আমাদের শ্রীগুরুপরম্পরা :
শ্রীশ্রীল ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ ভগবান্ শ্রীশ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর
              প্রভুপাদ
“শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠে সূর্যাস্ত কখনই হয় না” :
আমাদের মঠের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
 
আমাদের সম্পর্কে শ্রীউপদেশ শ্রীগ্রন্থাগার শ্রীগৌড়ীয় পঞ্জিকা ছবি ENGLISH
 

কবে আমি পাইব বৈষ্ণব-পদছায়া ?

ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তি নির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের হরি-কথামৃত
উলুবেড়িয়া, ২৬ জানুয়ারি ২০২০

 

আর কত দিন আপনারা থাকবেন এই জগতে ? এক্ষুণইও চলে যেতে পারি । এই মুহুর্তেও আপনাদেরকে গঙ্গার ধারে নিয়ে যাওয়া হতে পারে, কিন্তু আপনারা হরিভজন করলেন না, ভগবানকে ডাকতে পারলেন না । যখন সময় আসবে, তখন সবাইকে জবাব দিতে হবে—যখন শেষে ঘাটে পৌঁছে গিয়ে নদী পার করতে হবে, তখন আপনাদের জবাব দিতে হবে । কী জবাব দেবেন তখন ? সেবা করেছিলেন ?

কালকে আমরা ভিক্ষা করেছিলাম । এক জায়গায় লোকটা ৫০ কেজি চাল দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু দিয়েছেন ৪০ কেজি । ও ভাবছে, “১০ কেজি কম দিয়ে আমার এবার লাভ হবে ।” কিন্তু সেটা কিসের লাভ ? সেই চালটাকে ভগবান অন্য জায়গায় নিয়ে নেবেন । কিন্তু চালটা অন্য কাকে চলে যাবে, ভগবানের সেবায় তার লাগাবে না । তাই কিসের লাভ সেটা ? হবে না । গুরু মহারাজও বলতেন, “ভগবানকে কেউ গরিব করতে পারে না ।” ভগবান ত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মালিক, ভগবান এই জগতের মালিক—তাঁকে কেউ কম দিতে পারে না । উপরন্তু, তাঁকে দিলে কখনও কিছু কমে যায় ? কখনও কমে যায় না । সব সময় এটা মনে রাখতে হবে ।

দোকানদারী-বুদ্ধিতে ভগবানের সেবা হয় নয় । এই দোকানদারী-বুদ্ধিতে আপনারা সবাই বন্ধ করবেন । আমরা ভাবছি, “গুরুদেবের কাছে দীক্ষা নিয়েছি, তার বিনিময় কিছু পাব ।” আর কেউ ভাবছি, “আমি শিষ্য করেছি, তার বিনিময় ও আমাকে প্রণাম করবে”—এটার গুরুদেবকে চিন্তা করা উচিত নয় । ওইরকম গুরু গুরু নয়, ওইরকম গুরুর প্রণাম নেওয়ার অধিকার নেই । কেউ ভাবছে, “আমি পরিব্রাজক হয়েছি, পণ্ডিত হয়েছি, অমুক হয়েছি, অনেক কিছু হয়েছি” কিন্তু ওইরকম গুরুর প্রণাম নেওয়ার অধিকার নেই—যে গুরু আপনাদের মৃত্যরূপ-সংসার থেকে উদ্ধার করতে না পারে, যে গুরু আপনাদেরকে সঠিক পথ না দেখিয়ে দেন, গোলোক বৃন্দাবনে ভগবানের সেবার অধিকার দিতে না পারে, সেই গুরু কখনও গুরু হতে পারে না । কেউ যদি বলে, “আমি শিষ্য করেছি, আমাকে কেউ প্রণাম করল না”—সে গুরু কখনও গুরু হতে পারে না । “অমানিনা মানদেন” হতে হবে—সে আমাকে সম্মান দিল বা না দিল, সে আমাকে প্রণাম করল বা না করল, আমি তাকে প্রণাম করবই । “আমি গুরু হয়েও সেই শিষ্যকে প্রণাম করব । যিনি আমাকে প্রণাম না করেছে, তবে আমি তাঁকে প্রণাম করব”—সেই ভাবে গুরু সত্যিকারের গুরু হন । প্রভুপাদ শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরও বললেন, বহু শিষ্য না করিব, বহু গ্রন্থ না পড়িব, বহু কলাভ্যাস না করিব—ওই সব কিছুর দরকার নেই । গুরুদেব যদি সত্যিকারের গুরু হন, শিষ্যের যত অকর্ম্ম, কুকর্ম্ম, পাপ, তাপ, সব গুরুকে বহন করতে হয় । যত শিষ্য কম করবেন, তত আপনার মঙ্গল । এটা মনে রাখতে হবে ।

এই সব ত বুঝতে পারেন না আর যাঁরা বুঝতে পারেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠা কামী না আসে, তাঁদেরই অধিকার থাকে । শ্রীলভক্তিবিনোদ ঠাকুর গাইয়েছেন :

কবে শ্রীচৈতন্য মোরে করিবেন দয়া ।
কবে আমি পাইব বৈষ্ণব-পদছায়া ॥
কবে আমি ছাড়িব এ বিষয়াভিমান ।
কবে বিষ্ণুজনে আমি করিব সম্মান ॥

কবে আমি বৈষ্ণব-পদছায়া পাইব ? কবে আমি বৈষ্ণবগণকে প্রণাম করতে পারব ? কবে আমি বৈষ্ণবগণকে সম্মান করতে পারব ? কবে আমি ছাড়িব এ বিষয়াভিমান ? “আমার টাকা, আমার বাড়ি, আমি গুরু”—এটা সব বিষয়-অভিমান । যেমন “আমি গুরুদেব হয়ে গিয়েছি” তেমন “আমি শিষ্য হয়ে গিয়েছি”—উভয় হয়েছে জড়-অভিমান । গুরু ত হওয়ার দূরের কথা, আমি শিষ্যও হতে পারলাম না । আমি ত অনেক বার বলেছি—জগতে অনেক গুরু পাওয়া যায়, কিন্তু শিষ্যের সংখ্যা খুব কম । শিষ্য হতে হলে গুরুদেবের শাসন মনে চলতে হবে । গুরুদেব যে শাসন করেন, গুরুদেব যেটা বলেন, সেটা মেনে চলতে হবে । যদি গুরুদেব বলেন, “আমি এই দিকে যাচ্ছি,” আর আপনারা ভাবছেন, “আমি নিজের মনে ওই দিকে যাব,” তাহলে আপনারা শিষ্য নন । আপনারা মন্ত্র দীক্ষা নিতে পারেন, ওইরকম দীক্ষিত লোক অনেক আছে, কিন্তু সবাইকে শিষ্য বলা যাবে না ।

গলবস্ত্র কৃতাঞ্জলি বৈষ্ণব নিকটে ।
দন্তে তৃণ করি দাঁড়াইব নিষ্কপটে ॥

“তৃণ” মানে ঘাস । ঘাসটা কত সহ্য করে ? ঘাসে পা দিলে, ঘাসটা কী শুয়ে থাকে বা পাটা তুলে দেয় ? ঘাস শুয়ে যায়, আরো নিচু হয়ে যায় । ওইরকম আমাদেরও নিচু হতে হবে । আমার মাথায় যাদি কেউ পা রাখে, ঠিক আছে, রাখবে, আমি অপত্তি করব না ।

চৈতন্য মহাপ্রভু যখন পুরিতে ছিলেন, আপনারা জানেন সেখানে কী এক দিন হয়েছিল । এক মহিলা জগন্নাথ দর্শন করবার জন্য মহাপ্রভুর ঘাড়ে উঠছিল ! মহাপ্রভু তাকে কি ঠেলে ফেলে দিয়েছে ? না, ঠেলে ফেলে দেন নি । মহিলাটি কী করেছে দেখলে গোবিন্দ বললেন, “উঃ, তুমি কি করছ ? নামো, নামো !” কিন্তু মহাপ্রভু ওকে থামলেন, “চুপ । ওকে বাধা দেবে না ।” তখন গোবিন্দ আর কিছু বললেন না এবং মহিলাটি জগন্নাথ দর্শন করেছে । মহাপ্রভু যখন গম্ভীরায় ফিরে এলেন, তখন গোবিন্দ মহাপ্রভুকে জিজ্ঞাসা করলেন, “প্রভু, কী ব্যাপার ? একটা মহিলা আপনার গায়ে উঠছিল আর আপনি কিছু বলছিলেন না ? আপনি বললেন কিছু বলতে হবে না ?” মহাপ্রভু তদুত্তরে বললে, “দেখ, ওর জগন্নাথ দেখার কত আর্ত্তি, সেটা আমারও হল না ! যে আমি একটা সন্ন্যাসী মানুষ বা যে সে মহিলা, সে আমার গায়ে উঠেছে, সেটা খেয়াল নাই । তার ইচ্ছা কী ? তার খেয়ালটা কোন দিকে ? ‘আমি জগন্নাথ দর্শন করতে যাই !’ সেই জন্য আমি বললাম ওকে disturb (ডিসটার্ব) করতে হবে না ।” আর শ্রীল প্রভুপাদ কী বলেছেন ? কেউ যদি বলেন, “জগন্নাথকে দেখব,” তার কাছে জগন্নাথ দেখা দেবেন না । আর কেউ যদি মনোভাব নিয়ে যায়, “আমি জগন্নাথের সেবা করব,” তখন জগন্নাথ তাকে দর্শন দেবেন । “জগন্নাথকে দেখিয়ে লইব”—এই বুদ্ধিতে জগন্নাথ দর্শন হবে না ।

সেই জন্য, “দন্তে তৃণ করি” মানে দাঁতের মধ্যে ঘাস নিয়ে নিষ্কপটে ভাবে প্রার্থনা করব । ‘কপট’ মানে লোকের বাহিরে এক, ভিতরে আর এক । একবারে মন খুলে দিতে হবে—যা থাকবে, সব কিছু গুরুদেবের কাছে বলে দিতে হবে, কোন জিনিস লুকাতে নেই । ডাক্তারের কাছে যেমন যদি কোন জিনিস, কোন রোগ লুকিয়ে রাখেন, ডাক্তারটি আপানদের চিকিৎসা করতে পারবে না । আর যদি গুরুদেবের কাছে সব খুলে বলেন, তাহলে গুরুদেব আপনার সমস্ত ব্যবস্থা করবেন । যে কোন করেন—অন্যায় করেন, ভাল করেন, খারাপ করেন—সব কিছুই আপনাদের গুরুদেবকে বলতে হবে । কোন কপট থাকতে হবে না । আমি আগেও বলেছি—মন, বিদ্ধি, অনঙ্কার, দেহ, প্রাণ, সমস্ত কিছু গুরুর চরণে বিলিয়ে দিতে হবে ।

কাঁদিয়া কাঁদিয়া জানাইব দুঃখগ্রাম ।
সংসার অনল হৈতে মাগিব বিশ্রাম ॥

আমার যত দুঃখ, সমস্ত দুঃখের কথা গুরু-বৈষ্ণবের কাছে ছেড়ে দিতে হবে । তাদের নির্ভর করতে হবে । আমি এই সংসারের মধ্যে বারবার হাবুডুবু খাচ্ছি, এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছি ! অর পারছি না । “সংসার অনল হৈতে মাগিব বিশ্রাম”—‘অনল’ মানে ‘আগুন’ । গুরু-বৈষ্ণবের কাছে এসে তাঁদের কাছে তাঁদের পদছায়ার জন্য প্রার্থনা করব ।

শুনিয়া আমার দুঃখ বৈষ্ণব ঠাকুর ।
আমা' লাগি' কৃষ্ণে আবেদিবেন প্রচুর ॥

বৈষ্ণব ঠাকুরকে প্রার্থনা করলে, বৈষ্ণব ঠাকুর কি করবেন ? উনি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করবেন । ভগবানের কাছ থেকে চিঠি পাওয়া যায় না কিন্তু আপনারা যদি বৈষ্ণবের কাছে চিঠি দেন—বৈষ্ণবগণের কাছে দুঃখ-প্রার্থনা করলে, গুরু-বৈষ্ণবের কাছে দুঃখ কথা বললে, তাহলে গুরু-বৈষ্ণবগণ আপনাদের কথা ভগবানকে জানিয়ে দেবেন আর ভগবান আপনার সমস্ত সমস্যা সমাধান করবেন—ভগবান আপনাদের সমস্ত দুঃখ নিবারণ করে নেবেন । এটা ত নিয়ম । এই ভাবে যেতে হবে ।

বৈষ্ণবের আবেদনে কৃষ্ণ দয়াময় ।
এ হেন পারম প্রতি হবেন সদয় ॥
বিনোদের নিবেদন বৈষ্ণব চরণে ।
কৃপা করি সঙ্গে লহ এই অকিঞ্চনে ॥

শ্রীলভক্তিবিনোদ ঠাকুর বলছেন যে, তিনি বৈষ্ণব চরণে নিবেদন করছেন, “প্রভু, তুমি ত যাবে ভগবানের কাছে, তুমি আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাও ।” আমরাও বলব শ্রীলভক্তিবিনোদ ঠাকুরের কাছে, আমাদের গুরুদেবের কাছে, “হে প্রভু ! হে গুরুদেব ! তুমি ত যাচ্ছো ভগবানের কাছে, তুমি আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে যাও ।” এই নিবেদন করতে হবে  । এই ভাবে বৈষ্ণব ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতে হবে, তাহলে আমাদের পরম কল্যাণ বস্তু লাভ হবে ।

 


 

 

← গ্রন্থাগারে

বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥