আমাদের শ্রীগুরুপরম্পরা :
শ্রীশ্রীল ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ ভগবান্ শ্রীশ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর
              প্রভুপাদ
“শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠে সূর্যাস্ত কখনই হয় না” :
আমাদের মঠের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
 
আমাদের সম্পর্কে শ্রীউপদেশ শ্রীগ্রন্থাগার শ্রীগৌড়ীয় পঞ্জিকা ছবি ENGLISH
 

ভক্তি-ব্রত ও একাদশী-ব্রত

ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তি নির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের হরি-কথামৃত
২৬ জানুয়ারি ২০২০

 

বুদ্ধদেব সংসারের জরা, ব্যাধি, বার্ধক্য ও মৃত্যু ইত্যাদি দেখে তপস্যা করবার জন্য গৃহত্যাগ করেন । তপস্যা করে নির্বাণ বা মুক্তি লাভ করেছিলেন । তিনি জগৎকে মুক্তির পথ বা মহানির্বাণের পথ দেখিয়েছেন কিন্তু ভক্তগণ মুক্তিও চান না । তাঁরা ক্লেশ ও কষ্ট হাসিমুখে বরণ করতে পারেন, যদি ভগবানের সুখ হয় । ব্রজগোপীরা, ভক্তরা তাঁর সুখবিধানের জন্য দুঃখ চান । তাঁর জন্য কাঁদতেও রাজি আছেন । কান্না থেকে অব্যাহতি পেতে চান না ।যাঁরা ভক্তগণ, তাঁরা বলেন, “আমাকে দুঃখ দাও, কোন চিন্তা নেই । তোমার যদি সুখ হয়, তুমি আমাকে দুঃখ দাও না ।” কত উঁচ কথা সেটা ! ব্রজগোপীরা পায়ের ধূলা দিয়ে বললেন, “আমি নরকে যাব, তবু প্রভুকে ত শন্তি হবে ।” মা ছেলের জন্য রান্না করে—ধোঁয়ায় চখ জ্বালে তবু ত মা ছেলেকে খাওয়ার জন্য রান্না করে । যেভাবে মা তার ছেলে সন্তানকে ভালবাসে, সেইভাবে ভগবানের সেবাও করতে হবে ।

আমরা ভুক্তিও চাই না, মুক্তিও চাই না—এ কথা বলা সহজ, সবাই উপদেশ দিতে পারে কিন্তু এই কথাটা জীবনে আচরণকে ফুটিয়ে তুলতে হবে । খালি উপদেশ দিলে হবে না ।

যখন আমি ভাগবৎ পাঠ করতে যাচ্ছি, আমি বলছি, “ভুক্তি চাই না, মুক্তি চাই না,” আর যখন আমার একটা খাবার আসল তখন এই ভাগবৎ পাঠ ছেড়ে দিয়ে আমি ওই দিকে ছুটব । ঠিক কি না ? যাঁরা ভক্তগণ, তাঁরা ভাবেন, “ভগবান, আমি তোমার কথা বলছি, তুমি আমার ব্যবস্থা কর সব । যদি বিপদও আসে, তুমি সব ব্যবস্থা কর । আমি ভাগবৎ পাঠ করে যাচ্ছি, বন্ধ করব না ।” এই ভক্তির সম্বন্ধে যাঁরা পাঠ করেন, হরিকথা বলেন, তাঁদের নিজের আচরণও ঠিক রাখতে হবে । প্রচার করাই সহজ, কথা বলাই সহজ কিন্তু করা কঠিন । মুখে বলছি, “তৃণাদপি সুনীচেন,” কিন্তু তৃণাদপি সুনীচ কি হতে পারছি আমরা ? পারছি না । মুখে বলি, “তরোরিব সহিষ্ণুনা,” কিন্তু তরোর মত সহ্য করতে পারছি কি ? পারছি না । অপরকে সম্মান করতে পারছি কি ? পারছি না । অনেকে কীর্ত্তন করে কন্তু কীর্ত্তনের ভাবটা বুঝে না । কীর্ত্তনের ভাবটার দিকে, গভীর অর্থটার দিকে খুব কম লোকের দৃষ্টি থাকে । সত্য কথা বলতে গেলে অধিকাংশ লোকের এই জিনিসটা আকর্ষণ করে না । আমরা কীর্ত্তনে করি :

প্রভু ! তব পদযুগে মোর নিবেদন । নাহি মাগি দেহ-সুখ, বিদ্যা’ ধন, জন ॥

আমরা বলি, “নাহি মাগি দেহ সুখ” কিন্তু যখন আমরা শুয়েতে যাই, তখন বলছি, “গদিটা একটু শক্ত হয়েছে, গায়ে লেগে যাচ্ছে !”

ন ধনং ন জনং ন সুন্দরীং কবিতাং বা জগদীশ কাময়ে ।
মম জন্মনি জন্মনীশ্বরে ভবতাদ্ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ি ॥

ঠাকুরের সুখ হচ্ছে কি না ? এইটা বোধ করতে পারলে তবে হবে শুদ্ধ ভক্তি । শ্রীহরির সেবায় লেগাই থাকতে হল, ঠাকুরের জন্য সুন্দর রান্না করতে হবে, ঠাকুরকে ভাল করে খেতে দিতে হবে । পরের প্রতি আমরা উপদেশ দিই, আগে নিজেকে উপদেশ দেতে হবে । আগে নিজেকে উপদেশ দিতে হবে, তাহলে কাজ হবে, তারপর পরের উপদেশ দেব ।

শ্রীহরির সেবায় লেগে থাকতে হবে । এ-কথাটা বলার হয়ত আমার অধিকার নেই, তবু শুনতে হচ্ছে, বলতে হচ্ছে । এই আমার বলার অধিকার নেই তবুও বলছি—শুনতে শুনতে বলতে বলতে নিজের অধিকারের কথা চিন্তায় আসবে । নিজের প্রতি উপদেশটা আগে দিতে হবে, তারপর পরের প্রতি উপদেশ নয়, এ-কথাটা সব সময় মনে রাখতে হবে । নিজেকে আগে উপদেশ শিখাও ।

অনেক কথা হয়েছে—এখন বলুন, আপনাদের কার প্রশ্ন আছে ?

প্রশ্ন : একাদশীর সম্বন্ধে একটু বলবেন ?

একাদশী করতে গুরুদেব বলেছেন , মহাপ্রভু করতে বলেছেন, তাই করব । কোন ভোগ-ভাগী, কোন ফল আশা করুন না । একাদশীর মাহাত্ম্য কথা আছে—যেমন গীতা পড়লে, গীতার মহত্ম্য আছে, তেমন একাদশীর মাহাত্ম্যও আছে । একাদশী করলে শরীরও ভাল থাকে এবং একাদশী করলে ভগবানও খুশি হন । সবচেয়ে বড় কথা যে, ভগবানের প্রীতি বিধানের জন্য একাদশী করতে হবে । লোকে বলে, এই পুত্রদা একাদশী করলে একটা ছেলে লাভ হবে—কিন্তু সে ছেলে ডাকাতও হতে পারে ! আবার লোকে বলে যে, একাদশী শুধু বিধবা করবেন—আচ্ছা, তাহলে যখন বিধবা একাদশী করবেন তখন যে পুরুষের বউ মরে গেল, তারও একাদশী করতে হবে ! এটা শুনে সবাই তাড়াতাড়ি আবার বিয়ে করবে ।

কোন শাস্ত্রে এমন কথা নেই যে, একাদশী শুধু বিধবা করেন । আগের যুগে নিয়ম ছিল, আপনারা শুনেছেন, যাঁরা ইতিহাস পড়াশোনা করেছেন, তাঁরা জানেন যে, আগের যুগে বিধবার বিবাহ প্রচলন ছিল না—বিধবা আর বিয়ে করতে পারতেন না । তা ছাড়া আগের যুগে অল্প বয়সে বিয়ে হত । এমন শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরই যখন বিয়ে করলেন, তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল ৫ বছর ! সেই জন্য, আগের যুগে বাচ্চা বয়সে বিয়ে হত । আর যখন কোন মেয়ের স্বামী মারা গেলে, তখন সহমরণ নিয়ম ছিল—মেয়েকে চিতায় পুড়িয়ে দিত । কত কঠিন কাল ছিল ! কত খারাপ জিনিস ছিল । মেয়েকে জোর করে বেঁধে ছেদে পুড়িয়ে দিত । কত কষ্ট । যে মেয়েকে পুড়িয়ে দিত না, তাকে জোর করে একাদশীটা করতে হত কারণ মেয়েদের ত যৌবন থাকে আর যৌবনের একটা taste (টষ্টে) থাকে । আর আগে একাদশীতে তিন দিন ধরে উপবাস থাকতে হত—একাদশীর আগের দিন, একাদশীর দিন, অবার একাদশীর পরের দিন । তিন দিন উপবাস থাকতে হত নির্জল—তার ফলে মেয়েদের শক্তি কমে যাবে । সেইরকম নিয়ম ছিল । কিন্তু এটা শাস্ত্রে নেই । একাদশী ৮ থেকে ৮৮ বছর পর্যন্ত সবাই একাদশী করতে বলা হয় । শাশুড়িরা বেশি ভাগে ভাবে যে, যদি বউ একাদশী করবে, তাহলে আমার ছেলের অকল্যাণ হবে । আরে, ভগবান যদি খুশি হন, তাহলে ছেলের বা মেয়ের কখনও অকল্যাণ হতে পারে ? বলুন । এসব ভুল চিন্তা । ভুলধারণা ।দেখাতে পারেন কোন শাস্ত্রে বলা হয় যে, একাদশীর ফল এইরকম ?

আমরা সব সময় নিজের ভালোমন্দ খাওয়ার জন্য চিন্তা করি আর একাদশীর কথা শুনে ভয় পাই, “আমি একাদশীতে কি করে করব ? অন্ন না খেয়ে, কি করে চলব ?” এক দিন না খেলে কি হবে ?

হাসপাতালে ভর্তি থাকলে খালি saline (সালিনে) দেবে—একমাসও ওইরকম থাকতে হতে পারে, তখন কি হবে ? কেউ মরে যায় না ।

এক দিন মহাপ্রভু নিজের মাকে বললেন, “মা, তোমার কাছে আমি একটা জিনিস ভিক্ষা চাই । দেবে ?”

“কী ব্যাপার ?”

“তুমি আগে বল যে, তুমি দেব ।”

“ঠিক আছে । দেব, দেব, দেব । ৩০০বার দেব । কি দিতে হবে ?”

“মা, তুমি একাদশী দিন অন্ন গ্রহণ করবে না ।

“ঠিক আছে । ভালই ত—আমার অন্ন রান্না করতে হবে না ।”

যাঁরা ঠাকুরের সেবা করেন, তাঁদের অন্ন রান্না করতে হবে । অন্ন রান্না করে ঠাকুরের ভোগ দিতে হয় । তাঁর প্রমাণ মহাপ্রভুর লীলায়ও আছে । এক দিন মহাপ্রভু ক্রন্দন করেছেন—আর কান্নাকাটি কিছুতেই থামল না । সেটা ছিল একাদশী দিন—মা তাঁকে খেতে দেন নি । মহাপ্রভু ত ভগবান, তিনি সব জানেন—তিনি জানেন যে, তাঁর ভক্ত জগদীশ পণ্ডিত বাড়িতে অনেক ভোগ লাগিয়ে দিলেন । তাই নিমাই মাকে বললেন, “আমাকে জগদীশ পণ্ডিতের বাড়িতে নিয়ে যাও !” শচীমাতা তখন নিমাইকে হেঁটে হেঁটে নিয়ে গিয়েছিল জগদীশ পণ্ডিতের বাড়িতে । ওইসময় ঠাকুরের ভোগ রান্না হয়েছিল আর যখন জগদীশ পণ্ডিত নিমাইকে প্রসাদ দিলেন, সে অন্ন পেলে তাঁর কান্নাকাটি থামিয়ে গেল । এতে বুঝে যায় যে, ভগবানের জন্য ঠিক মত ভোগ লাগাতে হবে । ভগবানের জন্য একাদশী নেই ।

আমরা করি কি ? মঠে নিয়ম আছে—একাদশী দিন কাউকে অন্ন দেই না । একাদশী দিন আমরা অন্ন গোরুকে দিয়ে দিই, আর বাড়িতে কি করতে হয় ? বাড়িতে বাচ্চারা আছে, তারা বুঝে না আর কান্নাকাটি করে অন্নের জন্য, তাদেরকে অন্ন প্রসাদ দিয়ে দিতে পারেন । তাঁরা বুঝেন না কিন্তু যাঁদের সুবুদ্ধি হয়েছে, তাঁদের একাদশী করা উচিত ! ৮ থেকে ৮৮ বছর পর্যন্ত বা যতক্ষণ পারবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত করবেন । অসুস্থ হয়ে গেলে উপায় নেয়, তা ছাড়া সবাইকে নিয়মানুসারে একাদশী করা উচিত ।

একাদশী দিন অন্ন চলবে না শুধু যখন ওষুধ খেতে হবে—অনেকে ওষুধ খায়, সেটা খেতে বারণ করা হয় না । আর একটা সময়—যখন গুরুদেব যে প্রসাদ দেন, তখন সেটা নিতে হবে । কিন্তু গুরুদেব ত বোকা নন—সে একাদশী দিন কেন অন্ন খেতে দেবে ?

 


 

 

← গ্রন্থাগারে

বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥