আমাদের শ্রীগুরুপরম্পরা :
শ্রীশ্রীল ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ ভগবান্ শ্রীশ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর
              প্রভুপাদ
“শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠে সূর্যাস্ত কখনই হয় না” :
আমাদের মঠের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
 
আমাদের সম্পর্কে শ্রীউপদেশ শ্রীগ্রন্থাগার শ্রীগৌড়ীয় পঞ্জিকা ছবি ENGLISH
 

শ্রীভক্তিরক্ষক হরিকথামৃত


১২ । ভগবানের সঙ্গে যোগাযোগের উপায়

 

ভয়ং দ্বিতীয়াভিনিবেশতঃ স্যাদ্
ঈশাদপেতস্য বিপর্য্যয়োঽস্মৃতি ।
তন্মায়য়াতো বুধ আভজেৎ তয়ো
ভক্ত্যেকয়েশং গুরুদেবতাত্মা ॥

(ভাঃ ১১/২/৩৭)

     আমাদের ভয় এটা হচ্ছে দ্বিতীয়াভিনিবেশের জন্য, separate interest ই হচ্ছে আমাদের বিপদ সুতরাং Back to God Back to Home; কেননা একটা পাগলের যেমন সবই আছে, ছেলে-মেয়ে, পিতা-মাতা, সহায়-সম্পদ কিন্তু মাথাটা বিগড়ে গিয়েছে, রাস্তায় কাগজ কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে, তাকে খানকতক কাগজ হাতে দিলেই তো তার সেবা করা হবে না, তার ব্রেইনটার যে এলোমেলোভাব সেইটাকে ঠিক করতে হবে । সেই রকম আমাদের আসল সমস্যা হচ্ছে God conscious অর্থাৎ ঈশ্বর চেতনা থেকে দূরে সরে আসার জন্য যে দ্বিতীয়াভিনিবেশ অর্থৎ ঈশ্বর সম্পর্ক হীন অন্য কিছু খুঁজতে এসে এই land of misconception এখানে নিয়ে এসেছে, আর এখানে মায়াবশতঃ স্বরূপের বিস্মৃতি ঘটছে । মায়া মানে ‘মৃয়তে অনয়া’, আর ‘মা-যা’ অর্থাৎ যাহা নয় । রবিঠাকুরের বিসর্জন নাটকে তিনি বলছেন মহামায়া মানে মহামিথ্যা, এই মহামিথ্যার পাল্লায় পড়ে এই misconception, separate interest আমাদেরকে ঘোরাচ্ছে । এখন এসব থেকে বেরুনোর উপায় বলতে গিয়ে বলেছেন—

যজ্ঞার্থাৎ কম্মণোঽন্যত্র লোকঽয়ং কর্ম্মবন্ধনঃ ।

(গীতা)

     যজ্ঞ মানে ভগবদর্পিত নিষ্কাম-কর্ম অর্থাৎ ভগবৎ-প্রীতি সাধক কর্মই হচ্ছে যজ্ঞ । Action Reaction অর্থাৎ আমি আজ যাকে খাচ্ছি সে একদিন আমাকে খাবে এভাবে চলতে থাকবে আর এ হোতে বেরুনো অত্যন্ত কঠিন, কেবল ঐ কৌশল দিয়ে বেরুতে হবে, ‘যোগ কর্মসুকৌশলম্ ।’ যোগ কি ? সমস্ত কামনা বাসনা বিসর্জন দাও, লাভ লোকসান, জয়-পরাজয়, সুখ-দুঃখ সব বিসর্জন দিয়ে infinite -এর সঙ্গে কানেকশন্ কর । সেই প্লেনে যে ওয়েভ চলছে সেই ওয়েভের সঙ্গে তুমি হারমনিতে এস, এটি বাঁচবার বাঁচাবার শুধু নয়, এহল প্রকৃত সমৃদ্ধময় জীবন ।
     Land of dedication সেটা, সেখানে প্রত্যেকটা ইউনিট শুধু দেয়, নেয় না । ব্যাংকে টাকা জমা করে চেক কাটেনা । অর্থাৎ পরমেশ্বরকে শুধু সেবা করে যাওয়া বিনিময়ে কিছুর প্রত্যাশা নয় । এখানে exploitation করে বাঁচা মানেই একে অপরকে খাওয়া, আর সেখানে প্রত্যেকে কেবল নিজেকে দেয় । সেবা করে সেখানে আনন্দ পাওয়া যায় । চন্দন ঘষলেই যেমন অতি সুন্দর সৌরভ উঠে তেমনি প্রত্যেকে সেবা করছে বলে সেখানে হলাহলের পরিবর্তে অমৃত উত্থিত হচ্ছে । সুতরাং, এই আত্মদান সেটার আবার দুই স্তর । প্রথম স্তরে বৈকুন্ঠতে সেটা constitutional, আইন মেনে চলা, শাস্ত্র মেনে চলা আর উপরে সেটা continious—অটোমেটিক love of labour, সেখানে প্রত্যেকে নিজেকে বিতরণ করছে । এই হলো গোলক-বৃন্দাবনের পরিচয় । সেখানে শ্রীকৃষ্ণ তিনিই হচ্ছেন Reality the Beautiful, আর এই জগত শাসন করবার মূল কারণ হচ্ছে প্রীতি, সৌন্দর্য্য—সত্যম্-শিবম্-সুন্দরম্, সৎ-চিৎ-আনন্দ, তিনিই প্রাইম কজ, তিনিই শাসন করছেন । এই সবই হচ্ছে মহা প্রভুর চিন্তাধারা । এখন সেখানে যাওয়া যেতে পারা যায় যদি সেইরকম যোগাযোগ করা যায়, মহাপ্রভু বলছেন—

ব্রহ্মাণ্ড ভ্রমিতে কোন ভাগ্যবান্ জীব ।
গুরু-কৃষ্ণ-প্রসাদে পায় ভক্তিলতা-বীজ ॥
মালী হইয়া করে সেই বীজ আরোপণ ।
শ্রবণ-কীর্ত্তন-জলে করয়ে সেচন ॥
উপজিয়া বাড়ে লতা ‘ব্রহ্মাণ্ড’ ভেদি যায় ।
‘বিরজা’, ‘ব্রহ্মলোক’ ভেদি পরব্যোম পায় ॥
তবে যায় তদুপরি ‘গোলক-বৃন্দাবন’ ।
‘কৃষ্ণচরণ’-কল্পবৃক্ষে করে আরোহণ ॥
তাঁহা বিস্তারিত হইয়া ধরে প্রেম ফল ।
ইঁহা মালী সেচে নিত্য শ্রবণাদি জল ॥
প্রেমফল ‘পাকি’ পড়ে মালী আস্বাদয় ।
লতা অবলম্বি মালী কল্পবৃক্ষ পায় ॥
তাহা সেই কল্পবৃক্ষের করয়ে সেবন ।
সুখে প্রেমফল-রস করে আস্বাদন ॥

(চৈঃ চঃ মধ্য ১৯/১৫১-১৬৩)

     এখন গৌড়ীয় সম্প্রদায় কি প্রচার করে ? একটা হচ্ ফচ্ পাঁচ মিশুলি খিচুড়ি পাকিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া, এই প্রকারের নয়, সূক্ষ্ম বিচার, শাস্ত্রের চুল-চেরা বিচার করে গোস্বামীগণ দেখিয়ে গেছেন, মহাপ্রভুর প্রেরণা অনুসারে শ্রীসনাতন গোস্বামী, শ্রীরূপ গোস্বামী, শ্রীজীব গোস্বামী দেখিয়ে গেছেন । আর গৌড়ীয় মঠ মানে Comparative study of Theology ।
     প্রশ্নঃ যে গোলকের কথা বলা হচ্ছে সেখানে কি ভাবে যাওয়া যেতে পারে ?
     গুরুমহারাজঃ হাঁ, সেখানে যাবার উপায় আছে, আদৌ শ্রদ্ধা এই লাইনে যেতে হবে । শ্রদ্ধা কাকে বলে ? ‘শ্রদ্ধা শব্দে বিশ্বাস কহে সুদৃঢ় নিশ্চয় / কৃষ্ণে ভক্তি কৈলে সর্ব কর্ম কৃত হয় ।’ এই ধরনের একটা সেন্ট্রাল ট্রুথ আছে—

যস্মিন জ্ঞাতে সর্ব্বমিদং বিজ্ঞাতং ভবতি
যস্মিন প্রাপ্তে সর্ব্বমিদং প্রাপ্তং ভবিত ॥

     যাঁকে জানলে সব জানা হয়ে যায়, যাঁকে পেলে সব পাওয়া হয়ে যায়, সাধারণ লোক বলবে এটা পাগলামি বা বোকামীর কথা কিন্তু এইটাই আসল কথা, ভাগবতে দৃষ্টান্ত দিয়ে বলছেন—

যথা তরোর্মূলনিষেচনেন
তৃপ্যন্তি তৎষ্কন্ধ ভুজোপশাখাঃ ।
প্রাণোপহারাচ্চ যথেন্দ্রিয়ানাং
তথৈব সর্ব্বার্হনমচ্যুতেজ্যা ॥

     —যেরূপ বৃক্ষের মূলদেশে সুষ্ঠরূপে জল সেচন করলেই ঊহার স্কন্ধ শাখা, উপশাখা, পত্রপুষ্পাদি সকলেই সঞ্জীবিত হয়, প্রাণে আহার্য্য প্রদান করলে যেরূপ সমস্ত ইন্দ্রিয়েরই তৃপ্তি সাধিত হয়, সেইরূপ একমাত্র শ্রীকৃষ্ণের পূজা দ্বারাই নিখিল দেব পিত্রাদির পূজা হইয়া থাকে । গীতাতে ভগবান বলছেন—

সর্ব্বধর্ম্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ । অহং ত্বাং সর্ব্বপাপেভ্য মোক্ষয়িস্যামি মা শুচঃ ॥

     তার justification কি ? আমার মনে আছে ছেলে বেলায় যখন ঝোক ছিল সাধু হয়ে যাব তখন গীতা পড়তে গিয়ে—শ্রেয়ান্ স্বধর্ম্মো বিগুণঃ পরধর্ম্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ । স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম্মো ভয়াবহঃ ॥
     এই জায়গায় ঘাবড়ে যেতাম যে বেশী বাড়াবাড়ি করব না—পরধর্ম্ম ভয়াবহ । কিন্তু যখন আবার ‘সর্ব্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ’ এই শ্লোকের চিন্তা করতাম তখন গায়ে বল হয়ে যেত ।
     একটা কনষ্টিটিউশানেল মেথড্ আর একটা বৈপ্লবিক মেথড্ । ‘সর্ব্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ’ এর জাষ্টিফিকেশন হচ্ছে, যে যেখানে আছ সমস্ত কর্তব্য পরিত্যাগ করে আমার দিকে এগোও, আমি রক্ষা করব চিন্তা নেই । এরকম আশ্বাসবাণীর ঘোষণা দিচ্ছেন, যেখানে যে পজিসনে আছ সব ছেড়ে Absolute Call এ সাড়া দাও । তখন Relative Call—এর কোন দাম থাকে না । দেশে যখন যুদ্ধ বাধে তখন জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে দেওয়া হয়, তখন গভর্ণমেন্টের ক্ষমতা অনেক বেড়ে যায় তখন সাধারণের সম্পত্তি গভর্ণমেন্টের অধিকারে এসে যায় । সুতরাং Absolute Call মানেই যে যেখানে যে পজিসনে আছ আমার দিকে এগোও আমি দেখব ।
     সুতরাং শ্রদ্ধা, ভক্তি এসব থাকা চাই । ভক্তি জন্মে কোথা হতে, ‘ভক্তিস্তু ভগবৎ ভক্ত-সঙ্গেন পরিজায়তে, ভক্তি জন্মে ভক্তের সঙ্গে । ‘কৃষ্ণভক্তি জন্ম মূল হয় সাধুসঙ্গ’, দীপ থেকে যেমন দীপের জন্ম তেমনি সাধুর ভেতর যে ফ্লেম ঐ ফ্লেম জ্বালিয়ে নাও তোমার হৃদয়েতে । আর সাধুসঙ্গ পাওয়া যায় কি করে ? সুকৃতির দ্বারা । সুকৃতি দুই প্রকার, জ্ঞাত সুকৃতি আর অজ্ঞাত সুকৃতি হয় । সেটা জেনেও হতে পারে না জেনেও হতে পারে । আমার অজানা অবস্থায় হলে অজ্ঞাত সুকৃতি । তারপর শ্রদ্ধা faith ভেতরে এসে যায় । শ্রদ্ধা বা faith এবং সেটি প্রকৃত faith হওয়া চাই । প্রকৃত faith তাকে শ্রদ্ধা বলে । ‘শ্রদ্ধাময়োং লোক’ উপনিষদে এই কথা বলেছেন । যেমন কান থাকলে শব্দ জগৎ আছে । চোখ থাকলে রূপ জগৎ আছে তেমনি শ্রদ্ধা থাকলে ঐ ভগবৎ-ধাম আছে । শ্রদ্ধার সাহায্যে সেই লোকটাকে দেখা যায়, অনুভব করা যায় ‘বিশ্বপূর্ণ সুখায়তে’ ।

 


 

← ১১. মানব জীবনের কর্ত্তব্য ১৩. আগুন জ্বালো, বাতাস আপনি আসবে →

 

সূচীপত্র:

শ্রীশ্রীগুরু-গৌরাঙ্গ-প্রণতি
নম্র নিবেদন
প্রণতি-দশকম্
শ্রীগুরু আরতি-স্তুতি
শ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ সম্পর্কে
১। আত্মতত্ত্ব ও ভগবৎ-তত্ত্ব
২। জীবের চরম প্রাপ্তি
৩। সমস্যা ও সমাধান
৪। পরমার্থ লাভের পন্থা
৫। বন্ধন মুক্তির উপায়
৬। বৈষ্ণব জীবনে আনুগত্য
৭ । ধর্ম্ম শিক্ষা ও বিশ্বাস
৮ । শ্রীশরণাগতি
৯ । বজীবের স্বাধীন ইচ্ছার নিশ্চয়াত্মক স্বার্থকতা
১০ । সর্ব্বাবস্থায় ভগবানের কৃপাদর্শনেই প্রকৃত সুখ লাভ
১১ । মানব জীবনের কর্ত্তব্য
১২ । ভগবানের সঙ্গে যোগাযোগের উপায়
১৩ । আগুন জ্বালো, বাতাস আপনি আসবে
১৪ । মা মুঞ্চ-পঞ্চ-দশকম্


PDF ডাউনলোড (26.7 Mb)
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥