আমাদের শ্রীগুরুপরম্পরা :
শ্রীশ্রীল ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ ভগবান্ শ্রীশ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর
              প্রভুপাদ
“শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠে সূর্যাস্ত কখনই হয় না” :
আমাদের মঠের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
 
আমাদের সম্পর্কে শ্রীউপদেশ শ্রীগ্রন্থাগার শ্রীগৌড়ীয় পঞ্জিকা ছবি ENGLISH
 

অন্ধ, অনাথ ও অজ্ঞানের লোকের সঠিক পথ

ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তি নির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের হরি-কথামৃত
উলুবেড়িয়া, ২৬ জানুয়ারি ২০২০

 

আমরা একটা বৈষ্ণব কীর্ত্তনে বলি, “অনাথ কাতরে তেঁই কান্দে ।” অর্থ কী ? মামা-বাবা হারিয়ে গিয়েছি ? না । যাঁরা ভক্তগণ তাঁরা নিজের বাবা-মামাকে বাবা-মামা বলেন না—তাঁরা বলেন, “কৃষ্ণ মাতা, কৃষ্ণ পিতা ।” শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়ও বলা হয়,

শ্রেয়ান্ স্বধর্ম্মো বিগুণঃ পরধর্ম্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ ।
স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম্মো ভয়াবহঃ ॥

নির্দ্দোষভাবে আচরিত অন্যের ধর্ম্ম অপেক্ষা কিঞ্চিৎ অঙ্গহীন স্বীয় ধর্ম্মাচরণ ভাল । স্ব স্ব বর্ণ ও আশ্রমোচিত ধর্ম্মে বর্ত্তমান থাকিয়া নিধনপ্রাপ্ত হওয়া মঙ্গলপ্রদ হইয়া থাকে ; যেহেতু পরধর্ম্ম আচরণ ভয়াবহ জানিবে । (অধোক্ষজে ভক্তি সর্ব্বজীবের নিত্য স্বাভাবিক পরমধর্ম্ম হওয়ায়, ইহা বাহ্যিক সুদুরাচারযুক্ত হইলেও মায়িক সত্ত্বাদি গুণাশ্রিত সদাচার সংস্কারযুক্ত অনাত্ম ধর্ম্ম হইতে সর্ব্বদা শ্রেষ্ঠ । সাধুসঙ্গে এই শুদ্ধভক্তি যাজন করিতে করিতে দেহপাত হইলেও শ্রেয়ঃস্কর ; যেহেতু অবিদ্যাশ্রিত সংষ্কারের অনিশ্চয়তাপূর্ণ ঔপাধিক সদাচার দ্বিতীয়াভিনিবেশ থাকায় ভয়াবহ ।)

(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ৩/৩৫)

“পরধর্ম্মো ভয়াবহ ।” কেউ মনে করবে, “ব্রহ্মাণ যদি ক্ষত্রিয় ধর্ম্ম পালন করে, হিন্দু যদি খৃস্টান হয়ে যায়, খৃস্টান যদি হিন্দু হয়ে যায় বা হিন্দু যাদি মুসলিম হয়ে যায়, মুসলিম যদি হিন্দু হয়ে যায়, তাহলে পরধর্ম্ম হয়ে গেল ।” সেটা নয় । এখানে এটা কথা নয় । জীবের ধর্ম্ম কী ? জীবের ধর্ম্ম হয়েছে ভগবানের সেবা করা । যা জীব সেটা না বুঝে করে, নিজের সন্তানাদির দিকে আসক্ত হয়ে পড়ে, সেটা হচ্ছে পরধর্ম্ম । পরধর্ম্ম ভয়াবহ ! জীবের ধর্ম্ম হয়েছে ভগবানকে সেবা করা আর সেটা বাদ দিয়ে আমরা মুর্খ মানুষ যসি মনে করি, “আমাদের সংসার ,সন্তানাদি, এই সব পালন করব,” তাহলে এই হবে পরধর্ম্মো ভয়াবহ ।

কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, অভিমান সহ
আপন আপন স্থানে টানে ।

আমরা মাঝে মাঝে খবরের কাগজে দেখি যে, অপরাধ করলে লোক ক্ষমা চায়—যেমন একজন ছেলে বাপ-মাকে খুন করে দিয়ে সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে বললেন, “আমাকে ক্ষমা করে দাও ।” কিন্তু নিজের বাপ-মাকে খুন করে দিয়ে কেউ যদি বলে, “আমি অনাথ হয়ে গেলাম, আমাকে ক্ষমা করে দাও”—তাকে কি ক্ষমা করা যাবে ? এইরকম অনাথ কিন্তু আমাদের অনাথ আলাদা—আমরা সবাই অনাথ কেন ? কারণ আমরা সবাই ভগবানকে ভুলে গিয়েছি, ভগবানকে ডাকতে পারছি না, ভগবানকে পাচ্ছি না । ভগবানকে সেবা করতে না পেরে ভগবানের সঙ্গে সংযোগ করতে পারছি না । সেই জন্য “অনাথ কাতরে তেঁই কান্দে ।” আমরা গর্ব করে ভাবছি, “আমি অনেক কিছু করে ফেলেছি ! অনেক কিছু পেয়ে গিয়েছি !” সেটা নায়—ভ্রম করলে হবে না  । “ভক্ত হয়ে গিয়েছি, দীক্ষা নিয়ে গিয়েছি”—এই অহঙ্কার যদি মন-বুদ্ধিতে জন্মে, তাহলে আমি ভক্ত-লাইন থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ব । আসলে আমি বহু ভাগ্যের ফলে এই ভক্ত-লাইনে এসেছি, তাই আমাকে আর বেশি সেবা করতে হবে, আর বেশি নাম করতে হবে, বেশি করে কীর্ত্তন করতে হবে, বেশি করে ভজন করতে হবে । আজ দীক্ষা পেয়ে গেলাম, কিছু করেছি, আর কালকে বন্ধ করে দিলাম—এইরকম করলে হবে না । এক দোকানে দীক্ষা নিয়ে যদি মনে করি, “আমি সব পেয়ে গেলাম, সব বুঝে গেলাম !” আর আরাম হয়ে যাই ।

নিদ্রলস্য-হত সুকার্য্যে বিরত
অকার্য্যে উদ্যোগী আমি
প্রতিষ্ঠা লাগিয়া শাঠ্য-আচরণ
লোভ-হত সদা কামী ।
এ হেন দুর্জ্জন সজ্জন-বর্জ্জিত
অপরাধী নিরন্তর ॥

(শরণাগতি, শ্রীলভক্তিবিনোদ ঠাকুর)

যাঁরা সত্যিকারের সাধকগণ, তাঁরা ভাবেন, “আমি বারবার অপরাধ করে দিই”—তাঁরা সব সময় নিজেকে অত্যন্ত দীন হীন মনে করে । “আমি কিছু জানি না, আমি কিছু বুঝি না, আমার কোন যোগ্যতা নেই । জ্ঞান-কর্ম্ম কিছু নেই । আমি ভক্তি-লাইনে এসেছি বটে, আমি কিছু জানি না, আমার কিছু জ্ঞান হয় নি । আমি কিছু বুঝতে পারি না ।” সেই জন্য, আমাদের প্রত্যেক দিন অনুশীলন করতে হবে । অনুশীলন না করলে হবে না । আজকে এক দিন নাম শুনলে, একটু কীর্ত্তন শুনলে, হরিনাম করলে, আবার যা যা বাড়ি গিয়ে সব ভুলে গেলে—না ! নিত্য কাল ধরে, প্রত্যেক দিন ভগবানের সেবা করতে হবে । নিত্য নাম-কীর্ত্তন করতে হবে, নিত্য হরিভজন করতে হবে । এটা ভুলে গেলে চলবে না ।

ঐছন আমার মন ফিরে যেন অন্ধজন
সুপথ বিপথ নাহি জানে ॥

যাঁরা বৈষ্ণবগণ, তাঁরা ভাগবতের প্রত্যেক অক্ষরে, ভাগবতের প্রত্যেক বর্ণে স্বয়ং ভগবান থেকে অভিন্ন মনে করেন । সাধুগণ ভগবানের শাস্ত্রানুসারে ভগবানের কথা বলেন । প্রকৃত বৈষ্ণবগণ শাস্ত্র ব্যতিরিকে কথা বলেন না । প্রকৃত বৈষ্ণবগণ শাস্ত্রের প্রমাণ দিয়ে কথা বলেন—শাস্ত্র ছাড়া কোন কথা বলেন না । নিজের মনগড়া, নিজের বানান কথা এসব প্রকৃত বৈষ্ণবগণ কখনও বলেন না । সেই জন্য, “আমার মন যা বলছে, সেইটা আমি করলাম,” “মনগড়া একটা কথা লিখে দিলাম,” “মনগড়া একটা কবিতা লিখে দিলাম” । এসব কিছু নয় । বড় বড় সাহিত্যিক, বড় বড় কবি, বড় বড় গায়ক, বড় বড় গায়িকা—তাদের কিছু মূল্য নেই ।

কত লোক হারমোনিয়াম, করতাল নিয়ে, শঙ্খ-ঘন্টা বাজিয়ে কীর্ত্তন শুরু দেয়, কিন্তু সেই কীর্ত্তন আর গুরু-বৈষ্ণবের কীর্ত্তন এক জিনিস নয় । গুরু-বৈষ্ণব কীর্ত্তন করলে ভগবান খুশি হন । আর যদি কয়েক বাহিরের লোক (ভাড়াটিয়া কীর্ত্তনীয়াগণ) এসে কীর্ত্তন করে, তাঁরা সেই কীর্ত্তন করে নিজের ইন্দ্রিয়-তর্পণ এবং অপরের ইন্দ্রিয়-তর্পণ করবার জন্য—তাদ্বারা ভগবান, বৈষ্ণবগণ কখনও খুশি হতে পারেন না । “গুরুমুখ-পদ্ম-বাক্য”—সাধু-গুরু-বৈষ্ণবগণ যে কথা বলেন, সেই ত হরিকথা । কীর্ত্তন নাও হয়—মুখে হরিকথা বলে যায়, সেটা হচ্ছে কীর্ত্তন । আর নাহলে ওগুলা জঞ্জাল, ওগুলা সব শুধু গান । গান ও কীর্ত্তন এক কথা নয় । গান গাইলে লোকের নিজের ইন্দ্রিয় তর্পণ হয়, কিন্তু ভগবানের ইন্দ্রিয় তর্পণ হয় না । ভগবান সুখী হন না । এট মনে রাখতে হবে ।

আসলে, মনটা আমাদের দুষ্ট । মনটা যা চায়, সেটা করলে, কি লাভ হবে ? মনটা অন্ধ । যেমন একটা অন্ধ লোককে রাস্তা পার করতে হলে, অপরের সাহায্য লাগবে (অপর একজন সাহায্য করলে তবে সে রাস্তা পারাতে হবে), তেমন মনটাও অন্ধ, সে সুপথ, বিপথ জানে না—কোনটা ভাল পথ আর কোনটা খারাপ পথ, সেটা জানে না—কিন্তু একজন বৈষ্ণব যদি মনটাকে পরিণতি করে দিয়ে গুরু-বৈষ্ণবের চরণে ফেলতে পারে, তাহলে সেটা হবে সঠিক পথ ।

 


 

 

← গ্রন্থাগারে

বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥