আমাদের শ্রীগুরুপরম্পরা :
শ্রীশ্রীল ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ ভগবান্ শ্রীশ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর
              প্রভুপাদ
“শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠে সূর্যাস্ত কখনই হয় না” :
আমাদের মঠের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
 
আমাদের সম্পর্কে শ্রীউপদেশ শ্রীগ্রন্থাগার শ্রীগৌড়ীয় পঞ্জিকা ছবি ENGLISH
 

সাধুসঙ্গের প্রভাব

ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তি নির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের হরি-কথামৃত
২৩ মে ২০১৮

 

প্রত্যেক দিন কীর্ত্তনে আমরা গাই, “রামচন্দ্র সঙ্গ মাগে নরোত্তম দাস” । নরোত্তমদাস ঠাকুর রামচন্দ্র কবিরাজের সঙ্গ চাইছেন । বিভিন্ন কীর্ত্তনে নিজের নাম বা গুরুদেবের নাম করে লেখা আছে, এখানে গিয়ে নরোত্তমদাস ঠাকুরের গুরু কি রামচন্দ্র ? না । তিনি হচ্ছেন তাঁদের শিক্ষা-গুরু বলা চলে । কেন তিনি তাঁর সঙ্গ মাগছেন ? কেন এটা প্রার্থনা করছেন ?

মহাপ্রভুর পরে তিনজন সমসাময়িক ছিলেন—শ্যামানন্দ প্রভু, আচার্য্য শ্রীনিবাস আর নরোত্তমদাস ঠাকুর । এঁরা মহাপ্রভুর পরে তাঁর লাইনটা রক্ষা করলেন ।

একদিন আচার্য্য শ্রীনিবাস আর নরোত্তমদাস ঠাকুর একটা নিমগাছের তলায় বসে ছিলেন আর ওখান দিয়ে রামচন্দ্র কবিরাজ বিয়ে করে যাচ্ছিলেন । আগের যুগে কি করে লোক বিয়ে করতেন আপনারা দেখেছেন কি না জানি না, আপনাদের বাবা মা তা দেখেছেন, আমিও বাবা মায়ের মুখে শুনেছি । আগে লোক পণ (টাকা) দিয়ে মেয়ে কিনে পালকি করে নিয়ে আসত । সেইজন্য, রামচন্দ্র কবিরাজ তাঁর বউকে নিয়ে একসঙ্গে পালকিতে ওঁকে শ্বশুর বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিলেন । ওইটা দেখেই আচার্য্য শ্রীনিবাস বললেন, “গেল ! এই লোকটা মায়ার কবলে পড়ে গেল, এর জীবন বৃথা হয়ে গেল...”

এটা কথা রামচন্দ্র কবিরাজের কানে গেল আর তিনি বাড়িতে গিয়ে চিন্তা করতেন, “যখন নিমগাছের তলা দিয়ে আসছিলাম, দুইজন সাধু ওখানে বসে ছিলেন আর তাঁদের মধ্যে একজন সাধু আমাকে দেখেই বললেন যে, আমার জীবন বৃথা হয়ে গিয়েছে । মানেটা কী ? আমরা সংসার করেছি, জীবন বৃথা হয়ে গেল মানে কী ?” রামচন্দ্র কবিরাজ সারা ক্ষণ ওই চিন্তা করতেন : “লোকটা আমাকে কী বললেন ?” বউয়ের চিন্তা করছিলেন না—বাড়িতে নতুন বউ এসেছেন, বাসর রাত্র, এসব আর চিন্তা নেই, শুধু ওই সাধুদের কথা মাথার মধ্যে আসল । “সাধু কী বললেন ? জীবন চলে গেল ? মায়ার মধ্যে পড়ে গেলাম - এটার মানে কী ?” এসব সারা ক্ষণ চিন্তা করতে করতে পরের দিন সকালবেলা নিমগাছটা খুঁজে বের করে সাধুদের কাছে চলে এসে বললেন, “কালকে যখন আমরা স্বামী স্ত্রী যাচ্ছিলাম পালকি করে তখন আমার কানে ওইটা শুনলাম… আপনি বললেন যে, আমার জীবন বৃথা হয়ে গেল, যে আমি মায়ার কবলে পড়ে গেলাম । কী ব্যাপার ?” (শুধু কান দিয়ে শুনলে হবে না—হৃদয় দিয়ে শ্রবণ করতে হবে  । রামচন্দ্র কবিরাজ হৃদয় দিয়ে শ্রবণ করলেন আর তখন সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ওই কথাটা হৃদয়ে লেগেছে ।) তখন আচার্য্য শ্রীনিবাস আর নরোত্তমদাস ঠাকুর হরিকথা বলতে শুরু করলেন আর তাঁকে সব ভাল করে বুঝিয়ে দিলেন—মায়া কাকে বলে, মায়ার কবলে পড়লে কী অবস্থা হয় ইত্যাদি ।

সর্বশেষে রামচন্দ্র কবিরাজ আচার্য্য শ্রীনিবাসের কথা শুনতে শুনতে বললেন, “আমি আপনার কাছ থেকে দীক্ষা নিতে চাই ।” দীক্ষা দিয়ে আচার্য্য শ্রীনিবাস বললেন, “তুমি দীক্ষা নিয়েছ, এখন বাড়ি চলে যাও ।” বাড়ি গিয়ে আর কিছুতেই তাঁর সংসারে মন লাগছে না । তিনি আবার চলে আসলেন । আচার্য্য শ্রীনিবাস অবাক হয়ে বললেন, “সে কী ? তুমি আবার চলে এসেছ ? তোমার বাড়িতে নতুন স্ত্রী, কয়েক দিন আগে বিয়ে হয়েছে আর কালকে দীক্ষা নিয়ে চলে গিয়ে আবার পরের দিন চলে এসেছ ? তুমি ঠিক করে বাড়ি ফিরে যাও ।” বুঝিয়ে টুঝিয়ে দিয়েছেন কিন্তু তিনি বারবার ফিরে চলে আসলেন । তখন তাঁকে আর কী বলবেন ? তখন আচার্য্য শ্রীনিবাস আর তাঁকে ফিরাতে পারলেন না—সেইভাবে রামচন্দ্র কবিরাজ আচার্য্য শ্রীনিবাসের কাছে থাকতে লাগলেন আর সর্বশেষে তাঁর সঙ্গে বৃন্দাবনে চলে গেলেন ।

এটাই বলা হচ্ছে সাধু-সঙ্গ—তিনি সুন্দর ভাবে হৃদয় দিয়ে কথাটা শ্রবণ করেছেন আর সেই শোনার ফলে তাঁর দেখুন কী হয়ে গেল ? সাধুসঙ্গের প্রভাবে সদ্গুরুর কাছে শরণাপন্ন হয়ে তিনি হরিভজন করতে পারলেন—শুধু তাই নয়, বাড়ি ঘর ছেড়ে দিয়ে তিনি পুরাপুরি চলে আসলেন । তাহলে শ্রবণের কী ফল ? বুঝতে পারছেন ? হৃদয় দিয়ে শ্রবণ করতে হয় ।

সেইজন্য নরোত্তমদাস ঠাকুর বলছেন, “রামচন্দ্র সঙ্গ মাগে নরোত্তম দাস ।”

‘সাধুসঙ্গ’, ‘সাধুসঙ্গ’—সর্ব্বশাস্ত্রে কয় ।
লবমাত্র সাধুসঙ্গে সর্ব্বসিদ্ধি হয় ॥

(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, ২/২২/৫৪)

প্রকৃত সাধুসঙ্গ হলে তবে আমাদের পরমকল্যাণ বস্তু লাভ হবে ।

অসাধুসঙ্গে ভাই কৃষ্ণনাম নাহি হয় ।
নামাক্ষর বাহিরায় বটে তবু নাম কভু নয় ॥

(শ্রীশ্রীপ্রেমবিবর্ত্ত, ৭/১)

অসাধুসঙ্গে কখনও কৃষ্ণনাম হয় না । লবমাত্র সাধুসঙ্গ হলেই তার ফলে সর্ব্বসিদ্ধি হয়ে যাবে ।

আপনারা বারবার এখানে আসেন কিন্তু সত্যিকারের সাধুসঙ্গ যদি হত, তাহলে আপনারা আরও অনেক উপরে উঠতে পারতেন । আর যদি আপনাদের মনে হয় যে, “সাধু আমার মত খায়, সাধু আমার মত বাথরুমে যায়, সাধু আমার মত স্নান করে, সে আমার মত একই রকম ব্যক্তি”,—তাহলে সেটা সাধুসঙ্গ নয় । সাধুর বাহ্যিক বিষয় বস্তু শুধু দেখেন অার তাঁর আসল বিষয় বস্তু দেখতে পারেন না । সেইজন্য, আমাদের সত্যিকারের সাধুসঙ্গ করতে হবে—হৃদয় দিয়ে আর নিষ্কাম ভাবে ।

 


 

← গ্রন্থাগারে

অন্য রচনা:
শ্রীনৃসিংহদেবের কথা
দণ্ড মহৎসব
মায়ার চিন্তা বা কৃষ্ণের চিন্তা ?
আমাদের একমাত্র উপায়
ভক্তির অভাব
গৃহে আবদ্ধ
মায়ের পেট থেকে মায়ার পেটের মধ্যে
জীবকে সত্য দয়া কি ?
ভোগী নই ত্যাগীও নই
শ্রবণ-কীর্ত্তনে মতি
ভগবানের কৃপা ও আপনার চেষ্টা
শান্তির গুপ্ত কথা
পবিত্র জীবন
বামনদেবের কথা
ভক্ত ও নাপিত
ভগবানের চরণে পথ
পূজনীয় বিসর্জন
শিবজী মহারাজ : পরম বৈষ্ণব
শ্রীহরিনাম দীক্ষা : গুরুপাদপদ্মের দান
আমি তো সব ব্যবস্থা করি নাকি ?
চকচক করলেই সোনা হয় না
আমার শোচন
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥