আমাদের শ্রীগুরুপরম্পরা :
শ্রীশ্রীল ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ ভগবান্ শ্রীশ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর
              প্রভুপাদ
“শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠে সূর্যাস্ত কখনই হয় না” :
আমাদের মঠের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
 
আমাদের সম্পর্কে শ্রীউপদেশ শ্রীগ্রন্থাগার শ্রীগৌড়ীয় পঞ্জিকা ছবি ENGLISH
 

ভবরোগের বোঝা

ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তি নির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের হরি-কথামৃত
৬ মে ২০১৮

 

দীক্ষা নিয়ে শুধু চারবার মালা জপলে আর আজেবাজে কথা বেশি বললে, কাজ হবে না । শুধু হরিনাম নিলেই হবে না—হরিনাম নিলে ঠাকুরের প্রসাদ ভক্ষণ করতে হবে : “প্রসাদ-সেবা করিতে হয় সকল প্রপঞ্চ জয়” । প্রসাদ সেবা করবেন ।

শুধু ঠাকুরকে পূজা করলেও হবে না । আপনারা আমাকে প্রতি দিন গলায় মালা দেন, পায়ে ফুল দেন, আর আমার যখন ক্ষিদা লাগছে, তখন খেতে দিচ্ছেন না, তাহলে কি কাজ হয় ? প্রত্যেক দিন ঠাকুরকে ভোগ দিতে হবে । আমরা যেমন প্রতিদিন খাই, ঠাকুরকেও খেতে দিতে হবে । এটা হচ্ছে নিত্যসেবা ।

ঠাকুরকে সকালবেলা উঠে মঙ্গলারতি করতে হবে । সকাল সকাল শুরু করতে হবে—টিভি দেখা, রেডিও শোনা, সিরিয়েল দেখা, ওই সব বন্ধ করতে হবে । এগুলো হচ্ছে দ্বেষ ও অভিনিবেশ । সকালে উঠে মঙ্গলারতি করতে হবে, বাল্য-ভোগ দিতে হবে, অর্চ্চন করতে হবে, তারপর ঠাকুরকে ভোগ দিতে হবে, ভোগ দিয়ে ভোগারতি কীর্ত্তন করবেন । দুপুরে ঠাকুরকে শয়ন দিতে হবে, বিকালে আবার কিছু বৈকালের ভোগ দিতে হবে (ফল, মিষ্টি, শসা, যে যা জোটাতে পারেন, সেটা দেবেন) । সন্ধ্যা সময় আরতি করবেন আর যা রান্না হবে সে ভোগ দিয়ে রাত্রে ঠাকুরকে শয়ন দিয়ে তাঁর প্রসাদ পাবেন । এটাই হলো নিয়ম, আর এইটা নিয়ম করে সব সময় চলতে হবে ।

“প্রসাদ-সেবা করিতে হয় সকল প্রপঞ্চ জয় ।” প্রসাদ সেবা করতে হবে ।

প্রশ্ন : প্রপঞ্চ মানে কী ?

প্রপঞ্চ মানে পাঁচটা রোগ আছে : অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ, অভিনিবেশ । এটা ক্যান্সার রোগ নয়, গল ব্লাডার স্টোন নয়, টিউমার নয়—প্রপঞ্চ মানে ভবরোগ ।

অবিদ্যা—মানে অজ্ঞান । যাহা জাগতিক স্কুলে পড়ানো হয় সেগুলো হচ্ছে অবিদ্যা বা জড়বিদ্যা । এই সব বিদ্যার ফলে জীব নিজের িচৎ-স্বরূপ (অর্থাৎ আমি কে) ভুলে যায় । এটা হচ্ছে রোগ । “আমি অমুক মহারাজ,” “আমি অমুক মঠের ম্যানেজার,” “আমি বাড়ির মালিক, কর্তা,” “আমার ছেলে-মেয়েরা, স্ত্রী আমার আনুগত্যে থাকবে, আমার নিচে থাকবে ।”

‘কৃষ্ণ-নিত্যদাস’—জীব তাহা ভুলি’ গেল ।
এই দোষে মায়া তার গলায় বান্ধিল ॥

(চৈঃ চঃ ২/২২/২৪)

বড় বড় সায়েন্টিস্টরা বলে আমরা সব আবিস্কার করেছি, আমরা সব করেছি, ভগবান নেই । আমি বলি : “যদি ভগবান নেই তাহলে মানুষের প্রাণ দাও দেখি । তোমরা মানুষের জীবন বাঁচাতে পার কিন্তু মৃত মানুষকে বাঁচাও দেখি ।” জীব যে চিৎস্বরূপ সেটা হচ্ছে “জীব নিত্যকৃষ্ণদাস ।” জীব নিজের চিৎস্বরূপ—আমি যে একটা দেহ নই, আমি যে আত্মা—ভুলে গেছে । সে ভুলে যাওয়ার নামই হচ্ছে অবিদ্যা ।

অস্মিতা—স্থূল জড়দেহে আত্মবুদ্ধি । মায়াবাদীরা এটা করে । দেহবুদ্ধি মানে আমি ভাবছি যে, আমি আর আমার দেহ এক বস্তু । কিন্তু সেটা সত্য কথা নয় । আমিটা হচ্ছে আত্মা আর দেহটা হচ্ছে পঞ্চভৌতিক (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম) । দেহবুদ্ধি দ্বারা আমরা সব সময় ভাবছি, “আমার বাড়ি,” “আমার পুত্র,” “আমার স্ত্রী,” “আমার সন্তান,”— আমার আমার করে যাই ।

রাগ—লোকের সঙ্গে রাগ করা সেই রাগ এটা নয় । দেহের অনুকূল জড়বিষয়ে তীব্র আসক্তি । এটা মানে দেহের প্রতি আসক্তি, সব সময় দেহের চিন্তা, আমি আমার চিন্তা করা : “আমার কী হবে ? আমি মঠে এসেছি, কিন্তু বয়স্ক যখন হয়ে যাব আমাকে কে দেখবে ? কিছু টাকা জমাতে হবে ।” এটা হচ্ছে রোগ ।

দ্বেষ—বিষয় ভোগের প্রতিকূল বিষয়ে দ্বেষবুদ্ধি । যাঁরা হারিনাম করছেন বা সেবা করছেন তাঁদের প্রতি হিংসা করা—নিজে করব না আর অন্য কাউকে করতেও দেব না, আর যদি কেউ কিছু করছেন, আমি তাঁর পিছনে দোষ দিচ্ছি না নিন্দা করছি ।

আসলে আমরা ভোগীও নই, আমরা ত্যাগীও নই । যেমন একটা গাছের আম হচ্ছে—আমি আমটা যদি খেয়ে নিই তাহলে আমি ভোগী, আর আমি ত্যাগী মানে গাছের আমটা দেখে আমি বলছি, “খাব না !” এবং ফলটা পচে যায় । কিন্তু দুটোই ভুল ধারণা । যদি আমি আমটা ছিলে গোবিন্দের সেবায় লাগিয়ে দেই আর পরে প্রসাদ নিই, তাহলে এইটা হচ্ছে সেবা । ভোগও করলেও হবে না, ত্যাগও করলে হবে না ।

আর অভিনিবেশ মানে অনুকূল বিষয়ের প্রতি মমতা বা আবিষ্টতা এবং তাহার ত্যাগে অসহিষ্ণুতা । আমি জানি কী কী ভক্তির প্রতিকূল কিন্তু সেটা ছাড়তে পারছি না । আর যে ভক্ত্যঙ্গ আছে—সাধুদের সেবা করতে হয়, সবজি রান্না করতে হয়, ঠাকুরের বাসন মাজতে হয়, জায়গায় ঝাড়ু দিতে হয়, পরিষ্কার করতে হয়—এই সবের প্রতি আসক্তি নেই, এসবের প্রতি আমি অনাসক্ত কিন্তু উলটা দিকে (জড়বিষয়ের প্রতি) আমার আসক্তি আছে । জুয়া খেলা, তাস খেলা ; মদ, গাঁজা, পান, বিড়ি, সিগারেট ; পরের মেয়ের দিকে চোখ দেওয়া, পরের স্ত্রীর দিকে লোভ ; মাছ মাংস—এসব ছাড়তে পারছি না । এটা হচ্ছে অভিনিবেশ ।

এই পাঁচটা রোগ আছে । প্রসাদ সেবা করলে এই পাঁচটা রোগ চলে যাবে । পাঁচটা রোগ সারাতে হবে ।

একটা চিন্তা করুন তো । আপনি আপনার বাড়িতে আমাকে নিমন্ত্রণ করছেন, “বাবা, আমার বাড়ি যাবেন ।” কিন্তু আপনার যা ঘর আছে সে সব ঘরের মধ্যে আপনি ধানের বস্তা (চালের বস্তা, ডালের বস্তা, গমের বস্তা আর অন্য সংসারের জিনিস) বোঝাই করে রেখে দেন । কোথায় আমাকে বসতে দেবেন, বলুন ? আপনার জায়গাই তো নেই । সেইরকম গুরুদেব, ভগবান, ভক্তিদেবীকে বসার জন্য হৃদয়ে জায়গা দিতে হবে । হৃদয়ে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য্য, অভিমান, রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ, কনক, কামিনী, প্রতিষ্ঠা—এগুলো দিয়ে ভর্তি করে রাখেন (আপনার হৃদয়ে বসার জায়গা নেই) আর ওখানে যদি ডাকছেন ভক্তিদেবীকে বা ভগবানকে, তাহলে তাঁদের রাখবেন কোথায় ? ভক্তিদেবী এসে ফিরে যাবেন ।

 


 

← গ্রন্থাগারে

অন্য রচনা:
শ্রীনৃসিংহদেবের কথা
দণ্ড মহৎসব
মায়ার চিন্তা বা কৃষ্ণের চিন্তা ?
আমাদের একমাত্র উপায়
ভক্তির অভাব
গৃহে আবদ্ধ
মায়ের পেট থেকে মায়ার পেটের মধ্যে
জীবকে সত্য দয়া কি ?
ভোগী নই ত্যাগীও নই
শ্রবণ-কীর্ত্তনে মতি
ভগবানের কৃপা ও আপনার চেষ্টা
শান্তির গুপ্ত কথা
পবিত্র জীবন
বামনদেবের কথা
ভক্ত ও নাপিত
ভগবানের চরণে পথ
পূজনীয় বিসর্জন
শিবজী মহারাজ : পরম বৈষ্ণব
শ্রীহরিনাম দীক্ষা : গুরুপাদপদ্মের দান
আমি তো সব ব্যবস্থা করি নাকি ?
চকচক করলেই সোনা হয় না
আমার শোচন
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥