![]() |
|||||||
| |||||||
|
|||||||
শ্রীভক্তিরক্ষক হরিকথামৃত ১১ । মানব জীবনের কর্ত্তব্য
আমি সর্ব্বপ্রথম আমার শ্রীগুরুপাদপদ্মের অভিন্নবিগ্রহ সতীর্থ বৈষ্ণবগণের বন্দনা করি এবং সভাস্থ সজ্জনবৃন্দকে আমার অভিনন্দন জ্ঞাপন করি ।
“আত্মারামশ্চ মুনয়ো নির্গ্রন্থা অপ্যুরুক্রমে ।
হরি নামক বস্তু, ব্রহ্মের অপর পারেতে তাঁর অধিষ্ঠান । তাঁর এমন মাহাত্ম্য, এমন মাধুর্য্য যে যাঁরা আত্মারাম, জড়ারাম পরিত্যাগ করে আত্মারামত্বে অবস্থিত, তাঁদের চিত্তকে অহৈতুকী ও অপ্রতিহত ভাবেতে আকর্ষণ করে থাকেন । চতুঃসন, শুকদেব গোস্বামী, বিল্বমঙ্গল ঠাকুর প্রভৃতি দৃষ্টান্তে ও তাঁদের উপদেশেতে আমরা এই প্রকার জগতের সন্ধান পাই । রামানুজ মধ্বাচার্য্য প্রভৃতি মধ্যযুগীয় আচর্য্যগণও বেদান্তের ভাষ্যেতে সেই তত্ত্বের সন্ধান দিয়েছেন ।
“কর্ম্মণাং পরিণামিত্বাদাবিরিঞ্চাদমঙ্গলম্ ।
শ্রীমদ্ভাগবতে বলেছেন,—আমরা তো অতি ক্ষুদ্র । আমাদের আর কতটুকুই বা পুঁজি, স্বয়ং ব্রহ্মা যিনি এই সমগ্র জগতের স্রষ্টা, তিনি পর্য্যন্ত অমঙ্গলের অধীন । কেন ?—যেহেতু কর্ম্মার্জ্জিত বিষয়ের প্রতি নির্ভরশীল । এই ব্রহ্মাণ্ডকে তিনি সৃষ্টি করেছেন । তিনি এত বড় একটা প্রকাণ্ড অধিকার পেয়েছেন, তথাপি তাঁর জীবনটাও এই নশ্বর বস্তুর আপেক্ষিকতায় বর্ত্তমান । এই জন্য তাঁর স্থান পর্য্যন্ত এই ত্রিতাপ পৌঁছে গিয়েছে । সেখানেও অমঙ্গল । ব্রহ্মাকেও মৃত্যুবরণ করতে হয় এবং সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে তাঁকেও মৃত্যুর মুখে প্রবেশ করতে হয় ।
“নৃদেহমাদ্যং সুলভং সুদুর্ল্লভং শাস্ত্রের বহু স্থানেতেই এই কথা বলা হয়েছে । যদি তোমার এই দুর্ল্লভ জন্মের সার্থকতা সম্পাদন করতে না পার, তবে জেনো যে তুমি নিজেকে হত্যা করছ । তুমি যেসব কাজেতে এখন নিযুক্ত আছ, এসব কাজ যে কোন জায়গায় হবে । পশু, পক্ষী, কীট, পতঙ্গ—যেখানে যাবে জন্ম হবে । সর্ব্বত্রই এই বিষয়ে রসের আস্বাদন পাবে । বরং মনুষ্য জন্মের চেয়ে আরও ভালভাবেও পেতে পার । ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের পরিচালনের যোগ্যতা অনেক জন্মেরই বেশী আছে । চক্ষুর দৃষ্টি অনেক পক্ষীর বেশী আছে । এই প্রকার বিভিন্ন বিষয়ে অধিকার রসাস্বাদন সম্ভাবনা অন্যত্র রয়েছে, কিন্তু মনুষ্য জীবনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে আত্মজ্ঞানের অনুশীলন কর । নিজের অনুসন্ধান কর । আমি কে ?আমি কোথায় ? আমার কিসে মঙ্গল হয় । যেমন যারা ডোগ্লা জাতীয় তারা উপস্থিত ভাবনা করে ‘আজ কি খাব ?’ কিন্তু যাঁরা একটু বিচক্ষণ, তারা ভবিষ্যতের চিন্তা করে । তারা ভাবে কাল কি খাব ? সেই প্রকার যাঁরা হুঁসিয়ার ব্যক্তি—তাঁরা কাল, পরশ্ব তৎপরশ্ব প্রভৃতির চিন্তা করে থাকেন । আর সাধুগণ উপস্থিত যদৃচ্ছালাভে সন্তুষ্ট থেকে ভবিষ্যতের—জন্ম-জন্মান্তরের জন্য চিন্তা করেন । আমরা সকলেই জানি—এজ্ সিওর্ এজ্ ডেথ্—মৃত্যুর চেয়ে এজগতে নিশ্চিত আর কিছু নয় ।
“অহন্যহনি ভূতানি গচ্ছন্তি যম-মন্দিরম্ । যুধিষ্ঠির মহারাজের এই প্রকার আশ্চর্য্যের সম্বন্ধে যে ধারণা এবং তিনি যা বলেছিলেন, সেটা আমাদের অনেকেরই বিদিত । কিন্তু সে বিষয়েতে আমরা অনবধানযুক্ত অবশ্যম্ভাবী জিনিষ যেটা আসবে আমরা সে বিষয়ের প্রতিকারের কোন চেষ্টাই করছি না এইটাই আশ্চর্য্য । অতএব আমরা নিজের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছি । নিজের ইন্টারেষ্ট্ নিজে নষ্ট করছি । অতএব এই অবস্থার হাত হতে নিষ্কৃতি পাওয়া দরকার । এই অবস্থায় কেবল সাধুগণ আসেন আমাদের দ্বারে । আমাদের দ্বারা তিরষ্কৃত, লাঞ্ছিত এবং অনেক প্রকারে অপমানিত হয়েও বা দুর্ব্যবহার পেয়েও তাঁরা উপযুক্ত অভিভাবকের মত আমাদের মঙ্গলচিন্তাই করে থাকেন । আমাদের স্বরূপোদ্বোধনের যত্ন করে থাকেন । আত্মজ্ঞান প্রদান করে থাকেন ।
“তব কথামৃতং তপ্তজীবনং ভাগবত বলেছেন—যাঁরা সেই ভগবানের কথামৃত দান করেন, তাঁরাই প্রকৃত দাতা । তাঁরাই ‘ভূরিদা’ । ভূরি মানে প্রচুর । প্রচুর পরিমাণে দান কে করে ? আমরা মনে করি,—অন্নদান, বস্ত্রদান, ঔষধদান প্রভৃতি দানই খুব বড় দান । কিন্তু তা নয় । সর্ব্বশ্রেষ্ট দান হচ্ছে ভগবানকে দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা । তা কি করে পাওয়া যায় ? না—সাধুগুরুর আনুগত্যে ভগবচ্চরণে শরণাগত হলেই তা পাওয়া যায় । তিনি শরণাগতকে রক্ষা করেন । তিনি সব জায়গাতেই আছেন । তাঁর নাম আশ্রয় করে ডাক্বার যে সহজ পন্থা সেইটি গুরুরূপী ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শ্রীমদ্ভাগবত হতে প্রকাশ করে দিয়ে সকলকে ব্যাপকভাবে জানিয়ে দিলেন । একদিক দিয়ে অত্যন্ত সহজ কিন্তু চরম আন্তরিকতার প্রয়োজন । ফাঁকি দিলেই ফাঁকে পড়তে হবে । আন্তরিকভাবে সেই ভগবানের নাম গ্রহণের দ্বারাই আমরা সর্ব্বস্বার্থ লাভ করতে পারি ।
“কলিং সভাজয়ন্ত্যার্য্যা গুণজ্ঞাঃ সারভাগিনঃ ।
যাঁরা সারগ্রাহী, তাঁরা কলিকাল কবে আসছে বলে অপেক্ষা করে থাকেন; যেহেতু ঐ সময় যদি জন্ম গ্রহণ করতে পারি তো হরিনামরূপী ভগবানের কৃপাবলে আমি বহু উচ্চ অবস্থায় চলে যেতে পারবো । খুব সহজ পন্থায় চরম জিনিষ—ব্রজরস পাবার সৌভাগ্যলাভ করবো ।
বিক্রীড়িতং ব্রজবধূভিরিদঞ্চ বিষ্ণোঃ ‘হৃদ্-রোগম্’ অর্থাৎ আমরা সকলেই যে হার্টডিজিজ্ এ সাফার্ করছি । হৃদ-রোগটা কি ? না—কাম । কাম অর্থাৎ বাসনা । সহস্র সহস্র কামনা—বাসনা ।
“সহস্রমিচ্ছতি সতি সহস্রীং লক্ষমীয়তে ।
আমরা যতই পাই তাতে তৃপ্তি হয় না । আরও চাই আরও চাই করি । এইটিই হোল হৃদ্রোগ । এর চিকিৎসা কি ? না সব ভগবানেতে অর্পণ । অর্থাৎ সব ভগবানের । আমার কিছু নয় । আমিও তাঁরই । এই কন্সেপ্সনেতে আমরা যদি নিজেকে এড্জাষ্ট করতে পারি । তা হলেই আমরা প্রকৃত মুক্তি লাভ করবো ।
“শ্রীমদ্ভাগবতং পুরাণমমলং যদ্বৈষ্ণবানাং প্রিয়ং ভাগবতের মুক্তির স্বরূপের বিলক্ষণ বৈশিষ্ট্য আছে । তাতে পজেটিভ্—কেবল ডেষ্ট্রাক্টিভ্ নয়—কনষ্ট্রাক্টিভ্ বস্তু প্রদান করা হয়েছে । এজগতে আমরা যে রস আস্বাদন করছি—ড্র করছি—এর ঠিক্ পজেটিভ্ জগৎ একটা রয়েছে । এটা সেই মূল জগতের বিকৃত প্রতিফলন মাত্র । আমাদের প্রকৃত সম্বন্ধ সেই জগতের সঙ্গে । সেই সম্বন্ধে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সেখানকার রস আহরণ করা প্রয়োজন । ভোগবুদ্ধিই এই অলীক জগতে বসবাসের কারণ । যেমন যদি অপরের সম্পত্তি জাল দলিলের দ্বারা নিয়ে আমি ভোগ করি, তা হলে চরমে দাগা পেতে হয়, সেই প্রকার একটা ভুল ধারণার উপরেতে যে আমাদের অধিকার স্থাপন করে আমরা তা হতে সুখ পেতে চাচ্ছি, সেটা সবই মায়া । মায়া—মা যা; সেটা যা নয় তাকে তাই মনে করে সেখান থেকে আশা ভরসার ধোকা পাওয়া । সত্যিকারের আমি যা, সেই স্থানেতে অবস্থিত হয়ে—যে সুখ আমাদের স্বাভাবিক ভাবেই স্বরূপের সম্পত্তি—সেই সুখ বা রসের জন্য চেষ্ঠা করতে বলে গিয়েছেন । “মুক্তির্হিত্বান্যথারূপং স্বরূপেণ ব্যবস্থিতিঃ” । সেই রস হচ্ছে ভগবদ্রস । কৃষ্ণলীলারস । কৃষ্ণের লীলা দেখে তাতে নিজের সুখ অনুভব করা । কর্ম্মের মুক্তি তো বটেই, ‘ভক্তি সহিত-নৈষ্কর্ম্ম্যমাবিষ্কৃতম্’ । সেবার সঙ্গে নিষ্কাম । কেবল ত্যাগ নয় । মূল পজেটিভ্ জিনিষ রয়েছে তাতে,—শ্রীভগবৎসেবা । ভগবান রসস্বরূপ । তিনি জ্ঞানস্বরূপ—তিনি আনন্দস্বরূপ । সুতরাং আমাদের জ্ঞানবৃত্তির চরিতার্থতা সেখানে মিলবে এবং আমাদের সর্ব্বোপরি যে সর্ব্বোত্তমা বৃত্তি, রসাস্বাদনপর আকাঙ্খা—সেটা তাঁর সান্নিধ্যে সুষ্ঠু চরিতার্থতা লাভ করবে । সুতরাং এই বিষয়ে যে চেষ্ঠা সেইটিই হোল পজেটিভ্ লাইন্ । তদ্ব্যতীত অন্যান্য যা কিছু এন্গেজ্মেন্ট্ সবই বিপদসঙ্কুল—স্বার্থহানিকর । সব সময়ে উল্টাদিকে আকর্ষণ করে আমাদের বাস্তব সম্ভাবনা হতে আমাদিগকে বঞ্চিত করছে । সাধু সাবধান ! আমরা সকলেই নিজেকে সাহায্য করতে চাই আন্তরিকভাবে—এতে কোন সন্দেহ নাই কিন্তু এমন পারিপার্শ্বিকতার প্রলোভনের চাপে আমরা পড়েছি যে আমাদের সে কাজটা আমরা করতে পারছি না । যেমন নাবালক মালিক দুষ্ট কর্ম্মচারিদের পাকে পড়ে সুবিধা করতে পারে না, সেই প্রকার একটু যাদের কাণ্ডজ্ঞান মুকুলিত হয়েছে, সেইরূপ বদ্ধজীবের চেষ্টাটাও অনেকটা এই প্রকার অসুবিধাগ্রস্ত । তাদের আত্মার কর্ম্মচারীরূপী যে মন, ইন্দ্রিয় প্রভৃতি রয়েছে তারা আত্মাকে দাবিয়ে রেখে নিজেরা প্রভু হয়ে সেই আত্মার স্বার্থহানি করছে । সেই জন্য অন্য আর একজন সৎ মেজর্ প্রপ্রাইটারের সঙ্গে এই মাইনর্ প্রপ্রাইটারের যদি একটা যোগযোগ হয়, তা হলেই তার প্রকৃত ইন্টারেষ্ট সংরক্ষিত হতে পারে । সেই প্রকার যে সমস্ত মায়িকজ্ঞান আমাদিগকে বঞ্চনা করছে, আমাদেরই ভেতরে বাস করে আমাদের রক্ত খেয়ে আমাদের অনিষ্ট করছে, এমন যে সব … আইডিয়াস্—সেই গুলোক সাধুর কাছ থেকে বল লাভ করে দাবিয়ে দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে ।
ন তে বিদুঃ স্বার্থগতিং হি বিষ্ণুং স্বার্থের গতি হচ্ছে শ্রীবিষ্ণুপাদপদ্ম । য এদং বিশ্বং ব্যাপ্নোতি । তিনি অধোক্ষজ বস্তু । আমাদের ইন্দ্রিয় জ্ঞানের অতীত তত্ত্ব হচ্ছেন বিষ্ণু । তাঁর পাদপদ্ম ছাড়া আর যা কিছু অনিত্য বস্তু সমস্তই আমাদের স্বার্থহানিকর ।আমি ৪২ বৎসর আগে এখানে যে প্যারাফ্যার্নেলিয়া দেখেছিলাম তার কতটুকু অংশ এখন অবশিষ্ট আছে ? যেটা রয়েছে সেটাও অনেক বিকৃত এবং সে সব লোক ‘যয়েদং ধার্য্যতে জগৎ’ এই সম্পত্তি, এই গ্রাম এবং এখানকার ব্রহ্মণ্যধর্ম্মের যাঁরা মাষ্টার, এই সমস্ত সমাজ ও মনুষ্যদের নিয়ে খেলা করতেন—আজ তাঁরা কোথায় ? তাঁদের প্রায় সকলকেই আজ দেখতে পাচ্ছি না । সুতরাং আরও কিছুদিন পরে বা যে কোন সময় আমরাও ঐ অবস্থায় যাব, আবার নূতন সেট্ আসবে, অতএব এই প্রকার যে কালপ্রবাহ চলছে আমরা কোথায় তার স্রোতে ভেসে চলে যাচ্ছি । অতএব এর একটা কূল পাওয়া দরকার এবং সেটা অবুঝের কাজ নয় । প্রকৃত বুদ্ধিমানের কাজ । গীতায় ভগবান বলেছেন,— ‘জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধি-দুঃখদোষানুদর্শনম্’
জন্ম, মৃত্যু, জরা এবং ব্যাধি এর মধ্যে যে দুঃখ আছে এই জিনিষটা যারা অনুভব করে, তাদের বুদ্ধিই প্রকৃত সাত্বিক বুদ্ধি—শ্রেষ্ঠ বুদ্ধি । যেমন ভাল রাডার্—এতে সূক্ষ্মানুসূক্ষ্ম জিনিষও ধরা পড়ে, তেমনি তাঁদের ফাইন্ ইন্টেলক্টেতেও প্রকৃতির এই খেলা ধরা পড়ে যায় এবং তার প্রতিকারও তাঁরা করতে চেষ্টা করেন ।
গুরুপাদপদ্মে রহে যাঁর নিষ্ঠা ভক্তি ।
|
শ্রীশ্রীগুরু-গৌরাঙ্গ-প্রণতি PDF ডাউনলোড (26.7 Mb) |
||||||
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥ | |||||||
© Sri Chaitanya Saraswat Math, Nabadwip, West Bengal, India. For any enquiries please visit our contact page. |