আমাদের শ্রীগুরুপরম্পরা :
শ্রীশ্রীল ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ ভগবান্ শ্রীশ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর
              প্রভুপাদ
“শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠে সূর্যাস্ত কখনই হয় না” :
আমাদের মঠের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
 
আমাদের সম্পর্কে শ্রীউপদেশ শ্রীগ্রন্থাগার শ্রীগৌড়ীয় পঞ্জিকা ছবি ENGLISH
 

শ্রীনবদ্বীপধাম মাহাত্ম্য-মুক্তা-মালা


শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের ভজনকুটির
(স্বানন্দ-সুখদা-কুঞ্জ)

 

বন্দে ভক্তিবিনোদং শ্রীগৌরশক্তিস্বরূপকম্ ।
ভক্তিশাস্ত্রজ্ঞসম্রাজং রাধারসসুধানিধিম্ ॥

শ্রীল গুরুদেবের কৃপায়, সমস্ত ভক্তিবৃন্দের কৃপায় আমাদের শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠ (আন্তর্জাতিক) পরিক্রমা সঙ্ঘ এখন শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের ভজনকুটির ও সমাধি-মন্দিরে এসেছে । এই গৃহে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর থাকতেন ও ভজন করতেন ।

যখন শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর এখানে এসেছিলেন, তখন মায়াপুরে কিছু ছিল না—যে সমস্ত মঠ-মন্দির, দারুণ অট্টালিকা, ইত্যাদি আপনারা এখন দেখতে পারছেন, সেটা তখন কিছু ছিল না । মহাপ্রভুর জন্মস্থানও লুকায়িত ছিল । সমস্ত গৌড়ীয় মঠের মন্দিরগুলো শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের দ্বারা আবিষ্কার করা হয়েছিল ।

আমাদের পরমগুরুদেব ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজের শ্রীমদ্ভক্তিবিনোদবিরহদশকম্ পড়ে শ্রীল পভুপাদ ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর খুব খুশি হয়ে গেলেন, বিশেষ ভাবে এই শ্লোকের দ্বারা :

শ্রীগৌরানুমতং স্বরূপবিদিতং রূপাগ্রজেনাদৃতং
রূপাদ্যৈঃ পরিবেশিতং রঘুগণৈরাস্বাদিতং সেবিতম্ ।
জীবাদ্যৈরভিরক্ষিতং শুক-শিব-ব্রহ্মাদি-সম্মানিতং
শ্রীরাধাপদসেবনামৃতমহো তদ্দাতুমীশো ভবান্ ॥

“শ্রীগৌরচন্দ্রের অনুজ্ঞালব্ধ শ্রীস্বরূপ দামোদর যাহার মর্ম্মজ্ঞ, শ্রীসনাতন গোস্বামী যাহার আদরকারী, শ্রীরূপপ্রমুখ রসতত্ত্বাচার্য্যগণ যাহা পরিবেশন করিতেছেন, শ্রীরঘুনাথদাস গোস্বামী প্রমুখ যাহা আস্বাদন ও সমৃদ্ধ করিতেছেন, শ্রীজীবপ্রভু প্রভৃতি যাহার রক্ষণাবেক্ষণ করিতেছেন এবং শ্রীশুক, দেবাদিদেব মহাদেব ও লোকপিতামহ ব্রহ্মা প্রভৃতি যাহা (দূর হইতে) সম্মান করিতেছে—অহো সেই শ্রীরাধাপদপরিচর্য্যা-রসামৃত—তাহাও দান করিতে আপনি সমর্থ ।”

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর আমাদেরকে কী দিয়েছেন ?

গুরুদং গ্রন্থদং গৈরধামদং নামদং মুদা
ভক্তিদং ভূরিদং বন্দে ভক্তিবিনোদকং সদা

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর আমাদের গুরু দিয়েছেন ।

আসলে যদি তিনি আমাদের শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর না দিতেন, তাহলে কোথায় আমরা আশ্রয় পেতাম ? কার চরণে আমরা আশ্রয় গ্রহণ করতাম ? কোথা থেকে আমরা আমাদের গুরু বা গুরুবর্গ পেতাম ?

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর অনেক জায়গায় উড়িষ্যা বা পশ্চিমবঙ্গে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন । আস্তে আস্তে তিনি বুঝতে পেরেছেন যে, মহাপ্রভুর শুদ্ধ ভক্তি, শুদ্ধ সিদ্ধান্ত প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল এবং বহু অপসম্প্রদায়—আউল, বাউল, কর্তাভজা, নেড়া, দরবেশ, সাঁই, সহজিয়া, সখীভেকী, স্মার্ত, জাত-গোসাঞি, অতিবাড়ী, চূড়াধারী, গৌরাঙ্গনাগরী—সব জগতে ঘুরে বেড়ায় । তীব্র দুঃখ পেয়ে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর (তাঁর নাম ছিল শ্রীকেদারনাথ দত্ত ওই সময়) তাঁর স্ত্রী ভগবতীদেবীর সাথে জগন্নাথ মন্দিরে বিমলাদেবীর কাছে গিয়ে প্রার্থনা করলেন, “হে দেবী ! তুমি আমাকে একজনকে পাঠাও যে এই শুদ্ধ ভক্তির সিদ্ধান্ত প্রবাহিত করতে পারবে !” বিমলাদেবী কৃপা করে ভক্তিবিনোদ ঠাকুরকে সন্তান দিলেন—তাঁর নাম হয়েছিল বিমলা প্রসাদ । সেই বিমলা প্রসাদ পরে শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর হয়েছেন—তিনি সর্ব্ব দেশে এমনকি বিদেশেও প্রচার করে ৬৪টি মঠ স্থাপন করেছিলেন । শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর ও শ্রীল প্রভুপাদের অহৈতুকি কৃপায় আমরা এখন এই পরিক্রমা করতে পারি এবং এই শ্রীরূপানুগ গুরুবর্গের সঙ্গে থাকতে সুযোগ পেয়েছি ।

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর আমাদের গ্রন্থ দিয়েছেন ।

যখন শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর প্রথম মহাপ্রভুর শুদ্ধ সিদ্ধান্ত জানতে ­ও পড়তে চাইছিলেন, তখন তিনি বহু যত্ন করে শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ সংগ্রহ করেছিলেন । ওই সময় সব গ্রন্থ প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল বা বিভিন্ন প্রাচীন মন্দিরের গ্রন্থাগারের মধ্যে রাখা হল । মহাপ্রভুর শুদ্ধ সিদ্ধান্ত প্রচার করবার জন্য শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর অনেক গ্রন্থ সংগ্রহও করেছিলেন এবং বহু গ্রন্থ রচনাও করেছিলেন । তিনি অনেক গীতি-কবিতা, গ্রন্থভাষ্য, বক্তৃতা, প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন । প্রতি দিন আমরা যে সকাল-সন্ধ্যার সময় কীর্ত্তন করি, সে প্রায় সমস্ত কীর্ত্তন তিনিই রচনা করেছিলেন । অনেক কীর্ত্তনগুলোও শরণাগতি থেকে আছে ।

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর আমাদের গৌরধাম দিয়েছিলেন ।

যখন শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর এই জগতে আবির্ভূত হয়েছেন, তখন অনেকেই ভাবতেন যে, মহাপ্রভুর জন্মস্থান গঙ্গায় হারিয়ে গিয়েছিল । কিন্তু শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর চিন্তা করলেন, “গঙ্গা নিতে পারে কিন্তু গঙ্গা ফিরেও দিতে পারে । নিশ্চয়ই মহাপ্রভুর জন্মস্থান এখনই বর্তমান ।”

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের অভ্যাস ছিল এইরকম : উনি প্রত্যেক দিন খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তেন—সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে পড়লে আবার রাত দুপুরের সময় উঠতেন, সারা রাত তিনি হরিনাম করতেন । এক দিন সকাল বেলায় উঠে এই বাড়ির ছাদের উপরে হরিনাম করতে করতে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর এখান থেকে কিছু দূরে দিব্য জ্যোতি দেখতে পেলেন । যেখানে দিব্য জ্যোতি ছিল, সেখানে সকাল বেলায় তিনি আর একজনকে নিয়ে চলে এলেন আর তুলসী বাগান দেখলে একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই জমির নামটা কী ?”

লোকটি বললেন, “ঠিক মত জানি না, সবাই বলে মিয়াপুর ।”

“আর জমিটা কার ?”

“আমরাও বলতে পারি না ।”

“তোমরা এখানে কি চাষবাস করছ না ?”

“না, আমরা চেষ্টা করলাম, পাট ও ধান লাগিয়ে দিয়েছি কিন্তু কিছু হয় নি, যা লাগাই, সব তুলসী গাছ হয়ে যায় ।”

তখন শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর ভাবলেন, “এটা নিশ্চয়ই একটি বিশেষ স্থান, নতুবা তুলসী বাগান এখানে কেন ?”

তখন নবদ্বীপে ফিরে এসে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর শ্রীল জগন্নাথদাস বাবাজী মহারাজের কাছে গিয়েছিলেন । শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মহারাজ, আপনি কি আমার সঙ্গে যাবেন ? আমি একটি অদ্ভুত স্থান দেখেছি, আপনাকে এই জায়গা দেখাতে চাই ।” বয়স্ক হয়ে (তাঁর বয়স তখন কাছাকাছি ১৩৫ বছর ছিল) শ্রীল জগন্নাথদাস বাবাজী মহারাজ হাঁটতে পারতেন না, তাই তাঁর সেবক তাঁকে ঝুড়ি করে মাথায় বয়ে নিয়ে এসেছিলেন । যখন শ্রীল জগন্নাথদাস বাবাজী মহারাজ ওই স্থানে পৌঁছে গিয়েছিলেন, তখন তিনি ঝুড়ি থেকে লাফ দিয়ে নাচতে শুরু করলেন ! তিনি চিৎকার করতে থাকলেন, “হ্যাঁ ! পেয়েছি ! এইটা প্রভুর জন্মস্থান ! এইটা যোগপীঠ !”

এইভাবে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর মহাপ্রভুর জন্মস্থান—মহাপ্রভুর ধাম প্রকাশ করেছিলেন । মায়াপুর আবিষ্কার করার পর, তিনি ও শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর সমস্ত গৌর-পার্ষদগণের স্থানগুলো কিনে নিয়ে সেখানে গৌড়ীয় মঠ স্থাপন করেছিলেন । তাঁর কৃপায় আমরা এখন মন্দিরে মন্দিরে তীর্থে তীর্থে গিয়ে এই ধাম পরিক্রমা করতে পারি ।

আর একটা কথা বলা ও জানা উচিত যে, যখন শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর মায়াপুর ধাম আবিষ্কার করেছিলেন, তখন সমস্ত বাবাজীগণ সকলে মিলে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের বিরুদ্ধে কেস (মোকদ্দমা) দায়ের করলেন—ওরা বললেন, “না, মহাপ্রভুর জন্মস্থান আসলে নবদ্বীপটাউনে (মায়াপুরে নয়, গঙ্গার অপর তীরে) কিন্তু হাই কোর্ট (High Court) ও সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court) সবাই রায় দিয়েছেন যে, না, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর জন্মস্থানটা মায়াপুর (যোগপীঠে) । এই কথা আপনাদের সব সময় মনে রাখতে হবে । সহজিয়া, আউল, বাউল, ইত্যাদি ভাবছে ও বলছে যে, নবদ্বীপটাউন হচ্ছে প্রাচীন মায়াপুর ও মহাপ্রভুর জন্মস্থান কিন্তু গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ সেটা কখনও ভাবেন না—যোগপীঠ, মায়াপুর হচ্ছে চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান ।

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর আমাদের নাম দিয়েছেন ।

মহাপ্রভু বলেছিলেন :

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ॥
হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামৈব কেবলম্ ।
কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা ॥

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মহাপ্রভুর পর অনেক নাম-অপরাধী উৎপন্ন হয়ে গেল । অনেক অপসম্প্রদায় হরিনাম বিতরণ করতে শুরু করল কিন্তু তাঁদের হরিনাম ইচ্ছামত । শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর ভাবলেন, “নিত্যানন্দ প্রভু নামের হট্ট স্থাপন করেছেন আর আমি এই নামহট্টে ঝাড়ুদার হব—ঝাড়ু দিয়ে আমি সম ভুল সিদ্ধান্ত নামের হট্ট থেকে বিতাড়ন করব !” এই রকম ঘোষণা করলে তিনি তাই করেছিলেন ।

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর আমাদের ভক্তি দিয়েছেন ।

ভগবানের কাছ থেকে তাঁর ভক্তি লাভ করা এত সহজ নয়—ভগবান্ সব সময় লুকিয়ে থাকেন ।

কৃষ্ণ যদি ছুটে ভক্তে ভুক্তি মুক্তি দিয়া ।
কভু ভক্তি না দেন রাখেন লুকাইয়া ॥

যদিও ভগবান তাঁর ভক্তি দেন, সেটা সম্পূর্ণ ভক্তি নয়—তিনি অনেক কিছু দিতে পারেন কিন্তু নিজেকে তিনি কাউকে দেন না । উপরন্তু কৃষ্ণের কাছে তাঁর সঙ্গ লাভ করবার জন্য গেলে আপনি অসুর-হত্যাকারী কৃষ্ণ পেতে পারেন—তাঁর সঙ্গ করলে আপনাদের কী অবস্থা হবে ? কিন্তু ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণকে সত্যিকারে কে দিতে পারে ? শুধু বৈষ্ণব-ঠাকুর, ভগবানের ভক্ত । যখন ভগবানের প্রিয় ভক্ত আপনাদের কিছু দেন, তখন সেটা সম্পূর্ণ দান । সেই জন্য যে দান ঠাকুর ভক্তিবিনোদ ঠাকুর আমাদেরকে দিয়েছিলেন, যে ভক্তি-সিদ্ধান্ত তিনি এই জগতে প্রচার করতেন, সেটা শুদ্ধ ভক্তি । তার চাইতে এই জগতে আর কিছু নেই ।

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর আমাদের ভূরিদা ।

তিনি হচ্ছেন সপ্তম গোস্বামী । মহাপ্রভু বৃন্দাবনে ছয় গোস্বামীকে পাঠিয়েছেন : শ্রীল রূপ গোস্বামী, শ্রীল সনাতন গোস্বামী, শ্রীল রঘুনাথ ভট্ট গোস্বামী, শ্রীল জীব গোস্বামী, শ্রীল গোপাল ভট্ট গোস্বামী এবং শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামী । মহাপ্রভু ওঁদের আদেশ দিলেন যে, ওঁরা বৃন্দাবনে গিয়ে মহাপ্রভুর মূল-সিদ্ধান্ত প্রচার করবেন । ওঁরা সফল ছিলেন—মহাপ্রভুর অভীষ্ট সম্পূর্ণরূপে ওঁরা সিদ্ধ করলেন ।

কিন্তু তারপর তাঁরা সব স্বধামে চলে গেলেন... কে তাঁদের পর প্রচার করবেন ? এক দিন শিশির ঘোষ লিখেছেন, “কে সপ্তম গোস্বামী হতে পারেন ? যদি এই জগতে ছয় গোস্বামীর পরে কেউ গোস্বামী হতে পারেন, তাহলে সেটা মাত্রই শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর মহাশয় হতে পারে ।”

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের সম্বন্ধে আমরা অনেক কিছু বলতে পারি কিন্তু তাঁর মূল শিক্ষা তাঁর গ্রন্থের মধ্যেই রেখেছেন । যদি আপনারা তাঁর বইগুলো পড়বেন, আপনারা বুঝতে পারবেন সনাতন-ধর্ম্ম বা জৈব-ধর্ম্ম কাহাকে বলা হয়, আমাদের সিদ্ধান্ত কী ইত্যাদি ।

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর না থাকতেন কি করে আমরা এসব পেতে পারতাম ? কি করে আমরা শ্রীল প্রভুপাদকে পেতাম ? প্রভুপাদ না আসতেন আমরা শ্রীল শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজকে কি করে পেতাম ? আর শ্রীল শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ যদি শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠ স্থাপন না করতেন, তাহলে আমরা কি করে আমাদের গুরুদেবকে (ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজকে) পেতাম ? তাই শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের অবদান ও কথা আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে ।

আমাদের পরম গুরুদেব ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ শ্রীমদ্ভক্তিবিনোদবিরহদশকম্ রচনা করেছিলেন :

হা হা ভক্তিবিনোদঠক্কুর ! গুরো ! দ্বাবিংশতিস্তে সমা
দীর্ঘাদ্দুঃখভরাদশেষবিরহাদ্দুঃস্থীকৃতা ভূরিয়ম্ ।
জীবানাং বহুজন্মপুণ্যনিবহাকৃষ্টো মহীমণ্ডলে
আবির্ভাবকৃপাং চকার চ ভবান্ শ্রীগৌরশক্তিঃ স্বয়ম্ ॥১॥

হা হা ! ভক্তিবিনোদ ঠাকুর ! হে পরমগুরো ! এই দ্বারিংশবর্ষকাল দীর্ঘদুঃখময় আপন অপরিসীম বিরহে এই পৃথিবী দুর্দ্দশা গ্রস্ত হইয়াছে । জীবগণের বহুজন্ম-সুকৃতিপুঞ্জদ্বারা আকৃষ্ট হইয়া শ্রীগৌরশক্তি আপনি স্বয়ং এই ভূমণ্ডলে কৃপাপূর্ব্বক আবির্ভূত হইয়াছিলেন ॥১॥

দীনোঽহং চিরদুষ্কৃতির্নহি ভবৎপাদাব্জধূলিকণা-
স্নানানন্দনিধিং প্রপন্নশুভদং লব্ধুং সমর্থোঽভবম্ ।
কিন্ত্বৌদার্য্যগুণাত্তবাতিযশসঃ কারুণ্যশক্তিঃ স্বয়ম্
শ্রীশ্রীগৌরমহাপ্রভোঃ প্রকটিতা বিশ্বং সমন্বগ্রহীৎ ॥২॥

আমি দীন ও অতি দুষ্কৃতি, তজ্জন্যই আর পাদপদ্মধূলীকণায় স্নানানন্দরূপ প্রপন্নমঙ্গলপ্রদ নিধিলাভ আমার ভাগ্যে ঘটিল না । কিন্তু আপনার উদারতাগুণে মহাপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গের করুণাশক্তি স্বয়ং মহাযশা আপন হইতে প্রকাশিত হইয়া এই বিশ্বকে অনুগ্রহ দান করিলেন (অর্থাৎ বিশ্বের অন্তর্গত হওয়ায় আমি তাঁহার অনুগ্রহ প্রাপ্ত হইলাম) ॥২॥

হে দেব ! স্তবনে তবাখিলগুণানাং তে বিরিঞ্চাদয়ো
দেবা ব্যর্থমনোরথাঃ কিমু বয়ং মর্ত্ত্যাধমাঃ কুর্ম্মহে ।
এতন্নো বিবুধৈঃ কদাপ্যতিশয়ালঙ্কার ইত্যুচ্যতাং
শাস্ত্রেষ্বেব 'ন পারয়েঽহ'মিতি যদ্গীতং মুকুন্দেন তৎ ॥৩॥

হে দেব ! আপনার নিখিল গুণরাশির (সুষ্ঠভাবে) স্তব করিতে যখন সেই ব্রহ্মাদি দেবগণও ব্যর্থমনোরথ হন, তখন অধম মনুষ্যমাত্র আমাদের কা কথা । এই উক্তিকে পণ্ডিতগণ কখনও অতিশয়ালঙ্কার বলিবেন হা । কারণ ভগবান্ স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণই (তোমাদের ভক্তির প্রতিদান দিতে) “আমি পারি না” বলিয়া শাস্ত্রসমূহে সেই প্রসিদ্ধ গান গাহিয়াছেন ॥৩॥

ধর্ম্মশ্চর্ম্মগতোঽজ্ঞতৈব সততা যোগশ্চ ভোগাত্মকো
জ্ঞানে শূন্যগতির্জপেন তপসা খ্যাতির্জিঘাংসৈব চ ।
দানে দাম্ভিকতাঽনুরাগভজনে দুষ্টাপচারো যদা
বুদ্ধিং বুদ্ধিমতাং বিভেদ হি তদা ধাত্রা ভবান্ প্রেষিতঃ ॥৪॥

যে সময়ে ধর্ম্ম চর্ম্মবিচারময়, অজ্ঞতাই সাধুতা এবং যোগ ভোগাভিসন্ধিমূলক—যখন জ্ঞানানুশীলনে শূন্যমাত্র গতি এবং জপ ও তপস্যায় যশঃ ও পরহিংসাই অন্বেষণের বিষয়—যখন দানে দাম্ভিকতার অনুশীলন এবং অনুরাগভক্তির নামে ঘোরতর পাপাচার প্রভৃতি বিচার বুদ্ধিমান্ জনগণেরও বুদ্ধিভেদ ঘটাইতেছিল, ঠিক সেই সময়ে বিধাতাকর্ত্তৃক আপনি প্রেরিত হইলেন ॥৪॥

বিশ্বেঽস্মিন্ কিরণৈর্যথা হিমকরঃ সঞ্জীবয়ন্নোষধীর্-
নক্ষত্রাণি চ রঞ্জয়ন্নিজসুধাং বিস্তারয়ন্ রাজতে ।
সচ্ছাস্ত্রাণি চ তোষয়ন্ বুধগণং সম্মোদয়ংস্তে তথা
নূনং ভূমিতলে শুভোদয় ইতি হ্লাদো বহুঃ সাত্বতাম্ ॥৫॥

এই বিশ্বে হিমকর চন্দ্র যেরূপ কিরণ সমূহ দ্বারা ওষধি সকলকে সঞ্জীবিত ও তারাগণকে রঞ্জিত করিয়া নিজ জ্যোৎস্নামৃত বিস্তার করিতে করিতে শোভা পাইতে থাকেন, তদ্রূপ শুদ্ধ শাস্ত্রসমূহের (অনুশীলনদ্বারা) তোষণ এবং পণ্ডিতগণের (শ্রৌত সিদ্ধান্তদ্বারা) পূর্ণানন্দ বিধান করিয়া নিশ্চিতই এই পৃথিবীতে আপনার শুভোদয় । ইহাতে সাত্বতগণের সুখের সীমা নাই ॥৫॥

লোকানাং হিতকাম্যয়া ভগবতো ভক্তিপ্রচারস্ত্বয়া
গ্রন্থানাং রচনৈঃ সতামভিমতৈর্নানাবিধৈর্দর্শিতঃ ।
আচার্য্যৈঃ কৃতপূর্ব্বমেব কিল তদ্রামানুজাদ্যৈর্বুধৈঃ
প্রেমাম্ভোনিধিবিগ্রহস্য ভবতো মাহাত্ম্যসীমা ন তৎ ॥৬॥

লোকসমূহের কল্যাণার্থে আপনি বহু গ্রন্থের রচনা দ্বারা এবং সাধুসম্মত নানাবিধ উপায়ে শ্রীভগবদ্ভক্তি প্রচার প্রদর্শন করিয়াছেন । শ্রীরামানুজ প্রভৃতি মনীষিগণ ও অন্যান্য অনেক আচার্য্যও এইপ্রকার কার্য্য পূর্ব্বকালে করিয়াছেন ; এইরূপ শ্রুত হওয়া যায় । কিন্তু প্রেমামৃত-মূর্ত্তিস্বরূপ আপনার মাহাত্ম্যসীমা তাহাতেই (আবদ্ধ) নয় ॥৬॥

যদ্ধাম্নঃ খলু ধাম চৈব নিগমে ব্রহ্মেতি সংজ্ঞায়তে
যস্যাংশস্য কলৈব দুঃখনিকরৈর্যোগেশ্বরৈর্মৃগ্যতে ।
বৈকুন্ঠে পরমুক্তভৃঙ্গচরণো নারায়ণো যঃ স্বয়ম্
তস্যাংশী ভগবান্ স্বয়ং রসবপুঃ কৃষ্ণো ভবান্ তৎপ্রদঃ ॥৭॥

যাঁহার চিদ্ধামের জ্যোতির্মাত্র ‘ব্রহ্ম’সংজ্ঞায় বেদে সংজ্ঞিত হইয়াছেন, যাঁহার অংশাংশের অংশমাত্র যোগেশ্বরগণ বহুদুঃখ স্বীকার করিয়া অন্বেষণ করেন, পরমমুক্তকুল যাঁহার পাদপদ্মে মধুকরস্বরূপে শোভমান, সেই পরব্যোমনাথ সাক্ষাৎ শ্রীনারায়ণেরও যিনি অংশী স্বয়ং ভগবান্ অখিলরসামৃতমূর্ত্তি শ্রীকৃষ্ণ—তাঁহাকেই আপনি প্রদান করেন ॥৭॥

সর্ব্বাচিন্ত্যময়ে পরাৎপরপুরে গোলোক-বৃন্দাবনে
চিল্লীলারসরঙ্গিনী পরিবৃতা সা রাধিকা শ্রীহরেঃ ।
বাৎসল্যাদিরসৈশ্চ সেবিত-তনোর্মাধুর্য্যসেবাসুখং
নিত্যং যত্র মুদা তনোতি হি ভবান্ তদ্ধামসেবাপ্রদঃ ॥৮॥

সর্ব্বপ্রকারে অচিন্ত্য গুণময় পরব্যোমের পরমোচ্চ প্রদেশে গোলোক নামক শ্রীবৃন্দাবনধামে, যেখানে সখীজনে পরিবৃত হইয়া সেই চিন্ময়লীলারস-বিলাসিনী শ্রীমতী রাধিকা বাৎসল্যাদি-রসচতুষ্টয়সেবিত-বিগ্রহ শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রের মাধুর্য্যরসময় সেবাসুখ নিত্যকাল পরমানন্দের সহিত বিস্তার করিতেছেন, আপনি সেই ধামের সেবা প্রদান করিতে পারেন ॥৮॥

শ্রীগৌরানুমতং স্বরূপবিদিতং রূপাগ্রজেনাদৃতং
রূপাদ্যৈঃ পরিবেশিতং রঘুগণৈরাস্বাদিতং সেবিতম্ ।
জীবাদ্যৈরভিরক্ষিতং শুক-শিব-ব্রহ্মাদি-সম্মানিতং
শ্রীরাধাপদসেবনামৃতমহো তদ্দাতুমীশো ভবান্ ॥৯॥

শ্রীগৌরন্দ্রের অনুজ্ঞালব্ধ শ্রীস্বরূপ দামোদর যাহার মর্ম্মজ্ঞ, শ্রীসনাতন গোস্বামী যাহার আদরকারী, শ্রীরূপপ্রমুখ রসতত্ত্বাচার্য্যগণ যাহা পরিবেশন করিতেছেন, শ্রীরঘুনাথদাস গোস্বামী প্রমুখ যাহা আস্বাদন ও সমৃদ্ধ করিতেছেন, শ্রীজীবপ্রভু প্রভৃতি যাহার রক্ষণাবেক্ষণ করিতেছেন এবং শ্রীশুক, দেবাদিদেব মহাদেব ও লোকপিতামহ ব্রহ্মা প্রভৃতি যাহা (দূর হইতে) সম্মান করিতেছে—অহো সেই শ্রীরাধাপদপরিচর্য্যা-রসামৃত—তাহাও দান করিতে আপনি সমর্থ ॥৯॥

ক্বাহং মন্দমতিস্ত্বতীবপতিতঃ ক্ব ত্বং জগৎপাবনঃ
ভো স্বামিন্ কৃপয়াপরাধনিচয়ো নূনং ত্বয়া ক্ষম্যতাম্ ।
যাচেঽহং করুণানিধে ! বরমিমং পাদাব্জমূলে ভবৎ-
সর্ব্বস্বাবধি-রাধিকা-দয়িত-দাসানাং গণে গণ্যতাম্ ॥১০॥

কোথায় আমি মন্দমতি, অতি পতিতজন, আর কোথায় আপনি জগৎপাবন মহাজন ! হে প্রভো ! কৃপাপূর্ব্বক (এই স্তবকারী) আমার অপরাধ সমূহ আপনি নিশ্চিতই ক্ষমা করিবেন । হে করুণাসাগর ! আপনার পাদপদ্মমূলে এই বর প্রার্থনা করিতেছি য়ে, আপনার প্রাণসর্ব্বস্ব শ্রীবার্ষভানববীদয়িতদাসগোষ্ঠীমধ্যে আমাকে গণনা করিয়া কৃতার্থ করুন ॥১০॥

 

আমাদের গুরুদেব ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের সম্বন্ধে আমাদের মঠের গৌড়ীয় দর্শন পত্রিকায় একটি খুব সুন্দর প্রবন্ধ ১৯৫৫ সালে লিকেছেন । শেষ করে আমরা এই বিশেষ প্রবন্ধ এখানে প্রদান করি :

 

শ্রীল ভক্তিবিনোদ-আবির্ভাব-তিথিতে

(শ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজের
বক্তৃতার মর্ম্ম, শ্রীধাম নবদ্বীপ)

"মুকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্ ।
যৎকৃপা তমহং বন্দে শ্রীগুরুং দীনতারণম্ ॥

নমো ভক্তিবিনোদায় সচ্চিদানন্দ-নামিনে ।
গৌরশক্তি-স্বরূপায় রূপানুগবরায়তে ॥

বাঞ্ছাকল্পতরুভ্যশ্চ কৃপাসিন্ধুভ্য এব চ ।
পতিতানাং পাবনেভ্যো বৈষ্ণবেভ্যো নমো নমঃ ॥"

আজ শ্রীমঠে শ্রীগুরু-পাদপদ্মের অনুপস্থিতিতে তাঁর ইচ্ছায় শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের মহিমা শংসন জন্য আপনাদের সম্মুখে আমি দণ্ডায়মান্, আমার মত এজন পতিত অধম জড়ধীর কোন অধিকারই নাই—সেই অপ্রাকৃত তত্ত্ব ঠাকুর মহাশয়ের কথা কীর্ত্তন করিবার । কেন না—“অপ্রাকৃত বস্তু নহে প্রাকৃত-গোচর । বেদ-পুরাণেতে ইহা কহে নিরন্তর ॥” শ্রীভগবান্ বা তাঁহার ভক্তগণ—পার্ষদগণ,—অধোক্ষজতত্ত্ব ; তাঁহাদের নাম-রূপ-গুণ-লীলা-পরিকর-বৈশিষ্ট সমস্তই অধোক্ষজ । অক্ষজ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়জ-জ্ঞানের সাহায্যে সেই তত্ত্ব জানা কোন প্রকারেই সম্ভব নহে । বেদাদি সর্ব্ব-শাস্ত্রেই ষ্পষ্টরূপে একথা কীর্ত্তিত আছে । “নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো ন মেধয়া বা বহুনা শ্রুতেন—“ ইত্যাদি । অতএব আমার মত মূঢ় কিভাবে সেই তত্ত্বের পরিচয় দিতে পারে ? তবুও আমি আজ আপনাদের ন্যায় মহান্ বিজ্ঞ বৈষ্ণবগণের সম্মুখে যে দণ্ডায়মান্ হয়েছি,—তাহা একমাত্র গুরু-পাদপদ্মের কৃপাদেশ বলেই । “বৈষ্ণবের গুণগান করিলে জীবের ত্রাণ, শুনিয়াছি সাধু-গুরুমুখে ।”—কিন্তু আমি অযোগ্য । তবে শ্রীগুরু-পাদপদ্মের কৃপাশক্তি সঞ্চারিত হইলে বিষ্ঠাভোজী কাক ও ভগবদ্বাহন গরুড়ের পদবী লাভ করিতে পারে ; পঙ্গুও পর্ব্বত উল্লঙ্ঘনের সামর্থ্য লাভ করিতে পারে ; মহামুর্খও পাণ্ডিত্য-প্রতিভালোকে দশদিক উদ্ভাসিত করিতে পারে এমনকি মুক অর্থাৎ বাক্-শক্তিরহিত ব্যক্তিও সরস্বতীর ন্যায় বক্তা হইতে পারে ; অতএব আমি সর্ব্বাগ্রে শ্রীগুরু-পাদপদ্মে প্রণত হইয়া সেবামুখে তাঁহার করুণা-শক্তি প্রার্থনা করি ।

ভগবান শ্রীগৌরসুন্দরের ইচ্ছাতেই তাহার কৃপা-শক্তি বিগ্রহ ঠাকুর শ্রীল সচ্চিদানন্দ ভক্তিবিনোদ আজ হ’তে প্রায় ১১৭ কি ১১৮ বৎসর পূর্ব্বে গৌর-ধামের অন্তর্গত নদীয়া জেলার বীরনগর গ্রামে আবির্ভূত হন ।

ভগবান্ বা তদীয়গণের আবির্ভাব-কালের লক্ষণ, শাস্ত্রে এই প্রকার দেখা যায় যে,—যখন যখন ধর্ম্মের গ্লানি এং অধর্ম্মের অভ্যুত্থান হয় সেই সেই কালে সাধুগণের পরিত্রাণ বা পালন, দুষ্কৃতগণের বিনাশ বা দমন এবং ধর্ম্ম-সংস্থাপনের জন্য ভগবান্ বা তাঁর পার্ষদ বা তাঁর ভক্তগণ জগতে আবির্ভূত হইয়া থাকেন । ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর কিছু পরে, ঠিক অনুরূপ অবস্থা জীব-জগৎকে অন্ধকারময় করিয়া তুলিয়াছিল ; সর্ব্ব-শাস্ত্র-তাৎপর্য্যসার সুবিমল বৈষ্ণবধর্ম্ম কাল-প্রভাবে ক্রমশঃ আত্মগোপন করিতে থাকিলেন এবং তৎস্থানে মায়াপিশাচীর নব-নব বিলাস-ধর্ম্ম, জীবগণকে মহাধ্বান্তপূর্ণ ভ্রান্তপথে পরিচালিত করিতে থাকিল ; ফলে ধর্ম্ম, চর্ম্মগত-বিচারময় হইয়া পড়িল ! অজ্ঞতাই সাধুতার আসন গ্রহণ করিল ; যোগাদি, ভোগাভিসন্ধিমূলক হইয়া পড়িল ; জ্ঞানানুশীলন, শূন্যগতিতে পর্য্যবসিত ; জপাদি যশোলোভের জন্য, তপস্যাদি পরহিংসার জন্য অনুষ্ঠিত হইতেছিল ; দানাদি দ্বারা প্রতিষ্ঠা সংগ্রহ এবং অনুরাগময় ভগবদ্ভজনের নামে ঘোরতর ব্যভিচার, বুদ্ধিমানগণেরও বুদ্ধিভেদ ঘটাইতেছিল । সাধুগণ—কালের প্রবল-প্রভাব দর্শন করিয়া, ও নিজেদের ভজন-জীবনের অত্যন্ত বিপদ-শঙ্কুল অবস্থা সমাগত দেখিয়া—ভীত হইয়া পড়িলেন এবং জীব-মঙ্গলের জন্য আকুল প্রাণে ভগবচ্চরণে যখন সকাতর প্রার্থনা জানাইতেছিলেন,—ঠিক সেই সময় ভুবনমঙ্গল অবতার নদীয়া-বিহারী শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দরের কৃপা-শক্তি-বিগ্রহ শ্রীল সচ্চিদানন্দ ভক্তিবিনোদ ঠাকুর নিজ প্রভুর মনোঽভীষ্ট পূর্ণ করতে নদীয়ার পূর্ব্বশৈল উদ্ভাসিত করিয়া বিমলানন্দ-জনকরূপে সাধুগণের হৃদয়ানন্দ বর্দ্ধন করিতে করিতে আবির্ভূত হইয়াছিলেন ।

ভগবান্ বা তাঁহার পার্ষদগণের জন্মাদি লীলা প্রাকৃতের ন্যায় দৃষ্ট হইলেও তাহা অপ্রাকৃত—একথা আপনারা বহুবার শুনিয়াছেন ; কর্ম্ম-ফলবাধ্য জীব স্বকৃত-কর্ম্মফল-ভোগের জন্য এই জগতে জন্ম-গ্রহণ করিতে বাধ্য, কিন্তু ভগবান্ বা তদীয়গণ, কৃপা পরবশ হইয়া অচিৎ জগৎ হইতে—এই বিপদ-শঙ্কুল সংসার হইতে জীবগণকে চিন্ময়ানন্দময় জগতে লইবার জন্য—ভগবৎ সেবানন্দরূপ স্বরূপ-সম্পদ দান করিবার জন্য স্বেচ্ছায় জন্মলীলা পরগ্রিহ করেন । একটি—পরতন্ত্রতা বশতঃ ; অপরটী—স্বতন্ত্র বা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত । আংশিক দৃষ্টান্তস্বরূপ,—কারাগারে কয়েদীগণ ও কয়েদীগণের মঙ্গলবিধানকারী শিক্ষকগণকে ধরা যাইতে পারে । এতদ্ব্যতীত তাঁরা যে কোন কুলেই জন্মগ্রহণ করুন্ না কেন—কুলের সঙ্গেও তাঁদের কোন সম্পর্ক থাকে না । হনুমান্—কপিকুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ; ভগবদ্বাহন গরুড়দেব—পক্ষীকুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তথাপি সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তাঁহাদের পূজাই করিয়া থাকে । এই জগতের শাস্ত্রীয় দৈব-বর্ণাশ্রম বিধিতেও দেখা যায় যে,—যে কোন কুলোৎপন্ন ব্যক্তিই তাহার গুণ-কর্ম্মাদি লক্ষণানুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র প্রভৃতি সংজ্ঞায়—সংজ্ঞিত হইবে । জন্মের পরিচয়ে তাহাদের বর্ণ-নিরূপণ হইবে না । সুতরাং ভগবৎপার্ষদ যাঁরা—যাঁরা নিত্যমুক্ত, কুল-পরিচয়ে তাঁহাদের পরিচয় কিরূপে সম্ভব হইবে ? এই জন্য জীব-শিক্ষক শ্রীল সনাতন গোস্বামী,—শ্রীদাস গোস্বামী প্রভুর বংশ পরিচয় বিষয়ে—“কায়স্থ-কুলাব্জ-ভাস্করঃ” এই পরিভাষা প্রয়োগ করিয়াছেন । পদ্মের সঙ্গে সূর্য্যের যতটুকু সম্পর্ক অর্থাৎ পদ্ম—জল জাত কোমল পুষ্প এবং সূর্য্য জগৎ-প্রকাশক, জ্বলন্ত অগ্নি-পিণ্ডস্বরূপ ; এই দুইএর কুলগত বা পদার্থ গত কোন সাম্য বা সাদৃশ্য নাই । তথাপি সূর্য্য স্বীয় কর-বিতরণের দ্বারা পদ্মকে প্রস্ফুটিত ও প্রফুল্লিত করিয়া যেটুকু সম্পর্ক অঙ্গীকার করেন, কুলের সঙ্গে বৈষ্ণবগণের সেইটুকু সম্পর্ক—এ দৃষ্টান্তও আংশিকভাবে গ্রহণ করা যাইতে পারে । বস্তুতঃ পক্ষে পার্ষদগণ বা বৈষ্ণবগণ যে কুলকে অঙ্গীকার করিয়া আবির্ভূত হন সেই কুলই পবিত্র হইয়া যায়—এবিষয়ে শাস্ত্রের এই শ্লোকটী প্রমাণরূপে আপনারা বিচার করিয়া দেখিবেন—“কুলং পবিত্রং জননী কৃতার্থা বসুন্ধরা সা বসতি শ্চ ধন্য ।” ‘মদ্ভক্তপূজাভ্যধিকা’ এই শ্রৌত ন্যায়ানুসারে বিচার করিলে আমরা আরও বুঝিতে পারি যে, ভক্তের আবির্ভার তিথির মাহাত্ম্য শ্রীভগবদাবির্ভাব তিথি-মাহাত্ম্য অপেক্ষাও অধিক মঙ্গলদায়ক । যেহেতু ভক্তের জীবনচরিতে অতি সুষ্ঠুভাবে শ্রীভগবৎ-তত্ত্বানুশীলন শিক্ষার যতটা সুযোগ হয় সাক্ষাৎ শ্রীভগবচ্চরিত্রে ততদূর হয় না । সেইজন্যই শ্রীভগবৎ-তত্ত্ব ভক্ত-তত্ত্বের আচ্ছাদনে শ্রীমন্মহাপ্রভুরূপে জগতে উদিত হইয়া ভক্তি-শিক্ষা প্রদান করিয়াছিলেন ।

এইরূপে ঠাকুর শ্রীল ভক্তিবিনোদের আবির্ভাব জগতের হাওয়া ক্রমশঃই পরিবর্ত্তিত হইতে থাকে এবং ঠাকুরের মহাপুরুষ-লক্ষণ সমূহ সজ্জনগণের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া তাঁহাদিগকে আনন্দ প্রদান করে । প্রাকৃত পরিচয়ে,—বালক স্বল্প বয়সে পিতৃহীন হইয়া মাতুলালয়ে বিদ্যাধ্যয়নাদি কার্য্যে কালাতিবাহিত করেন । তাঁহার অদ্ভুত প্রতিভা, মনোমুগ্ধকর চেষ্টা, অভূত পূর্ব্ব কবিত্ব-শক্তি এবং প্রগাঢ় ধর্ম্মানুরাগ দর্শন করিয়া আত্মীয় বর্গ বিস্মিত হইয়া যান এবং বালকের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল হইতে থাকেন । ধর্ম্মানুরাগ ঠাকুরের জীবনে এত প্রবলরূপ ধারণ করে যে, সেই অল্প বয়সেই সমস্ত ধর্ম্ম-শাস্ত্রে অগাধ পাণ্ডিত্য দর্শনে পণ্ডিতগণও মোহযুক্ত হইয়া পড়িতেন । সেই সময় হইতেই ঠাকুর মহাশয় বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন গ্রন্থাদি রচনা করিতে থাকেন । আত্মীয়গণও বালকের কৈশোর-সৌন্দর্য্য দর্শন করিয়া উদ্বাহক্রিয়া সম্পন্ন করাইয়া দেন ।

বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃত জীবের ন্যায় কর্ম্ম-লীলায় অবতীর্ণ হইয়া ঠাকুর মহাশয়, তৎকালে বঙ্গ-সন্তানগণের দুর্ল্লভ পদবী সমূহ গ্রহণ করিয়া ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে উড়িষ্যায় গমন করেন এবং সেখানে শ্রীজগন্নাথের মন্দিরের সন্নিকটে অবস্থান করিতে থাকেন । তৎকালে তাঁহার ধর্ম্মালোচনার বিশেষ সুবিধা হয় এবং শ্রীজগন্নাথদেবের মন্দিরে শ্রীভক্তিমণ্ডপ স্থাপন করিয়া শ্রীল সনাতন গোস্বামী প্রভুর অনুসরণে বহু ভক্তবৃন্দ, পণ্ডিত, ব্রাহ্মণগণের দ্বারা পরিশোভিত হইয়া জগৎ-জীবের ভব-বন্ধন-ছেদন করিতে করিতে শ্রীমদ্ভাগবতাদি শাস্ত্র-গ্রন্থ সমূহ বিচার করিতেন । কৃষ্ণ-বিমুখ—বহির্ম্মুখ জীবের দুঃখে এতবেশী কাতর হইতেন যে, সময় সময় আত্মভোলার ন্যায় উচ্চৈঃস্বরে—“হা গৌরাঙ্গ হা নিত্যানন্দ ! তোমরা এই জগৎ-জীবের প্রতি একবার চাও প্রভো !” বলিয়া অজস্র রোদন করিতেন । সেই ভক্তিবিনোদ প্রভুর আকুল আহ্বানেই গৌর মহাপ্রভুর করুণার মূর্ত্ত-বিগ্রহরূপে একদিন জগদ্বাসী শ্রীল সরস্বতী গোস্বামী প্রভুপাদের চরণ-ধূলি লাভ করিয়াছিল ।

অত্যল্পকালের মধ্যেই শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের নাম সর্ব্বত্র বিস্তৃত হইয়া পড়ে এবং তাঁহার ধর্ম্ম প্রচারাদি আচার্য্য-লীলায় বহু শিক্ষিত গণ্যমান্য সজ্জনগণও সেবকসূত্রে যোগদান করেন । শ্রীল ঠাকুরের প্রচারের পূর্ব্বে শ্রীমন্মহাপ্রভু প্রচারিত বিমল-বৈষ্ণব-ধর্ম্ম, কতকগুলি অপস্বার্থপর ব্যক্তিগণের দ্বারা এরূপভাবে কলুষিত, বিকৃত ও বিপর্ষ্যস্ত হইয়াছিল যে, লোকে বৈষ্ণব-ধর্ম্ম বলিতে—অত্যন্ত হেয়, ঘৃণ্য, নীচ-প্রকৃতি উপহাস করিত ; কিন্তু ভক্তিবিনোদের অভ্যুদয়ে ও চেষ্টায় বৈষ্ণব-ধর্ম্ম গ্লানিমুক্ত হইয়া পুনরায় স্বীয় বিমল-স্বরূপে আত্ম-প্রকাশ করিয়া সর্ব্ব-ধর্ম্মের শীর্ষস্থানে ‘জৈব-ধর্ম্ম’রূপে জগতের ধর্ম্মাকাশে নবোদিত প্রভাত-ভাস্করের ন্যায় শোভা পাইতে গাগিল ; সজ্জনগণ সকলেই জানিলেন যে, বৈষ্ণব ধর্ম্মই একমাত্র নির্ম্মল-উজ্জ্বল-নির্ম্মৎসর-ভক্তিবিনোদ কারী স্বরূপধর্ম্ম,—যার ভিতর নাই কোন কপটতা—আবিলতা—অবরতা এবং আরও জানিলেন—যদি সমস্ত ধর্ম্মও ব্যাষ্টি বা সমষ্টিগতভাবে সুষ্ঠুরূপে অনুষ্ঠিত হয় তবে নিশ্চিত সেগুলি বৈষ্ণব-ধর্ম্মের সোপানরূপে শোভা পাইতে থাকিবে ।

তথাকথিত চিজ্জড়-সমন্বয়বাদীর ভ্রান্ত-ধারণা নিরসন করিয়া, শ্রীমন্মহাপ্রভুর প্রচারিত ধর্ম্মই যে, সর্ব্ব-ধর্ম্মের একমাত্র মহান্ চিৎসমন্বয় প্রদান করিতে পারে, একথা ঠাকুর মহাশয় তাঁহার ভাষা-লেখনী ও সর্ব্ব-প্রকার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়া প্রমাণ করিয়াছেন । বস্তুতঃপক্ষে সপার্ষদ শ্রীচৈতন্যদেবের পরে জীব-জগৎকে তিনি যেভাবে হরিবিমুখতা হইতে রক্ষা করিয়াছেন তাহার দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত অতীব বিরল । শ্রীল ঠাকুর মহাশয়কে কোনদিনই কাহারও প্রতি মৎসরভাব পোষণ করিতে কেহই দেখে নাই, তবে নিরপেক্ষ-সত্যকথা কীর্ত্তনে বিন্দুমাত্র কুন্ঠাও তাঁহার ছিল না । ভক্তির নামে ছলধর্ম্ম, মিছাভক্তি বা অভক্তিপর বিচারের প্রশ্রয় কোনদিনই দেন নাই । তাঁহার লেখনী নির্ভীকভাবে তারস্বরে সত্যকথা ঘোষণা করিয়াছে । জাগতিক প্রতিষ্ঠাকে তিনি শূকরের বিষ্ঠার তুল্য মনে করিতেন । সেই সময় বঙ্গের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার গৌরাঙ্গ-বিষয়ক নাটকের উদ্বোধনের জন্য শ্রীল ঠাকুরকে বিশেষ অনুরোধ করেন, কিন্তু তিনি তাহা সোজাসুজি পাঁচ-মিশালী ব্যাপার বলিয়া প্রত্যাখ্যান করেন । উড়িষ্যার কোন এক মহাযোগী (?) যৎকালে প্রতিষ্ঠা-বিষ্ঠা পাহাড়ের চুড়া হইতে নিজেকে মহাবিষ্ণুর অবতার বলিয়া নরকের পথে স্ব-দলবলে অগ্রসর হইতেছিল এবং সনাতন-ধর্ম্মের পথে কণ্টকরাশি প্রদান করিতেছিল, তখন তিনিই তাঁহাকে কঠোরভাবে দমন করিয়াছিলেন । ভারতের বিশেষ বিশেষ মলিনতীর্থ সমূহকে যখন নির্ম্মল করিবার জন্য তিনি অভিযান করেন তখন কত অধম, কত পাপী তাপী তাঁহার সুশীতল চরণ স্পর্শ লাভে নিজেদিগকে কৃতার্থ মনে করিয়াছিল তাহার আর কত উদাহরণ দিব । তাঁহার ভারত ভ্রমণে বহু বিরূদ্ধধর্ম্মের অবসান হইয়াছিল । এইসবের দ্বারা তাঁহার মহিমার দিগ্­দর্শন করাও আমার পক্ষে সম্ভব নহে ;—শ্রীল সরস্বতী গোস্বামী প্রভুপাদ অতি সংক্ষেপে (বিস্তৃত ত আছেই) দুই একটী পয়ারের মাধ্যমে ঠাকুর মহাশয়ের যে নিগূঢ় পরিচয় প্রদান করিয়া গিয়াছেন, তাহাতেই বিদ্বন্মণ্ডলী তাঁহার সুষ্ঠু পরিচয় পাইয়া থাকেন । শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃতের “অনুভাষ্য” শেষে শ্রীল প্রভুপাদ লিখিয়াছেন—

"তাঁহার করুণা-কথা, মাধব-ভজন-প্রথা,
তুলনা নাহিক ত্রিভুবনে ।
তাঁর সম অন্য কেহ, ধরিয়া এ নর-দেহ,
নাহি দিল কৃষ্ণ-প্রেম-ধনে ॥
সেই প্রভু-শক্তি পাই, এবে অনুভাষ্য গাই,
ইহাতে আমার কিছু নাই ।
যাবৎ জীবন রবে, তাবৎ স্মরিব ভবে,
নিত্যকাল সেই পদ চাই ॥
শ্রীগৌর-কৃপায় দুই, মহিমা কি কব মুই,
অপ্রাকৃত-পারিষদ-কথা ।
প্রকট হইয়া সেবে, কৃষ্ণ-গৌরাভিন্ন-দেহে,
অপ্রকাশ্য কথা যথা তথা ॥"

এই পয়ার কয়টী শুনিলেই আমাদের মুখ বা কলম একেবারে বন্ধ হইয়া যায় ; মনে হয় করিতেছি কি ! শিব গড়িতে গিয়ে বাঁদর গড়িয়া ফেলিতেছি ! ঠাকুরের মহিমা গাহিবার মত শক্তি আমাদের কোথায় ?—কোথায় সেই অতিমর্ত্ত্য মহাপুরুষের অমল-চরিত, আর কোথায় আমি মহাপতিত নরাধম !—শুধু এইটুকু আশাবন্ধ যে, শ্রীল ভক্তিবিনোদ প্রভুর অনুসম্বন্ধও জীবের সর্ব্বোত্তম কল্যাণ প্রদানে সমর্থ । বস্তুতঃপক্ষে ঠাকুরের করুণা সহস্রমুখে সহস্রধারায় প্রবাহিত হইয়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পবিত্র করিয়াছে ।

এমন কোন পদার্থ, এমন কোন ভাব, এমন কোন বিষয়ই ছিল না, যাহাকে শ্রীল ঠাকুর কৃষ্ণ-সম্বন্ধে নিযুক্ত না করিয়াছেন । তাঁহার চেষ্টার প্রধান দুইটি ধারার মধ্যে যেন ভাগীরথী ধারায় (স্বয়ং আচার ও প্রচার) সমগ্র জগৎকে পূত করিয়া কৃষ্ণসেবার উপকরণ করিয়াছেন ; আর সরস্বতী ধারায় বেদব্যাসের ন্যায় বেদাদি শাস্ত্রসমূহ মন্থন করিয়া আরও সহজ এবং সরলভাবে সর্ব্বত্র মুক্ত হস্তে কৃষ্ণপ্রেম-নবনীত বিলাইয়া দিয়াছেন । জগতে শ্রীল ভক্তিবিনোদের এই অতুলনীয় দানের কোন উপমা নাই—কোন বিনিময় নাই । গ্রন্থ জগতেও ঠাকুরের অপূর্ব্ব মহিমা সর্ব্বত্র সর্ব্বকালে চিরস্মরণীয় হইয়া রহিয়াছে ও থাকিবে । তাঁহার রচিত “কি সূত্র-গ্রন্থ ; কি সংহিতা গ্রন্থ ; কি গীতি-গ্রন্থ ; কি ভাষা-গ্রন্থ ; কি লীলা-গ্রন্থ ; কি রস-বিজ্ঞানমূলক-গ্রন্থ ; কি সমালোচনা-গ্রন্থ ; কি টীকা-টিপ্পনী, কি ভাষ্য-রচনা ; কি তত্ত্ব-সিদ্ধান্তমূলক গ্রন্থ ; কি কাব্য-বিজ্ঞান-সাহিত্য-দর্শন” প্রভৃতির আলোচনার গ্রন্থসমূহ ; তাঁহার প্রকাশিত অপ্রকাশিত সর্ব্বপ্রকার গ্রন্থ-রত্নাবলীই আজ শ্রীচৈতন্য-সরস্বতীর সুস্নিগ্ধ সেবাময় আলোকে আরও অধিকরত উদ্ভাসিত হইয়া জগতের জীবকল্যাণ বিষয়ে মহাবদান্য অবতারীর অমন্দোদয়া-দয়ার আধারস্বরূপে তদভিন্নত্ব প্রতিপাদন করিতেছে । সময় অত্যন্ত সংক্ষেপ হইয়া আসিতেছে অতএব আর ২।১টী কথা বলিয়াই আমি বিদায় লইব ।

শ্রীগৌরাঙ্গের ধাম-সেবায় যিনি নিজের চেষ্টার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছেন—সেই ভক্তিবিনোদপ্রভুর ধাম-প্রকাশের কথা আপনারা সকলেই শুনিয়াছেন । বহু অপস্বার্থপর ব্যক্তি শ্রীমন্মহাপ্রভুর জন্মস্থান আবিষ্কার বিষয়ে তাঁহাকে বহুপ্রকারে বাধা দিয়াছিল—কিন্তু তিনি অচল-অটলভাবে শ্রীগৌরসুন্দরের মনোঽভীষ্ট যে শ্রীধামের প্রকাশ, তাহা এরূপ সুষ্ঠুভাবে করিয়া গিয়াছেন যে আজ সমস্ত অপস্বার্থপর ব্যক্তিগণের কলুষিত জিহ্বার কপাট বন্ধ হইয়া গিয়াছে । এখন আর মায়াপুরকে চাপা দিবার কোন উপায়ই তাহারা খুজিয়া পায় না । এখন সকলেই মুক্তকন্ঠে মায়াপুরের গুণগান করিয়া থাকে । এককথায় বলিতে গেলে শ্রীল ঠাকুর ভক্তিবিনোদ ছিলেন একাধারে—শ্রীস্বরূপ-সনাতন-রূপ-রঘুনাথ-রায়রামানন্দ—হরিদাস-শ্রীজীব-কৃষ্ণদাস- নরোত্তম-প্রভুগণের মিলিতস্বরূপ । কেন না গোস্বামিবর্গের সমস্ত চেষ্টার পরাকাষ্ঠা তাঁহাতে পূর্ণরূপে বিদ্যমান দেখা যায় । কি ধাম প্রকাশ কার্য্যে ; কি লুপ্ত-তীর্থ-উদ্ধার বিষয়ে ; কি অপ্রাকৃত গ্রন্থাদি-রচনায় ; কি ভক্তি-সিদ্ধান্তে ; কি বৈরাগ্যে ; কি দার্শনিক বিচারে ; কি হরিকথা কীর্ত্তনে ; কি হরিনাম সংকীর্ত্তনের দ্বারা জীবোদ্ধারলীলায়; সর্ব্ব বিষয়েই তাঁহার অপ্রাকৃত সামর্থ্যের মহিমা যে ভাগ্যবান্ ব্যক্তিই দেখিয়াছেন, তিনিই তাঁহার চরণে বিলুন্ঠিত হইয়াছেন ।

আজ্কের এই তিথিকে অবলম্বন করিয়াই তিনি প্রকটিত হইয়াছিলেন । অতএব এই তিথিও পরম পূজনীয়া, বরণীয়া এবং করুণাময়ী । আমার এমন কোন উপায়নই নাই যাহার দ্বারা আমি এই তিথিবরার পূজা করি । আপনারা মহান্—পরম বৈষ্ণব ; আপনারা কৃপা পূর্ব্বক এই তিথিবরার পূজা করিবার যোগ্যতা আমাকে প্রদান করুন ;আর আপনাদের কৃপায় শ্রীল ভক্তিবিনোদ প্রভুর কৃপা প্রার্থনার মহান্ আর্ত্তি জাগরিত হইয়া আমার অস্তর্বহিঃ শ্রীগৌর-বিহিত কীর্ত্তনের দ্বারা গৌরব মণ্ডিত হউক এবং নিত্যকাল শ্রীবিনোদ-সারস্বতগণের সেবায় নিযুক্ত করুক—এই প্রার্থনা ।

বাঞ্ছাকল্পতরুভ্যশ্চ কৃপাসিন্ধুভ্য এব চ ।
পতিতানাং পাবনেভ্যো বৈষ্ণবেভ্যো নমো নমঃ ॥

 


 

← Main page-এ ফিরে
← গ্রন্থাগারে ফিরে

 


শ্রীনবদ্বীপধাম
মাহাত্ম্য-মুক্তা-মালা


অনন্তশ্রীবিভূষিত ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংসকুলচূড়ামণি বিশ্ববরেণ্য জগদ্­গুরু শ্রীশ্রীমদ্ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের পদ্মমুখের হরিকথামৃত


এইগ্রন্থশিরোমণি শ্রীগুরুপাদপদ্ম ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের ইচ্ছা পূর্ণ করবার জন্য এবং তাঁর শ্রীচরণের তৃপ্তির জন্য তাঁর অহৈতুক কৃপায় শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠ হইতে প্রকাশিত হয় শ্রীমন্ মহাপ্রভুর শুভার্বিভাব তিথিতে শ্রীগৌরাব্দ ৫৩৪, বঙ্গাব্দ ১৪২৬, খৃষ্টাব্দ মার্চ্চ ২০২০ ।


সূচীপত্র:

শ্রীগৌরধাম ও শ্রীভক্তিবিনোদ

শ্রীনবদ্বীপধাম মাহাত্ম্য
(১) শ্রীশ্রীনবদ্বীপধামের সাধারণ মাহাত্ম্য কথন
(২) শ্রীশ্রীগৌড়মণ্ডল ও শ্রীশ্রীনবদ্বীপধামের বাহ্যস্বরূপ ও পরিমাণ
(৩) শ্রীশ্রীনবদ্বীপধাম পরিক্রমার সাধারণ বিধি
(৪) শ্রীজীবের আগমন ও শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু তাঁহাকে শ্রীনবদ্বীপতত্ত্ব বলেন
(৫) শ্রীমায়াপুর ও শ্রীঅন্তর্দ্বীপের কথা
(৬) শ্রীগঙ্গানগর, শ্রীপৃথুকুণ্ড, শ্রীসীমন্তদ্বীপ, শ্রীবিশ্রামস্থানাদি দর্শন
(৭) শ্রীসুবর্ণবিহার ও শ্রীদেবপল্লী বর্ণন
(৮) শ্রীহরিহরক্ষেত্র, শ্রীমহাবারাণসী ও শ্রীশ্রীগোদ্রুমদ্বীপ বর্ণন
(৯) শ্রীমধ্যদ্বীপ ও নৈমিষ বর্ণন
(১০) শ্রীব্রাহ্মণপুষ্কর, শ্রীউচ্চহট্টাদি দর্শন ও পরিক্রমা-ক্রম বর্ণন
(১১) শ্রীশ্রীকোলদ্বীপ, শ্রীসমুদ্রগড়, শ্রীচম্পাহট্ট ও শ্রীজয়দেব-কথা বর্ণনা
(১২) শ্রীশ্রীঋতুদ্বীপ ও শ্রীরাধাকুণ্ড বর্ণন
(১৩) শ্রীবিদ্যানগর ও শ্রীজহ্ণুদ্বীপ বর্ণন

শ্রীনবদ্বীপধাম মাহাত্ম্য-মুক্তা-মালা
শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের ভজনকুটির (স্বানন্দ-সুখদা-কুঞ্জ)
শ্রীনৃসিংহপল্লী
শ্রীকোলদ্বীপ


বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥