| |||||||
|
|||||||
মায়ার সাথে আপোষ করা যায় না
ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তি নির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের হরি-কথামৃত
জয় ওঁ বিষ্ণুপাদ জগৎগুরু শ্রীল ভক্তি সুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ কী
জয় প্রথমে আমার গুরুপাদপদ্ম ওঁ বিষ্ণুপাদ জগৎগুরু শ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজের রাতুলচরণে ষাষ্টাঙ্গে দণ্ডবৎ পূর্ব্বক সেবামুখে তাঁহার অহৈতুকী কৃপা প্রার্থনা ভিক্ষা করছি । তারপর গুরুবর্গ, গুরুভ্রাতৃমণ্ডলী, শ্রোত্রমণ্ডলী, মাতৃমণ্ডলী, ভক্তমণ্ডলী আপনাদের শ্রীচরণে অধমের দণ্ডবৎ প্রণতি জ্ঞাপন করছি যে এই অধমকে কৃপা করবেন । অজকে অনেক দিন পরে আমরা সুযোগ পেয়েছি কিছু ভগবানের কথা শুনবার জন্য । সব সময় ত ভগবানের কথা শোনা হয়ে উঠে কারণ মঠে বিভিন্ন সেবা, মঠে বিভিন্ন ধরনের কাজ-কর্ম্ম নিয়ে সব সময়ই ব্যস্ত থকতে হয় । কিন্তু সুযোগটা সব সময় কমই এলেই তারমধ্যেও সময় বের করে নিতে হয় ভগবানের কথা আলোচনা করবার জন্য, ভগবানের কীর্ত্তন করবার জন্য—কৃষ্ণকথা, হরিকথা, ভগবানের কথা বিনে যেন দিন নহি যায় । ভগবানের সেবাটাও হরিনাম সঙ্কীর্ত্তন হয় । একাঙ্গ সাধন করলেই, ৬৪-প্রকার ভক্ত্যঙ্গ সাধন হয়ে যায় । একসঙ্গে সব ৬৪-প্রকার ভক্ত্যঙ্গ সাধন করা যাবে না, আবার শাস্ত্রে বলেছে সেবোন্ মুখে কহ কৃষ্ণনাম—সেবা করতে করতে হরিনাম, ভগবানের নাম করা যায় । আমরা সেই সুযোগটা লাভ করেছি—আমরা ভগবানের কথা চিন্তা করি’ ভগবানের সেবা করতে পারি । এই জগতে আমরা তো আর বেশি দিন ঠিকই থাকব না, এটা বড় কথা নয় । যদি ১০০ বছরই বাঁচি কিন্তু তার মধ্যে কিছুই না করলাম, জীবের জন্য দয়া না করলাম, জীবের চিন্তা না করলাম, গুরুদেব-ভগবানের সেবা না করলাম, নিজের স্বার্থপরের মত ভাল খেলাম, ভাল পরলাম, ভাল ঘুমলাম—এটা যদি চিন্তা করে গেলাম তাহলে সে জীবন ১০০ বছর থাকা আর না থাকা সমান কথা । সেটা অনর্থক, নিরর্থ—কন অর্থ হয় না । ১০০ বছর বেঁচে থেকে যদি জীবের প্রতি দয়াই না হল, সত্যিকারের জীবে দয়া করা যদি না গেল, গুরু-সেবা, ভগবানের সেবা করা না গেল, তাহলে সে ১০০ বছর বেঁচে থাকার আমাদের কন দরকার নেয় । কিন্তু আমি ৩০ বছরও বাঁচি, ৪০ বছরই বাঁচি, কিন্তু আমি এই ৪০ বছরের মধ্যে জীবের জন্য কী করে গেলাম, ভগবানের জন্য কী করে গেলাম, বৈষ্ণবের জন্য কী করে গেলাম, ভক্তের জন্য কী করে গেলাম—সেই টা ভাবতে হবে, তাহলে সেই ৪০ বছর জীবের থাকা সার্থক জীবন… আমরা অপরকে বিচার করতে পারি না । নিজের দোষ কী আগে দেখা উচিৎ কিন্তু আমরা তো নিজের দোষ দেখতে পাই না, সব সময় অপরের দোষ খোঁজার চেষ্টা করি আর নিজের মধ্যে কী কী দোষ আছে সেটা আমরা কখনও ভাবি না । এমন মায়াবদ্ধ জীব আমরা—মায়ার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে আমরা নিজেদের দোষটা কখনই দেখতে পাই না, আমরা সব সময় অপরের দোষটা খোঁজার চেষ্টা করি । বৈষ্ণব হবে অদোষ-দরশি—অপরের দোষ দেখবেন না ; কিন্তু আমরা সব সময় অপরের দোষ দেখার চেষ্টা করি । নিজের দোষটা কী সেটা কোখোনই খোঁজার চেষ্টা করি না । তাই যত দিনই এই জগতে থাকি, তত দিন যদি আমরা একটু হরি-গুরু-বৈষ্ণবের সেবা করতে পারি, ভগবানের সেবা করতে পারি, তাহলে আমাদের জীবন সার্থক হবে, অল্প দিন বাঁচলেও সেই তো জীবন সার্থক হয়ে যাবে । তাহলে আমরা প্রকৃত অর্থে ভগবানের কাছে পৌঁছাতে পারব । আমরা সব সময় “শরণাগত, শরণাগত” করি কিন্তু কইজন আমরা ভগবানের কাছে শরণাগত হয়েছি ? কইজন আমরা গুরুদেবের কাছে শরণাগত হয়েছি ? গুরুসেবার করিবার পরিবর্তে গুরুদেবের কাছে দীক্ষা নাওয়ার নাম করে দীক্ষা নাওয়ার অভিনয় করি । গুরুর সেবার পরিবর্তে গুরু-ভোগী, গুরু-ত্যাগী হয়ে পড়ি কন্তু গুরু-সেবী হতে পারি নি, গুরু-সেবা করতে পারি নি । নিজের স্বার্থ, নিজের জন্য, নিজের ভাল-মন্দ, টাকার জন্য জীবনটা কাটিয়ে গেলাম কিন্তু আমরা কখনই অপরের চিন্তা করলাম না, জীবের জন্য চিন্তা করলাম না, জীবে যে কী করে মঙ্গল লাভ হয়, সে চিন্তা করলাম না । এই কথা সব সময় মনে রাখতে হবে ! এক জন যদি আমার কাছে দীক্ষা নেয়, সেইটা আমাকে মনে রাখতে হবে যে, আমি তাকে দীক্ষা দিয়ে উপকার করলাম না ! আমার কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে সে আমারই উপকার করেছে । আমি এক জনকে দীক্ষা দিলাম মনে করি তার একবারে গুরু কিছু করে ফেলাম ? না । সে আমার উপকার করেছে, এইটা আমাদের কর্তব্য । যে এ আমাকে দয়া করে, এইটা সব সময় আমাদের চিন্তা করতে হবে । যখন শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের কাছ থেকে কোন শিষ্য এসে দন্দবৎ করতেন, তিনি বললেন, “দাসো ‘স্মি ।” অর্থাৎ “আমি আপনার দাস ।” কিন্তু আমরা সবাই ‘master’ হয়ে যাই, সবাই ‘প্রভু’ হয়ে যাই—সবাই মহারাজ হয়ে যাই । আমাদের কেউ দণ্ডবৎ না রকলে আমরা মনে মনে রাগ হয়ে যাই, মনে মনে অহঙ্কার এসে যায় : “আমি সন্নাস নিচ্ছি, আমাকে কেউ দণ্ডবৎ করছে না ! মহারাজ বলছে না !” আমাদের মধ্যে এর মত অহঙ্কার ভাব এসে যায় কিন্তু এটা বৈষ্ণবগণের ধর্ম্ম নয়, ভাই । বৈষ্ণবের culture হচ্ছে এইরকম—
দৈন্য, দয়া, অন্যে মান, প্রতিষ্ঠা বর্জ্জন । দৈন্যতা থাকতে হবে । দয়া থাকতে হবে । অপরের সম্মান করতে হবে । এইগুণটা সব সময় থাকতে হবে । আমাদের বড়ও হাওয়ার প্রযোজন নয় । মহাপ্রভু কী বলেছেন ?
ন ধনং ন জনং ন সুন্দরীং কবিতাং বা জগদীশ কাময়ে । এই শ্লোকটা বর্ণনা করে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর কীর্ত্তন করেছেন :
ধন জন আর কবিতা সুন্দরী ধন, জন, কবিতা, সুন্দরী… কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে, বহির জগতের লোক, যারা কৃষ্ণবহির্মুখ জীব, তারা ভগবানের কাছে এসে প্রার্থনা করে, “ধনং দেহি, বিদ্যাং দেহি, রূপং দেহি, ভার্যাং দেহি, কবিতাং সুন্দরীং দেহি”—এটা সব সময় চায় । এটা পূজা করার সময় বামুনরাও বলে, লোকেরাও বলে—এটা সব সময় চিন্তা করে থাকে কিন্তু কপালে যেটা আছে, সেটাই হবে । আপনি দশ তলায় ঘুমিয়েও যে সুখ পাচ্ছেন, মাটিতে ঘুমিয়ে তার চাইতে আরও বেশি সুখ পাবেন । মহাপ্রভুর শিক্ষা দেখেন আপনারা । যখন কৃষ্ণ দ্বারকায় ছিলেন, তখন মহিষীরা তাকে বাতাস করতেন, তিনি পালঙ্কে শুয়ে আরামভাবে বিশ্রাম করতেন, আবার সেই ভগবান এই কলিযুগে চৈতন্য মহাপ্রভুর রূপে এসে সন্ন্যাস গ্রহণ করে মাটিতে কলার পাতার উপরে শুয়েছিলেন । জগদানন্দ পণ্ডিত ও স্বরূপ দামদর বার বার চেষ্টা করতেন মহাপ্রভুর ভাল গদি দেওয়ার জন্য কিন্তু শেষ পর্যন্ত জগদানন্দ পণ্ডিত কলার শুখনা পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিজের কপড়ের মধ্যে রেখে দিয়ে গদির মত বানিয়ে দিলেন । মহাপ্রভু সেটা গ্রহণ করলেন । কী ভাবে জীবন-যাপন করতেন রঘুনাথ দাস গোস্বামী ? কইদিন পরে (পরের শনিবার) তার চিড়া-দহি মহোৎসব হবে । আপনারা যাবেন সবাই । এই দিন দাস গোস্বামী প্রভু নিত্যানন্দ প্রভুর কৃপা লাভ করে মহাপ্রভুর কাছে চলে গেলেন আর মহাপ্রভু তাকে গ্রহণ করলেন । নিত্যানন্দের কৃপা বিনা যে কিছু হয় না সেটা এখানেই প্রমাণ । নিত্যানন্দ-তত্ত্ব হচ্ছে গুরুতত্ত্ব । “নিতাইয়ের করুণা হবে ব্রজে রাধাকৃষ্ণ পাবে, ধর নিতাইয়ের চরণ দুঃখানি । নিতাইয়ের চরণ সত্য তাঁহার সেবক নিত্য, নিতাই-পদ সদা কর আশ ।” নিত্যানন্দের চরণ বিনা যে কিছু হয় না সেইটা আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে । তাই, সব সময় ভগবানের কীর্ত্তন করতে হবে, ভগবানের নাম করতে হবে । সর্ব্বক্ষণ সব সময় ভগবানের উপর নির্ভর করতে হবে, সর্ব্বক্ষণ ভগবানের চিন্তা করতে হবে—সব সময় ভগবানের জন্য নিজের ভোগ-সুখ পরিত্যাগ করতে হয়, মায়ার কাছে surrender (সমর্পণ) করলে হবে না । ভগবানের কাছে surrender (সমর্পণ) করলে আপনার লাভ হবে । আমরা সবাই মায়ার জগতে থাকি, মায়ার কাছে surrender (আত্মসমর্পণ) করে মায়ার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে দিন রাত হয়ে যায় । আমাদের কথাই একটাই—“কৃষ্ণ বল, সঙ্গে চল ! এই মাত্র ভিক্ষা চাই ।” আপনাদের কাছে প্রার্থনা যে, আপনারা যেখানে যে অবস্থায় থাকুন না কেন, যত কিছু করুন না কেন, তার মধ্যে সব কিছু মনের পিচনে ভাগবত্-সেবা, হরি-সেবা, গুরু-সেবা, ভাগবত্-কীর্ত্তন, হরি-কীর্ত্তন, গুরু-বৈষ্ণবের গুণগণ কীর্ত্তন যদি করতে পারি, তাহলে আমাদের চরম কল্যাণ লাভ হবে আর তা না হলে বার বার গতাগত অনুসারে এই সংসারের মধ্যে আসতে হবে । নিতাই চরণ না ভজিল যাওয়া-আশা সার হইল । জয় শ্রীল গুরুমহারাজ কী জয় ।
|
• অনলাইন শুনতে :
অন্য রচনা: • শ্রীনৃসিংহদেবের কথা • দণ্ড মহৎসব • মায়ার চিন্তা বা কৃষ্ণের চিন্তা ? • আমাদের একমাত্র উপায় • ভক্তির অভাব • গৃহে আবদ্ধ • মায়ের পেট থেকে মায়ার পেটের মধ্যে • জীবকে সত্য দয়া কি ? • ভোগী নই ত্যাগীও নই • শ্রবণ-কীর্ত্তনে মতি • ভগবানের কৃপা ও আপনার চেষ্টা • শান্তির গুপ্ত কথা • পবিত্র জীবন • বামনদেবের কথা • ভক্ত ও নাপিত • ভগবানের চরণে পথ • পূজনীয় বিসর্জন • শিবজী মহারাজ : পরম বৈষ্ণব • শ্রীহরিনাম দীক্ষা : গুরুপাদপদ্মের দান • আমি তো সব ব্যবস্থা করি নাকি ? • চকচক করলেই সোনা হয় না • আমার শোচন |
||||||
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥ | |||||||
© Sri Chaitanya Saraswat Math, Nabadwip, West Bengal, India. For any enquiries please visit our contact page. |