![]() |
|||||||
| |||||||
|
|||||||
শ্রীপুরীধাম মাহাত্ম্য-মুক্তা-মালা মহাপ্রভুর পুরীতে যাত্রা : রেমুণা
রেমুণায় এসে মহাপ্রভু ভক্তগণকে গোপীনাথের কথা বললেন । এই কথা তিনি তাঁর গুরুদেব শ্রীঈশ্বরপুরীর কাছ থেকে আগে শুনেছিলেন । শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে লেখা আছে যে, শ্রীমাধবেন্দ্রপুরীপাদ ভক্তিকল্পতরুর অঙ্কুর হচ্ছেন ।
জয় শ্রীমাধবপুরী কৃষ্ণপ্রেমপূর । (চৈঃ চঃ ১/৯/১০) এক সময় ভ্রমণ করতে করতে মাধবেন্দ্রপুরী বৃন্দাবনে পৌঁছে গেলেন । এসে গোবিন্দকুণ্ডে এক গাছের তলায় বাস করতে লাগলেন । সব সময় রাধাকৃষ্ণপ্রমে বিভাবিত হয়ে তিনি অযাচিত-বৃত্তি ছিলেন : ভিক্ষা করতেন না । মাঝে মাঝে কেউ তাঁকে কিছু দিয়ে দিলেন, তাই তিনি খেতেন, তা না হলে তিনি উপবাস করতেন । সেইভাবে তিনি সব সময় হরিনাম করতে করতে জীবনযাপন করতেন । একদিন সন্ধ্যা সময় যখন তিনি গোবিন্দকুণ্ডের তীরে বসে ছিলেন, তখন তাঁর কাছে এক সুন্দর দেখতে গোপবালক এসে বললেন, “মাধব, আমি শুনেছি তুমি সারা দিন না খেয়ে আছ...” “তুমি এটা কি করে জান ?” “মহিলাগুলো জল নিতে এসেছিল । তারা আমাকে বলল, গোবিন্দকুণ্ডের পাশে এক সন্ন্যাসী বসে আছেন, কিছু না খেয়ে শুধু হরিনাম করছেন । তাই ওরা আমাকে তোমার কাছে দুধ নিয়ে পাঠিয়ে দিল । দুধটা তুমি নাও ।” অবাক হয়ে মাধবেন্দ্রপুরী জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কে ? কোথায় থাক ?” “তুমি দুধটা খাও, আমি পরে পাত্র নিতে আসব, তখন কথা বলব । আমায় এখন গরু চড়াতে যেতে হবে ।” দুধটা খেয়ে মাধবেন্দ্রপুরীপাদ বিস্মিত হয়ে ভাবলেন, “আশ্চর্য ! এটা খাঁটি অমৃত ! আমি জীবনে অনেকবার দুধ খেয়েছি, কিন্তু এমন স্বাদ কখনও পাইনি !” বালকের জন্য অপেক্ষা করতে করতে তিনি সারা রাত ওখানে বসে থাকলেন আর শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়লেন । গোপ-বালকটি তাঁর কাছে স্বপ্নেই এসে বললেন, “মাধব, তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে আমি কে—আমার নাম গোবর্দ্ধন-ধারী গোপাল । অনেক বছর আগে কৃষ্ণের প্রপৌত্র আমার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কিন্তু যখন যবনগণ এলেন, তখন ওরা আমার মন্দির ভেঙ্গে দিল । পূজারী আমাকে জঙ্গলের মধ্যে ভাল করে লুকিয়ে রেখেছিলেন । তুমি আমাকে সেখান থেকে বের করে নাও, মাধব ! আমি তোমার জন্য অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছি ।”
বহুদিন তোমার পথ করি নিরীক্ষণ । (চৈঃ চঃ ২/৪/৩৯-৪০) স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল আর মাধবেন্দ্রপুরী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “হাই, কপাল ! গোপাল শ্রীকৃষ্ণ নিজে এসেছিলেন আর আমি তাঁকে চিনতে পারলাম না ! কি দুর্ভাগ্য আমার !” সকালবেলা তিনি বৃন্দাবনবাসীগণের কাছে গিয়ে সব কথা বলে দিলেন । উত্তেজিত হয়ে গ্রামবাসীরা কুড়াল-কোদাল নিয়ে তাঁর সঙ্গে জঙ্গলের মধ্যে গেলেন । জঙ্গলের পথ পরিষ্কার করতে করতে এগিয়ে গিয়ে অনেক পরিশ্রম করে তাঁরা গোপালকে খুঁজে পেলেন আর গোবর্দ্ধনের উপরে এনেছিলেন । সেখানে মাধবেন্দ্রপুরীপাদ একটা পাথর সিংহাসনের মত রেখে দিয়ে গোপালকে তার উপরে রাখলেন আর আরেকটা পাথর গোপালের পিছনে রেখে দিলেন । তখন খবর পেয়ে সমস্ত বৃন্দাবনবাসীগণ সেখানে গিয়ে অনেক অনেক নিবেদন এনেছিলেন—প্রথম কীর্ত্তন করে অভিষেক হয়ে গেল, তারপর গোপালকে নতুন ভাল কাপড় দিয়ে অনেক অনেক ভোগ লাগিয়ে দিলেন । সেই ভাবে কয়েক দিন ধরে বিরাট অন্নকূট মহোৎসব হয়ে গেল । দুই বছর পর গোপাল মাধবেন্দ্রপুরীর কাছে স্বপ্নে আবার এসে অনুরোধ করে বললেন, “মাধব, আমার তাপ নাহি যায়, মলয়জ-চন্দন আনলে, তখন সে জুড়ায় । পুরীধামে গিয়ে সেখান থেকে চন্দন নিয়ে এস ।” দেরি না করে গোপালের আদেশ অনুসারে মাধবেন্দ্রপুরীপাদ তখনই জগন্নাথ পুরীধামে চলে গেলেন । সেখানে গিয়ে তিনি কয়েক দিন শান্তিপুরে অদ্বৈত আচার্য্যের বাড়িতে কাটিয়েছিলেন । যখন অদ্বৈত আচার্য্য তাঁকে দেখলেন, তিনি তখন আনন্দিত হয়ে তাঁর পাদপদ্ম ধুয়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন । শেষে অদ্বৈত আচার্য্য তাঁর কাছে মিনতি করলেন যেন তিনি তাঁকে দীক্ষা দেবেন । চলে যাওয়ার আগে মাধবেন্দ্রপুরী তাঁকে দীক্ষা দিলেন । কিছুদিন পর তিনি রেমুণায় পৌঁছে গেলেন । সেখানে বিখ্যাত গোপীনাথের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত আছে । গোপীনাথের সেবা-পূজা দর্শন করে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে গেলেন । পূজারীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “প্রভু, আপনারা কী ভোগ গোপীনাথকে লাগিয়ে দেন ?” পূজারী প্রভু বললেন যে, তাঁরা প্রতি দিন গোপীনাথকে দ্বাদশ পাত্রে বিশেষ ক্ষীর “অমৃত-কেলি” ভোগ দেন । শুনে মাধবেন্দ্রপুরী ভাবলেন, “এই ক্ষীরের স্বাদ পেলে আমি আমার গোপালকে এটা ভোগ লাগিয়ে দিতে পারব ।” কিন্তু সেইক্ষণই তিনি লজ্জা পেয়ে ভাবলেন, “না, না, আমার জিহ্বা বে হয়ে গেল ! আমি অপরাধ করেছি ! এটা ভাল নয় ।” তাই তিনি শীঘ্র সেখান থেকে চলে গেলেন । একটা শূন্য-হাটে এসে তিনি কাঁদতে কাঁদতে হরিনাম করে বসে থাকলেন । রাতে যখন পূজারীপ্রভু ঘুমিয়ে গেলেন, তখন গোপীনাথ তাঁর কাছে স্বপ্নে হাজির হয়ে বললেন, “হে পূজারী, শুন । উঠে পড় ! আমি কাপড়ের ভিতরে এক পাত্র ক্ষীর রেখেছি । আমার প্রিয় ভক্ত মাধবেন্দ্রপুরী এসেছে । ও বাহিরে হাটে একা বসে আছে । ওকে খুঁজে বার করে ক্ষীরটা দিয়ে দাও ।” পূজারী উঠে সঙ্গে সঙ্গে বেড়িয়ে গেলেন । মাধবেন্দ্রপুরীকে খুঁজে খুঁজে রাস্তায় গিয়ে চিৎকার করতে লাগলেন, “কোথায় মাধবেন্দ্রপুরী ? কোথায় সে ? গোপীনাথ তোমার জন্য ক্ষীর চুরি করেছেন ! তুমি কোথায় ?” সেই শূন্যহাটে এসে তিনি দেখতে পেলেন যে, এক সাধুজন বসে কেঁদে কেঁদে হরিনাম করছিলেন । পূজারী অনুমান করলেন যে, উনি নিশ্চয়ই মাধবেন্দ্রপুরী হবেন । ওঁর কাছে গিয়ে বললেন, “আপনি তো মাধবেন্দ্রপুরী ?” মাধবেন্দ্রপুরী লাজুক হয়ে বললেন, “হ্যাঁ । আমি তো ।” “গোপীনাথ আপনার জন্য এই ক্ষীর চুরি করেছেন । এটা নিন ।” পূজারীপ্রভু ওঁকে ক্ষীরটা দিলেন—মাধবেন্দ্রপুরীর ভাব দেখে অবাক হয়ে প্রণাম করলেন আর মন্দিরে ফিরে চলে গেলেন । মাধবেন্দ্রপুরী ক্ষীরটা পেয়ে পাত্রটা কপালে স্পর্শ করতে করতে প্রসাদ পাওয়ার পর পাত্রটা ভাল করে ধুয়ে খণ্ড-খণ্ড করে বহির্বাসে রেখে দিলেন আর প্রতি দিন এক টুকরা এক টুকরা খেতেন । প্রতি বার যখন তিনি এই পাত্রটা খেতেন, প্রতিবার তাঁর কৃষ্ণপ্রেম হয়েছিল । প্রসাদ পাওয়ার পর মাধবেন্দ্রপুরী ভাবলেন, “আমি এখানে থাকলে সকালবেলা সবাই জানতে পাবে কী হয়েছিল । আমার এইক্ষণেই এখান থেকে চলে যেতে হবে !”
প্রতিষ্ঠার ভয়ে পুরী রহে পলাঞা । (চৈঃ চঃ, ২/৪/১৪৭) সারা পৃথিবীর লোক কত চেষ্টা করে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য কিন্তু মাধবেন্দ্রপুরীপাদ প্রতিষ্ঠা এড়ানোর জন্য দেরি না করে রেমুণা থেকে চলে গিয়েছিলেন । কয়েক দিন পর তিনি পুরীতে আগমন করলেন । তবু পুরীধামে এসে দেখলেন যে, সবাই ইতিমধ্যে জানতে পেয়েছেন কী হয়েছিল । ফলে তিনি শীঘ্র ও অনায়াসে গোপালের জন্য চন্দনটা পেয়েছিলেন । পেয়ে বৃন্দাবনে ফিরে যেতে শুরু করে তিনি পথে আবার রেমুণায় থামলেন গোপীনাথ দর্শন করবার জন্য । সেই দিন রাতে গোপাল আবার তাঁর কাছে স্বপ্নে হাজির হয়ে বললেন, “মাধব, তোমার এত কষ্ট করতে হবে না, তোমার বৃন্দাবনে যেতে হবে না । এখানে থাক । গোপীনাথ আমার থেকে অভিন্ন, তাঁকে চন্দন দিলে মোর তাপ বিদূরিত হয়ে যাবে । আমাকে বিশ্বাস কর ।” উঠে মাধবেন্দ্রপুরী শীঘ্র করে পূজারীর কাছে গিয়ে সব বলে দিলেন আর পূজারী আনন্দিত ভাবে চন্দনটা নিয়ে পরের দিন থেকে গোপীনাথকে সেটা লাগাতে শুরু করলেন । সেই সময় থেকে মাধবেন্দ্রপুরী রেমুণায় বাস করতে লাগলেন । মাঝে মাঝে তিনি পুরীতেও যেতেন । তবু বেশীর ভাগে তিনি রেমুণায় থাকতেন । সেখানেই তিনি ভজন করতেন । মাধবেন্দ্রপুরীর কথা শেষ করে মহাপ্রভু বললেন,
প্রভু কহে, “নিত্যানন্দ, করহ বিচার । (চৈঃ চঃ, ২/৪/১৭১-১৭২)
পরম-বিরক্ত, মৌনী, সর্ব্বত্র উদাসীন । (চৈঃ চঃ, ২/৪/১৭৯) দেহ পরিত্যাগ করার আগে মাধবেন্দ্রপুরী সব সময় এই শ্লোক কহিতেন :
অয়ি দীনদয়ার্দ্র নাথ হে (চৈঃ চঃ, ২/৪/১৯৭) এই শ্লোকটা কহে মহাপ্রভু সব সময় মূর্ছিত হয়ে পড়তেন । শ্রীলকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী লিখেছেন :
এই শ্লোক কহিয়াছেন রাধা-ঠাকুরাণী । (চৈঃ চঃ, ২/৪/ ১৯৪ , ১৯৬) সেই মাধবেন্দ্রপুরীপাদের মাহাত্ম্য বলতে বলতে মহাপ্রভুর অষ্ট-সাত্ত্বিক-বিকার হয়েছে । নিত্যানন্দ প্রভু তাঁকে কোলে নিলেন আর মহাপ্রভু আবার উঠে নাচতে কাঁদতে শুরু করলেন । রাতে সময় পূজারী প্রভু তাঁদেরকে ক্ষীর প্রসাদ দিয়ে দিলেন আর রাত ওখানে কাটিয়ে মহাপ্রভু ভক্তগণকে নিয়ে আগে চলে গেলেন ।
জয় শ্রীমাধবেন্দ্রপুরীপাদ কি জয় ।
|
অনন্তশ্রীবিভূষিত ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংসকুলচূড়ামণি বিশ্ববরেণ্য জগদ্গুরু শ্রীশ্রীমদ্ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের পদ্মমুখের হরিকথামৃত
সূচীপত্র
সূচনা : |
||||||
বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥ | |||||||
© Sri Chaitanya Saraswat Math, Nabadwip, West Bengal, India. For any enquiries please visit our contact page. |