| |||||||
|
|||||||
শ্রীপুরীধাম মাহাত্ম্য-মুক্তা-মালা গম্ভীরা—বিরহের জ্বলন্ত ঘর
গম্ভীরার অর্থটা কী ? ‘গম্ভীরা’ মানে ঘরের মধ্যে ঘর । এই খুব ছোট ঘরেই মহাপ্রভু থাকতেন । আমার গুরুমহারাজের কথা মনে পড়ে—যখন তিনি পুরীতে এসেছেন, তিনি এক বার আমাকে একটা প্রশ্ন করলেন, “বিনোদ, তুমি কি জান ওই ঘরের মধ্যে মহাপ্রভু কি করে বাহু তুলে নৃত্য করতেন ? মহাপ্রভু এত লম্বা (৭ ফুত ৬ ইঞ্চ), তিনি অজানুলম্বিত ভুজা (হাতগুলা হাঁটুর নিচে পড়ে) আর গম্ভীরাটা এত ছোট ঘর ।” এই রকম প্রশ্ন গুরুমহারাজ করলেন । কাকেই বা বলব আর কাকেই বা শুনাইব ? সেটা হচ্ছে খুব গভীর কথা । উদ্দণ্ড নৃত্য করলে, ঘর উঁচু হয়ে যায় । ভগবানের কাছে সব কিছুই সম্ভব । এই ঘরে বসে মহাপ্রভু বিপ্রলম্ভ লীলা আস্বাদন করতেন । বিপ্রলম্ভ লীলা মানে বিরহ লীলা ।
অয়ি দীনদয়ার্দ্র নাথ হে “তুমি আমাকে একবার দর্শন দিলে আর দর্শন দিচ্ছ না ।” মহাপ্রভু কে ছিলেন ? যখন এক দিন দ্বাপর-যুগে কৃষ্ণ আমলীতলায় বসে ধ্যান করছিলেন, তখন তিনি যমুনার মধ্যে তাঁর ছবিটা দেখতে পেয়ে ভাবলেন, “বাঃ ! আমি কত সুন্দর !” আর তিনি মনে করলেন, “আমি দেখতে চাই রাধারাণী আমার নাম করে এত কাঁদে কেন ? রাধারাণী আমার সেবা করে কি শান্তি পায় ? সেই রাধার রসটা আমাকে জানতে হবে ! আমি রাধার ভাব ধরে এই কলি-যুগে আসব !” তাঁর ইচ্ছা মত তিনি এই কলি-যুগে শ্রীনবদ্বীপ ধামে জগন্নাথমিশ্র-শচীমাতাকে অবলম্বন করে এবং শ্রীরাধার ভাব ও কান্তি চুরি করে জগতে অবতীর্ণ হলেন । এই গৌরহরিরূপে তিনি দ্বারে দ্বারে যেতে যেতে বলেছেন, “জীব জাগ, জীব জাগ ! কত নিদ্রা যাও মায়া-পিশাচীর কোলে ! জীব, তুমি কত ঘুমাবে ? তুমি উঠ পড় ! তোমরা ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছ ! আমি তোমাকে নিতে এসেছি—আমার সঙ্গে চল, আমি তোমাদেরকে নিজের বাড়িতে পাঠিয়ে দেব !” মহাপ্রভু ১২ বছর ধরে গম্ভীরায় বিপ্রলম্ভ লীলা আস্বাদন করেছেন । যখন মহাপ্রভু নবদ্বীপে (মায়াপুরে) ছিলেন, তিনি তখন এই লীলা প্রকাশ শুরু করলেন । তাঁর মা শচীমাতা হায় হায় করে বললেন, “বিশ্বরূপ চলেই গেছে আর এখন আমার একটি মাত্র ছেলেটি পাগল হয়ে গেছে ! ও অবল-তাবল বলছে । আমি কী করব এখন ?” তিনি ডাক্তারের কাছে গেলেন আর ডাক্তারবাবু তাঁকে বললেন যে, নিমাইকে ঠাণ্ডা তেল মাথায় দিতে হবে । শচীমাতা তাই করলেন । এদিকে শ্রীবাস পণ্ডিত এসে বললেন, “দিদি, তুমি কী করছ ? ওর যা হয়েছে সেটা তেল দিয়ে কিছু হবে না ! আমিও এর মত পাগল হতে চাই ! ওর যা হয়েছে, আমিও সেটা চাই কিন্তু আমার সেরকম ভাগ্য হয় নি ।” শ্রীবাস পণ্ডিতের কথা শুনে মহাপ্রভু হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে পড়ে তাঁর হাত ধরে বললেন, “শ্রীবাস, তুমিও যদি বলতে যে আমি পাগল হয়ে গেছি, আমি গঙ্গায় লাফিয়ে আত্মহত্যা করতাম ! যে অন্তত তুমি বুঝতে পারছ, সেটা আমার ভরসা ।”
কৃষ্ণবর্ণং ত্বিষাঽকৃষ্ণং সাঙ্গোপাঙ্গাস্ত্রপার্ষদম্ । “যিনি ‘কৃষ্ণ’ এই বর্ণদ্বয়-কীর্ত্তনপর কৃষ্ণোপদেষ্টা অথবা ‘কৃষ্ণ’ এই বর্ণদ্বয় কীর্ত্তনের দ্বারা কৃষ্ণানুসন্ধান তৎপর, যাঁহার ‘অঙ্গ’— শ্রীমন্নিত্যানন্দাদ্বৈতপ্রভুদ্বয় এবং ‘উপাঙ্গ’—তদাশ্রিত শ্রীবাসাদি শুদ্ধভক্তগণ, যাঁহার ‘অস্ত্র’—হরিনামশব্দ এবং পার্ষদ—শ্রীগদাধর-দামোদরস্বরূপ-রামানন্দ-সনাতন-রূপাদি যিনি কান্তিতে ‘অকৃষ্ণ’ অর্থাৎ পীত (গৌর), সেই অন্তঃকৃষ্ণ বহির্গৌর রাধাভাবদ্যুতিসুবলিত শ্রীগৌরসুন্দরকে কলিযুগে সুমেধাগণ সঙ্কীর্ত্তনপ্রধান যজ্ঞের দ্বারা আরাধনা করিয়া থাকেন ।” (শ্রীমদ্ভাগবতম্, ১১/৫/৩২)
শ্রীরাধার ভাবে যিনি সুবর্ণ বরণ । (শ্রীলভক্তিবিনোদ ঠাকুর) তখন নবদ্বীণ ছেড়ে দিয়ে মহাপ্রভু শ্রীপুরীধামে এসেছেন আর সেখানে তাঁর শেষ লীলা প্রকাশ করে বাস করতেন । এক দিন জগদানন্দ পণ্ডিত তাঁকে একটি চিঠি নিয়েছেন, চিঠিটা অদ্বৈত প্রভুর কাছ থেকে ছিল ওইরকম :
বাইলকে কহিহ,—লোক হইল বাউল । “মহাপ্রভুকে কহিও যে, লোক প্রেমে উন্মত্ত হইয়াছে, আর প্রেমের হাটে প্রেমরূপ চাউল-বিক্রয়ের স্থল নাই । মহাপ্রভুকে কহিও যে, আউল অর্থাৎ প্রেমোন্মত্ত বাউল আর সংসারিক-কার্য্যে নাই । মহাপ্রভুকে কহিও যে, প্রেমোন্মত্ত হইয়াই অদ্বৈত একথা কহিয়াছে । তাৎপর্য এই যে, প্রভুর আবির্ভাব হইবার যে তাৎপর্য্য ছিল, তাহা সম্পূর্ণ হইল, এখন প্রভুর যাহা ইচ্ছা, তাহাই হউক ।” (চৈঃ চঃ ৩/১৯/২০-২১) এই কবিতা পড়ে মহাপ্রভু গম্ভীর হয়ে পড়লেন । স্বরূপ দামোদর জিজ্ঞেস করলেন, “প্রভু, তার অর্থটা কী ?” মহাপ্রভু বললেন, “আমি আসল অর্থটা জানি না, কিন্তু অদ্বৈত আচার্য্য বড় পূজক—সে প্রথম দেবকে পূজা করবার জন্য দেবকে নিমন্ত্রণ করে, আর একটু পরে তার পূজা শেষ করে দেবকে বিদায় করে দেয় । বোধহয় আদ্বৈত ভাবছে যে, দেবের চলে যাওয়ার সময় হয়েছে ।” সেই কাল থেকে মহাপ্রভুর লীলা অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে গেল—তিনি সব প্রচার বন্ধ করে শেষ দিনগুলো বিরহের জ্বালায় কেটেছেন ।
বাঁশি বারণও মানে না, কথা যে শুনে না, এই বিরহের জ্বালায় শ্রীগৌরহরি রাধিকার ভাব ধরে কৃষ্ণের জন্য উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন । ব্রজগোপীরা বললেন, “কৃষ্ণ, তুমি আমাদেরকে বৃন্দাবন ছেড়ে চলে গিয়েছ—আমাদের যত কাঁদিয়েছ, তোমাকেও তত এই জগতে এসে কাঁদতে হবে !” সেইরকম লীলা গম্ভীরায় হয়েছিল ।
|
অনন্তশ্রীবিভূষিত ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংসকুলচূড়ামণি বিশ্ববরেণ্য জগদ্গুরু শ্রীশ্রীমদ্ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের পদ্মমুখের হরিকথামৃত
সূচীপত্র
সূচনা : |
||||||
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥ | |||||||
© Sri Chaitanya Saraswat Math, Nabadwip, West Bengal, India. For any enquiries please visit our contact page. |