| |||||||
|
|||||||
শ্রীপুরীধাম মাহাত্ম্য-মুক্তা-মালা শ্রীআলালনাথের কথা
শ্রীপুরুষোত্তমের পাশে সমুদ্রের তীরে প্রয় ৬ ক্রোশ দূরে ব্রহ্মগিরি বা আলালনাথ নামে একটা সুপ্রাচীন দিব্য স্থান আছে । এই স্থানে ব্রহ্মা সত্যযুগে বিষ্ণুর পূজা করতেন কাজেই সেই স্থানের নামও হচ্ছে ব্রহ্মগিরি । ভগবানের পার্ষদগণকে (‘ভক্ত’ বা ‘devotee’) তামিল ভাষায় বলা হয় ‘আলোয়ার’ বা ‘আলবর’, তাই অলরনাথের নামের অর্থ হচ্ছে ‘আলবর নাথ’ বা ‘ভক্তদের নাথ’ । এক সময় কয়েক ভক্ত এই স্থানে গিয়ে তার নির্জনতা, পবিত্রতা ও ভগবানের সেবায় আকৃষ্ট হয়ে চতুর্ভুজ শ্রীনারায়ণ মূর্তি স্থাপন করে বারশত কোমা ব্রাহ্মণকে তাঁর সেবায় লাগিয়ে দিলেন । (সেই ভাবে শ্রীনারায়ণের মূর্তির নাম হচ্ছে আলালনাথ আর সেই চতুর্ভুজ নারায়ণ মূর্তির দর্শন আমরা আজও আলালনাথের মন্দিরে পেতে পারি—তাঁর ডান দিকে নিম্ন হস্থে পদ্ম, উর্দ্ধ হস্তে চক্র, বাম দিকে উর্দ্ধ হস্তে শঙ্খ এবং নিম্ন হস্তে গদা আছে ।) এক সময় পূজারী বিপ্র বাহিরে চলে গিয়েছিলেন আর যাওয়ার আগে তিনি তাঁর ছোট ছেলের উপর ভার দিয়ে বললেন, “বাবা, আমি যাচ্ছি, তুই এদিকে সেবা-পূজা করবি ।” সঙ্গে সঙ্গে ভোগ নিবেদন করার সময় হয়েছিল । ছেলেটির মন ছিল সরল—নিবেদনের মন্ত্র কিছু না জেনে সে ভোগটা নিয়ে ঠাকুরের কাছে এসে বলল, “প্রভু, পিতা বিদেশে গমন করেছেন আর আমি অজ্ঞ বালক, কোন মন্ত্র-তন্ত্র জানি না । আপনি কৃপা করে এই ভোগ গ্রহণ করুন ।” আলালনাথের নিকটে এই ভোগ রেখে দিয়ে সে দরজা বন্ধ করলেন আর বাহিরে বাচ্ছা ছেলেদের সঙ্গে খেলা করতে গিয়েছে । ছেলের মা পুত্রকে এইরকম খেলাধুলায় দেখে ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি রে বাবা ! ঠাকুরকে ভোগ দিয়েছিস ? ভোগ সমাপ্ত হয়েছে ?” ছেলেটি বলেল, “হ্যাঁ, দিয়েছি ।” “তাই ভোগ তো কোথায় গেল ?” “মন্দিরের ভিতরে ।” “ভোগ দিয়ে কিছু কাল পরে তো ভোগটা সরাতে হয় । ভোগটা আবার বাহিতে আনতে হয় ! প্রসাদটা বাড়িতে নিয়ে এসে সবাইকে বিতরণ করতে হয় । তুমি কি এটা জানিস না ?” “ঠিক আছে, মা, আমি দেখছি ।” তখন মায়ের আদেশ মতও মন্দিরে ভোগ সরাবার জন্য গেল কিন্তু কোথাও সে ভোগ দেখতে পেল না—যে ভোগটা ও আগে নিয়ে এলেন, সে ভোগটা মন্দিরে আর নেই । ছেলেটি মাকে এটা বলেল, কিন্তু মা ওকে বিশ্বাস করেলন না । ইনি নিজে মন্দিরে গিয়ে ভোগটা কোথাও না দেখে মনে করলেন, “হয়তো এই বদমাশ ছেলে ঠাকুরের ভোগটা সব খেয়ে ফেলেছে আর এখন প্রহারের ভয়ে মিথ্যা কথা বলছে ।” আর ছেলেকে বললেন, “তুই কি সব খেয়ে ফেলেছিস ? তোর লজ্জা নেই ?” “মা আমি কিছু খাই নি! ঠাকুর সমস্ত ভোগ গ্রহণ করেছেন ! আমি কিছু করি নি ! বিশ্বাস কর ।” “তোর পিতা ষোড়শোপচারে আলালনাথের পূজা করে কিন্তু ভগবান কোন দিনই কিছু ভক্ষণ করে ফেলেন না । আর তুই ভগবানের পূজা-বিধি কিছুই জানিস না, কোন মন্ত্র জানিস না, আর একবার ভোগ নিবেদন করে ভগবান সব তোর ভোগ খেয়ে নিলেন ? এটা কি হতে পারে ? তুমি কি আমার সঙ্গে চালাকি করছিস ?” কিছু সময় পরে ছেলের বাবা বাড়ি ফিরে এলেন । স্ত্রী তাকে সব কথা বলে দিলেন আর ব্রাহ্মণটি বললেন, “ঠিক আছে । তুমি আবার রান্না কর আর আমি ওকে আবার ভোগ নিবেদন করতে পাঠিয়ে দেব । তখন আমরা নিজের চোখে দেখব কি করে ঠাকুর ভোগ গ্রহণ করছেন ।” যখন সব রান্না-বান্না হয়েছিল, তখন ব্রাহ্মণ ছেলেকে ডেকে বললেন, “শুন, বাবা । তুই এই ভোগ নিয়ে মন্দিরে যাও আর ঠাকুরকে নিবেদন কর । মা তোকে বিশ্বাস করছে না, তাই তুমি আবার ওখানে গিয়ে ভোগ লাগিয়ে দাও ।” ছেলেটি বললেন, “ঠিক আছে, বাবা । আমাকে বিশ্বাস কর, আমি কিছু খাই নি ।” তখন ভোগ নিয়ে ও মন্দিরে গেলেন । এদিকে ব্রাহ্মণটি মন্দিরে ছুটে গেলেন আর ওখানে গিয়ে কোণে লুকিয়ে থাকলেন । সেখান থেকে তিনি দেখলেন যে, ছেলেটি ভোগটা ঠাকুরের সামনে রেখেছে আর ঠাকুরকে বলছে, “হে ঠাকুর, আমি মন্ত্র-তন্ত্র জানি না, আপনাকে ভোগ নিবেদন কি রকম করা হয়ও জানি না । বাবা এখন উপস্থিত নেই—তিনি না আসা পর্যন্ত আপনি কৃপা করে ভোগ আমার হাত থেকে গ্রহণ করুন ।” এই বলে ছেলেটি মন্দিরের দরজা আবার বন্ধ করল । তখন বাবা দেখলেন যে, আলালনাথ চার হাত দিয়ে সমস্ত ভোগটা গ্রহণ করছেন । দেখে নিজেকে সংযত করতে না পেরে ব্রাহ্মণটি বললেন, “প্রভু, আপনি যখন সমস্ত ভোগ খেয়ে নিয়েছেন, আমরা তখন কি করে বাঁচব ? আমরা কি না খেয়ে থাকব ?” তখন শ্রীঅলরনাথ বললেন, “আমি তোমার বালকের প্রীতিতে সমস্ত ভোগ ভক্ষন করেছি । তুমি আমার থেকে কী বর চাও ? বল ।” পূজারী ব্রাহ্মণ বললেন, “ আমি আর কি বর চাইব ? আপনি যখন আমার প্রাপ্য সমস্ত ভক্ষণ করেন তখন আমাদের অনাহারে প্রাণ ত্যাগ করতে হবে । আমি আর কি বর চাইব ? আমার সব খাওয়া দাওয়া সব শেষ ! আপনি সব খেয়ে নিয়েছেন !” শ্রীআলালনাথ বললেন, “শুন বিপ্র । আজ থেকে আমি আর তোমার প্রদত্ত কোন বস্তু গ্রহণ করব না । এই জগতে যা কিছু আছে আমার ভোগের জন্য—আমি যা কিছু প্রদান করি, সেই সব তোমার আমার উচ্ছিষ্টরূপে গ্রহণ করার অধিকার আছে । কিন্তু তোমরা অহঙ্কারে বশীভূত হয়ে ‘আমার বল’, ‘আমার খাওয়া’, ‘আমার পরা’, ‘আমার ঠাকুর’, ‘আমার বাড়ি’, ‘আমার গাড়ি’—সব সময় ‘আমার’ ‘আমার’ কর—সেইজন্য শুধু তোমার ছেলে আমার ধামে পৌঁছাতে পারবে আর তুমি ও তোর স্ত্রী-স্বজন অচিরাৎ ধর্ম্মগত থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে ।” যখন আপনারা ভগবানকে কিছু নিবেদন করেন, তখন ভগবান সব গ্রহণ করে আবার তাঁর ভক্তের জন্য সব রেখে দেন—এই বিশ্বাস থাকতে হব । সেটা হচ্ছে আলালনাথের মন্দিরের মাহাত্ম্য । মহাপ্রভু কেন এখানে এসেছিলেন ? আপনারা যদি জগন্নাথ রথযাত্রার কিছু আগে মন্দিরে যাবেন, তখন জগন্নাথ দর্শন করতে পারবেন না কারণ জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা পরে ১৫ দিন ধরে তিনি অসুস্থ লীলা প্রকাশ করেন—ওই সময় তাঁকে আয়ুর্বৈদিক পাঁচন খাওয়ায় আর এদিকে ভক্তরা রথের জন্য সব ব্যবস্থা করেন । এই ১৫ দিন ধরে জগন্নাথ মন্দির বন্ধ থাকে আর রথের আগের দিন আবার খুলে যায় । সেই সময় মহাপ্রভুর মন খুব দুঃখিত হয়ে পড়ল কারণ তিনি জগন্নাথ মন্দিরে প্রতি দিন যেতেন আর সেই সময় যেতে পারলেন না । তখন এক দিন জগন্নাথদেব তাঁকে বললেন, “আলালনাথ গেলে তুমি আমাকে দেখতে পাবে ।” তিনি সেইক্ষণই সেখানে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলেন । তিনি অত্যন্ত বিভোর হয়ে পড়লেন—বিকার লাভ হয়ে তিনি এখানে এসে প্রণাম করলেন আর তাঁর প্রণামের ফলে যেখানে তিনি শুয়ে পড়লেন, সেখানে পুরো পাথরটা গলে গিয়েছিল—যেখানে তাঁর গা পাথরটা স্পর্শ করল, সেখানে দাগ রইল । সেই পাথরটা এখনও বিদ্যমান আছে—আলালনাথে গিয়ে সব দেহের দাগগুলো পাথরটার মধ্যে দেখতে পাবেন । তাঁর এত ভক্তি, এত ভগবানে প্রীতি ছিল...
দেখ ওরে ভাই ত্রিভুবনে নাই এমন কি পশু-পাখীও নিতাইগৌরের গুণ কীর্ত্তন শুনে কাঁদতে শুরু করলেন, কিন্তু আমরা তো এত নিষ্ঠুর যে আমার মন পাষাণের চাইতে কঠিন কারণ আমরা কৃষ্ণকথা, গৌরাঙ্গ কথা, নিত্যানন্দ প্রভুর কথা শুনে কাঁদছি না । আমরা এখানে আসি কি জন্য ? আলালনাথের সেবা করবার জন্য আর যেহেতু ওখানে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু এসেছিলেন ।
গৌর আমার যে সব স্থানে করল ভ্রমণ রঙ্গে । গৌর যে সব স্থানে গিয়েছেন আমরা ভক্তের সঙ্গে সেই স্থানে যাই । নিজে নিজে যাব না । আমরা পূজনীয় বৈষ্ণবগণের সঙ্গে এখানে এসেছি । আমি আপনাদেরকে গুরুদেবের আদেশ অনুসারে এখানে নিয়ে এসেছি আর তাঁর শ্রীমুখে যে কথা শুনেছি তাই আপনাদেরকে বলে দিচ্ছি । সে কথা শুনলে, আপনাদের মঙ্গল হবে ।
|
অনন্তশ্রীবিভূষিত ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংসকুলচূড়ামণি বিশ্ববরেণ্য জগদ্গুরু শ্রীশ্রীমদ্ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের পদ্মমুখের হরিকথামৃত
সূচীপত্র
সূচনা : |
||||||
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥ | |||||||
© Sri Chaitanya Saraswat Math, Nabadwip, West Bengal, India. For any enquiries please visit our contact page. |