শ্রীভক্তিরক্ষক হরিকথামৃত
৪ । পরমার্থ লাভের পন্থা
প্রাপঞ্চিকতয়া বুদ্ধ্যা হরিসম্বন্ধিবস্তুনঃ ।
মুমুক্ষুভিঃ পরিত্যাগো বৈরাগ্যং ফল্গু কথ্যতে ॥
(শ্রীভক্তিরসামৃতসিন্ধুঃ)
অর্থাৎ—
‘শ্রীহরি-সেবায় যাহা অনুকুল
বিষয় বলিয়া ত্যাগে হয় ভুল ॥
আর—
অনাসক্তস্য বিষয়ান্ যথার্হমূপযুঞ্জতঃ ।
নির্ব্বন্ধঃ কৃষ্ণসম্বন্ধে যুক্তং বৈরাগ্যমুচ্যতে ॥
(শ্রীভক্তিরসামৃতসিন্ধুঃ)
অর্থাৎ—
‘আসক্তি রহিত | সম্বন্ধ সহিত |
বিষয়সমূহ সকলি মাধব ॥ |
একটা negative (ন্যস্ত্যর্থক) আর একটা positive (অস্ত্যর্থক) । পূর্ব্বে ত্যাগী জীবনেরই প্রাধান্য ছিল । পরবর্ত্তীকালে বেদ, উপনিযদ, পুরাণ প্রভৃতি মন্থন করে এবং তার অর্থ অনুধাবন করে ব্যাসদেব যে বিচার দিয়ে গেলেন তাতে বললেন যে, সমস্ত বিষয় বিষ নয়, ত্যাজ্য নয়, তাকে আমাদের যথাযথ অনুধাবন করে সেই প্রকার ব্যবহার করতে হবে ।
ভোগ, ত্যাগ ও সেবা এই তিন রকমের বিচার আমরা দেখতে পাই । ভোগের মধ্যে কুভোগ সুভোগ আছে, ত্যাগের মধ্যেও রকমারী আছে । ভোগকে ত্যাগ করেই সাধু হওয়া যায় এইটিই কোন কোন সস্প্রদায়ের ধারণা । কিন্তু বৈষ্ণব আচার্য্যগণ তা বলেননি, তাঁরা তৃতীয় জীবনের কথা বলেছেন যাতে ভোগ এবং ত্যাগ এ দুটিই অপরাধ জনক । ভোগ করা অপরাধ অর্থাৎ অন্যকে নিজের কাজে লাগানো, এর পরিণাম ভাল নয় এটা অনেকেই সহজেই বুঝতে পারেন । কিন্তু ভোগকে ত্যাগই সমাপ্তি নয়, কারণ ত্যাগ ভোগেরই মত অনেক সময় তার চেয়ে ক্ষতিকারক আমাদের ভোগেরও অধিকার নেই ত্যাগেরও অধিকার নেই, দুটিই অপরাধজনক ব্যাপার । কেবল ভগবৎ-সেবা সম্বন্ধে সবকিছুর সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং সেইরকম অনুশীলন করা এটিই আমাদের সর্ব্বোত্তম জীবন ।
এমনি দৃষ্টান্তের সাহায্যে বুঝতে পারি যে, দেশের স্বার্থই বর্ত্তমানে সব চাইতে বড় ; অন্ততঃ সাধারণে এটাই বলেন ও বুঝেন । কিন্তু দেশের স্বার্থে যারা নিজেরা কালোবাজারী করেন, সেটাও যেমন খারাপ তেমনি ধর্ম্মঘট প্রভৃতি করে দেশের production (উৎপাদন) বন্ধ করা এটাও দেশের পক্ষে খারাপ । দেশের স্বার্থে সকলে তার যথাযথ শক্তি নিয়োগ করলে পরেই সেটির দ্বারাই দেশের সর্ব্বোত্তম মঙ্গল সাধন করা হবে । এই দেশকে আমরা ধরছি, দেশ হচ্ছে স্বর্থের একটু বৃহত্তর পরিচয় । ‘দেশের সঙ্গে দেশের সংঘাত'—এই সবকিছুকে ছাড়িয়ে একেবারে সস্পূর্ণভাবে পরিপূর্ণ বস্তু ঈশ্বরের সেবার জন্য নূতন জীবন লাভ করতে হবে, এটাই হচ্ছে সেবা অর্থাৎ শুদ্ধ সেবা । সেই সেবাময় জীবনই কল্যাণপ্রদ । এই সেবা কষ্টকর নয়, শুধু কর্ত্তব্যবোধে সেবা করতে হয় যাতে আনন্দ নেই তা নয় । এই সেবা চরমে এমন অবস্থা লাভ করতে পারে যে এর তুল্য আর কোন সুখ নেই যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় ।
সুখের অন্বেষণ আমরা সকলেই করছি, “দুঃখ হত্যৈ সুখায় চ”—দুঃখকে নাশ করে সুখ প্রাপ্তির চেষ্টা সর্ব্বত্রই দেখা যায় । পশু, পক্ষী, কীট, পতঙ্গ, বৃক্ষ, প্রস্তর, স্থাবর, জঙ্গম সর্ব্বত্রই অনুসন্ধান করলে দেখা যায় সুখের জন্য এবং দুঃখ বর্জনের জন্য একটা struggle (যুদ্ধ বা দ্বন্দ্ব) চলছে । এই struggle (যুদ্ধ বা দ্বন্দ্ব) মোটামুটি দুভাগে ভাগ করা যায় । একটা উপর থেকে আসছে সেই অনুসারে চলা, মুক্ত ভূমিকা হতে আসে সুতরাং তাকেই অনুসরণ করে চলা । আর একটা হচ্ছে এখানকার পারিপার্শ্বিকতা, অবস্থা ও নিজেদের বুদ্ধি থেকে উদ্ভুত একটা পন্থা । একটা deductive (বিয়োগ) আর একটা inductive (যোগ); একটা descending (অবরোহ) আর একটা ascending (আরোহ) । আমাদের সীমিত বুদ্ধির জগৎ ছাড়াও আর এক অতীত প্রদেশ আছে এবং সেখানে সবই ভাল এরূপ শ্রদ্ধার সাহায্যে এবং বিশ্বাসের সাহায্যে সেই উপর থেকে নেমে আসা জ্ঞান আমাদের মঙ্গলের নিমিত্তই এবং এর মাহাত্ম্য সর্ব্বাপেক্ষা অধিক এইটি একটি দলে বুঝতে পারেন । এই দল শ্রৌতপন্থায় নিজেদের মঙ্গল অন্বেষণ করেন । আর এই জড় জগৎ থেকে উদ্ভুত মনীষার সাহায্যে যারা মঙ্গল অন্বেষণ করেন সে আর একদল ।
আরোহ পন্থী ও অবরোহ পন্থী এই দুটি দল দেখতে পাওয়া যায় । তার মধ্যে যারা আরোহ পন্থী অর্থাৎ inductive method (যোগ প্রণালী)-এ এখান থেকে কল্যাণ লাভের চেষ্টা করে থাকেন তাদের বুদ্ধি বিচার যে খুব সীমাবদ্ধ তা অতি সহজেই বোঝা যায় । আর উপর থেকে অর্থাৎ যা নিত্য ভূমিকায় আছে এবং তা সেখান থেকে আমাদের কল্যাণের নিমিত্ত, সাহায্যের জন্য নামিয়ে দেওয়া হয় সেইটিই প্রকৃতপক্ষে আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির পক্ষে সহায়ক । এইটি যারা বুঝতে পারেন তারা অবরোহ পন্থী । কিছু কিছু লোক বহু অভিজ্ঞতার ফলে এখানকার অসারতা অযোগ্যতা হৃদয়ঙ্গম করেন এবং শ্রদ্ধা সুকৃতির সাহায্যে, বিশ্বাসের সাহায্যে সেই অনুসারে চলে তার ফল পান ।
উদ্ধব জিজ্ঞাসা করলেন কৃষ্ণের কাছে—“হে প্রভু, ধর্ম্মের নামে জগতে এতকিছু আছে, বহু রকমের ব্যাপার চলছে এর কোনটি ঠিক কোনটি ঠিক নয় তা যার তার বোঝবার ক্ষমতা নেই, তুমি যদি কৃপা করে কিছু উপদেশ কর ।”
কৃষ্ণ বললেন—“প্রলয়ে কিছুই ছিল না, নতুন সৃষ্টি হলে পরে আমি ব্রহ্মাকে ধর্ম্মের কথা বলি এবং এর বিষয় বস্তু আমিই । আমিই সত্য মূল বস্তু, উদ্দিষ্ট বস্তু, সকলের আমাকে পেলেই সব পাওয়া হয়ে যায় ।” গীতায় ভগবান্ বলেছেন—
সর্ব্বধর্ম্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ ।
অহং ত্বাং সর্ব্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ॥
এমন জিনিষ থাকতে পারে যে, সমস্ত বাদ দিয়ে যাঁকে লাভ করলে সব পাওয়া হয়ে যায় । বেদেও বলা হয়েছে—
যস্মিন্ জ্ঞাতে সর্ব্বমিদং বিজ্ঞাতং ভবতি ।
যস্মিন্ প্রাপ্তে সর্ব্বমিদং প্রাপ্তং ভবতি ॥
শ্রৌত সিদ্ধান্তের মূল কথা এই,—এমন আশা-ভরসা দেওয়া হয়েছে যে একটা জিনিষ জানলেই সব জানা হয়ে যাবে, একটা জিনিষ পেলেই সব পাওয়া হয়ে যাবে । সেই তত্ত্ব, পুরুষোত্তম তত্ত্ব কৃষ্ণ । তিনিই বলছেন—“আমিই সেই বস্তু অর্থাৎ ধর্ম্মের বিষয় । কিন্তু আমার নিকট থেকে ব্রহ্মা, ব্রহ্মার নিকট থেকে তাঁর শিষ্যগণ, সেই শিষ্যগণ থেকে পরবর্ত্তী শিষ্যগণ, এরূপভাবে শিষ্য থেকে শিষ্যগণের মধ্য দিয়ে এই ধর্ম্ম পারম্পর্য্য ক্রমে অবতীর্ণ । সে সব আবার এই পরম্পরা ও প্রকৃতি বৈচিত্রের মধ্য দিয়ে বহুরকমের হয়ে দাঁড়িয়েছে ; আবার এর মধ্যে বিভেদও দেখা যায় ।”
আর এখানকার যে পাষণ্ডমত fossilism (জীবাষ্ম) থেকে ক্রমশঃ evolution (ক্রমবিকাশ), প্রথমে প্রাণী তারপর মানুষ, আর ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এইসব বাক্যের কদর্থ করে যা হচ্ছে, তার দ্বারা অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে । সেজন্য ভগবান কখনও কখনও নিজে কখনও নিজের জন পাঠিয়ে সকলকে revive (অভ্যুত্থান) করেন, বিশেষ করে যখন নানারকম সংঘাত দেখা দেয়, নানারকম বিপর্যয় হয় । সাধারণ লোক বুঝতে পারে না, কিন্তু শাস্ত্র বা সাধুর মারফতে বা শাস্ত্রের পরিপূর্ণ বিকাশ শ্রীমদ্ভাগবতে এটা আমরা দেখতে পাই এবং সুধীগণ বুঝতে পারেন । ভগবানও গীতায় বলেছেন—
যদা যদা হি ধর্ম্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ।
অভ্যুত্থানমধর্ম্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ॥
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্ ।
ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ॥
তাই দেখি শ্রীচৈতন্যদেব এই কলিযুগে, আর শ্রীমদ্ভাগবত দ্বাপরের শেষে অবতীর্ণ হয়ে পরস্পরের যোগাযোগে একটা অদ্ভুত পন্থার আবির্ভাব হয়েছে, যে একমাত্র ভগবানের নামানুশীলনের দ্বারাই সর্ব্বকার্য্য সিদ্ধ হবে বা সর্ব্বার্থ লাভ হতে পারে । কেবল শব্দানুশীলনের দ্বারা, কিন্তু সেই শব্দ—‘শব্দব্রহ্ম’ । শব্দব্রহ্মের অনুশীলনের দ্বারাতেই, হরিকীর্ত্তনের দ্বারাতেই সর্ব্বার্থ সিদ্ধ হতে পারে ।
কলের্দোষনিধেরাজন্ অস্তি হ্যেকো মহানগুণঃ ।
কীর্ত্তনাদেব কৃষ্ণস্য মুক্তসঙ্গঃ পরং ব্রজেৎ ॥
(শ্রীমদ্ভাগবত)
—“কলি সমস্ত দোষের বটে, তথাপি হে রাজন ! কলির একটি মহাগুণ এই যে, কৃষ্ণকীর্ত্তনে জীব মায়াবদ্ধ হতে মুক্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণরূপ পরতত্ত্ব লাভ করে ।”
|
সূচীপত্র:
শ্রীশ্রীগুরু-গৌরাঙ্গ-প্রণতি
নম্র নিবেদন
প্রণতি-দশকম্
শ্রীগুরু আরতি-স্তুতি
শ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ সম্পর্কে
১। আত্মতত্ত্ব ও
ভগবৎ-তত্ত্ব
২। জীবের চরম প্রাপ্তি
৩। সমস্যা ও সমাধান
৪। পরমার্থ লাভের পন্থা
৫। বন্ধন মুক্তির উপায়
৬। বৈষ্ণব জীবনে আনুগত্য
৭ । ধর্ম্ম শিক্ষা ও বিশ্বাস
৮ । শ্রীশরণাগতি
৯ । বজীবের স্বাধীন ইচ্ছার নিশ্চয়াত্মক স্বার্থকতা
১০ । সর্ব্বাবস্থায় ভগবানের কৃপাদর্শনেই প্রকৃত সুখ লাভ
১১ । মানব জীবনের কর্ত্তব্য
১২ । ভগবানের সঙ্গে যোগাযোগের উপায়
১৩ । আগুন জ্বালো, বাতাস আপনি আসবে
১৪ । মা মুঞ্চ-পঞ্চ-দশকম্
PDF ডাউনলোড (26.7 Mb)
|