আমাদের শ্রীগুরুপরম্পরা :
শ্রীশ্রীল ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ ভগবান্ শ্রীশ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর
              প্রভুপাদ
“শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠে সূর্যাস্ত কখনই হয় না” :
আমাদের মঠের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
 
আমাদের সম্পর্কে শ্রীউপদেশ শ্রীগ্রন্থাগার শ্রীগৌড়ীয় পঞ্জিকা ছবি ENGLISH
 

সাধুসঙ্গের সর্ব্ব শ্রেষ্ঠ ফল

ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তি নির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের হরি-কথামৃত
উলুবেড়িয়া, ১৮ জানুয়ারি ২০২০, প্রথম অংশ

 

এই শ্রীরূপানুগ লাইনটা মনে রাখতে হবে । যে গৌড়ীয়া-বৈষ্ণবগণ শ্রীরূপানুগ-ধারায় আচরণ করেছেন, তাদেরকে বাদ দিয়ে কিছু হতে পারে না । সেই লাইন ধরে আমাদেরকে যেতে হবে । এই লাইনের বাহিরে গেলে আমাদের কোন কাজ নয় । শ্রীশ্রীরূপ-সনাতনের কথা, শ্রীশ্রীরূপা-রঘুনাথের কথা, মহাপ্রভুর কথা শুনতে হবে এবং এই সব কথা প্রচার করতে হবে । যে গুরুবর্গগণ শ্রীরূপানুগ-ধারার মাধ্যমে আছেন, তাঁদের কথা শুনতে হবে ।

[শ্রোতাগণের মধ্যে গোলমাল শোনা হয় ।] কী হল ? এত কথা কিসের এখন ? একদম চুপ করুন । মহাপ্রভু বললেন,

গ্রাম্যকথা না শুনিবে, গ্রাম্যবার্ত্তা না কহিবে ।
ভাল না খাইবে আর ভাল না পরিবে ॥
অমানী মানদ হঞা কৃষ্ণনাম সদা ল'বে ।
ব্রজে রাধাকৃষ্ণ সেবা মানসে করিবে ॥

(চৈঃ চঃ, ৩/৫/২৩৬-২৩৭)

তাহলে আপনারা কি মহাপ্রভুর কথা মানবেন না ? মহাপ্রভুকে স্মরণ করবেন না ? “দিনের মধ্যে আবল-তাবল কত পচাল পাড়িতে পার, তার মধ্যে কি একবার গোবিন্দ বলতে নার ।” কত কথা আমরা বলি ! সারা মিথ্যা কথা বলি ! ভগবান আমাদের মুখটা কথা বলতেই দিয়েছেন, আর যে দিন ভগবান মুখটা (বাকশক্তি) কেড়ে নিবেন, তখন আর কথা বলতে পারব না—তখন যারা আমাদেরকে কাঁধে নিয়ে চলে যাবেন শ্মশান ঘাটে গঙ্গার ধারে, তারা বলবেন ‘বল হরি’—কিন্তু যাকে ‘বল হরি’ বলতেন বলতেন, সে আর বলবে না । আমাদের বলার যখন সময় ছিল, তখন আমরা ‘হরি বল’ বলি নি—আমরা তখন নিজের কথা বলেছি ।

সেইজন্য, গুরু-বৈষ্ণবগণ যে আমাদেরকে কথা বলেন, সে কথাটা শুনতে হবে । আমরা কীর্ত্তনে গাই :

তব নিজ-জন কোন মহাজনে
পাঠাইয়া দিলে তুমি ।
দয়া করি' মোরে পতিত দেখিয়া
কহিল আমারে গিয়া ॥

(শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, শরণাগতি)

যে এখানে উলুবেড়িয়ায় সিনিয়র (বরিষ্ঠ) ভক্তরা আছেন, তাঁরা অনেক দিন ধরে চেষ্টা করছেন—অনেক দিন ধরে আপনাদের গ্রামে গ্রামে, দরজায় দরজায় গিয়ে কী বলছেন ? “বল কৃষ্ণ, ভজ কৃষ্ণ, কর কৃষ্ণ শিক্ষা !” (চৈঃ ভাঃ, ২/১৩/৯) এই কথা মেগেছেন, এই কথা ভিক্ষা করেছেন আপনাদের শ্রীচরণে । যার ভাগ্য হয়েছে, যার পূর্ব্ব পূর্ব্ব জন্মের সুকৃতি ছিল, তারাই সাধুসঙ্গে এসে আর সাধুসঙ্গ করে তাদের হৃদয়টা একটু পরিষ্কার হয়েছে, নির্ম্মল হয়েছে—চিত্তের মল বিলীন হয়েছে । যখন আমাদের চিত্ত থেকে ময়লা-ধূলিখানা পড়েছে, তখন :

ব্রহ্মাণ্ড ভ্রমিতে কোন ভাগ্যবান্ জীব ।
গুরু-কৃষ্ণ-প্রসাদে পায় ভক্তিলতা-বীজ ॥

লোকের দ্বারে দ্বারে গিয়ে, প্রচার করে এবং সবাইয়ের হৃদয় পরিষ্কার করতে করতে, এখান ওঁদের বয়স হয়ে গিয়েছেন—কত বয়স্ক বুড়ো হয়ে গিয়েছেন তবুও আপনাদেরকে টেনে টেনে নিয়ে এখান থেকে হাওড়ায় নিয়ে যান, হাওড়া থেকে নবদ্বীপ, পুরী, বৃন্দাবন, অনেক জায়গায় জায়গায় নিয়ে যান—যেন আপনারা এই সত্যিকারের লাইনে আসতে পারেন, যেন আপনারা কৃষ্ণ পদে, ভগবানের পদের আসতে পারেন, তার জন্য ওঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন । সেই চেষ্টার ফল খুশি হওয়ায়, এখান একট মঠ স্থপান হতে যাচ্ছে । সেই মঠের নাট মন্দিরে বসে আমরা এখন হরি-কীর্ত্তন করবার একটু সুযোগ লাভ করেছি । এটা হয়েছে বহু ভাগ্যের কথা । বহু জন্মজন্মান্তর পরে আমরা এই রকম সুযোগ পেয়েছি । আমরা কীর্ত্তনেও করি,

দুর্ল্লভ মানব জন্ম লভিয়া সংসারে ।
কৃষ্ণ না ভজিনু দুঃখ কহিব কাহারে ॥
সংসার সংসার ক'রে মিছে গেল কাল ।
লাভ না হইল কিছু ঘটিল জঞ্জাল ॥
কিসের সংসার এই, ছায়াবাজী প্রায় ।
ইহাতে মমতা করি' বৃথা দিন যায় ॥
দিন যায় মিছা কাজে নিশা নিদ্রাবশে ।
নাহি ভাবি মরণ নিকটে আছে বসে ॥

(শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, কল্যাণ-কল্পতরু)

চৌরাশি লক্ষ যোনি ভ্রমণ করে আমাদের এই ভারত-ভূমিতে জন্ম গ্রহণ হয়েছে । কত বার আমরা মানুষ হয়েছি ? তার কোন শেষ নাই—কত বার আমরা অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়েছি, কত অনেক নোংরা জিনিস খেয়েছি, কত অনেক আজেবাজে জিনিস খেয়েছি কিন্তু খিদা মেটে নি । এখন ২৫০ গ্রাম চালের ভাত বা ছাগল-গোরু-মুরগি খেয়ে খিদা মিটবে । একটা গোরু যদি মরে যায় লোক ওকে মাঝে মাঝে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয় আর কুকুরগুলো সেখানে এসে ওই মরা গোরুকে নিয়ে কাড়াকাড়ি করে । আর মাঝে মাঝে রাস্তায় গিয়ে আমি দেখছি যদখন লোকে তাজা গোরু বা তাজা ছাগল কিনছে, ওই সব গোরু বা ছাগল লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে, ঘাস খাচ্ছেন—ওরা ভাবতেও পারেন না (শুনবেও না !) যে পরের মুহুর্তে ওদেরকে মরে যেতে হবে । সেই জন্য, ওই রকম খাওয়ার লোভে, পায়সার লোভে, টাকার লোভে, ধনের লভে, অর্থের লোভে, মুক্তির লোভে, ভুক্তির লোভে, ভোগ-বাসনার জন্য আমরা এই সাধন-ভজনের ফল অবলম্বন করতে পারি না । আমরা বৃহৎ স্বার্থ পেতে পারি না কারণ আমরা ক্ষুদ্র স্বার্থ ছাড়তে পারি না ।

জিহ্বার লালসে যেই ইতি-উতি ধায় ।
শিশ্নোদরপরায়ণ সে কৃষ্ণ নাহি পায় ॥

আপনারাও বলবেন যে, মাঝে মাঝে একটা গুরু আসে যে বলবে, “তুমি যা খুশি তাই কর, আমার কাছ থেকে দীক্ষা নাও আর আমি খালি মাসে একবার-দুবার করে আসব, তুমি অমাকে ১০০, ২০, ৫০ টাকা প্রণামি দেবে, তোমার বাড়িতে সুন্দর করে খেতে দেবে । আমি তাই দিয়ে খুশি হব । আয়, আমার কাছে দিকীষা নাও ।” এ রকম জগতে গুরু অনেক পাওয়া যায় । জগতে এ রকম গুরু আছে—কর্ম্মী গুরু আছে, জ্ঞানী গুরু আছে, যোগী গুরু আছে, ইত্যাদি কিন্তু পারমার্থিক গুরু এটা কথা বলবেন না—তারা শিষ্যকে টেন না, তারা এই সব ভান করতে চান না । কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে । আপনারা সৎগুরুর কাছে আশ্রয় নিলে হরিনামও করছেন, অন্যায়ও করছেন কিন্তু দুটো কাজকে এক সঙ্গে করতে পারেন না । যে ভক্তির অনুকূল, সে করতে হয়, আর যে ভক্তির প্রতিকূল, সে বিসর্জন দিতে হয় (বর্জন করতে হয়) । যদি আপনি দুধ খেয়ে তার সঙ্গে তামাক, বিড়ি, সিগারেট খাবেন, তখন দুধের সব উপকারটা থাকবেন না । আপনারা ঠিক মত ওষুধ খাবেন আর সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু খাবেন—এই ভাবে আপনার রোগ কখনই সারবে না । হরিভজনেও ওই রকম—আপনারা অন্যায় কাজ গ্রহণ করেন, জিহ্বার লালস অনুসরণ গ্রহণ করেন আবার হরিনামও করেন—দুটো এক সঙ্গে হয় না !

তাই বহু ভাগ্যের ফলে আপনারা এই মানব জন্ম লাভ করেছেন—সাধুসঙ্গ করে একটা সুযোগ এসেছেন আপনাদের সামনে । এই সাধুসঙ্গের ফলে আমি যদি আজকে একটু হরিনাম করলাম, আর পরের দিন করব না—এটা হবে না ! আপনি যেমন প্রতি দিন খান, প্রতি দিন ঘুমান, প্রতি দিন সেই ভাবে নিত্য ঠাকুরের সেবা করতে হলে, নিত্য জপ করতে হবে, নিত্য ভগবানের সেবা করতে হবে ।

কি শয়নে, কি ভোজনে, কিবা জাগরণে ।
অহর্নিশ চিন্ত কৃষ্ণ, বলহ বদনে ॥

(চৈঃ ভাঃ, ২/২৮/২৮)

সেবার জন্য, ভগবানের জন্য অহর্নিশ চিন্ত করতে হবে ! এই সব কথা শুনতে পারলে আপানাদের এই সব কথা মনে রাখতে হবে সব সময় ।

 


 

 

← গ্রন্থাগারে

বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥