| |||||||
|
|||||||
শ্রীপুরীধাম মাহাত্ম্য-মুক্তা-মালা শ্রীরঘুনাথদাস গোস্বামীর শ্রীপুরীধামে
নবদ্বীপ থেকে পুরী আসবার সময় এক দিন যখন শিবানন্দ সেন কিছু দেরি করে ফেললেন, তখন নিত্যানন্দ প্রভু রেগে গিয়ে বললেন, “ওর দুটো পুত্র মরে যাক !” যখন শিবানন্দ সেন এসেছিলেন, তাঁর স্ত্রী তাঁকে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “সাধুটি অভিশাপ দিয়েছেন যে, আমাদের দুটো ছেলে মরে যাবে !” কিন্তু শিবানন্দ সেন নাচতে নাচতে বললেন, “তুমি বুঝতে পারছ না ! এটা হচ্ছে আশীর্বাদ, এই অভিশাপ মোটেও নয় ! তোমার ছেলেদের মৃত্যু হলে তাদের পরম কল্যাণ হবে ।” আমরা বুঝতে পারছি না, বড় বড় বৈষ্ণবগণের কিরকম কৃপা হয় । আপনারা রঘুনাথদাস গোস্বামীর কথা নিশ্চয় শুনেছেন । যখন রঘুনাথ দাস গোস্বামী খবর পেয়েছিলেন যে, মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করে কাটোয়া থেকে শান্তিপুরে এলেন, তিনি তখন শীঘ্র করে মহাপ্রভুর কাছে গেলেন । তিনি অল্প বয়স থেকে মহাপ্রভুর কাছে চলে যেতে চেষ্টা করলেন—একবার নয়, দুবার নয়, দশবারও নয় ; তিনি বারবার মহাপ্রভুর কাছে যেতেন কিন্তু মহাপ্রভু তাঁকে বারবার ফিরৎ পাঠিয়ে বললেন, “মর্কট বৈরাগ্য করবে না ! বাড়ি ফিরে যাও! বাতুল হইও না !”
মর্কট-বৈরাগ্য না কর লোক দেখাঞা । (চৈঃ চঃ, ২/১৬/২৩৮) “বাঁদরের মত লোক-দেখান বৈরাগ্য করতে হবে না ! ঘরে ফিরে যাও !” এক বার রঘুনাথদাস গোস্বামী হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “প্রভু, আমি আপনার চরণে আসব কি করে ? বাড়িতে বাবা এগারজন পাহাড়াদার রেখে দিয়েছেন—আমি ওখান থেকে পালাব কি করে ?” মহাপ্রভু তাঁকে উপদেশ দিলেন,
সে ছল সেকালে কৃষ্ণ স্ফুরাবে তোমারে । (চৈঃ চঃ, ২/১৬/২৪১) হতাশ হয়ে তিনি ঘরে ফিরে গেলেন । কিন্তু একবার তিনি শুনতে পেলেন যে, নিত্যানন্দ প্রভু সমস্ত ভক্তগণকে নিয়ে পানিহাটিতে চলে এলেন । শুনে তিনি সেই ক্ষণই বাবার অনুমতি নিয়ে সেখানে গেলেন । পানিহাটিতে নিত্যানন্দ প্রভু সমস্ত ভক্তগণকে নিয়ে এক গাছের তলায় বিশ্রাম করে বসে ছিলেন । যখন ভক্তরা দূর থেকে রঘুনাথদাস গোস্বামীকে দেখতে পেলেন (তাঁর বাবাকে সবাই জানতেন কারণ তিনি বিখ্যাত জমিদার ছিলেন, তাই সবাই রঘুনাথদাস গোস্বামীকেও চিনতে পারলেন), তখন একজন নিত্যানন্দ প্রভুকে বলে দিলেন, “দেখুন, দেখুন, প্রভু, রঘুনাথ চলে আসছেন !” যখন রঘুনাথদাস গোস্বামী ঘোড়া থেকে নেমে নিত্যানন্দ প্রভুকে প্রণাম করতে যাচ্ছিলেন, নিত্যানন্দ প্রভু তখন তাঁকে দেখে বললেন, “আয় চোর, এদিকে আয় ! আমি তোমাকে আজ শাস্তি দেব !” কেন তিনি “চোর” বললেন ? রঘুনাথদাস গোস্বামী তো কিছু করেছিলেন না—তিনি কী চুরি করেছিলেন ? “চোর”টা মানে তিনি নিত্যানন্দ প্রভুকে বাইপাস (bypass) করে মহাপ্রভুর কাছে গিয়েছিলেন—গুরু বাদ দিয়ে কি গৌরাঙ্গ পাওয়া যায় ? নিত্যানন্দ প্রভু হচ্ছেন গুরুতত্ত্ব । নিত্যানন্দ প্রভুর কথা শুনে রঘুনাথদাস গোস্বামী জিজ্ঞেস করলেন, “কী শাস্তি দেবেন, প্রভু ?” “আজকে এই যে ভক্তগণ এখানে বসে আছেন, তোমায় সবাইকে চিড়া-দধি দিতে হবে !” “এটা তো শাস্তি নয়, এটা তো হচ্ছে আশীর্বাদ ! কোন অসুবিধা নেই, প্রভু । আমি সব ব্যবস্থা করে দেব ।” আনন্দিত হয়ে যে পয়সা পকেটে ছিল, সে সব পয়সা দিয়ে তিনি দোকানে যা দেখতে পেলেন, সে সব কিনলেন । আর এত বেশী লোক সেখানে এসে গেলেন—অনেকেই গঙ্গা-তীরে জায়গা না পেয়ে গলা পর্যন্ত জলে দাঁড়িয়ে প্রসাদ নিলেন ! প্রসাদ হয়ে যাওয়ার পর নিত্যানন্দ প্রভু খুশি হলেন আর যখন রঘুনাথদাস গোস্বামীপ্রভু নিত্যানন্দ প্রভুর চরণে পড়ে গিয়ে বললেন, “প্রভু আমাকে নিস্তার করুন !” তখন নিত্যানন্দ প্রভু তাঁর মাথার মধ্যে পা রেখে দিয়ে বললেন, “যাও, এবার চলে যাও ! তোমার যে মায়ার বন্ধন ছিল, সে সব বন্ধন থেকে তুমি মক্ত হয়ে গেছ ! বৈষ্ণব সেবা করলে তোমার আর বন্ধন থাকল না । তুমি এবার প্রভুর কাছে চলে যাও ।” তখন সব কিছু ছেড়ে দিয়ে তিনি পালিয়েছিলেন । দেখুন, মায়ার খেলা কী রকম ? সারা দিন বাবার লোক পাহার দিতেন কিন্তু এক দিন নিজের লোক এসে বললেন, “রঘুনাথ, চল আমার সঙ্গে, একটা কাজ আছে ।” তাঁর বাবা কিছু চিন্তা না করে তাঁর সঙ্গে যেতে অনুমতি দিলেন কিন্তু কাজটা করলে তিনি লোকটাকে বললেন, “ঠিক আছে, প্রভু, তুমি বাড়ি ফিরে যাও, আমি পরে আসছি ।” আর আসলে তিনি একবার হাঁটতে হাঁটতে দুমাসের রাস্তা বারদিনে হেঁটে চলে গেছেন । আর তার মধ্যে তিনি শুধু তিনবার খেয়েছিলেন (শুধু মাত্র কিছু দুধ গোয়ালার বাড়িতে খেতেন) । এইভাবে তিনি সব সময় মহাপ্রভুর চিন্তা করতে করতে শ্রীপুরীধামে এসেছিলেন । সেই বার মহাপ্রভু তাঁকে স্বীকার করলেন । সেটা কাঁর কৃপার ফলে হচ্ছিল ? নিত্যানন্দ প্রভুর কৃপায় । সেইজন্য আমরা ভগবানকে দেখছি না, আমরা গুরুকে দেখছি—আমরা গুরুর চরণে আশ্রয় নিচ্ছি । আমাদের গুরুর চিন্তা করতে হবে, “গুরুকে কী ভাবে সন্তুষ্ট করা যায় ?”
তীর্থযাত্রা পরিশ্রম কেবল মনের ভ্রম, এক দিন রঘুনাথদাস গোস্বামী স্বরূপ দামোদরকে বললেন (তিনি মহাপ্রভুর সামনে কিছু বলতেন না, তার পরিবর্তে তিনি সব সময় মহাপ্রভুর সেবকগণ দ্বারা কথা বলতেন), “আমি সব ছেড়ে দিয়ে প্রভুর চরণে শরণাপন্ন হয়েছি, কিন্তু এখন আমার কর্তব্য কী ?” স্বরূপ দামোদর মহাপ্রভুর কাছে গিয়ে তাঁর কথা বলে দিলেন, আর মহাপ্রভু তখন তাঁকে শ্রীউপদেশ দিলেন :
“গ্রাম্যকথা না শুনিবে, গ্রাম্যবার্ত্তা না কহিবে । (চৈঃ চঃ, ৩/৬/২৩৬-৭, ২৩৯) তারপর মহাপ্রভু রঘুনাথদাস গোস্বামীকে তাঁর অন্তরঙ্গ সেবক স্বরূপ দামদরের হাতে দিলেন আর রঘুনাথদাস গোস্বামী ওইরকম শ্রীপুরীধামে ১৬ বছর ধরে মহাপ্রভুর অন্তরঙ্গ সেবা করলেন । রঘনাথদাস গোস্বামী একজন বড় ও ধনী জমিদারের পুত্র ছিলেন । যখন তাঁর বাবা বুঝতে পেরেছেন যে, তিনি ফিরে আসবেন না, তিনি তখন প্রতি মাস তাঁর জন্য ৪০০ টাকা পাঠাতে শুরু করলেন । প্রথমে রঘনাথদাস গোস্বামী টাকাটা স্বীকার করে মাসে দুটো দিন ধরে সমস্ত বৈষ্ণবগণকে নিমন্ত্রণ করে বিরাট বৈষ্ণবসেবা উৎসব করতে লাগলেন । সেইভাবে দুটো বছর কেটে গেল । সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুঝতে পরেছেন যে, মহাপ্রভু সেটা দেখে বেশী পছন্দ করলেন না কারণ তাঁর প্রতিষ্ঠা আসতে লাগলেন : “শুনেছেন তো ? রঘুনাথ বড় বৈষ্ণব হয়ে গেলেন ! তাঁর উৎসবে সবাই আসছেন, সবাই তাঁকে আদর করছেন, সম্মান দিচ্ছেন !” তিনি তখন সব টাকা ফিরৎ দিয়ে বাবাকে চিঠি লিখেছেন, “টাকা দিতে হবে না, আমি আর কিছু নেব না ।” ওই সময় থেকে তিনি সব উৎসব বন্ধ করে দিলেন । একদিন মহাপ্রভু স্বরূপ দামোদরকে জিজ্ঞেস করলেন, “স্বরূপ, কী হয়েছে ? আমি শুনেছি রঘুনাথ বৈষ্ণবসেবা উৎসব বন্ধ করেছে ? কেন ? তিনি আর কাউকে নিমন্ত্রণ করছে না ?” স্বরূপ দামোদর আবার মহাপ্রভুকে বুঝিয়ে দিলেন যে, তাঁর প্রতি প্রতিষ্ঠা আসছিল কাজে রঘুনাথদাস গোস্বামী বাবার টাকা ছেড়ে দিয়ে আর উৎসন আয়োজন করতেন না । এটা শুনে মহাপ্রভু খুব খুশি হলেন কিন্তু রঘুনাথদাস গোস্বামীকে কিছু বললেন না । এদিকে রঘুনাথদাস গোস্বামী কিরকম জীবনযাপন করতে শুরু করলেন ? প্রথমে স্বরূপ দামোদর তাঁকে মহাপ্রভুর প্রসাদ কিছু দিলেন বা যখন কেউ বৈষ্ণব সেবা করছিলেন তখন তিনি সেখানে গিয়ে কিছু প্রসাদ পেলেন, কিন্তু এক দিন তিনি ভাবলেন, “এটা ঠিক নয় । আমি বরং জগন্নাথ মন্দিরে গিয়ে বাহিরে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করব । যখন রাতের সময় কেউ প্রসাদ নিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে যাবেন, তখন লোকটি আমাকে কৃপা করে নিশ্চয় কিছু দেবেন ।” তাই করলেন । কিন্তু কিছু দিন পরে তিনি আবার ভাবলেন, “সিংহদ্বারে ভিক্ষা-বৃত্তি—বেশ্যার আচার ! যদি আমি কারও কাছ থেকে কিছু আশা করি, সেটা বেশ্যার ব্যবহার । আমি প্রসাদের জন্য অপেক্ষা করছি, যে কোন সময় কেউ বেড়িয়ে যাচ্ছেন, আমি তাঁর প্রতি কিছু আশা করি আর যখন লোকটি আমাকে কিছু দেবেন না, আমি বিরক্ত হয়ে যাই । এটা তো ঠিক নয় ! বৈষ্ণব কারও কাছে কিছু আশা করেন না ।” তখন তিনি এটাও ছেড়ে দিয়ে ভিক্ষা আর করলেন না । তিনি তখন চরম বৈরাগ্য প্রকাশ করলেন । জগন্নাথ মন্দিরের পাশে এক জায়গা ছিল যেখানে সব দোকানদার পচা প্রসাদ রাখতেন—যে তাঁরা কয়েক দিন পরে বিক্রি করতে পারতেন না, যে প্রসাদ দুর্গন্ধের জন্য গরুও খেতেন না, সে ভাত প্রসাদ রঘুনাথদাস গোস্বামী প্রভু রাতে চয়ন করে জল দিয়ে ধুয়ে কিছু লবণ দিয়ে নিতেন । এক দিন রঘুনাথ দাস গোস্বামীর খাওয়া দেখে স্বরূপ দামোদর হেসে বললেন, “তুমি কী খাচ্ছ ? আমাকে কিছু দিচ্ছ না কেন ?” তখন জোর করে কিছু হাতে নিয়ে খেয়ে ফেললেন, “হাই, তুমি প্রতি দিন এত অমৃত খাও আর আমাদের দিচ্ছ না ! কি তোমার প্রকৃতি ?” যখন মহাপ্রভু স্বরূপ দামদরের কাছ থেকে শুনলেন যেরকম রঘুনাথদাস গোস্বামী খেতেন, তখন তিনিও পরের দিন নিজে তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, “আরে, তুমি কী সব জিনিস খাও আর আমাকে দিচ্ছ না কেন ?” তখন তিনিও জোর করে এক গ্রাস নিলেন আর যখন দ্বিতীয় গ্রাস নিতে যাচ্ছিলেন, তখন স্বরূপ দামোদর তাঁকে থামালেন, “ছেড়ে দাও, প্রভু ! সেই খাবার তোমার যোগ্য নয় ।” মহাপ্রভু বললেন, “প্রতি দিন আমি নানারকম প্রসাদ খাই কিন্তু এর মত স্বাদ আমি কোন দিন পাই নি !” তার আগে যখন মহাপ্রভু শুনলেন যে, রঘুনাথদাস গোস্বামী ভিক্ষা করতে বন্ধ করলেন (আর কী কারণে তিনি এটা করতে বন্ধ করলেন), তখন তিনি অত্যন্ত খুশি হয়ে তাঁকে তাঁর শ্রেষ্ঠ গোবর্দ্ধন-শিলা ও গুঞ্জামালা দিলেন । রঘুনাথ দাস গোস্বামী নিষ্ঠা-প্রীতি সহকারে এই শিলা ও গুঞ্জামালা আরাধানা করতে লাগলেন । তাঁর অতি বৈরাগ্য, আচরণ, নিয়ম-পালন ও নিষ্ঠার তুলনা নেই । তিনি সাড়ে বাইশ ঘণ্টা হরিনাম করতে করতে নিজেকে সেবায় নিযুক্ত করতেন আর যখন তিনি সময় পেতেন, তখন বাকি দেড় ঘণ্টা স্নান করতেন এবং বিশ্রাম, প্রসাদ নিতেন । সেইভাবে তিনি ১৬ বছরে ধরে পুরিতে সেবা করে থাকলেন । যখন মহাপ্রভু অগোচর হয়ে গেলেন, তিনি তখন অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবার জন্য বৃন্দাবনে চলে গেলেন কিন্তু সেখানে গিয়ে রূপ-সনাতন গোস্বামীর সঙ্গ লাভ করে তিনি নতুন জীবন পেলেন... ।
|
অনন্তশ্রীবিভূষিত ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংসকুলচূড়ামণি বিশ্ববরেণ্য জগদ্গুরু শ্রীশ্রীমদ্ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের পদ্মমুখের হরিকথামৃত
সূচীপত্র
সূচনা : |
||||||
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥ | |||||||
© Sri Chaitanya Saraswat Math, Nabadwip, West Bengal, India. For any enquiries please visit our contact page. |