| |||||||
|
|||||||
শ্রীনবদ্বীপধাম মাহাত্ম্য-মুক্তা-মালা শ্রীকোলদ্বীপ
শ্রীবরাহদেবের দর্শন ও গুপ্ত-গোবর্দ্ধন এই দ্বীপ কুলিয়া পাহাড় নামে প্রসিদ্ধ হয় কারণ এই দ্বীপ উচ্চ জায়গায় পর্ব্বতের মত গঙ্গা তীরে উপস্থিত হয় । শাস্ত্রে এই কুলিয়া নগর কোলদ্বীপ নামে বর্ণিত হয় । সত্যযুগে এখানে একজন ছেলে ছিল, তাঁর নাম বাসুদেব । তিনি প্রতি দিন বরাহদেবের পূজা করতেন । বরাহদেবের পূজা করতে করতে তিনি সব সময় প্রার্থনা করতেন, “হে প্রভু, কৃপা করি তোমার দর্শন আমাকে দাও—আমার জীবন সফল কর ! তোমাকে না দেখলে আমার জীবন বৃথা কেটে যাবে !” এক দিন স্বয়ং ভগবান্ বরাহদেব অপূর্ব মনোহর কোল (বা শূকর) রূপ ধারণ করে দয়া করে বাসুদেবের সামনে হাজির হয়েছিলেন । নানারত্ন বিভূষিত বরাহদেব পাহাড়ের মত লম্বা ছিলেন । বাসুদেব ভগবান দর্শন পেয়ে প্রেমাবেশে মাটিতে দণ্ডবৎ করে পড়লেন । তাঁর ভক্তি দেখে ভগবান্ সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “বাসুদেব, তুমি আমার ভক্ত, আমি তোমার পূজার দ্বারা খুবই সন্তুষ্ট । নবদ্বীপধাম-সম ধাম এই ত্রিভুবনে নেই । তুমি এত ভাগ্যবান্, তুমি এখানে বসবাস করছ । যেহেতু তুমি আমার পূজা এই নবদ্বীপে করছ, সেহেতু যখন আমি কলিযুগে গৌররূপে অবতীর্ণ হয়ে আসব তখন তুমিও জন্ম গ্রহণ করে আমার সঙ্কীর্ত্তন দর্শন পাবে ।” এটা বলে বরাহদেব অদৃশ্য হয়ে পড়লেন । এরপর বাসুদেব আনন্দিত হয়ে সঙ্কীর্ত্তন করতে শুরু করলেন । তিনি সব সময় গৌরনাম করতেন । বরাহদেবের দর্শন পেয়ে বাসুদেব এই স্থানে কোলদ্বীপ পর্ব্বত নাম দিয়েছিলেন । যখন শ্রীমন্নিত্যানন্দ প্রভু শ্রীল জীব গোস্বামী প্রভুকে এখানে নিয়েছিলেন, তখন তিনি বললেন যে, এই কোলদ্বীপ গিরি-গোবর্দ্ধন থেকে অভিন্ন । সেইজন্য এই স্থানের নাম হচ্ছে গুপ্তগোবর্দ্ধন । অতএব শ্রীনবদ্বীপধাম পরিক্রমা করলে গোবর্দ্ধন পরিক্রমার ফল পাওয়া যায় । এই শ্রীকোলদ্বীপের মধ্যে আরো অনেক উচ্চতম স্থানগুলা আছে—এখানে বহুলাবন, খদিরবন, দ্বারকা, মহাপ্রয়াগ, গঙ্গসাগর, কুলিয়া গ্রাম, সমুদ্রগড়, চম্পাহাট্টি, বিদ্যা-বাচস্পতির টোল নিত্য বিরাজ করেন । কুলিয়া গ্রাম : অপরাধ-ভঞ্জনের পাট কোলদ্বীপের আধুনিক নাম হচ্ছে ‘নবদ্বীপ টাউন’ । আগে ওর নাম ছিল কুলিয়া গ্রাম (গঞ্জ) । এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ লীলা ঘটিয়াছিল । যখন মহাপ্রভু নিমাই বিশ্বম্ভর সন্ন্যাস নিয়েছিলেন, তখন তিনি নবদ্বীপ থেকে পুরীধামে যাত্রা করলেন । কিছু দিন পর তিনি বৃন্দাবনে যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন আর বৃন্দাবনে যাওয়ার সময় তিনি আবার গৌড়দেশে এসেছিলেন । মহাপ্রভু আবার নবদ্বীপে এসেছিলেন খবর পেয়ে হাজার হাজার লোক তাঁর দর্শন পাওয়ার জন্য তাঁর কাছে আসতে শুরু করলেন । ভিড়ের শেষ নেই । যেমন যারা মহাপ্রভুর কাছে অপরাধ করেছিলেন—সমস্ত পাপীগণ, পাষণ্ডিগণ, ইত্যাদি—তারাও মহাপ্রভুর কাছে এসে তাঁর শ্রীচরণে পড়ে অপরাধ ক্ষমা প্রার্থনা করলেন । মহাপ্রভু সমস্ত লোকের অপরাধ ক্ষমা করে কৃষ্ণপ্রেম অবাধ বিস্তার করেছিলেন বলে এই কুলিয়া গ্রাম অপরাধ-ভঞ্জনের পাটের নামে প্রসিদ্ধ হয়েছিল । চপালগোপালও এখানে উদ্ধার পেয়েছিলেন । তাঁর কথা আমরা আগে শ্রীমায়াপুরে বলেছিলাম । এই কুলিয়া গ্রামে একটা বিখ্যাত ভাগবত-টোলবাড়ী ছিল । সেখানে দেবানন্দ নামে একজন পণ্ডিত ছিলেন—তাঁর দৈনন্দিন পঠ শ্রবণ করবার জন্য অনেক লোক উপস্থিত হত । এক দিন এই দেবানন্দ পণ্ডিত মহাপ্রভুর কাছে কৃষ্ণপ্রেম ভিক্ষা করেছিলেন, কিন্তু মহাপ্রভু তাঁকে বললেন, “তুমি বৈষ্ণব অপরাধ করেছ, তাই তুমি কৃষ্ণপ্রেম পেতে পার না ।” মহাপ্রভুর কথা শুনে দেবানন্দ পণ্ডিত অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কখন ও কার কাছে আমি অপরাধ করেছি ? আমার মনে হয় না !” তখন মহাপ্রভু তাঁকে শ্রীবাস পণ্ডিতের কথা স্মরণ করালেন । এক দিন শ্রীবাস পণ্ডিত দেবানন্দ পণ্ডিতের পাঠে এসেছিলেন শ্রীমদ্ভাগবতম্ শোনাবার জন্য । পাঠ শুনতে শুনতে শ্রীবাস পণ্ডিত হঠাৎ করে কৃষ্ণপ্রেমে অভিভূত হয়েছিলেন । “অহো ! ভগবাত্ অক্ষরে অক্ষরে প্রেমময় !”—সেটা ভাবতে ভাবতে তিনি উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে লাগলেন । দেবানন্দ পণ্ডিতের শিষ্যের মধ্যে কয়েকজন শিষ্য বিশেষ বিরক্ত হয়ে শ্রীবাস পণ্ডিতকে বললেন, “বন্ধ কর ! তুমি পাঠ নষ্ট করছ !” আর কেউ বললেন, “যাও এখান থেকে !” অবশেষে তাঁরা শ্রীবাস পণ্ডিতকে হাত ধরে নিয়ে তাড়িয়ে দিলেন । দেবানন্দ পণ্ডিত এটা দেখলেন কিন্তু কিছু বলেন নি—সেটা ছিল তাঁর অপরাধ । (আমাদের সব সময় সাবধান থাকতে হবে—কখন আমরা অপরাধ করছি সেটা আমরা বুঝতে পারি না ।) অধিকন্তু—এক দিন মহাপ্রভুর দেবানন্দ পণ্ডিতের কথা মনে পড়ল এবং তিনি এত বেশী বিরক্ত হয়েছিলেন যে তিনি বললেন, “আমি ওর ভাগবতম্ ছিঁড়িয়া ফেলব ! যা তিনি ব্যাখ্যা করছে, সেটা সব মায়া ! সব ভুলসিদ্ধান্ত !” শ্রীবাস পণ্ডিত ও ভক্তগণ মহাপ্রভুকে থামিয়ে দিলেন । সেইজন্য, ভাগবতম্ পড়তে এত সহজ নয় । এক সময় স্বরূপ দামোদর গোস্বামী প্রভু একজনকে বললেন, “ভাগবত পড় বৈষ্ণবের স্থানে, একান্ত আশ্রয় কর চৈতন্য-চরণে !” ভাগবতম্ পড়তে চাইলে বৈষ্ণবের শ্রীচরণে আশ্রয় নিতে হবে এবং তাঁদের শ্রীমুখে শ্রবণ করতে হবে—তা না হলে স্বাধীন ভাবে ভাগবতম্ পড়া খবরের কাগজ পড়ার মত হতে পারে । অবশেষে মহাপ্রভু দেবানন্দ পণ্ডিতকে বললেন, “যদি তুমি শ্রীবাস পণ্ডিতের কাছে অপরাধ ক্ষমা প্রার্থনা কর, তাহলে তুমি কৃষ্ণপ্রেম লাভ করবে ।” দেবানন্দ অত্যন্ত লাজ্জুক হয়ে পড়ে শ্রীবাস পণ্ডিতের কাছে অপরাধ ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন । এই সব ঘটনা এই কুলিয়ায় হয়েছিল । শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠ শ্রীকোলদ্বীপে এসে আমাদের আর একটা প্রগাঢ় কথা বলা উচিত । এই গুপ্তগোবর্দ্ধনের মধ্যে আমাদের শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠ বিরাজ করে । আমাদের পরমগুরুদেব পূজ্যপাদ ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ এখানে ১৯৪১ সালে এসেছিলেন । প্রথম তিনি একটি ছোট কুটিরে গঙ্গা তীরে বাস করতেন—তাঁর ছোট ভাই মনিবাবু মাসে দশটাকা তাঁকে দিতেন এবং শ্রীল শ্রীধর মহারাজ ওই টাকার নিয়ে একাই এখানে জীবনযাপন করতেন । তিনি ভিক্ষা করতে যেতেন না এবং বিশেষ ভাবে প্রচারও করতেন না । কিছু দিন পর শ্রীপদ সখীচরণ প্রভু তাঁকে প্রস্তাব করলেন, “যদি আপনি একটি জমি নির্বাচন করবেন, আমি ওই জমিটাকে কেনবার জন্য টাকা দেব ।” অপরাধ-ভঞ্জনের পাট এবং গুপ্ত গোবর্দ্ধনের মহিমা স্মরণ করে শ্রীল শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ তখন এই শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠের জমি কোলেরগঞ্জে নির্বাচন করেছিলেন আর ১৯৪১ সালে শ্রীজগন্নাথদেবের রথ-যাত্রা দিনে সেখানে প্রবেশ করে বসবাস করতে লাগলেন । তিনি মঠের নাম রেখে দিয়েছিলেন ‘শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠ’ । যদিও আমরা ব্রহ্ম-মাধ্ব-গৌড়ীয় সম্প্রদায়, আসালে রাগানুগ-ভক্তির সিদ্ধান্ত শ্রীল মাধবেন্দ্র পুরীপাদের দ্বারা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল । শ্রীল মাধবেন্দ্র পুরীপাদে এই সিদ্ধান্ত বীজরূপে উপস্থিত হয় এবং আমরা দেখতে পাই যে, এই বীজটা সম্পূর্ণভাবে বৃক্ষরূপে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রভাবে স্ফুরিত হয় । সুতরাং আমাদের সম্প্রদায়ের এই মূলস্বরূপ মনে রেখে শ্রীল শ্রীধর মহারাজ তাঁর মঠের নামে রাখলেন ‘শ্রীচৈতন্য’ শব্দ । আর শ্রীল শ্রীধর মহারাজের গুরুদেবের নাম হচ্ছে ওঁ বিষ্ণুপাদ ভগবান্ শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর প্রভুপাদ—সেইজন্য সমস্ত সম্প্রদায়ের স্বরূপ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অন্তর্গত করবার জন্য শ্রীল শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ তাঁর মঠ ও মিশনের নাম রেখেছিলেন ‘শ্রীচৈতন্যসারস্বত মঠ’ । প্রথম শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠের জমি ১ একর (প্রায় ৩ বিঘা) ছিল—ওই সময় এখানে অনেক গাছ, বাগান, দারুণ অট্টালিকা কিছু ছিল না । এখানে শুধু তিন আমগাছ, দুটো পেয়ারা গাছ এবং কিছু বাঁশ বাগান ছিল । কিন্তু শ্রীল শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ এই জমি কিনে নিয়ে প্রথম দিনে সর্ব্বাগ্রে একটি লম্বা ও দামি বাঁশের খুঁটি নিজ হাতে বাঁশ বাগানে গিয়ে নির্বাচন করে নিয়েছিলেন—যেখানে এখন মূল মন্দির বিরাজ করে, সেখানে তিনি একটা পতাকা উত্তোলন করে খুঁটিটা মটিতে পুঁতে দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন :
শ্রীমচ্চৈতন্য-সারস্বত-মঠবর-উদ্গীতকীর্ত্তির্জয়শ্রীং “যে পরম রমণীয় দিব্য-আশ্রমে শ্রীগৌর-সরস্বতীর মতানুরক্ত অনুকূল কৃষ্ণানুশীলন-তৎপর নিষ্কিঞ্চন ভক্তগণ নিত্যকাল সপার্ষদ শ্রীশ্রীগুরু-গৌরাঙ্গ-গান্ধর্ব্বা-গোবিন্দসুন্দরগণের প্রেমসেবন তৎপরতায় আশাবন্ধ-হৃদয়ে অফুরন্ত মাধুর্য্যোজ্জ্বল প্রেম-সম্পদের ভাণ্ডারী শ্রীশ্রীরূপ-রঘুনাথের পরমানুগত্যে নিরন্তর মহাবদান্য অবতারী ভগবান শ্রীশ্রীগৌরাঙ্গসুন্দরের নামগুণানুকীর্ত্তন করিয়া থাকেন, দিব্যচিন্তামণিধাম শ্রীবৃন্দাবনাভিন্ন শ্রীনবদ্বীপধামে পতিতপাবনী ভগবতী ভাগীরথীর মনোরম তটনিকটবর্তী গিরিরাজ শ্রীগোবর্দ্ধনাভিন্ন কোলদ্বীপে দেদীপ্যমান এই মঠরাজবর্য্য শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠ, তাঁহার ক্রমবিবর্দ্ধমান্ উদ্গীত কীর্ত্তির উড্ডীয়মান বিজয়-বৈজয়ন্তীর সুশীতল স্নিগ্ধছায়ায় নিখিলচরাচর বিস্মাপিত করিরা জয়শ্রী ধারণ পূর্ব্বক নিত্য বিরাজমান্ রহিয়াছেন ।” সঙ্গে সঙ্গে কয়েক জন ভক্তগণ শ্রীল শ্রীধর মহারাজের সঙ্গে থাকতে শুরু করলেন । অনেক গুরুভ্রাতাও শ্রীল শ্রীধর মহারাজকে খুঁজে পেয়ে তাঁর সঙ্গে থাকতেন । সেইরকম ছিল শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠের আরম্ভ । যখন শ্রীল শ্রীধর মহারাজ প্রথম এখানে এসেছিলেন, তখন তিনি গিরিধারী ঠাকুরকে এখানে বৃন্দাবন থেকে নিয়েছিলেন । ১৯৪৪-১৯৪৫ সালে মহাপ্রভুর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন আর যখন আমাদের গুরুদেব ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ মঠে যোগদান করেছিলেন, তখন প্রায় চার বছর পর শ্রীশ্রীগান্ধর্ব্বা-গোবিন্দসুন্দরজিউ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন । পরে কাছাকাছি ১৯৪৫ সালে মূলমন্দির নির্মাণ আরম্ভ হল—নির্মাণটা সম্পূর্ণ করার জন্য প্রায় ২০ বছর লাগল (১৯৭৩ সালের পর্যন্ত) । ১৯৭৫ নাটমন্দিরের নির্মাণ আরম্ভ হল । সেটা হচ্ছে মঠের সংক্ষেপ ইতিহাস । এক দিন শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠের গুণমহিমা-শ্লোক শুনে (‘শ্রীমচ্চৈতন্য-সারস্বত-মঠবর...’) সখিচরণ প্রভু শ্রীল শ্রীধর মহারাজকে বললেন, “আপনার একটি খড়ের ঘর ছাড়া কিছু নেই—আপনার বালিশ একটা ইট, আপনার বিছানা খড়—কিন্তু আপনি এত লম্বা বাঁশের খুঁটি পুঁতে দিয়ে এত বড় শ্লোক রচনা করেছেন !” শ্রীল শ্রীধর মহারাজ উত্তরে বললেন, “আপনি ভবিষ্যতে দেখতে পাবেন এখানে কী হবে ।” শ্রীমঠের নগরের মত অপূর্ব্ব রূপ আজকে দেখে সেটার আমরা এখন সহজভাবে অনুমান করতে পারি । সেটা শুধু দারুন অট্টালিকা নয় ! যখন মন্দিরের প্রথম তলা সম্পূর্ণ হয়েছিল, তখন শালগ্রাম-শিলা-রূপে কোলদ্বীপ-অধিপতি (লক্ষ্মী-বরাহদেব) নিজের ইচ্ছামত আশ্চর্যভাবে এখানে এসেছিলেন । ওই শালগ্রাম-শিলা এক রাজার বাড়িতে বাস করতেন কিন্তু কিছু দিন পর ওখানে অনেক সমস্যা-ঝামেলা শুরু হল বলে রাজা শালগ্রাম-শিলাটি একজন বড় পণ্ডিতকে দিয়েছিলেন । কিছু দিন পর ওই পণ্ডিতের বাড়িতে অনেক ঝামেলা শুরু হয়েছিল । এক দিন ওই পণ্ডিতের সাথে শ্রীল শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজের সাক্ষাৎ হল এবং তিনি শ্রীল শ্রীধর মহারাজকে বললেন, “এই শালগ্রাম-শিলা সর্ব্বত্রই অশান্তি সৃষ্টি করছে, আপনি কৃপা কর ওঁকে নিয়ে যান ।” শ্রীল শ্রীধর মহারাজ রাজি হলেন এবং পণ্ডিতকে এ শিলা শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠে পাঠিয়ে দিতে বললেন । প্রথম ওই পণ্ডিত শালগ্রাম-শিলা শ্রীল যাযাবর মহারাজের মঠে (মেদিনীপুরে) পাঠিয়ে দিলেন কিন্তু দুসপ্তাহের মধ্যে শিলাটি আবার অনেক অশান্তি করেছিলেন—কেউ তাঁর মঠে থাকতে পারছিলেন না ! তখন শ্রীল যাযাবর মহারাজ শ্রীল শ্রীধর মহারাজকে চিঠি লিখে বললেন, “কৃপা করে আপনার শিলা নিয়ে যান !” মেদিনীপুর নবদ্বীপ থেকে কিছু দূর বলে শ্রীল শ্রীধর মহারাজ শ্রীল যাযাবর মহারাজকে বললেন শিলাকে শ্রীল গোস্বামী মহারাজের মঠে (কলকাতায়) পাঠিয়ে দিতে—উনি সেখান থেকে পরে শিলাকে নবদ্বীপে পাঠিয়ে দেবেন । শ্রীল যাযাবর মহারাজ শিলাকে শ্রীল গোস্বামী মহারাজের মঠে পাঠিয়ে দিলেন আর শ্রীল গোস্বামী মহারাজ ভাবলেন, “আমি একটি শালগ্রাম-শিলা পেয়েছি ! আমি শিলাকে মঠেই রাখব ।” তিনি জানলেন যে, শ্রীল শ্রীধর মহারাজ আপত্তি করবেন না, তাই তিনি শিলাকে তাঁর মঠে রাখলেন । কিন্তু আবার ১৫ দিনের মধ্যে অনেক কিছু ঘটেছিল এবং শ্রীল গোস্বামী মহারাজ তখন ভাবলেন, “এই শিলা আমার মঠে অমঙ্গল করছে !” তখন তিনি শ্রীল শ্রীধর মহারাজের কাছে চিঠি লিখলেন, বললেন, “মহারাজ, আপনার শিলা আমার মঠে থেকে, যত দ্রুত সম্ভব নিয়ে যান ।” শ্রীল শ্রীধর মহারাজ শ্রীল গোবিন্দ মহারাজকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন ওই শালগ্রাম-শিলাকে নিয়ে আসার জন্য । শেষ পর্যন্ত শালগ্রাম-শিলাকে পেয়ে শ্রীল শ্রীধর মহারাজ শ্রীল গোবিন্দ মহারাজকে বললেন, “কী ব্যাপার ? এই শিলা সর্ব্বত্র এত অশান্তি সৃষ্টি করছেন কেন ? তুমি খুঁজে বার কর শালগ্রাম-শিলার নাম কী ।” তখন হরিভক্তিবিলাস ও গরুড়-পুরণে শ্রীল গোবিন্দ মহারাজ অনেক শালগ্রামশিলার লক্ষণের বর্ণনায় দেখলেন, ওই শালগ্রাম-শিলার লক্ষণ হচ্ছে লক্ষ্মীবরাহদেবের লক্ষণ । শ্রীল শ্রীধর মহারাজও বললেন, “আমিও ভাবি যে, এটা লক্ষ্মীবরাহদেব—তিনি তাঁর নিজের কোলদ্বীপে আসতে চান । তিনি হচ্ছেন কোলদ্বীপ-অধিপতি । কিন্তু নিশ্চিত করবার জন্য তুমি ওই পণ্ডিতের কাছে চিঠি লিখে জিজ্ঞাসা কর ।” তখন ওই পণ্ডিত বললেন যে, হ্যাঁ এটা আসলে লক্ষ্মীবরাহদেব । তখন শ্রীল শ্রীধর মহারাজ বললেন, “তাই ত ! সেই জন্য তিনি কোথাও থাকতে চান না । এখানে তাঁর নিজের স্থান, তারজন্য তিনি এখানে আসতে চেয়েছিলেন ।” লক্ষ্মীবরাহদেবের আরাধনা খুবই কঠিন । শ্রীল শ্রীধর মহারাজ বললেন যে, লক্ষ্মীবরাহদেবকে বিশেষ ভাবে প্রতি দিন ভালো পরমান্ন ভোগ লাগানো হতে হবে । ওই সময় থেকে শ্রীলক্ষ্মীবরাহদেব সুষ্ঠুভাবে মঠে বসবাস করেন এবং মঠে সমস্ত কিছু শীঘ্র ভাবে উন্নত হয় । তার মধ্যে বিশেষ ভাবে ও সুন্দর ভাবে পরে শ্রীগোবিন্দ কুণ্ডও প্রকাশিত হয়েছিল । সেটা হচ্ছে শ্রীকোলদ্বীপধাম এবং সেটা হচ্ছে আমাদের মূলমঠের মাহাত্ম্য ও ইতিহাস । সেটা হচ্ছে খুবই মঙ্গলময় স্থান । “কুলিয়া গ্রামেতে আসি’ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য । হেন নাহি যা’রে প্রভু না করিলা ধন্য ॥” এখানে অপরাধ করলে কোন রেহাই নাই কিন্তু বাহির থেকে অপরাধ করে আসলে ক্ষমা চাইলে এখানে অপরাধ খণ্ডন হয়ে যায় ।
|
অনন্তশ্রীবিভূষিত ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংসকুলচূড়ামণি বিশ্ববরেণ্য জগদ্গুরু শ্রীশ্রীমদ্ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের পদ্মমুখের হরিকথামৃত এইগ্রন্থশিরোমণি শ্রীগুরুপাদপদ্ম ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের ইচ্ছা পূর্ণ করবার জন্য এবং তাঁর শ্রীচরণের তৃপ্তির জন্য তাঁর অহৈতুক কৃপায় শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠ হইতে প্রকাশিত হয় শ্রীমন্ মহাপ্রভুর শুভার্বিভাব তিথিতে শ্রীগৌরাব্দ ৫৩৪, বঙ্গাব্দ ১৪২৬, খৃষ্টাব্দ মার্চ্চ ২০২০ । সূচীপত্র:
শ্রীনবদ্বীপধাম মাহাত্ম্য
শ্রীনবদ্বীপধাম মাহাত্ম্য-মুক্তা-মালা |
||||||
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥ | |||||||
© Sri Chaitanya Saraswat Math, Nabadwip, West Bengal, India. For any enquiries please visit our contact page. |