| |||||||
|
|||||||
শ্রীপুরীধাম মাহাত্ম্য-মুক্তা-মালা গোবিন্দ প্রভুর শিক্ষা
শ্রীঈশ্বর পুরীর শিষ্য হয়ে গোবিন্দ প্রভু মহাপ্রভুর গুরুভাই ছিলেন । কিন্তু গুরুভাই হয়েও তিনি শিষ্য রূপে তাঁকে সম্মান করতেন । এক দিন গোবিন্দ ঈশ্বরপুরীর কাছে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “প্রভু, আপনি চলে গেলে আমি কার সেবা করব ?” ঈশ্বরপুরীর বললেন, “তুমি কাঁদছ কেন ? আমার পরে তুমি মহাপ্রভুর সেবা করবে । কান্নাকাটি করার দরকার নেই ।” কিছুদিন পরে শ্রীঈশ্বরপুরী দেহ ছেড়ে দিয়ে স্বধামে চলে গেলেন আর গোবিন্দ তাঁর গুরুর আদেশ অনুসারে মহাপ্রভুর চরণে এসে পড়লেন । এসে উনি বললেন, “প্রভু, আপনার সেবার জন্য আমাকে নিয়ে নিন ।” মহাপ্রভু বললেন, “সেটা কি করে হয়, প্রভু ? আমি শুনেছি যে, ‘গুরুর কিঙ্কর হয় মান্য সে আমার’—গুরুদেবের সেবককে মান্য করতে হয় আর আমি কি করে তোমাকে নিজের সেবায় লাগাব ? আমি যদি গুরুভাইকে নিজের সেবায় লাগিয়ে দিই দেখলে, সবাই বলেবে যে, আমি অন্যায় করছি ।” তবে শ্রীঈশ্বর পুরীর শিষ্য হয়ে গোবিন্দ প্রভু খুব বুদ্ধিমান ছিলেন । ইনি মহাপ্রভুকে জিজ্ঞেস করলেন, “প্রভু, ঐসব গ্রন্থে লেখা আছে, কিন্তু আপনার গুরুদেব বলে দিয়েছেন যে, আমাকে আপনার সেবা করতে হবে, তাই আপনি কোনটা মানবেন ? গ্রন্থ মানবেন না গুরুদেবের কথা মানবেন ?” মহাপ্রভু হেরে গেলেন—আর কিছু বলতে পারলেন না । স্বরূপ দামোদর, রামানন্দ রায়ও ওখানে ছিলেন, তাঁরা উভয় বললেন, “গোবিন্দ ঠিকই বলছেন, প্রভু !” তখন মহাপ্রভুর আর কোন উপায় নেই— তিনি গোবিন্দকে নিজের সেবায় লাগিয়ে দিলেন । সেই সময় থেকে গোবিন্দ প্রভু তাঁর কাছে থেকে তাঁর অন্তরঙ্গ সেবা করতেন । এক দিন গম্ভীরায় একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ লীলা হয়েছিল, তার সিদ্ধান্ত আমাদের বুঝতে হবে । এই সিদ্ধান্তের মূল কথা হচ্ছে যে, ভগবানের সেবার জন্য অপরাধ স্বীকার করা উচিৎ আর নিজের ভোগের জন্য অপরাধের কিঞ্চিৎ মাত্র করা উচিৎ নয় । যেমন আপনাদের প্রতি দিন ঠাকুরকে ফুল দিতে হয়, আর যদি কোন দিন বাগানে ফুল নেই, তাহলে আপনি কী করবেন ? আপনি যদি পাড়া-পড়শির বাগান থেকে কিছু ফুল চুরি করলেন, তখন অসুবিধা কী ? ব্রজগোপীরা চিন্তা করলেন, “ভগবানের জন্য পায়ের ধূলা দিলে আমাদের কী ক্ষতি হবে ?” কিন্তু ”আমরা পড়ে যাব,” “আমরা মরে যাব,” “আমাদের পাপ হবে”—এসব চিন্তা তাঁরা কোন দিন করেন নি । তাঁদের পা পচা যাক, ছারখার হয়ে যাক, কুষ্ঠব্যাধি হয়ে যাক—তাঁরা কোন চিন্তা করেন নি । তাই এক দিন মহাপ্রভু উদ্দণ্ড-নৃত্য কীর্ত্তন করতে করতে এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন যে সন্ধ্যার সময় তিনি আস্তে আস্তে হেঁটে গম্ভীরায় এসে সেখানেই দরজার সামনেই শুয়ে পড়েছিলেন । গম্ভীরায় দরজাটা খুবই ছোট আর মহাপ্রভু ৭ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা ছিলেন । তাই গোবিন্দ এসে তাঁর পা টিপতে যাচ্ছিলেন কিন্তু পা নাগালে পাওয়া যাচ্ছে না—তখন পাগুলো কী করে টিপবেন ? মহাপ্রভুর মাথা ওদিকে, পা এদিকে, ভিতরেও যেতে পারছেন না । গোবিন্দ মহাপ্রভুকে বললেন, “প্রভু একু সরে শোবেন ? আপনার পাগুলো একটু টিপব ?” মহাপ্রভু বললেন, “আজকে আমি এত ক্লান্ত নড়তে-চড়তেও পারছি না ।” “তবে আমি আপনার পা প্রতি দিন টিপি আর আজ কী হবে ?” “তুমি করবে কি না, এটা তোমার ব্যাপার ।” এইরকম গুরুদেব শিষ্যকে পরীক্ষা করেন । সত্যিকারের যারা শিষ্য, তাদের নিষ্ঠা (sincerity, সিনসিড়িটি) আছে । নিষ্ঠা মানে তারা ভাবেন, “আমি প্রত্যেক দিন যে সেবাটা করি, সেটাই আমার প্রত্যেক দিনই করতে হবে ।” আপনারা যেমন প্রত্যেক দিন পায়খানায় যান, প্রত্যেক দিন টয়লেটে যান, প্রত্যেক দিন খান, তেমন ভগবানকেও সেরকম প্রত্যেক দিন সেবা করতে হবে—প্রত্যেক দিন নিষ্ঠা সহকারে সেবা করতে হবে । আপনারা প্রশ্ন করবেন, “আমি বাড়িতে প্রত্যেক দিন ঠাকুরকে ভোগ লাগাই, ঠাকুরের সেবা করি, কিন্তু এখন রথের সময় এলে কী করা হয় ? আপনার বাড়িতে আলোকচিত্রটা আছে—শ্রীশ্রীগুরু-গৌরাঙ্গ-গান্ধর্ব্বা-গোবিন্দসুন্দরজিউ বা শ্রীশ্রীগুরু-গৌর-নিত্যানন্দ বা গুরুদেবের আলোকচিত্র । সব আলোকচিত্রের বিগ্রহ যেখানেই আছে, সেখানেও তাঁদের ভোগ হচ্ছে—নবদ্বীপ, একচক্র, নৃসিংহ পল্লী, ইত্যাদি, সব স্থানে ঠাকুরের ভোগ লাগানো হয় । সেইজন্য কোন অপরাধ হবে না, ভগবান ওখানে খেতে পারছেন । কিন্তু যদি আপনারা বিগ্রহ রাখেন, তাহলে ভোগ দিতে হবেই, বিগ্রহ ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারবেন না । বিগ্রহের সেবা কখনও ছেড়ে দিয়ে হবে না । তাই গোবিন্দের নিষ্ঠা এইরকম ছিল—তিনি ভাবলেন, “আমি প্রতি দিন এই সেবাটা করি আর আজকে আমি সেটা বন্ধ করব ? আমি প্রভুকে জোর করে সরাতেও পারি না...” তখন তিনি কী করলেন ? তিনি নিজের উত্তরীয় খুললেন আর তাকে মহাপ্রভুর শরীরের উপরে বিছিয়ে দিয়ে প্রভুকে ডিঙ্গিয়ে ভিতরে চলে আসলেন । যে ধুলা উত্তরীয়ে পড়ল, তিনি সে সব ধূলা মাথায় নিয়ে রাখলেন । তখন তিনি ঘরে ভিতরে বসে ভাল করে মহাপ্রভুর পা টিপে দিয়েছিলেন । মহাপ্রভুর বিশ্রাম হয়ে গেছে আর গোবিন্দ আস্তে আস্তে পা টেপা বন্ধ করে দিলেন আর ঘরের কোণে বসে ঘুমিয়ে পড়লেন । মহাপ্রভুর গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে গেল । তিনি উঠে দেখলেন যে, গোবিন্দ ওখানে বসে আছেন, তিনি তাঁকে ডেকে বললেন, “আরে গোবিন্দ ! তুমি বসে আছ এখানে কেন ? তুমি ঘুমাতে যাও নি ? প্রসাদ পেতে যাও নি ?” গোবিন্দ বললেন, “প্রভু, আপনি তো দরজার সামনে শুয়ে আছেন, আমি আপনাকে ডিঙ্গিয়ে কি করে যাব ?” “মানে ? তুমি কি করে ভিতরে ঢুকলে ? নিশ্চয়ই ডিঙিয়ে চলে আসলে !” “প্রভু ওই সময় আমি এসেছি আপনার সেবা করার জন্যই, কিন্তু নিজের আত্মেন্দ্রিয় তর্পণ করবার জন্য (পেট ভর্তি করবার জন্য না ঘুমাবার জন্য) আমি আপনাকে ডিঙ্গিয়ে যেতে পারি না । আমি এত অপরাধ করতে পারি না ।” তাঁর কথা শুনে মহাপ্রভু খুশি হলেন । এই লীলার অর্থটা বুঝতে হবে । ভগবানের সেবার জন্য গোবিন্দ ভিতরে ভগবানকে ডিঙ্গিয়েও চলে এলেন কিন্তু নিজের ভোগের জন্য, নিজের প্রসাদ পাওয়ার জন্য তিনি মহাপ্রভুকে ডিঙ্গিয়ে গেলেন না, অপরাধ করলেন না ।
|
অনন্তশ্রীবিভূষিত ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংসকুলচূড়ামণি বিশ্ববরেণ্য জগদ্গুরু শ্রীশ্রীমদ্ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের পদ্মমুখের হরিকথামৃত
সূচীপত্র
সূচনা : |
||||||
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥ | |||||||
© Sri Chaitanya Saraswat Math, Nabadwip, West Bengal, India. For any enquiries please visit our contact page. |