 |
আমাদের শ্রীগুরুপরম্পরা :
|
“শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠে সূর্যাস্ত কখনই হয় না” :
|
|
|
|
|
|
শ্রীশ্রীপ্রেমবিবর্ত্ত
১৯। নামরহস্যপটল
একদা গৌরাঙ্গচাঁদ চন্দ্রালোক পাঞা ।
সমুদ্রের তীরে আইল ভক্তবৃন্দ লঞা ॥১॥
হরিদাস-সমাজের উপকণ্ঠে বসি’ ।
সর্ব্ব বৈষ্ণবের প্রতি বলে গৌরশশী ॥২॥
|
শ্রীনামই একমাত্র ও শ্রেষ্ঠ সাধন
|
“শুন হে ভকতবৃন্দ, কলিকালের ধর্ম্ম ।
শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন বিনা আর নাহি কর্ম্ম ॥৩॥
কর্ম্ম-জ্ঞান-যোগ-ধ্যান দুর্ব্বল সাধন ।
অপ্রাকৃত সম্পত্তি লাভের নহে ক্রম ॥৪॥
ধর্ম্ম, ব্রত, ত্যাগ, হোম, সকলই প্রাকৃত ।
অপ্রাকৃত তত্ত্ব লাভে নাহি করে হিত ॥৫॥
কৃষ্ণনাম উচ্চারণে, স্মরণে, শ্রবণে ।
অপ্রাকৃতসিদ্ধি হয়, বলে শ্রুতিগণে ॥৬॥
শ্রীনামরহস্য সর্ব্বশাস্ত্রেতে দেখিবা ।
নাম-উচ্চারণমাত্র চিৎসুখ লভিবা ॥৭॥
|
পদ্মপুরাণ স্বর্গখণ্ড ৪৮ অধ্যায়, নামরহস্যপটলং, যথা—
|
‘শ্রীশৌনক উবাচ—
নামোচ্চারণমাহাত্ম্যং শ্রূয়তে মহদদ্ভুতম্ ।
যদুচ্চারণমাত্রেণ নরো যায়াৎ পরং পদম্ ।
তদ্বদস্বাধুনা সূত বিধানং নামকীর্ত্তনে ॥৮॥
শ্রীসূত উবাচ—
শৃণু শৌনক বক্ষ্যামি সংবাদং মোক্ষসাধনম্ ।
নারদঃ পৃষ্টবান্ পূর্ব্বং কুমারঃ তদ্বদামি তে ॥৯॥
একদা যমুনাতীরে নিবিষ্টং শান্তমানসম্ ।
সনৎকুমারং পপ্রচ্ছ নারদো রচিতাঞ্জলিঃ ।
শ্রুত্বা নানাবিধান্ ধর্ম্মান্ ধর্ম্মব্যতিকরাংস্তথা ॥১০॥
শ্রীনারদ উবাচ—
যোঽসৌ ভগবতা প্রোক্তা ধর্ম্মব্যতিকরো নৃণাম্ ।
কথং তস্য বিনাশঃ স্যাদুচ্যতাং ভগবৎপ্রিয়’ ॥১১॥
এই পটলের অর্থ কিছু বিশেষ করিয়া ।
বলি স্বরূপ রামানন্দ শুন মন দিয়া ॥১২॥
|
শ্রীনামকীর্ত্তন কি ? ‘উচ্চারণ’
|
‘উচ্চারণ’ শব্দে বুঝ শ্রীনামকীর্ত্তন ।
‘করে’ বা ‘মালায়’ সঙ্খ্যা করে ভক্তগণ ॥১৩॥
সঙ্খ্যা ছাড়ি’ অসঙ্খ্য নাম কভু কভু হয় ।
‘উচ্চারণ’ শব্দে এসব জানহ নিশ্চয় ॥১৪॥
|
লঘূচ্চারে ‘জপ’ হয়, উচ্চারে ‘কীর্ত্তন’ ।
স্মরণ-কীর্ত্তনে সব হয় ত’ গণন ॥১৫॥
কি প্রকারে নাম কৈলে সুকীর্ত্তন হয় ।
শ্রীনামকীর্ত্তনে তাহা বিধান নিশ্চয় ॥১৬॥
|
কীর্ত্তন সর্ব্বথা ও সর্ব্বদা কর্ত্তব্য
|
শ্রীনামকীর্ত্তন হয় জীবের নিত্যধর্ম্ম ।
জগতে বৈকুণ্ঠে জীবের এই মুখ্য কর্ম্ম ॥১৭॥
মায়াবদ্ধ জীবের এই মোক্ষ সাধন হয় ।
মুক্তজীবের পক্ষে তাহা সাধ্যাবধি রয় ॥১৮॥
|
ভক্তিহীন শুভকার্য ত্যাজ্য
|
ধর্ম্মশাস্ত্র-উক্ত ভক্তিহীন ধর্ম্ম যত ।
ভক্ত্যুদ্দেশ বিনা আর যত প্রকার ব্রত ॥১৯॥
ভক্ত্যুত্থিত বিরাগ ব্যতীত যত ত্যাগ ।
ভক্তি-প্রতিকূল যজ্ঞ প্রাকৃত বিভাগ ॥২০॥
এই সব শুভকর্ম্ম সম্বন্ধ বিচারে ।
ভক্তি-অনুকূল বলি’ শাস্ত্রেতে প্রচারে ॥২১॥
কলিকালে সেই সব জড়ধর্ম্ম হইল ।
ভক্তি-আনুকূল্য ত্যজি’ ধর্ম্ম নষ্ট ভেল ॥২২॥
অতএব কলিকালে নামসঙ্কীর্ত্তন ।
বিনা আর ধর্ম্ম নাই শুন ভক্তগণ ॥২৩॥
সে ধর্ম্মের ব্যতিকর যাহাই দেখিবে ।
তাহাই বর্জ্জিবে যত্নে ভক্তির প্রভাবে ॥২৪॥
‘শ্রীসনৎকুমার উবাচ—
শৃণু নারদ গোবিন্দপ্রিয় গোবিন্দধর্ম্মবিৎ ।
যৎ পৃষ্টং লোকনির্ম্মুক্তিকারণং তমসঃ পরম্’ ॥২৫॥
তুমি ত’ নারদ শ্রীগোবিন্দধর্ম্মবেত্তা ।
গোবিন্দের প্রিয়, মায়াবন্ধনের ছেত্তা ॥২৬॥
লোকনির্ম্মুক্তির হেতু জিজ্ঞাসা তোমার ।
তব প্রশ্নোত্তরে জীব হবে তমঃ পার ॥২৭॥
কলিতে সকল ধর্ম্মাধর্ম্ম তমোময় ।
নামধর্ম্ম বিনা জীবের সংসার নহে ক্ষয় ॥২৮॥
|
‘সর্ব্বাচারবিবর্জ্জিতাঃ শঠধিয়ো ব্রাত্যা জগদ্বঞ্চকাঃ
দম্ভাহঙ্কৃতিপানপৈশুন্যপরাঃ পাপাশ্চ যে নিষ্ঠুরাঃ ।
যে চান্যে ধনদারপুত্রনিরতাঃ সর্ব্বেঽধমাস্তেঽপি হি
শ্রীগোবিন্দপদারবিন্দশরণাঃ শুদ্ধা ভবন্তি দ্বিজ’ ॥২৯॥
|
শ্রীগোবিন্দপদারবিন্দে শরণ যে লয় ।
তার সর্ব্বপাপ নামে নিশ্চয় হয় ক্ষয় ॥৩০॥
কৃষ্ণনাম লয়ে কাঁদে, নিজ দোষ বলে ।
অতি শীঘ্র তার পাপ যায় ভক্তিবলে ॥৩১॥
|
কর্ম্ম প্রায়শ্চিত্তে বাসনা নষ্ট হয় না
|
কর্ম্মজ্ঞান-প্রায়শ্চিত্তে তার কিবা ফল ।
সে ফল দুর্ব্বল অতি, তার নাহি বল ॥৩২॥
এক কৃষ্ণনামে পাপীর যত পাপক্ষয় ।
বহু জন্মে সেই পাপী করিতে নারয় ॥৩৩॥
হেন পাপ স্মার্ত্তশাস্ত্রে না আছে বর্ণন ।
এক কৃষ্ণনামে যাহা না হয় খণ্ডন ॥৩৪॥
তবে কেন স্মার্ত্তলোক প্রায়শ্চিত্ত করে ? ।
সুকৃতি-অভাবে তার কর্ম্মে মতি হরে ॥৩৫॥
কর্ম্ম-প্রায়শ্চিত্তে কভু বাসনা না যায় ।
জ্ঞান-প্রায়শ্চিত্তে শোধে বাসনা হিয়ায় ॥৩৬॥
|
বাসনার মূল অবিদ্যা ভক্তিতে বিনষ্ট হয়
|
পুনঃ কিছুদিনে সে বাসনা হয় স্থূল ।
ভক্তিতে অবিদ্যা যায় বাসনার মূল ॥৩৭॥
যে জন গোবিন্দপদে লইয়া শরণ ।
নাম লয় কাকুভরে করয় রোদন ॥৩৮॥
তার পক্ষে শ্রীমুখের বাক্য সুমধুর ।
জীবের মঙ্গল, গীতায় দেখহ প্রচুর ॥৩৯॥
|
‘সর্ব্বধর্ম্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ ।
অহং ত্বাং সর্ব্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ॥৪০॥
অপি চেৎ সুদুরাচারো ভজতে মামনন্যভাক্ ।
সাধুরেব স মন্তব্যঃ সম্যগ্ব্যবসিতো হি সঃ ॥৪১॥
ক্ষিপ্রং ভবতি ধর্ম্মাত্মা শশ্বচ্ছান্তিং নিগচ্ছতি ।
কৌন্তেয় প্রতিজানীহি ন মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি’ ॥৪২॥
অতএব কর্ম্মাঙ্গ প্রায়শ্চিত্তাদি পরিহরি’ ।
বুদ্ধিমান্ জন ভজে প্রাণেশ্বর হরি ॥৪৩॥
|
‘তমপি দেবকরং করুণাকরং
স্থাবর-জঙ্গম-মুক্তিকরং পরম্ ।
অতিচরন্ত্যপরাধপরা জনা
য ইহ তান্বপতি ধ্রুবনাম হি’ ॥৪৪॥
|
কৃষ্ণনাম দয়াময় কৃষ্ণতেজোময় ।
স্থাবর-জঙ্গম-মুক্তিদাতা সুনিশ্চয় ॥৪৫॥
নাম-অপরাধী তাহে করে অপরাধ ।
অতিচার আসি’ নাম-ধর্ম্মে করে বাধ ॥৪৬॥
সেই মহা-অপরাধীর দোষ, নামে হয় ক্ষয় ।
নাম বিনা জীববন্ধু জগতে না হয় ॥৪৭॥
‘শ্রীনারদ উবাচ—
কে তেঽপরাধা বিপ্রেন্দ্র নাম্নো ভগবতঃ কৃতা ।
বিনিঘ্নন্তি নৃণাং কৃত্যং প্রাকৃতং হ্যানয়ন্তি চ’ ॥৪৮॥
|
ওহে গুরু সনৎকুমার কৃপা করি বল ।
নামে অপরাধ যত প্রকার সকল ॥৪৯॥
নামরূপ মহাকৃত্য জীবের নিশ্চয় ।
সেই কৃত্য যাহে সাধকের নষ্ট হয় ॥৫০॥
নামকে প্রাকৃত করি’ সাধন করাঞা ।
সামান্য প্রাকৃত ফলে দেয় ফেলাইয়া ॥৫১॥
‘শ্রীসনৎকুমার উবাচ—
|
সতাং নিন্দা নাম্নঃ পরমপরাধং বিতনুতে
যতঃ খ্যাতিং যাতং কথমুসহতে তদ্বিগর্হাম্
।
শিবস্য শ্রীবিষ্ণোর্য ইহ গুণনামাদিসকলং
ধিয়াভিন্নং পশ্যেৎ স খলু
হরিনামাহিতকরঃ’ ॥৫২॥
|
দশটী নামাপরাধ ভিন্ন ভিন্ন করি’ ।
বুঝিয়া লইলে নাম-অপরাধে তরি ॥৫৩॥
এই শ্লোকে দুই অপরাধের বিচার ।
করিয়া করহ শুদ্ধ নামের আচার ॥৫৪॥
একান্ত নামেতে আশ্রয় আছে যাঁর ।
সাধুপদবাচ্য তেঁহ তারেন সংসার ॥৫৫॥
জড়কর্ম্মজ্ঞানচেষ্টা ছাড়ি’ সেই জন ।
শুদ্ধভক্তিভাবে নাম করেন উচ্চারণ ॥৫৬॥
নামের প্রচার একা তাঁহা হৈতে হয় ।
তাঁর নিন্দা কৃষ্ণনাম কভু না সহয় ॥৫৭॥
|
সে সাধুর নিন্দা, তাঁতে লঘু-বুদ্ধি যার ।
বড় অপরাধ নামে নিশ্চয় তাহার ॥৫৮॥
যত্নে এই অপরাধ করিয়া বর্জ্জন ।
সেই সাধু-সঙ্গ-বলে করহ ভজন ॥৫৯॥
|
মঙ্গলস্বরূপ বিষ্ণু পরতত্ত্ব হরি ।
অপ্রাকৃত স্বরূপেতে শ্রীব্রজবিহারী ॥৬০॥
তাঁর নাম-রূপ-গুণ-লীলা অপ্রাকৃত ।
তাঁহার স্বরূপ হৈতে ভিন্ন নহে তত্ত্ব ॥৬১॥
নাম নামী এক তত্ত্ব অপ্রাকৃত ধর্ম্ম ।
এ জড় জগতে তার নাহি আছে মর্ম্ম ॥৬২॥
এই শুদ্ধজ্ঞানলাভ ভক্তিবলে হয় ।
তর্কে বহু দূর ইহা জানিহ নিশ্চয় ॥৬৩॥
নিজ শুদ্ধসাধন, আর সাধুগুরুবল ।
দুইয়ের সংয়োগে লভি’ এ তত্ত্বমঙ্গল ॥৬৪॥
এই তত্ত্বসিদ্ধি যত দিন নাহি হয় ।
ততদিন প্রাকৃতবুদ্ধি কভু না ছাড়য় ॥৬৫॥
ততদিন নাম করি’ না পাই স্বরূপ ।
নামাভাসমাত্র হয় ভজনবিরূপ ॥৬৬॥
বহু যত্নে লাভ ভাই স্বরূপের সিদ্ধি ।
শুদ্ধনামোচ্চারে পাবে পরংপদ-বুদ্ধি ॥৬৭॥
যত্নসহ নিরন্তর নামাভাসে হরি ।
নামেতে স্বরূপসিদ্ধি দিবে কৃপা করি’ ॥৬৮॥
|
কৃষ্ণ সর্ব্বেশ্বর, শিবাদি তাঁহার অংশ
|
সর্ব্বেশ্বর কৃষ্ণ, তাহে জানিবে নিশ্চয় ।
শিবাদি দেবতা তাঁর অংশরূপ হয় ॥৬৯॥
সেই সেই দেবের নামাদি গুণরূপ ।
কৃষ্ণশক্তিদত্ত সিদ্ধ জানহ স্বরূপ ॥৭০॥
এরূপ জানিলে শিববিষ্ণুতে অভেদে ।
জন্মিবে স্বরূপবুদ্ধি, গায় সর্ব্ববেদে ॥৭১॥
ভেদবুদ্ধি অপরাধ যত্নেতে ত্যজিবে ।
গুরুকৃপাবলে তবে শ্রীনাম ভজিবে ॥৭২॥
|
‘গুরোরবজ্ঞা শ্রুতিশাস্ত্রনিন্দনং
তথার্থবাদো হরিনাম্নি কল্পনম্ ।
নাম্নো বলাদ্যস্য হি পাপবুদ্ধির্-
ন বিদ্যতে তস্য যমৈর্হি শুদ্ধিঃ’ ॥৭৩॥
|
কৃপা করি’ যেই জন হরি দেখাইল ।
হরিনাম-পরিচয় করাইয়া দিল ॥৭৪॥
সেই মোর কর্ণধার গুরু মহাশয় ।
তাঁহারে অবজ্ঞা কৈলে নামাপরাধ হয় ॥৭৫॥
‘হীনজাতি পাণ্ডিত্য-রহিত মন্ত্রহীন’ ।
নামের গুরুতে হেন বুদ্ধি অর্ব্বাচীন ॥৭৬॥
|
যেই শ্রুতিশাস্ত্র নামের ব্রহ্মত্ব দেখায় ।
অপার মাহাত্ম্য নামের জগতে জানায় ॥৭৭॥
তারে অনাদর করি’ কর্ম্মাদি প্রশংসে ।
শ্রুতিনিন্দা বলি’ তারে সর্ব্বশাস্ত্রে ভাষে ॥৭৮॥
|
নাম নিত্যধন সদা চিন্ময় অগাধ ।
তাহাতে কল্পনাবুদ্ধি গুরু অপরাধ ॥৭৯॥
|
নামবলে পাপবুদ্ধি হৃদয়ে যাহার ।
সতত উদয় হয়, সেই ত’ অসার ॥৮০॥
|
রোচনার্থা ফলশ্রুতি কর্ম্মমার্গে সত্য ।
ভক্তিমার্গে নামফল সর্ব্বকালে নিত্য ॥৮১॥
অপ্রাকৃত নামের মাহাত্ম্য সীমাহীন ।
তাতে যার ‘অর্থবাদ’ সেই অর্ব্বাচীন ॥৮২॥
|
এই সব অপরাধ বর্জ্জনে নামের কৃপা
|
এই পঞ্চ অপরাধ বর্জ্জিবে যতনে ।
তবে ত’ নামের কৃপা লভিবে সাধনে ॥৮৩॥
|
‘ধর্ম্মব্রতত্যাগহুতাদিসর্ব্বশুভক্রিয়াসাম্যমপি প্রমাদঃ ।
অশ্রদ্দধানে বিমুখেঽপ্যশৃণ্বতি যশ্চোপদেশঃ শিবনামাপরাধঃ’ ॥৮৪॥
|
বর্ণাশ্রমময়-ধর্ম্ম ধর্ম্মশাস্ত্রে যত ।
দর্শপৌর্ণমাসী-আদি তমোময়-ব্রত ॥৮৫॥
দণ্ডী মুণ্ডী সন্ন্যাসাদি ত্যাগের প্রকার ।
নিত্য নৈমিত্তিক হোম-আদির ব্যাপার ॥৮৬॥
অষ্টাঙ্গ-ষড়ঙ্গ-যোগ-আদি শুভ-কর্ম্ম ।
সকলই প্রাকৃত-তত্ত্ব, এই সত্য মর্ম্ম ॥৮৭॥
উপায় রূপেতে তারা উপেয় সাধয় ।
না সাধিলে জড় বই কিছু আর নয় ॥৮৮॥
|
নাম কিন্তু অপ্রাকৃত চিন্ময় ব্যাপার ।
সাধনে উপায়তত্ত্ব সাধ্যে উপেয়-সার ॥৮৯॥
অতএব নামতত্ত্ব বিশুদ্ধ চিন্ময় ।
জড়োপায় কর্ম্ম সহ সাম্য কভু নয় ॥৯০॥
|
কর্ম্মজ্ঞান সহ নাম তুল্য নহে
|
কর্ম্মজ্ঞান সহ নামে সাম্যবুদ্ধি যথা ।
নাম-অপরাধ গুরুতর ঘটে তথা ॥৯১॥
|
নামে যার বিশ্বাস না জন্মিল ভাগ্যাভাবে ।
তাকে নাম উপদেশি’ অপরাধ পাবে ॥৯২॥
এই দুই অপরাধ সদ্গুরুকৃপায় ।
বহু যত্নে ছাড়ি’ ভাই নামধন পায় ॥৯৩॥
|
‘শ্রুত্বাপি নামমাহাত্ম্যং যঃ প্রীতিরহিতোঽধমঃ ।
অহং‑মমাদি-পরমো নাম্নি সোঽপ্যপরাধকৃৎ’ ॥৯৪॥
|
নামের মাহাত্ম্য সব শুনি’ শাস্ত্র হৈতে ।
তবু তাহে রতি যার নৈল কোনমতে ॥৯৫॥
অহংতা-মমতা-বুদ্ধি দেহেতে করিয়া ।
লাভ-পূজা-প্রতিষ্ঠাতে রহিল মজিয়া ॥৯৬॥
পাপে রত হঞা পাপ ছাড়িতে না পারে ।
নামে যত্ন করি’ চেষ্টা করিবারে নারে ॥৯৭॥
সাধুসঙ্গে মতি নহে অসাধু বিষয়ে ।
সুখ পায় বিবেক বৈরাগ্য ছাড়াইয়ে ॥৯৮॥
এই ত’ নামাপরাধ ঘটনা তাহার ।
নামে রুচি নাহি পায় কৃষ্ণের সংসার ॥৯৯॥
এই দশ অপরাধ নামাপরাধ হয় ।
নামধর্ম্মে বাধা দেয় সুমঙ্গলক্ষয় ॥১০০॥
‘সর্ব্বাপরাধকৃদপি মুচ্যতে হরিসংশ্রয়ঃ ।
হরেরপ্যপরাধান্ যঃ কুর্য্যাদ্দ্বিপদপাংসনঃ ॥১০১॥
নামাশ্রয়ঃ কদাচিৎ স্যাত্তরত্যেষ[ব?] স নামতঃ ।
নাম্নোহি সর্ব্বসুহৃদোহ্যপরাধাৎ পতত্যধঃ’ ॥১০২॥
পাপ তাপ অপরাধ জীবের যত হয় ।
শ্রীহরিসংশ্রয়ে সব সদ্য হয় ক্ষয় ॥১০৩॥
|
কলির সংসার ছাড়িয়া কৃষ্ণের সংসার কর
|
কলির সংসার ছাড়ি’ কৃষ্ণের সংসার ।
অকৈতবে করে যেই অপরাধ নাহি তার ॥১০৪॥
|
দীক্ষাকালে অকৈতবে আত্মনিবেদনে সর্ব্বপাপক্ষয়
|
পূর্ব্ব যত পাপাদি বহু জন্মে করে ।
হরিদীক্ষামাত্রে সেই সব পাপে তরে ॥১০৫॥
অকৈতবে করে যবে আত্মনিবেদন ।
কৃষ্ণ তার পূর্ব্ব পাপ করেন খণ্ডন ॥১০৬॥
প্রায়শ্চিত্ত করিবারে তার নাহি হয় ।
দীক্ষামাত্র পাপক্ষয় সর্ব্বশাস্ত্রে কয় ॥১০৭॥
নিষ্কপটে হর্য্যাশ্রয় করে যেই জন ।
সর্ব্ব অপরাধ তার বিনষ্ট তখন ॥১০৮॥
আর পাপতাপে কভু রুচি নাহি হয় ।
পুণ্য পাপ দূরে যায়, মায়া করে জয় ॥১০৯॥
|
তবে তার কভু হয় সেবা-অপরাধ ।
সেই অপরাধে হয় ভক্তিক্রিয়াবাধ ॥১১০॥
সাধুসঙ্গে করে কৃষ্ণনামের আশ্রয় ।
নামাশ্রয়ে সেবা-অপরাধ নষ্ট হয় ॥১১১॥
নামকৃপা হৈলে জীব সর্ব্বশুদ্ধি পায় ।
কৃষ্ণের নিকট গিয়া করে শুদ্ধসেবার আশ্রয় ॥১১২॥
|
সর্ব্বদা নামাপরাধ বর্জ্জনীয়
|
কিন্তু যদি নাম-অপরাধ তার হয় ।
তবে পুনঃ অধঃপাত হইবে নিশ্চয় ॥১১৩॥
সর্ব্বজীব-বন্ধু নাম, তাঁর অপরাধ ।
কোনক্রমে ক্ষয় নহে প্রাপ্ত্যে হয় বাধ ॥১১৪॥
নাম অপরাধ ত্যাগ বহু যত্নে করি’ ।
লভে জীব সর্ব্বসিদ্ধি প্রাপ্ত হয় হরি ॥১১৫॥
|
‘এবং নারদঃ শঙ্করেণ কৃপয়া মহ্যং মুনীনাং পরং
প্রোক্তং নাম সুখাবহং ভগবতো বর্জ্জ্যং সদা যত্নতঃ ।
যে জ্ঞাত্বাপি ন বর্জ্জয়ন্তি সহসা নামাপরাধান্দশ
ক্রুদ্ধা মাতরমপ্যভোজনপরাঃ খিদ্যন্তি তে বালবৎ’ ॥১১৬॥
|
আমি পূর্ব্বে শিবলোকে শঙ্করসন্নিধানে ।
নাম-অপরাধ-কথা জিজ্ঞাসিলাম মুনে ॥১১৭॥
বহুমুনিগণ মধ্যে শম্ভু কৃপা করি’ ।
আমায় উপদেশ করে কৈলাস উপরি ॥১১৮॥
ভগবানের নাম সর্ব্বজীবসুখাবহ ।
তাতে অপরাধ সর্ব্ব-অমঙ্গল-বহ ॥১১৯॥
মঙ্গল লভিতে যার ইচ্ছা আছে মনে ।
সদা নাম-অপরাধ বর্জ্জিবে যতনে ॥১২০॥
সাধুগুরুসন্নিধানে বহু দৈন্য ধরি’ ।
দশ অপরাধ-তত্ত্ব লবে শিক্ষা করি’ ॥১২১॥
অপরাধগুলি যত্নে জানিয়া ত্যজিবে ।
সত্বরে শ্রীহরিনামে প্রেম উপজিবে ॥১২২॥
নাম পেয়ে অপরাধ বর্জ্জন না করে ।
সহসা তাহারে দশ অপরাধ ধরে ॥১২৩॥
|
অপরাধ বর্জ্জন না করিয়া নাম করা মূঢ়তা
|
অপরাধ বুঝিয়া যে বর্জ্জনে উদাসীন ।
তার দুঃখ নিরন্তর সেই অর্ব্বাচীন ॥১২৪॥
মায়ে ক্রোধ করি’ বালক না করে ভোজন ।
সুপথ্য অভাবে সদা ক্লেশের ভাজন ॥১২৫॥
সেইরূপ অপরাধ বর্জ্জন না করি’ ।
নাম করে মূঢ় নিজ শিব পরিহরি’ ॥১২৬॥
‘অপরাধবিমুক্তো হি নাম্নি জপ্তং সদাচর ।
নাম্নৈব তব দেবর্ষে সর্ব্বাং সেৎস্যতি নান্যথা’ ॥১২৭॥
সনৎকুমার বলে, ‘ওহে দেবর্ষিপ্রবর ।
নিরপরাধে নাম জপ সদাই আচর ॥১২৮॥
নাম বিনা অন্য পন্থা নাহি প্রয়োজন ।
নামেতে সকল সিদ্ধি পাবে তপোধন’ ॥১২৯॥
‘শ্রীনারদ উবাচ—
|
সনৎকুমার প্রিয় সাহসানাং
বিবেক-বৈরাগ্যবিবর্জ্জিতানাম্ ।
দেহপ্রিয়ার্থাত্ম্য-পরায়ণানাম্
উক্তাপরাধাঃ প্রভবন্তি নো কথম্’ ॥১৩০॥
|
ওহে সনৎকুমার তুমি সিদ্ধ হরিদাস ।
অনায়াসে করিলে নামরহস্যপ্রকাশ ॥১৩১॥
|
সাধকের নামাপরাধ বর্জ্জনোপায়
|
সাধক আমরা আমাদের বড় ভয় ।
অপরাধ-ত্যাগে যত্ন কিরূপেতে হয় ॥১৩২॥
বিষয় মোদের বন্ধু তাহার সাহসে ।
করিবে সকল কর্ম্ম বদ্ধ মায়াপাশে ॥১৩৩॥
বিবেকবৈরাগ্যশূন্য দেহ প্রিয়জন ।
অর্থস্বরূপে মোরা সদা পরায়ণ ॥১৩৪॥
কিরূপে সাধক-মনে অপরাধ দশ ।
নাহি উপজিবে তাহা করহ প্রকাশ ॥১৩৫॥
‘শ্রীসনৎকুমার উবাচ—
জাতে নামাপরাধে তু প্রমাদে বৈ কথঞ্চন ।
সদা সঙ্কীর্ত্তয়েন্নাম তদেকশরণো ভবেৎ ॥১৩৬॥
নামাপরাধযুক্তানাং নামান্যেব হরন্ত্যঘম্ ।
অবিশ্রান্ত-প্রযুক্তানি তান্যেবার্থকরাণি হি’ ॥১৩৭॥
নামেতে শরণাপত্তি যেই ক্ষণে হয় ।
তখনই নামাপরাধের সদ্য হয় ক্ষয় ॥১৩৮॥
তথাপি প্রমাদে যদি উঠে অপরাধ ।
তাহাতেও ভক্তিতে হইয়া পড়ে বাধ ॥১৩৯॥
অপরাধ প্রমাদেতে হইবে যখন ।
নামসঙ্কীর্ত্তন তবে করিবে অনুক্ষণ ॥১৪০॥
নামেতে শরণাগতি সুদৃঢ় করিবে ।
অনুক্ষণ নামবলে অপরাধ যাবে ॥১৪১॥
|
নামেই নামাপরাধ হইবেক ক্ষয় ।
অপরাধ নাশিতে আর কারও শক্তি নয় ॥১৪২॥
এ বিষয়ে মূলতত্ত্ব বলি হে তোমায় ।
বুঝহ নারদ তুমি বেদে যাহা গায় ॥১৪৩॥
|
‘নামৈকং যস্য বাচি স্মরণপথগতং শ্রোত্রমূলং গতং বা
শুদ্ধং বাশুদ্ধবর্ণং ব্যবহিতরহিতং তারয়ত্যেব সত্যম্ ।
তচ্চেদ্দেহ‑দ্রবিণ‑জনতা‑লোভ‑পাষণ্ড‑মধ্যে
নিক্ষিপ্তং স্যান্নফলজনকং শীঘ্রমেবাত্র বিপ্র’ ॥১৪৪॥
|
যার মুখে উচ্চারিত এক কৃষ্ণনাম ।
যাহার স্মরণপথে এক নাম গুণধাম ॥১৪৫॥
যার শ্রোত্রমূলে তাহা প্রবেশ করিবে ।
ব্যবহিত-রহিত হৈলে তখনই তারিবে ॥১৪৬॥
‘ব্যবহিত’ এই শব্দে দুই অর্থ হয় ।
অক্ষরের ব্যবধানে নাম আচ্ছাদয় ॥১৪৭॥
অবিদ্যার আচ্ছাদনে প্রাকৃত প্রকাশ ।
নাম নামী একভাবে অবিদ্যা-বিনাশ ॥১৪৮॥
ব্যবহিত-রহিত হৈলে শুদ্ধনামোদয় ।
বর্ণশুদ্ধাশুদ্ধিক্রমে দোষ নাহি হয় ॥১৪৯॥
অপ্রাকৃত নামে কৃষ্ণ সর্ব্বশক্তি দিল ।
কালাকাল শৌচাশৌচ নামে না রহিল ॥১৫০॥
সর্ব্বকাল সর্ব্বাবস্থায় শুদ্ধ নাম কর ।
সর্ব্ব শুভোদয় হবে সর্ব্বাশুভ হর ॥১৫১॥
|
অসৎসঙ্গ ত্যাগপূর্ব্বক নামগ্রহণ
|
এমত অপূর্ব্ব-নাম সঙ্গযুক্ত যথা ।
শীঘ্র শুভফলদাতা না হয় সর্ব্বথা ॥১৫২॥
দেহ, ধন, জন, লোভ, পাষণ্ডসঙ্গ ক্রমে ।
ব্যবহিত জন্মে, জীব পড়ে মহাভ্রমে ॥১৫৩॥
অতএব সকলের অগ্রে সঙ্গ ত্যজি’ ।
অনন্যশরণ লঞা নামমাত্র ভজি ॥১৫৪॥
নামকৃপাবলে হবে প্রমাদ রহিত ।
অপরাধ দূরে যাবে, হইবেক হিত ॥১৫৫॥
অপরাধমুক্ত হঞা লয় কৃষ্ণনাম ।
প্রেম আসি’ নামসহ করিবে বিশ্রাম ॥১৫৬॥
অপরাধীর নামলক্ষণ কৈতব নিশ্চয় ।
সে সঙ্গ যতনে ছাড়ি’ কর নামাশ্রয় ॥১৫৭॥
‘ইদং রহস্যং পরমং পুরা নারদ শঙ্করাৎ ।
শ্রুতং সর্ব্বাশুভহরমপরাধনিবারকম্ ॥১৫৮॥
বিদুর্বিষ্ণ্বাভিধানং যে হ্যপরাধপরা নরাঃ ।
তেষামপি ভবেন্মুক্তিঃ পঠনাদেব নারদ’ ॥১৫৯॥
সনৎকুমার বলে, ‘ওহে দেবর্ষিপ্রবর ।
পূর্ব্বে শ্রীশঙ্কর মোরে হঞা দয়াপর ॥১৬০॥
শ্রীনামরহস্য সর্ব্ব-অশুভ নাশন ।
অপরাধ-নিবারক কৈল বিজ্ঞাপন ॥১৬১॥
অপরাধপর জন বিষ্ণুনাম জানি’ ।
পাঠ করিলেই মুক্তি লভে ইহা মানি’ ॥১৬২॥
|
ওহে স্বরূপ রামরায় এ নামরহস্য- ।
পটল যতনে প্রচার করিবে অবশ্য ॥১৬৩॥
কলিতে জীবের নাহি অন্য প্রতিকার ।
নামরহস্যেতে পার হইবে সংসার ॥১৬৪॥
পূর্ব্বে মুঞি ‘শিক্ষাষ্টকে’ যে তত্ত্ব কহিল ।
এবে ব্যাসবাক্যে তাহা পুনঃ দেখাইল ॥১৬৫॥
যতনে রহস্যপটল প্রচারিবে সবে ।
সর্ব্বক্ষণ আলোচিয়া নাম লবে তবে ॥১৬৬॥
|
নামাচার্য্য ঠাকুর হরিদাসের আনুগত্যে শ্রীনামভজন
|
পৃথিবীর শিরোমণি ছিল হরিদাস ।
এই নামরহস্য সব করিল প্রকাশ ॥১৬৭॥
প্রচারিল আচরিল এই নামধর্ম্ম ।
নামের আচার্য্য হরিদাস, জান মর্ম্ম ॥১৬৮॥
হরিদাসের অনুগত হইয়া শ্রীনাম ।
ভজিবে যে জন সেই নিত্যসিদ্ধকাম” ॥১৬৯॥
|
|
সূচীপত্র:
১। মঙ্গলাচরণ
২। গ্রন্থরচনা
৩। প্রথম প্রণাম
৪। গৌরস্য গুরুতা
৫। বিবর্ত্তবিলাসসেবা
৬। জীব-গতি
৭। সকলের পক্ষে নাম
৮। কুটীনাটি ছাড়
৯। যুক্তবৈরাগ্য
১০। জাতিকুল
১১। নবদ্বীপ-দীপক
১২। বৈষ্ণব-মহিমা
১৩। শ্রীগৌরদর্শনের
ব্যাকুলতা
১৪। বিপরীত বিবর্ত্ত
১৫। শ্রীনবদ্বীপে
পূর্ব্বাহ্ণ-লীলা
১৬। পীরিতি কিরূপ ?
১৭। ভক্তভেদে আচারভেদ
১৮। শ্রীএকাদশী
১৯। নামরহস্যপটল
২০। নাম-মহিমা
|
|
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে ।
পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥
|