![]() |
|||||||
| |||||||
|
|||||||
হরিকথায় রুচি
ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তি নির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের হরি-কথামৃত
শ্রীমদ্ভাগবতম্ কথা বলছেন :
স বৈ পুংসাং পরো ধর্মো যতো ভক্তিরধোক্ষজে । (শ্রীমদ্ভাগবত ১।২।৬) আত্মার সুপ্রসন্ন তাঁর দিকে কেবলাভক্তি সাধকের লক্ষ্য না থাকলে সাধনে শৈথিল্য আসবে । কৃষ্ণপ্রেম প্রাপ্তি ও আত্মার সুপ্রসন্নতা—এ দুটি লক্ষ্যকে স্থির রেখে ভক্তির পাথে চলতে হয়। আগে যে পাঁচতা কীর্ত্তন করতাম, এখন কাউকে এটা ভাল লাগছে না—ভজনই অনেক সময় ভাল লাগছে না কারণ মায়া আমাদের আক্রমণ করছে । কিন্তু কৃষ্ণপ্রেম প্রাপ্তি আর আত্মার সুপ্রসন্নতা—এই দুই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে । কৃষ্ণের প্রসন্নতা আর কৃষ্ণপ্রেম প্রাপ্তি । আমাদের সবচাইতে উঁচু জিনিস কী ? কৃষ্ণপ্রেম প্রাপ্তি হতে হবে । কৃষ্ণ প্রেম আর আত্মার সুপ্রসন্নতা, এই দুইটা লক্ষ্যকে স্থির রেখে ভক্তির পথে চলতে থাকতে হবে । এটা ভাগবতের কথা । কেউ মনে করেন যে, আমি বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছি, এত কষ্ট, এত ঝামেলায় পড়ে গিয়েছি আর এই সব ঝামেলার দিকে তাকিয়ে যদি কেউ ভজন করতে আসে, সেটা ভজন হবে না । কষ্ট করে আমাদের ভজন করতে হবে । কষ্ট করে করলে ভজন করতে হবে । কৃষ্ণ বলেন, “ভক্তকে যদি আমার কথা বলতে পারো, আমার কথা কীর্ত্তন করতে পারো, তাহলে আমি অতি শীঘ্র প্রীত হই ।” হরিকথা বলাই হয়েছে সবচাইতে মূল্যবন জিনিস । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, “আমার ভক্তের নিকট আমার কথা কীর্ত্তন করলে আমাকে যেমন সুখ দেয়, মনুষ্যলোকে তেমন সুখ, আর কেউ দিতে পারে না । ভক্তের হৃদয়ে আমি থাকি ।” ভগবান কোথায় থাকেন ? ভগবান কি বলেছেন ?
নাহং তিষ্ঠামি বৈকুন্ঠে যোগিনাং হৃদয়ে ন চ । “আমি যোগীর হৃদয়েও থাকি না, বৈকুন্ঠেও থাকি না ।” বৈকুন্ঠ অর্চনের স্থান, বৈকুন্ঠে পূজা হয় কিন্তু সেখানে কীর্ত্তন নেই । যোগীরা ধ্যান নিয়ে থাকেন, ওরা শুধু ধ্যান নিয়ে করেন । সেখানে কীর্ত্তন নেই । কিন্তু ভক্তগণ সব সময় কীর্ত্তন রসে মগ্ন থাকেন । শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন প্রিয়শ্রবা । আপনারা যা না শুনছেন বস শুনছেন, তিনি কিন্তু সব খুব ভাল শুনছেন । আপনারা শুধু দুত কান দিয়ে কথা শুনেন আর তিনি কান দিয়ে শুনেন, তিনি নাক দিয়ে শুনেনে, চোখ দিয়েও শুনেন । আপনারা ভাবছেন কৃষ্ণ শুধু মুখ দিয়ে খান, কিন্তু গয়া-ধামে বিষ্ণুপাদপদ্ম আছে, সেখানে ভোগ দেওয়া হয় আর কৃষ্ণ পা দিয়ে খান । তাই তিনি হচ্ছেন প্রিয়শ্রবা—তাঁর মহিমা শুনলে বললে, তিনি শীঘ্র শীঘ্র প্রীত হন । “এই রহস্যটি স্বরূপ শক্তির দ্বারে প্রকটিত হয়। রাগমার্গ ভজনেও কীর্ত্তনই আশ্রয় । ব্রজ-বালকগণ তাঁদের প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণের বিরহে কেঁদেছেন আর আকুল হয়ে তাঁর মহিমা ও গুণ কীর্ত্তন করেছেন; তাঁকে গান গেয়ে গেয়ে ডেকেছেন । প্রিয়জনকে সবাই ডাকে। শ্রীকৃষ্ণের মত কেহই ত্রিভুবনে প্রিয় নেই ।” কিন্তু আপনাদের নাতি মরলে আপনারা কাঁদেন, পতি মরলে কাঁদেন, স্বামী মরলে কাঁদেন, স্ত্রী মরলে কাঁদেন, মা মরলে কাঁদেন, বাপ মরলে কাঁদেন কিন্তু ভগবানের বিরহে, ভক্তের বিরহে আপনাদের কষ্ট হয় না । আমাদের পাষাণ হৃদয় । শ্রীকৃষ্ণের মত কেহই ত্রিভুবনে প্রিয় নাই । ভগবান যে আমাদের প্রিয়, এই কথা কি করে আমাদের হৃদয়ে আসবে ? কি করে আমরা সেটা বুঝব ? “সাধু সঙ্গে তাঁর কথা শুনতে শুনতে এই প্রিয়ত্ববোধ জীবের হৃদয়ে জাগে । সাধু সঙ্গেই প্রিয়ের প্রতি সেবা প্রবৃত্তির উদয় হয় । প্রীতির কার্য্যই হ’লো তাঁকে শোনা, তাঁকে বলা, তাঁকে ধ্যান করা । কতকগুলি নীতি শুনে গেলেই চলবে না । এ পথে চলবার দৃঢ় সংকল্প থাকা চাই । শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সম্বন্ধ পাতিয়ে রস সৃষ্টি হলে তখন তাঁর কথায় রুচি হয় । এই রুচি বা রতির উদয় না হলে ভক্তিপথে কেউ চলতে পারে না । ভক্তরাজ শ্রীপ্রহ্লাদ মহারাজ কেঁদে কেঁদে বলেছেন—“আমার মত দীন ব্যক্তির তোমার মধুর কথায় রুচি হ’লো না, তোমাকে কি করে পাবো । গোপীগণের যে প্রেম, সেই প্রেম আমার হল না ।” ব্যাসদেব যে ভাগবতম্ রচনা করেছিলেন, তিনিও বলছেন, “ভগবানের কথা আমার রুচি হল না, ভগবানকে বুঝতে পারলাম না ।” আর আমরা দুই-এক দিন ধরে হরিকথা শুনে বলছি যে, আমরা সব ভক্ত হয়ে গেলাম ! কথা বা শব্দরূপে এই ভৌম জগতে ভগবানের অবতার—তিনি নাম রূপে এসেছেন, কথা রূপে এসেছেন, শব্দরূপে এসছেন (যে ভাগবতের কথা, গীতার কথা, এগুলো সব শব্দ, এই শব্দ রূপে তিনি এসেছেন) । শ্রবণ, কীর্ত্তন, স্মরণে কোন কালাকাল বিচার নেই কিন্তু তোমাতে আমার অনুরাগ হল না । ভক্ত-সাধুর দর্শনে, স্পর্শনে, সম্ভাষণে কথায় রুচি এসে যায় । কিন্তু এই কথায় যদি রুচি ঠিক না আনতে পারে, তখন ওইরকম মন্দ-ভাগ্যের জীবের উপয় কী ? শ্রীমদ ভাগবত তার সুগম উপয় বলে দিয়েছে—ভক্তসাধুর দর্শনে, স্পর্শনে, সম্ভাষণে কথায় রুচি এসে যায় । মহাবৈষ্ণব, মহাজনগণ আকুল প্রেমিক ভক্ত-সঙ্গের জন্য প্রার্থনা করেন—শ্রীগৌরসুন্দর শ্রীমন্মহাপ্রভু শ্রীলহরিদাস ঠাকুরের সঙ্গের জন্য নীলাচলে গিয়ে নিজে তাঁর জন্য ভজন কুটিরের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন । তিনি কেড়ে নিয়েছেন শ্রীরায় রামানন্দকে, রূপ-সনাতন প্রভুকে চরণ কমলে আকর্ষণ করে এনেছেন—তাঁদের কথার দ্বারা তিনি সুখি হন । মহাপ্রভু শ্রীরায়রামানন্দের কাছে থেকে ভাগবৎ কথা শ্রবণ করেছেন । এর চেয়ে আনন্দ আর কোথাও নেই । আর রায় রামানন্দ বলেছেন, “আমার মুখে বক্তা শ্রীচৈতন্য—আমি কিছু বলছি না, তুমি যে ভাবে আমাকে বলাছ, সেই বলছি ।” “পরম বিজয়তে শ্রীকৃষ্ণসঙ্কীর্ত্তনং ।”গৌরসুন্দর লীলায় নিজে গেয়ে গিয়ে ভারত পরিক্রমা করেছেন । কথার মুর্ত্ত-বিগ্রহ হয়ে প্রেমিক-সাধুর কথাই শ্রবণ করে যদি হৃদয়কে তীব্রভাবে স্পর্শ করে বৃষ্টির মত সাধু মুখ নিঃসৃত বাণী জীবকে উন্মুক্ত করে ভক্তির পথে নিয়ে যায়—তারপর শ্রীকৃষ্ণের প্রীতিময় সেবার জন্য জীব দৌড়াবে । যাঁরা শুদ্ধভক্তের সঙ্গে হরিকথায় রুচি লাভ করে নি, তারা সব সময় ভক্তি যাজন করতে পারে না । হরিকথার আশ্রয়ে জীবনযাপন করতে হলে মহামহা ভাগ্য চাই । কৃষ্ণকথাকে যিনি অন্তরের সঙ্গে আশ্রয় করেন, তিনি বাস্তবিকই ভক্তির অধিকারী হন । তখন জীবের আর কোন ইতর বাসনা থাকে না । তখন ওই সমস্ত বিষয়ে বাসনা সব দূরভিত হয়ে যায় । তাহলে মূল কথা হয়েছে এই যে, হরিকথা শ্রবণ-কীর্ত্তন করতে হবে, তাহলে ওই বিষয়ে বাসনা আর জাগবে না । এটা সব সময় মনে রাখবেন । ভক্তসঙ্গে পরিচর্য্যা ও প্রসঙ্গের দ্বারা জীবের ভক্তিসংস্কার গঠিত হয়। তখনই সে পায় ভক্তিলতা বীজ । এই ভক্তিবীজ সাক্ষাৎ হরিতোষণ । ভক্ত সাধুর কৃপায় সেই জীবকে নিত্য শ্রবণ কীর্ত্তন জলে সেচন করতে হয়। তবেই কৃষ্ণ কথায় রুচি দিন দিন বাড়তে থাকবে। এই রুচি এলেই স্বচ্ছন্দে সে ভক্তিপথে চলে যেতে পারবে। ভক্তির প্রাণ স্বরূপ হরিকথায় রুচি এলে অন্যদিকে দৃষ্টি যাবে না । ভক্তির এই সংস্কার আনতে লেখাপড়া, কর্মজ্ঞান-বৈরাগ্যের কোন প্রয়োজন নেই । এই সব যোগ্যতা ভক্তির অধিকার আনে না । হরিকথায় রুচি নাহ’লে পাণ্ডিত্য, ধন, জন, বৈরাগ্য সব কিছুই নিষ্ফল। আর যদি হরিকথায় রুচি হয়, তাহলে সাধনভক্তি, ভাবভক্তি, প্রেমভক্তির পথে ক্রমসোপান ধরে শ্রীকৃষ্ণচরণ কল্পবৃক্ষে আরোহণ করবে । সাধুসঙ্গই কৃষ্ণপ্রেম লাভ করবার জন্মমুল ।
কৃষ্ণভক্তি জন্মমূল হয় ‘সাধুসঙ্গ’। (শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত মধ্য—২২।৮০)
|
|||||||
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥ | |||||||
© Sri Chaitanya Saraswat Math, Nabadwip, West Bengal, India. For any enquiries please visit our contact page. |