| |||||||
|
|||||||
শ্রীপুরীধাম মাহাত্ম্য-মুক্তা-মালা ছোট হরিদাসের শাস্তি
যদি চাহ প্রণয় রাখিতে গৌরাঙ্গের সনে । (শ্রীশ্রীপরেমবিবর্ত, ৭/১২) শাস্ত্রে লেখা আছে যে, মহাপ্রভুর সাড়া তিন জন অন্তরঙ্গ সেবিকা ছিল : রায় রামানন্দ, স্বরূপ দামদার, শিখি মাহিতি হচ্ছে তিনজন আর বাকি অর্ধেক হচ্ছে শিখি মাহিতির ভগ্নী শ্রীমাধবীদেবী । যখন আমি রাশিয়ায় গিয়েছিলাম, আমি ওখান একবার বড় বিপাদে পড়েছিলাম—গুরুদেব আমাকে উদ্ধার করে দিয়েছেন । সেই দিন সন্ধ্যার সময় অনেক মঠের দেশি-বিদেশি সন্ন্যাসীরা স্টেজের উপরে বসে ছিলেন । গুরুদেবের অপেক্ষায় থেকে ভক্তরা এদিকে এক এক সন্ন্যাসীকে বিভিন্ন প্রশ্ন করলেন আর এক এক সন্ন্যাসীর কাছে পার্লামেন্টের মত মাইক্রোফোন থাকল । হঠাৎ করে এক মহিলা লাফিয়ে উঠে বললেন, “আচার্য্য মহারাজ সকালবেলা পাঠ করে বললেন যে, মহাপ্রভুর সাড়া তিন জন অন্তরঙ্গ ভক্তরা ছিল আর মাধবীদেবী অর্ধেক ছিল । আমরা মেয়েরা তো অনেক সেবা করি, আমরা কেন অর্ধেক ?” তাঁর সঙ্গে সব মহিলাগুলোও উত্তর পেতে দাবী করে লাফিয়ে উঠে গেল । আমি ভাবলাম, “গুরুদেব, বাঁচাও !” আমার উত্তরই জানা নেই কারণ কোন গ্রন্থে উত্তরটা লেখা নেই, তাই কী করে বলব ? আমি গুরুদেবকে শরণ নিলাম, “গুরুদেব, উত্তর তো তুমি বলে দাও !” তখন সঙ্গে সঙ্গে উত্তরটা মনে এসে… উত্তরটা ছিল ঐরকম : কোলকাতার কাছে গঙ্গার ধারে পানিহাটি নামে গ্রাম আছে, সেখানে রঘুনাথদাস গোস্বামী চিড়া-দধি মহোৎসব করবার ফলে নিত্যানন্দ প্রভুর কৃপা লাভ করেছিলেন । আর সেখানেও প্রত্যেক বছর মহাপ্রভুর জন্য একটি মেয়ে দময়ন্তী নামে শত শত প্রকার বিভিন্ন ভোগ রান্না করতেন । সেই ভোগটা নবদ্বীপ থেকে বেড়িয়ে রাঘব পণ্ডিত হেঁটে হেঁটে পুরীতে নিয়ে আসতেন । এই ভোগের নাম হচ্ছিল ‘রাঘবের ঝালি’—মহাপ্রভু সেটা খুব পছন্দ করতেন আর আনন্দের সহিত স্বীকার করতেন । সেই ভোগ কে বানাতেন ? দময়ন্তী । তিনি সব করতেন কিন্তু তিনি নিজে আসতে পারতেন না—তিনি প্রভুর কাছে নিজে এসে সেবা করতে পারতেন না, নিজে হাতে মহাপ্রভুকে খাওয়াতে পারতেন না । সেই জন্য তাঁকে অর্ধেক সেবিকা বলা হয় । পুরীতে মাধবীদেবীও সব খাবার তৈরি করতেন কিন্তু যে মহাপ্রভুর সামনে তিনি ভালো করে পরিবেশন করে খাওয়াবেন, সেটা তাঁর কপালে কোন দিন হয় নি । তাই তিনি অর্ধেক সেবা করতেন । যখন আমি এসব উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম, তখন মেয়েটি যে প্রশ্ন করেছিলেন, বললেন, “হ্যাঁ, এবার বুঝতে পেরেছি ।” পরে আমি গুরুমহারাজের কাছে গিয়ে বললাম যে, আমি সেই দিন খুব বিপদে পড়েছিলাম । যে প্রশ্ন এসেছিল আর যে উত্তর আমি দিয়েছিলাম, সেটা গুরুমহারাজকে বলে দিলাম । গুরু মহারাজ বললেন, “তোমার সঠিক উত্তর হয়েছে ।” এটা ঘটনা আমার সন্ন্যাস নেওয়ার একবছর পরে ছিল । তাই কথা হচ্ছে সেই মাধবীদেবীর উপরে । এক দিন মহাপ্রভুর ভক্ত ভগবান আচার্য্য ছোট হরিদাসকে তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিলেন কিছু চাল নেওয়ার জন্য (মাধবীদেবীর বাড়ি আলালনাথের কাছে) । ইনি বয়স্ক মহিলা, য়ুবতী সুন্দরী মেয়ে মোটেই নয়, তিনি সব সময় তপস্যা করতে আর সব নিয়মকানন যথাযথ মানতেন । মহাপ্রভু তাঁর সেবা স্বীকার করতেন । ছোট হরিদাস মহাপ্রভুর জন্য ভক্তের আদেশ অনুসারে তাঁর কাছ থেকে কিছু ভাল চাল নিয়ে এসেছিলেন আর প্রসাদ পাওয়ার সময় মহাপ্রভু জিজ্ঞেস করলেন, চালটা কোত্থেকে আসল । ভক্তরা বললেন যে, ছোট হরিদাস সেটা মাধবীদেবীর কাছ থেকে নিয়ে এসেছেন । মহাপ্রভু কিছু বললেন না । প্রসাদ পেয়ে তিনি গম্ভীরায় বিশ্রাম নিতে গেলেন আর ঘরে এসে গোবিন্দকে বললেন, “ছোট হরিদাস এখানে আর আসতে পারবে না । আমি ওর মুখ দেখতে চাই না ।”
প্রভু কহে,—”বৈরাগী করে প্রকৃতি সম্ভাষণ । (চৈঃ চঃ, ৩/২/১১৭)
দুর্ব্বার-ইন্দ্রিয় করে বিষয়-গ্রহণ । “মাতার সহিত, ভগ্নীর সহিত এবং দুহিতার সহিত নির্জ্জনে কখনও থাকিবে না ; কেননা, বলবান্ ইন্দ্রিয়-সমূহ বিদ্বান্-পুরুষেরও মন আকর্ষণ করতে পারে ।” (চৈঃ চঃ ৩/২/১১৭-১১৮) তিনি ভীষণ রেগে গেলেন আর কথাটা শুনে সব ভক্তরা চুপচাপ হয়ে পড়ল । গোবিন্দের কাছ থেকে মহাপ্রভুর কথা শুনে ছোট হরিদাস অবাক হয়ে গেলেন—এমন শাস্তি প্রভু তাঁকে দিলেন ! সমস্ত ভক্তরা মহাপ্রভুর কাছে গিয়ে মিনতি করলেন, “প্রভু, ছোট হরিদাস একটা সামান্য দোষ করেছে । কৃপা করে ওকে ক্ষমা করে দাও । ও খাওয়া-দাওয়া, স্নান-টান সব বন্ধ করে দিয়েছে, এখন অনেক দিন ধরে কিছু না খেয়ে আছে ।” তখন মহাপ্রভু বললেন, “তোমরা যদি আর একবার এর কথা বলবে, তোমরা আমাকে আর এখানে দেখতে পাবে না ।” তখন ভক্তরা আর কিছু বললেন না... এভাবে এক বছর কেটে গেল । মাঝে মাঝে ছোট হরিদাস অনেক দূর থেকে মহাপ্রভুর দর্শন পেতেন—যখন মহাপ্রভু জগন্নাথ মন্দিরে যেতেন, তিনি লুকিয়ে দূরে থেকে তাঁকে দেখতে পেতেন । আর অপেক্ষা করতে না পেরে, তিনি ঠিক করলেন যে, তিনি যেকোনরকম মহাপ্রভুর পাদপদ্ম লাভ করবেন । প্রযাগে গিয়ে তিনি ত্রিবেণীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলেন । সমস্ত ভক্তরা খুব দুঃখিত হয়ে পড়লেন আর মহাপ্রভু বুঝতে পারলেন, সব ভক্তের মন খারাপ হয়ে পড়ল । এক দিন হঠাৎ করে মহাপ্রভু জিজ্ঞেস করলেন, “আরে, ছোট হরিদাস তো কথায় ? ওকে ডেকে নিয়ে এস ।” ভক্তরা বললেন, “ওকে কি করে নিয়ে আসব ? ও গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছে । আত্মহত্যা করেছে ।” মহাপ্রভু হাসলেন “তাই না ?” আর সবাই অবাক হয়ে গেলেন । মহাপ্রভু বললেন, “তাই তোমরা ভাবছ আমার ভক্ত কখনও আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে পারে ? এটা হতে পারে ?” “প্রভু, ওর শ্রদ্ধাও হয়ে গেল । বৈষ্ণব-সেবাও হয়ে গেল । এখন ওকে পাওয়া কি করে সম্ভব ?” “ঠিক আছে । তোমরা আমাকে বিশ্বাস করছ না ।” আর চিৎকার করে মহাপ্রভু ডাক দিলেন, “আরে হরিদাস !! একটা কীর্ত্তন শুনাও !” ছোট হরিদাস ভাল করে কীর্ত্তন করতে পারতেন । ওই সময় কোন টেপ রেকর্ডার ছিল না, কোন DVD, CD ছিল না—কিন্তু সবাই শুনতে পেলেন যে, ছোট হরিদাস কীর্ত্তন গাইতে শুরু করলেন । সবাই অবাক হয়ে বলেন, “আরে, কোত্থেকে কীর্ত্তনের আওয়াজ আসছে ? ছোট হরিদাস কি ভূত হয়ে গেছে ?” ভগবানের ভক্ত কি কখনো ভূত হয় ? পেত্নী হয় ? আত্মহত্যা করলেও, কখনও ভূত হয় না । মহাপ্রভু তখন বললেন, “আমি যেখানে থাকি, আমার ভক্ত সেখানে আমার কাছেই থাকে ।” সেই ভাবে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু লোককে শিক্ষা দিয়েছিলেন ।
|
অনন্তশ্রীবিভূষিত ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংসকুলচূড়ামণি বিশ্ববরেণ্য জগদ্গুরু শ্রীশ্রীমদ্ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের পদ্মমুখের হরিকথামৃত
সূচীপত্র
সূচনা : |
||||||
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥ | |||||||
© Sri Chaitanya Saraswat Math, Nabadwip, West Bengal, India. For any enquiries please visit our contact page. |