আমাদের শ্রীগুরুপরম্পরা :
শ্রীশ্রীল ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ ভগবান্ শ্রীশ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর
              প্রভুপাদ
“শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠে সূর্যাস্ত কখনই হয় না” :
আমাদের মঠের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
 
আমাদের সম্পর্কে শ্রীউপদেশ শ্রীগ্রন্থাগার শ্রীগৌড়ীয় পঞ্জিকা ছবি ENGLISH
 

আমাদের পরিচয়

ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তি নির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের হরি-কথামৃত
উলুবেড়িয়া, ২৬ জানুয়ারি ২০২০

 

আপনারা জানেন যে, একবার হরিনামের যেই ফল হয়, কোটি যজ্ঞ করলে সেই ফল হয় না । গঙ্গার জল যত মাথায় দেন, গঙ্গার পরশটা হলে তবে পবিত্র হওয়া যাবে, কিন্তু বৈষ্ণবের শুধুমাত্র দর্শন পেলে পবিত্র হয়ে যায় । ভক্তগণ বা সাধুগণ যে ভক্ত-গৃহ বা মন্দিরে প্রবেশ করেন, সেই বাড়ি-মন্দির পবিত্র হয়ে যায়—তখন এই মন্দির আর আলাদা করে যজ্ঞ করার, উৎপাদন করার দরকার হয় না । সাধুরা আসলেই, মন্দির উৎপাদন হয়ে যায় ।

আপনারা বোধহয় শুনেছেন যে, প্রভুপাদ শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর শত-কোটি নাম-যজ্ঞ করেছিলেন (‘নাম যজ্ঞ’ মানে শত কোটি নাম করেছিলেন) । যত দিন সময় লেগেছেন, তত দিন তিনি কোটি নাম যজ্ঞ করেছিলেন । ওই কোটি নাম-যজ্ঞ করার পরেই উনি একটু হাঁটতে বেরিয়েছেন আর এক জায়গায় বিগ্রহ দেখতে পেলেন—শ্রীশ্রীগুরু-গৌরাঙ্গ-গন্ধর্ব্ব-গিরিধারী (শ্রীচৈতন্যমঠের বিগ্রহ, মায়াপুরে) । দেখে তিনি বললেন, “ওই, এটা আমার ঠাকুর চলে এসেছে ! চল, ঠাকুরকে নিয়ে চলে যাও !” তারপর, তিনি মন্দিরে ঢুকিয়ে দিলেন আর সেইরকম মন্দিরটা প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল । আমাদের গুরু মহারাজও সেটা বলতেন । যখন পাঁচতালা building (অট্টালিকা)-র নির্মাণ শেষ হল, আমি গুরু মহারাজকে চাবিটা দিলাম আর গুরুদেব আমাকে বলছেন, “উৎপাদন করবে ? চল । খোল-করতাল নিয়ে চল ।” তখন, আমি খোল-করতাল নিয়ে গেলাম, গুরুদেব একটু কীর্ত্তন করে দিলেন এবং বললেন, “তোমার উৎপাদন হয়ে গেল ।” কোন যজ্ঞের প্রযোজন বলে নি । কিন্তু এই জগতের লোক সেটা বুঝে না, লোকে মন খারাপ হয়, “আমার বাড়িতে একটু যজ্ঞ হল না ।”—সেই জন্য এসব আয়োজন করতে হয় । তাছাড়া আসলে ওই সব যজ্ঞের কোন দরকার নেই ।

শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য প্রভু জীবে দয়া করি' ।
স্বপার্ষদ স্বীয় ধাম সহ অবতরি ॥

(শ্রীলভক্তিবিনোদ ঠাকুর, শরণাগতি)

দ্বাপর যুগে যে যে পার্ষদগণ (ব্রজগোপী-গোপগণ) কৃষ্ণের সঙ্গে লীলা করেছেন—সুবল সখা, শ্রীদামা সখা, সুদামা সাখা, লালিতা-বিশাখাদি, সমস্ত ব্রগোপী-গোপগণ,—সমস্ত সখাবৃন্দ সহকারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই কলিযুগে গৌরাঙ্গ-রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন, যাঁরা তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন, তাঁরা দ্বাপর যুগে কৃষ্ণেরই পার্ষদ ছিলেন । কিসের উদ্দেশ্যে তিনি এসেছিলেন ?

অন্ত্যন্ত দুর্লভ প্রেম করিবারে দান ।
শিখায় শরণাগতি ভকতের প্রাণ ॥

(শ্রীলভক্তিবিনোদ ঠাকুর, শরণাগতি)

যে প্রেম সব জায়গায় পাওয়া যায়, তা নায়—জগতে অনেক প্রেম আছে কিন্তু যে দুর্ল্লাভ প্রেম চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রেম, সেই প্রেম তিনি দান করবার জন্য লোকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন । চৈতন্য মহাপ্রভু এত পরম দয়ালু !

শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য-দয়া করহ বিচার ।
বিচার করিলে চিত্তে পাবে চমৎকার ॥

(চৈঃ চঃ, ১/৮/১৫)

তিনি এই দয়া সমস্ত লোকের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বিতরণ করতেন, বলেছেন,

জীব জাগ, জীব জাগ, গোরাচাঁন বলে ।
কত নিদ্রা যাও মায়া-পিশাচীর কোলে ॥

(শ্রীলভক্তিবিনোদ ঠাকুর)

পিশাচী পাইলে যেন মতিচ্ছন্ন হয় ।
মায়াগ্রস্ত জীবের হয় সে ভাব উদয় ॥

(শ্রীশ্রীপ্রেমবিবর্ত্ত, ৬/৩)

এই মায়ার কবলে পড়ে আমরা সব সময় ভাবি, “আমার বাড়ি, আমার ঘর, আমার পুত্র, আমার পরিজন”—এই সব নিয়ে আমরা সব সময় ব্যস্ত হয়ে থাকি, জীব কাটিয়ে দিই । কিন্তু চোখটা বন্ধ করলে এসব কোথায় থাকবে ? আপনাদের দালান বাড়ি কোথায় থাকবে ? আপনাদের এত দালান ঘর, building (অট্টালিকা) কোথায় থাকবে ? সটা একবার ভেবে দেখেছেন কি ? আপনারা যে মনুষ্যরূপে জন্ম গ্রহণ করেছেন, বহু ভাগ্যের ফলে এই মানব জন্ম লাভ করেছেন, সেই জন্য :

ভারত-ভূমিতে হৈল মনুষ্য-জন্ম যার ।
জন্ম সার্থক করি' কর পর-উপকার ॥

(চৈঃ চঃ ১/৯/৪১)

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কী বলেছেন ? তিনি পর-উপকার করতে বলেছেন । আমাদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে জীবের মঙ্গল চিন্তা করার জন্য কৃষ্ণনাম প্রচার করতে হবে । জীবের দ্বারে দ্বারে যেতে হবে, প্রত্যেকটি লোকের দ্বারে দ্বারে গিয়ে কৃষ্ণনাম ভিক্ষা করতে হবে—কী ভিক্ষা ? ডাল, তেল, চাল নয়, টাকা-পায়সা-কড়ি নয়! “কৃষ্ণ বল, সঙ্গে চল এইমাত্র ভিক্ষা চাই !”

আপনারা এই মনুষ্য জন্ম লাভ করেছেন কিন্তু এই দেহটা আবার হারিয়ে ফেলবেন—আবার একটা অন্য দেহ পাবেন । যেমনটি কর্ম্ম, তেমনটি ফল ভোগ করতে হবে । আত্মার পরিচয় জানা দরকার । নিজের পরিচয় জানতে যদি না পারি, তাহলে বিপদ । যদি আমরা ভাবি যে, আমার পরিচয় অমুক রায়, অমুক চৌধুরী, অমুক মন্ডল, অমুক বিশ্বস, অমুক বানেরজী, অমুক চক্রবর্তী, অমুক বন্দোপাধ্যায়, অমুক minister (মন্ত্রী)—এই সমস্ত বড় বড় title (পদবি)-র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি কিন্তু আমাদের পরিচয় কী ? জীবের স্বরূপ হয় নিত্য কৃষ্ণদাস ।

'কৃষ্ণ-নিত্যদাস'—জীব তাহা ভুলি' গেল ।
এই দোষে মায়া তার গলায় বান্ধিল ॥

(চৈঃ চঃ, ২/২২/২৪)

আমরা এই মায়ার বন্ধনে পড়েছি কিন্তু ভগবান নিজের পার্ষদগণকে নিয়ে এসে আমাদের চরম শিক্ষা দেন :

অন্ত্যন্ত দুর্লভ প্রেম করিবারে দান ।
শিখায় শরণাগতি ভকতের প্রাণ ॥

ভগবান গৌরাঙ্গরূপে অবতীর্ণ হয়ে শরণাগতি শিখিয়েছেন । শরণাগতি না হলে হবে না । শরণাগতি মানে,

দৈন্য, আত্মনিবেদন, গোপ্তৃত্বে বরণ ॥
'অবশ্য রক্ষিবে কৃষ্ণ’—বিশ্বাস পালন ॥

কৃষ্ণ আমাদের পালন করেন । আমরা ভাবি আমাদের পিতা-মাতা পালন করেন, আমাদের স্ত্রী-পুত্র পালন করেন কিন্তু এই জগতে কেউ কার নয় । যদি পিতা-মাতা আপন হত, তাহলে পিতা-মাতা আমাদের ছেড়ে চলে যান কেন ? পুত্র-কন্যা আমাদের ছেড়ে দিয়ে চলে যায় কেন ? দাদা-দিদি আমাদের ছেড়ে দিয়ে চলে যায় কেন ? এই জগতে আপন কে ? একমাত্র কৃষ্ণ । সে সব সময় আছেন, ছিলেন, পরেও থাকবেন আর তাকে আমরা ভুলে গিয়েছি !

কৃষ্ণ ভুলি' সেই জীব অনাদি-বহির্ম্মুখ ।
অতএব মায়া তারে দেয় সংসারাদি-দুঃখ ॥

(চৈঃ চঃ, ২/২০/১১৭)

সংসারে দুঃখ পাচ্ছি কেন ? সংসারে যন্ত্রণায় কেন পুড়ছে ? কেন এই ত্রিতাপ-জ্বালায় জ্বলে পুড়ে মরছি ? কারণ আমরা নিজের পরিচয়টা ভুলে গিয়েছি—আমরা ভগবানকে ভুলে গিয়েছি ।

 


 

 

← গ্রন্থাগারে

বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥