (লাভ করেন) ॥২৯॥


কর্ম্মিকৃত যজ্ঞ ও জ্ঞানিকৃত তপস্যার ভোক্তা অর্থাৎ তাহাদের উপাস্য, সর্ব্বলোকের অন্তর্যামী ও মুক্তিদাতারূপে উপাস্য পুরুষরূপ আমি (নারায়ণ) এবং সর্ব্বভূতের সুহৃৎ অর্থাৎ ভক্তগণেরও আরাধ্য-বান্ধব আমি (কৃষ্ণ) । এবম্ভূত-স্বরূপ আমাকে জানিয়া জীব স্বরূপানন্দ লাভ করেন ॥২৯॥

 

ইতি শ্রীমহাভারতে শতসাহস্র্যাং সংহিতায়াং বৈয়াসিক্যাং
ভীষ্মপর্ব্বণি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং
যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসংবাদে কর্ম্মসন্ন্যাসযোগো নাম
পঞ্চমোঽধ্যায়ঃ ॥৫॥


ইতি পঞ্চম অধ্যায়ের অন্বয় সমাপ্ত ॥


ইতি পঞ্চম অধ্যায়ের বঙ্গানুবাদ সমাপ্ত ॥


 

 

—···—

 

 

← ৪ জ্ঞানযোগ ৬ ধ্যানযোগ →

 

সূচিপত্র:
মঙ্গলাচরণম্
গ্রন্থ-পরিচয়
প্রকাশকের নিবেদন
১ সৈন্য-দর্শন
২ সাংখ্যযোগ
৩ কর্ম্মযোগ
৪ জ্ঞানযোগ
৫ কর্ম্মসন্ন্যাসযোগ
৬ ধ্যানযোগ
৭ জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ
৮ তারকব্রহ্মযোগ
৯ রাজগুহ্যযোগ
১০ বিভূতিযোগ
১১ বিশ্বরূপ-দর্শনযোগ
১২ ভক্তিযোগ
১৩ প্রকৃতিপুরুষ-বিবেক-যোগ
১৪ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৫ পুরুষোত্তমযোগ
১৬ দৈবাসুরসম্পদ্-বিভাগ যোগ
১৭ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৮ মোক্ষযোগ
গীতামাহাত্ম্যম্
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥