![]() |
|||||||
| |||||||
|
|||||||
শ্রীভক্তিরক্ষক হরিকথামৃত ৬ । বৈষ্ণব জীবনে আনুগত্য
আত্মনিবেদন বা আত্মসমর্পণ করে প্রভুর আশ্রিত পশুর মত থাকতে হবে । পশু দুধ দেয়, ফসল দেয়, কিন্তু এসবের মালিক সে নয়, মালিক হলেন তিনি যাঁর আশ্রয়ে সে আছে । আমরা মালিকের behalf (পক্ষে)-এ কাজ করব । আর যদি তা না করি, তাহলে কর্ম্মের ফল অনুযায়ী ব্রহ্মাণ্ড ভ্রমন হবে, যা করছি অনাদি কাল থেকে ।
যেঽন্যেঽরবিন্দাক্ষ বিমুক্তমানিনস্ ত্বয্যস্তভাবাদবিশুদ্ধবুদ্ধয়ঃ । আরুহ্য কৃচ্ছ্রেণ পরং পদং ততঃ পতন্ত্যধোঽনাদৃতযুষ্মঙ্ঘ্রয়ঃ ॥ অর্থাৎ ভক্তিহীন জ্ঞানী জীব নিজেকে খুব বিমুক্ত বলে মনে করে, কিন্তু নিজের সীমাবদ্ধ চিন্তার মধ্যে থেকে তার উপরের সঙ্গে যে সম্বন্ধ তা অগ্রাহ্য করার জন্য সেই বিচারে গলদ থেকে যায় ; তার ফলে বহু কষ্টে ব্রহ্মলোক পর্য্যন্ত গিয়েও, তার উপরে ভক্তির current (প্রবাহ) ধরতে না পারায়, আবার নীচের দিকে নেমে যেতে হয় ; আর ঐ জন্ম মৃত্যুর ঘূর্ণিপাকে পড়তে হয় । সুতরাং বৈষ্ণব ধর্ম্ম বুঝতে হলে ঐ ব্রহ্মলোকের উপরে যেতে হবে । আমরা পাচ্ছি ভোগের রাজ্য, ত্যাগের রাজ্য আর সেবার রাজ্য ; তাই ভোগ্য জগত থেকে ত্যাগের জগতে যেতে হবে, তবে ত্যাগে সমাধিস্ত হয়ে থাকলে চলবে না, উপরের দিকে সেবার current (প্রবাহ) আছে তাকে ধরতে হবে । তাহলে সেবাটা কিরকম সেটাই বুঝতে হবে । সেবা হচ্ছে, তিনি ইচ্ছা করবেন আর আমি পালন করব ; ইচ্ছার মালিক তিনি, প্রয়োজনানুসারে তিনি বলবেন আর আমি অবিচারে তাঁর ইচ্ছা পালন করে যাব । এইরকমের জগতই হচ্ছে বৈকুন্ঠ জগৎ । সেখানে একজনই মালিক, তিনি হুকুম করছেন আর সব আদেশ পালন করছে । এই যে সেবা তা একটু হিসেব নিকেশ করে, ঐশ্বর্য্য, বৈরাগ্য নিয়ে করাটা হল বৈকুন্ঠের ব্যাপার, আর তারও উপরের প্রকোষ্ঠ গোলক, সেখানে কেবল অনুরাগের দ্বারা পরিচালিত হয়ে সেবা, কোন হিসেব নিকেশ নেই automatic (আপনা আপনি) সেবা শুধুই অনুরাগ, না করলে ভাল লাগে না, করলেই ভাল । এই অবস্থা হচ্ছে গোলকে । এখন কি করে এ অবস্থায় যাওয়া যায় সেটা দেখা যাক । এ সম্পর্কে মহাপ্রভু বলছেন—
দীক্ষাকালে ভক্ত করে আত্মসমর্পণ । সেইকালে কৃষ্ণ তারে করে আত্মসম ॥ সেই দেহ করে তার চিদানন্দময় । অপ্রাকৃত দেহে তাঁর চরণ ভজয় ॥ দীক্ষা হচ্ছে দিব্যজ্ঞান, অর্থাৎ তুমি সেব্য আমি সেবক, তুমি পুরুষ আর সব প্রকৃতি তাই তাদের কাজই হচ্ছে মুক্তাবস্থায় সেবা করা । তিনি ইচ্ছাময়, যা ইচ্ছা করবেন তাই আমরা পালন করব, তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করব যেহেতু আমরা slave । মহাপ্রভু বলেছেন—
জীবের স্বরূপ হয় কৃষ্ণের নিত্যদাস । কৃষ্ণের তটস্থাশক্তি ভেদাভেদ প্রকাশ ॥ কৃষ্ণভুলি সেই জীব অনাদি বহির্মুখ । অতএব মায়া তারে দেয় সংসারাদি দুঃখ ॥ এখন সাধুসঙ্গে থেকে কৃষ্ণসম্বন্ধ ভেতরে জাগ্রত করাই আমাদের কাজ । সেখানে কি ? সেখানে তিনি প্রভু আমি দাস । আমার ধর্ম্ম সেবা করা, তাঁর ধর্ম্ম সেবা নেওয়া । তিনি সুখ-স্বরূপ, আনন্দ-স্বরূপ । সেবার দ্বারাতেই সেই উৎকৃষ্ট ধরণের আনন্দ পাওয়া যায় । সেবার মাধ্যমেই তাঁর কৃপালাভ হবে তাতে সুখ স্বরূপ, আনন্দ-স্বরূপ প্রভুর আনন্দ সঞ্চারিত হতে পারে যা ভোগের দ্বারা সম্ভব নয় । ভোগ হচ্ছে নিম্নস্তরের জিনিষ, জড় জগতের জিনিষ, আর ত্যাগের দ্বারাতে ঐ মাঝামাঝি মুক্তির অবস্থা কিন্তু এর পরে হল গিয়ে ভক্তি রাজ্য । শ্রীমদভাগবতে (৬।১৪।৫) আছে— মুক্তানামাপি সিদ্ধানাং নারায়ণ-পরায়ণঃ । সুদুর্ল্লভঃ প্রশান্তাত্মা কোটীষ্বপি মহামুনে ॥ অর্থাৎ কোটী মুক্ত মধ্যে দুর্ল্লভ এক কৃষ্ণভক্ত । কৃষ্ণভক্ত মুক্ততো বটেই উপরন্তু সে ভগবানের সেবানন্দেতে বিভোর থাকে । সুতরাং সদ্গুরুর আশ্রয়ে তাঁর দাস্যে বাস করে নিজের বিচার জবাব দিতে হবে । নিজের মনকে তখন বলতে হবে যে, তোমার কথা বহুকাল শুনেছি এখন আর শুনব না, এখন বৈষ্ণব গুরুর দাস হয়ে তাঁর কথা শুনব, তিনি যা বলবেন তাতেই আমার কল্যাণ হবে । আমি তাঁর সেবা করব, আদেশ পালন করব, এটা যখন মনে হবে তখনই সত্যিকারের জীবন আরম্ভ হবে, বৈষ্ণব জীবন । ‘ভৃত্যস্য ভৃত্য’ হতে হবে, তবেই কিছু লাভের সম্ভাবনা । মহাপ্রভু বলেছেন—
নাহং বিপ্রো ন চ নরপতির্নাপি বৈশ্যো ন শূদ্রো নাহং বর্ণী ন চ গৃহপতির্নো বনস্থো যতির্বা । কিন্তু প্রোদ্যন্নিখিলপরমানন্দপূর্ণামৃতাব্ধে- র্গোপীভর্ত্তুঃ পদকমলয়োর্দাস-দাসানুদাসঃ ॥ আমি বর্ণ এবং আশ্রম এই চারিটির কোনটীর মধ্যেই নেই । আমি এর অতীত—‘গোপীভর্ত্তুঃ পদকমলয়োর্দাস-দাসানুদাসঃ’ । এই অবস্থা সম্ভব কেমন করে, তাও বলেছেন মহাপ্রভু— এত সব ছাড়ি আর বর্ণাশ্রম ধর্ম্ম । অকিঞ্চন হইয়া লয় কৃষ্ণৈকশরণ ॥ গোপীভর্ত্তা যে কৃষ্ণ, ভগবানের স্বয়ংরূপ তাঁর দাসের দাসের দাস হতে চাই, এই আমার পরিচয় । সুতরাং দাস্য জিনিষটা অনুশীলন করতে হবে, এবং সেটা যাতে কৃষ্ণদাস্য হয়, হরিদাস্য হয়, তার জন্য যিনি একান্তভাবে কৃষ্ণগত প্রাণ, এমন ব্যক্তির আশ্রয়ে থেকে সেবা করতে হবে । সেবা না করলে সে লোকে প্রবেশ হয় না । ভিসা জাগাড় করতে হবে । পাশপোর্ট হলে দেশের বাইরে যাওয়া যায়, কিন্তু অন্য দেশে প্রবেশ করা যায় না, সে দেশের ভিসা ছাড়া । তেমনি বৈকুন্ঠ জগতের ভিসা জোগাড় করতে হবে সেখানে প্রবেশ করার জন্য । মুক্তি হচ্ছে পাশপোর্ট স্বরূপ, এজগৎ থেকে মুক্তি, কিন্তু বৈকুন্ঠলোকে প্রবেশের জন্য সেবারূপ ভিসার প্রয়োজন । তাহলে গুরুদাস্য বা কৃষ্ণদাস্য হচ্ছে নিজেকে নিবেদন করে সেই চাতকের মত হয়ে থাকা । রূপ গোস্বামী লিখেছেন—
বিরচয় ময়ি দণ্ডং দীনবন্ধো দয়াম্বা গতিরিহ ন ভবত্তঃ কাচিদন্যা মমাস্তি । নিপততু শতকোটিনির্ভরং বা নবাম্ভস্ তদপি কিল পয়োদঃ স্তুয়তে চাতকেন ॥ ‘হে প্রভু আমার প্রতি দণ্ডই কর বা দয়াই কর এ সংসারে তোমাভিন্ন আমার অন্য কোন গতি নাই । বজ্রপাতই হোক বা প্রচুর নবাম্বুধারা বর্ষণই হোক চাতক সর্ব্বদা মেঘেরই স্তুতি গান করে থাকে ।’ কত সুন্দর উদাহরণ ! চাতক উভয় অবস্থায়ই এক রকম, সে শুধু চায় একফোঁটা উপরের জল, নীচের জল সে কখনও খাবে না সুতরাং এই ভাবেতে সেই দিকে লক্ষ্য করে চলবার চেষ্টা করতে হবে । আমার আর কোথাও গতি নেই, আশ্রয় নেই, যেখানেই যাব সেখানেই মরতে হবে, একমাত্র মৃত্যুকে অতিক্রম করে তোমার ধামেতে যেতে চাই, যেহেতু “যদ্গত্ত্বা ন নিবর্ত্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম”, অর্থাৎ যেখানে গেলে জন্ম-মৃত্যু, এই আসা-যাওয়া শেষ হয়ে যাবে । এটা বাস্তব জিনিষ, সখের জিনিষ নয়, যে আমি যতটা বুঝলাম তাই করলাম, তা হবে না । গুরু-বৈষ্ণবের আশ্রয়ে বাস মানেই সেখানে নিজের স্বতন্ত্রতা চলবে না । স্বতন্ত্র জীবন অনেক পেয়েছি, আর দুঃখও অনেক পেয়েছি ; ভক্তিবিনোদ ঠাকুর বলেছেন—“বহু দুঃখ পাইয়াছি স্বতন্ত্র জীবনে । সব দুঃখ দূরে গেল ওপদ বরণে ॥” নিজেকে ঠিক পথে চালিত করতে হবে, মনকে বলতে হবে যে, তোমার কথা শুনে জন্মজন্মান্তর অনাদিকাল হতে ঘুরে বেড়াচ্ছি এখন আমি উপরের হুকুম শুনব, ভগবানের প্রেরিত হুকুম শুনব ।” তোমার রসদ খাদ্য একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হবে, আর না খেতে পেয়ে তুমি মরে যাবে—“সর্ব্ব মনোনিগ্রহ লক্ষনান্ত ।” অদ্বৈতসিদ্ধির লেখক মধুসূদন লিখেছেন—“ততো ভবেৎ মনোনাশ,” মনটা নষ্ট হয়ে যাবে । মৌখিক পদ্ধতিতে যা হয় সেটা perfect নয় । সংকল্প বিকল্প মনের ধর্ম্ম । মন বলবে এটা চাই আবার বলবে এটা চাই না । এই যে কর্ত্তৃত্ত্ব, এটা আমাদের সর্ব্বনাশ করছে, ব্রহ্মাণ্ড ঘোরাচ্ছে, তার ভুমিকা দুষ্ট ম্যানেজারের ভূমিকা, বিদ্রোহী ম্যানেজারের ভূমিকা । আত্মা হল proprietor সত্ত্বাধিকারী, কিন্তু সে minor proprietor, সে নাবালক, আর বিদ্রোহী ম্যানেজার মন, আত্মার behalf এ কাজ করছে । এখন অন্য একজন major proprietor এর সঙ্গে এই minor proprietor যোগাযোগ করে নিজের ম্যানেজারকে দমন করে position নিতে পারে নিজের সম্পর্কে । সুতরাং আমাদের প্রাকৃত মন থেকে যা আসবে তা dismiss করে দিতে হবে, বলতে হবে তোমার কথা শুনব না, তোমার কথা বহু জন্মজন্মান্তর শুনে এসেছি, তোমার suggestion সে সব বিশ্বাসঘাতকতা, এর মধ্যে আমি নেই, আমি যাঁর আশ্রয়ে এসেছি তার কথা শুনব, তোমরা বিদায় দাও । মাধবেন্দ্র পুরীপাদ বলেছেন—
কামাদীনাং কতি ন কতিধা পালিতা দুর্নিদেশাস্ তেষাং জাতা ময়ি ন করুণা ন ত্রপা নোপশান্তিঃ । উৎসৃজ্যৈতানথ যদুপতে সাম্প্রতং লব্ধবুব্ধিস্ তামায়াতঃ শরণমভয়ং মাং নিযুঙ্ক্ষ্বাত্মদাস্যে ॥ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য্য এইসব প্রভুদের কথা আমি কতদিন, কতকাল, কতজন্ম যে শুনে এসেছি তার কোন ঠিক নেই, এদের দুষ্ট নির্দ্দেশ হুকুম বহুকাল বহু জন্ম জন্মান্তর পালন করে এসেছি । তাদের এতসব কথা আমি শুনেছি তথাপি আমার প্রতি তাদের করুণা হল না, আর আমার ও লজ্জা হল না তাদের দুষ্ট আদেশ শুনতে থাকলাম, কত ঘৃণ্য কাজ করলাম শুধু, ছিঃ ! ছিঃ ! কিন্তু সম্প্রতি আমি একটা বুদ্ধির প্রেরণা পেয়েছি, হে ঠাকুর ! হে যদুপতি ! আমি দেখছি যে, কোন প্রকারে যদি তোমার একটু চাকুরী, একটু সম্বন্ধ করতে পারি তাহলেই তোমার ভয়েই বেটারা পালিয়ে যাবে । তুমি যদি একটু তাকাও আমার দিকে তবেই আমি বেঁচে যেতে পারি, কারণ আমাকে তো তোমার মায়া মোটেই ভয় করে না, যদি তোমার একটু ঈশারা পড়ে তাহলেই মায়া আর আমায় কষ্ট দেবে না । গীতায় ভগবান বলেছেন—
দৈবী হ্যেষ্যা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া । মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে ॥ ভগবানের মায়া তাঁর কৃপাতেই ছেড়ে যেতে বাধ্য । মায়া জীবের চেয়ে বলবান কিন্তু ভগবানের অনুগত, তাই ভগবানের যদি একটু ঈশারা পড়ে তবেই মায়া সরে যাবে, আর তা নাহলে জীব যতই লম্ফ ঝম্ফ করুক না কেন তাতে কিছুই হবে না । সুতরাং আমি দেখছি যে আমি নিজে এই ভোগ, ত্যাগ এসব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারব না কিন্তু তোমার সর্ব্বসম্বন্ধই আমাকে বাঁচাবে, তাই আমায় যে করে হউক একটু connection দাও, একটু কিছু কাজ দাও যাতে করে তোমার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ হয় যার ফলে মায়া আমায় ছেড়ে যাবে, আমি উদ্ধার পাব । তাহলে দেখা যাচ্ছে সাধু গুরুর আনুগত্যই বাঁচার একমাত্র পন্থা, যেখানে আমার কোন ইচ্ছা চলবে না । সম্পূর্ণ যাঁকে বিশ্বাস করি, বৈষ্ণব বলে গুরুরূপে বরণ করেছি ভগবদাভিন্ন বিচার করে, তাঁকেই একমাত্র পথ প্রদর্শক করে তাঁর নির্দ্দেশেই পথ চলতে হবে । চাতকের মত অপেক্ষা করে থাকতে হবে কি নির্দ্দেশ উপর থেকে আসে আর সেই সেইটিই মঙ্গল, এই বুঝে নিজের ইচ্ছাকে বিসর্জ্জন দিতে হবে । আনুগত্যের মাধ্যমেই উপরের জিনিষ আমার মধ্যে সঞ্চার হয়ে যাবে । কি নিয়ে আমাদের কারবার সেটা ভাল করে বুঝতে হবে । গরুড় বচন আছে—
ব্রাহ্মণানাং সহস্রেভ্যঃ সত্রযাজী বিশিষ্যতে । সত্রযাজি সহস্রেভ্যঃ সর্ব্ববেদান্তপারগঃ ॥ সর্ব্ববেদান্তবিৎকোট্যা বিষ্ণুভক্তো বিশিষ্যতে । বৈষ্ণবানাং সহস্রেভ্য একান্ত্যেকো বিশিষ্যতে ॥ অর্থাৎ হাজার হাজার কর্ম্মকাণ্ডীয় যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণ থেকে একজন সর্ব্ববেদান্তবিৎ যিনি জ্ঞান ভূমিকায় যজ্ঞ করছেন তিনি শ্রেষ্ঠ । জ্ঞান বিচারে জগৎ কিছুই নয় সব মায়া, সব নশ্বর, তাই এভাবে যে যজ্ঞ তা জ্ঞানবিচারে আত্মভূমিতে, যা সেই কর্ম্মভূমিকায় স্থূলবস্তু নিয়ে যজ্ঞের চেয়ে অনেক শ্রেষ্ঠ যেহেতু আত্মভূমিকায় সে নিজেকেই দিচ্ছে আহুতি । এরূপ কোটী বেদান্তবিৎ ব্রাহ্মণ অপেক্ষা একজন বিষ্ণুভক্ত শ্রেষ্ঠ । কারণ বিষ্ণুভক্তের personal God কিন্তু বেদান্তবিৎ-এর impersonal ভাব । সোহং বলছে জ্ঞানী, অর্থাৎ সেই আমি, সেও চেতন আমিও চেতন । কিন্তু আমি ক্ষুদ্রচেতন সে বৃহৎ চেতন, এটা দর্শন হলেই পুরুষোত্তমের কাছে মাথা নুইয়ে পড়ে । গীতায় ভগবান বলেছেন—
ব্রহ্মভূতঃ প্রসন্নাত্মা ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি । সমঃ সর্ব্বেষু ভূতেষু মদ্ভক্তিং লভতে পরাম্ ॥ ব্রহ্মভূত হয়ে যাবার পর জীব পরাভক্তি লাভ করে । মুক্তির পর বেদান্ত আলোচনার দ্বারাতে এজগতের নশ্বরতা হৃদয়ঙ্গম হলে তারপরে আরো উপরে যিনি আছেন তিনি পুরুষোত্তম, তাঁর সেবায় যে মঙ্গল এটা বোঝা যায় । গীতায় আরো আছে—
বহুনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান মাং প্রপদ্যন্তে । বাসুদেবঃ সর্ব্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্ল্লভঃ ॥ যখন ব্রহ্মেতে পরব্রহ্ম দর্শন হয় তখন মাথা নুইয়ে পড়ে । তেমনি এখানে বেদান্তে সব ব্রহ্ম কেবল চেতন তারপর যখন পরব্রহ্মরূপে সেব্য দর্শন হয় তখন বিষ্ণুভক্ত হয়ে যায় আর সেই বিষ্ণুভক্ত কোটী বেদান্তবিৎ থেকে শ্রেষ্ঠ । আর সহস্র সহস্র বিষ্ণুভক্ত থেকে ঐকান্তিক একজনই শ্রেষ্ঠ । ঐকান্তিক মানে যাঁরা আইন কানুন না মেনেই বৃন্দাবনে কৃষ্ণের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছে । তাঁরা ভাল মন্দ কিছু জানে না বুঝতেও চায় না, তিনি আমাদের প্রাণের দেবতা তাঁর সেবাতেই আমাদের পরম মঙ্গল এই জেনেই তারা সেবানন্দে বিভোর থাকে । সুতরাং এইসব তাজা জিনিষ—এই কর্ম্ম ভূমিকা, জ্ঞান ভূমিকা ও ভক্তি ভূমিকা এইসব আলোচনা করে, বিচার করে, পালন করে আত্মোন্নতি করতে হলে গুরুদেবের অনুগত হতে হবে এবং এতেই দিব্যজ্ঞান লাভ সম্ভব হবে ।
|
শ্রীশ্রীগুরু-গৌরাঙ্গ-প্রণতি PDF ডাউনলোড (26.7 Mb) |
||||||
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥ | |||||||
© Sri Chaitanya Saraswat Math, Nabadwip, West Bengal, India. For any enquiries please visit our contact page. |