| |||||||
|
|||||||
শ্রীপুরীধাম মাহাত্ম্য-মুক্তা-মালা সার্বভৌম ভট্টাচার্য্যের শিক্ষা
সার্বভৌম ভট্টাচার্য্যের আদেশ অনুসারে গোপীনাথ আচার্য্য মহাপ্রভুর ঘরে এসে বললেন যে, সার্বভৌম ভট্টাচার্য্য তাঁকে ডাকছেন । মুকুন্দ দত্ত সার্বভৌম ভট্টাচার্য্যের কথা শুনেছিলেন আর মহাপ্রভুকে সব বলে দিয়েছেন, কিন্তু মহাপ্রভু বললেন, “মনে কর না, তিনি এটা আমারই মঙ্গলের জন্য বলেছেন । তাঁর কোন অপরাধ নেই ।” তখন সার্বভৌম ভট্টাচার্য্যের কাছে গিয়ে বললেন, “প্রভু, আপনি আমাকে ডেকেছেন ?” “হ্যাঁ, বস । এত অল্প বয়সে সন্ন্যাস নিয়ে তুমি কী পড়াশোনা করেছ ? বেদ-বেদান্ত পড়েছ ?” “এমন কিছু পড়িনি, ব্যাকরণ-ট্যাকরণ পড়েছি—” “ব্যাকরণ পড়ে কী হবে ? তুমি সন্ন্যাস নিয়েছ আর তুমি বেদান্তই পড়নি !” “ভগবান নাহি কহে মুই ভগবান” : ভগবান কখনও বলেন না যে, “আমি ভগবান হয়ে গেছি ।” তিনি নিজেকে কখনও ভগবান বলে বিচার করেন না । সত্যিকারের যারা বৈষ্ণব হয়, তারা কখনও বলেন না যে, “আমি বৈষ্ণব হয়ে গেছি ।” তখন কী হল ? মহাপ্রভু হাত জোড় করে বললেন, “প্রভু, আমাকে কৃপা করুন । মায়ের সেবা ছেড়ে দিয়ে আমি বাতুল হয়ে সন্ন্যাস নিয়েছি । আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন যেন আমার সন্ন্যাসটা থাকে ।” সার্বভৌম ভট্টাচার্য্য বললেন, “হ্যাঁ, তোমার বেদান্ত পড়তে হবে ! ঠিক আছে, আমি তোমাকে বেদান্ত শিখাব ।” তারপর সাত দিন ধরে মহাপ্রভু সার্বভৌম ভট্টাচার্য্যের কাছে বেদান্ত শ্রবণ করেছিলেন—বাধ্য ছাত্রের মত চুপচাপ বসে শুনতেন । সাত দিন পরে আর নিজেকে সংযত করতে না পেরে সার্বভৌম ভট্টাচার্য্য জিজ্ঞেস করলেন, “কী, নবীন সন্ন্যাসী ? তুমি বেদান্ত শুনছ কিন্তু তুমি তো কিছু বুঝতে পারছ কি না ? যেহেতু তুমি আমাকে কোন প্রশ্ন করছ না, সেহেতু আমি কি করে বুঝব, তুমি কিছু বুঝতে পেরেছ কি না ?” মহাপ্রভু বিনীতভাবে বললেন, “প্রভু, আপনি যখন বেদান্ত-পাঠ করছেন, তখন আমি দিব্যি বুঝতে পারছি, কিন্তু যখন আপনি অর্থ ব্যাখ্যা করছেন, তখন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ।” সার্বভৌম ভট্টাচার্য্য অবাক হয়ে ভাবলেন, “কী বলছে এই ছেলেটি ? আমি সাত দিন ধরে ওকে অনেক চেষ্টা করে ভালমনে শিক্ষা দিয়েছি আর ওর বলছে যে, আমি সব আজেবাজে কথা বলছি ?” তখন সার্বভৌম ভট্টাচার্য্য “আত্মারামাশ্চ মুনয়ো” শ্লোক বলে দিলেন । মহাপ্রভু বললেন, “প্রভু, এই শ্লোকের ভিতরে কিবা দোষ, কিবা গুণ একটু ব্যাখ্যা করুন ।” সার্বভৌম ভট্টাচার্য্য রেগে গিয়ে ভাবলেন, “দোষ ?” কিন্তু শ্লোকটার ব্যাখ্যা করলেন—তিনি নয় প্রকার ব্যাখ্যা করে মহাপ্রভুকে বলতে অনুরোধ করলেন । তখন মহাপ্রভু সেই শ্লোকটার আরও আঠারের প্রকার ব্যাখ্যা করেছিলেন—সার্বভৌম ভট্টাচার্য্যের নয় প্রকার ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে (তাঁর সব মায়াবাদী ভাষ্য বন্ধ করে দিয়ে) নতুন ভক্তিমর্গের ব্যাখ্যা করেছিলেন । মায়াবাদীর ভাষ্যটা হচ্ছে ব্রহ্ম-জ্ঞান : ব্রহ্মা সব সৃষ্টি করেছেন । আমরা গুরু-পরম্পরার কীর্ত্তনে গাই, “কৃষ্ণ হৈতে চতুর্ম্মুখ, হন কৃষ্ণসেবোন্মুখ, ব্রহ্মা হৈতে নারদের মতি ।” ব্রহ্মা কৃষ্ণ থেকে বল পেয়েছেন আর মায়াবাদীরা বলেন যে, ব্রহ্মা থেকে সব এসেছে । সেটা হচ্ছে ব্রহ্ম-জ্ঞান । রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামকৃষ্ণ মিশন, সারদা আশ্রম, ভারত সেবা আশ্রম—এরা মায়াবাদী, কৃষ্ণবাদে তারা বিশ্বাস করেন না । মায়াবাদীরা বলেন, “ব্রহ্মাই সৃষ্টিকর্তা । মানুষ মরে গেলে তারপর আর কিছু হয় না ।” তারা জন্মান্তর-বাদেও বিশ্বাস করেন না । যারা মায়াবাদী, তাদের মুখ দর্শন করতে নেই ! তারা বলেন কৃষ্ণের আকার নেই—কৃষ্ণ আমাদের দুটো হাত দিয়েছেন, দুটো চোখ দিয়েছেন, দুটো কান দিয়েছেন আর আমরা বলি যে, কৃষ্ণের আকার নেই ।” যেমন আমি আপনার কাছে এসে বলি, “প্রভু, আমাকে ১০ হাজার টাকা ধারর দিন । আমার টাকা নেই ।” আপনি আমাকে টাকাটা দিয়ে দিলেন আর একটু পরে আমি লোকের কাছে বলি, “ওই লোকটার কোন টাকা-পয়সা নেই !” কথা হয় ? তাই ভগবানও আমাদের হাত দিয়েছেন, পা দিয়েছেন, নাক দিয়েছেন, কান দিয়েছে—সবাইকে সব কিছু দিয়েছেন, সারা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন (ব্রহ্মা কৃষ্ণের ইচ্ছায় সৃষ্টি করেছেন) কিন্তু আমরা বলি কৃষ্ণের কোন আকার নেই, কৃষ্ণ নিরাকার । সেটা অপরাধ ! শুনতে নেই, বলতে নেই, আর যে এটা বলে, তার মুখও দেখতে নেই !” ভগবান নিজেই বলেছেন,
কৃষ্ণের যতেক খেলা, সর্ব্বোত্তম নরলীলা, (চৈঃ চঃ ২/২১/১০১-১০২) “আমার যত লীলা আছে, তার মধ্যে আমার নরলীলা (বৃন্দাবনের কৃষ্ণের রূপ) খুব ভাল লাগে ।” এ সব ব্যাখ্যা শুনে সার্বভৌম ভট্টাচার্য্য তখন বিস্মিত হয়ে পড়লেন—চোখগুলো বেরিয়ে গেল : লাল হেয়ে টগবগ করে ভাবলেন, “আমি সাত দিন ধরে কাকে বসে বসে বেদান্ত পড়িয়েছি ? এ কে ?!” কিন্তু ওইসময়ও তাঁর বিশ্বাস হল না । তখন মহাপ্রভু তাঁর ষড়ভুজরূপ দেখিয়ে দিলেন । সার্বভৌম ভট্টাচার্য্য আর মহাপ্রভুকে দেখতে পারলেন না—এই ষড়ভুজরূপটা দেখে তিনি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবতে ভগবানের চরণের সামনে পড়লেন । শুধুমাত্র যখন তিনি শরণাগত হয়ে মহাপ্রভু চরণে পড়লেন, তখনই তিনি শেষপর্যন্ত বিশ্বাস পেলেন । সেইক্ষণ মহাপ্রভু ষড়ভুজরূপটা লুকিয়ে রেখে আবার তাঁর সাধারণ মানুষের মত সন্ন্যাসীরূপ প্রকাশ করলেন আর সার্বভৌম ভট্টাচার্য্য সাষ্টাঙ্গ-প্রণামে পড়ে আর উঠলেন না । মহাপ্রভু ওকে ডেকে বললেন, “সার্বভৌম, উঠে পড় ! এবার উঠো ! হয়েছে !” আস্তে আস্তে তিনি উঠলেন । চারদিকে ঘুরে দেখে তিনি বললেন, “এ কী, প্রভু ? আপনার কী রূপ দেখলাম ? আপনি শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন । আবার কী রূপ দেখছি ?” নিজের স্বরূপ লুকিয়ে মহাপ্রভু বললেন, “ওইসব আপনি ভুল দেখেছেন, আপনার কৃষ্ণের একটু প্রীতি জন্মিয়াছে, এইজন্য আপনি ওইসব শঙ্খ-চক্র দেখছেন ।” তারপর সার্বভৌম ভট্টাচার্য্য মহাপ্রভুর ভক্ত ও বড় বৈষ্ণব হলেন । সব মায়াবাদী ভাষ্য ছেড়ে দিয়ে তিনি শুদ্ধসিদ্ধান্ত প্রচার করতে লাগলেন । জয় শ্রীলসার্বভৌম ভট্টাচার্য্য কি জয় ।
বৈরাগ্য-বিদ্যা-নিজভক্তিযোগ- “বৈরাগ্য, বিদ্যা ও নিজভক্তিযোগ শিক্ষা দিবার জন্য শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যরূপধারী এক সনাতন পুরুষ—সর্ব্বদা কৃপাসমুদ্র তাঁহার প্রতি আমি প্রপন্ন হই ।”
|
অনন্তশ্রীবিভূষিত ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংসকুলচূড়ামণি বিশ্ববরেণ্য জগদ্গুরু শ্রীশ্রীমদ্ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের পদ্মমুখের হরিকথামৃত
সূচীপত্র
সূচনা : |
||||||
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥ | |||||||
© Sri Chaitanya Saraswat Math, Nabadwip, West Bengal, India. For any enquiries please visit our contact page. |