আমাদের শ্রীগুরুপরম্পরা :
শ্রীশ্রীল ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেবগোস্বামী মহারাজ শ্রীশ্রীল ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ ভগবান্ শ্রীশ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর
              প্রভুপাদ
“শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠে সূর্যাস্ত কখনই হয় না” :
আমাদের মঠের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
 
আমাদের সম্পর্কে শ্রীউপদেশ শ্রীগ্রন্থাগার শ্রীগৌড়ীয় পঞ্জিকা ছবি ENGLISH
 

শ্রীপুরীধাম মাহাত্ম্য-মুক্তা-মালা


মহাপ্রভুর পুরীতে যাত্রা : আঠারনালা

 

যখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন, তখন তিনি তাঁর দণ্ড (যা তিনি সন্ন্যাস গুরুর কাছ থেকে পেয়ে গিয়েছিলেন) নিয়ে নিত্যানন্দ প্রভু মুকুন্দাদি ভক্তগণের সঙ্গে পুরীতে গিয়েছিলেন । হেঁটে হেঁটে নিত্যানন্দ প্রভু ভাবলেন, “মহাপ্রভু আমাকে কেন বহন করবেন ?”

শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ থেকে অভিন্নরূপ । একবার শিশুকালে কৃষ্ণ কিছু ভুল করেছিলেন আর বলরাম ওঁকে চড় মেরেছেন । কেঁদে কেঁদে যশোদা মায়ের কাছে গিয়ে গোপাল নালিশ করলেন, “মা, আজকে বলাইদা আমাকে মেরেছে !” যশোদা মা বলরামকে একটু বকলেন, “ও তোর ছোট ভাই । তুই ওকে বোঝাবি, গায়ে হাত দিবি কেন ?”

বলরাম মাথা নিচু করে চুপ করে শুনলেন আর যখন মা যশোদা চলে গেলেন, তখন কৃষ্ণকে কাঁধ ধরে এমন দৃঢ় ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “আমি তোকে একটু মেরেছি, তোর তা মঙ্গলের জন্যই ! আর তুই আবার মাকে নালিশ করতে গিয়েছিস ! তুই মনে করেছিস কী ? মা তোকে আমার চাইতে বেশী ভালবাসে ? তুমি মায়ের কাছে কতক্ষণ থাকিস ?! সারাক্ষণ এইদিকে সেইদিকে ঘুরে, ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে ঢুকিস, অঘাসুর, বকাসুর, বৎসসুর—সব অসুর বিনাশ করিস আর এখানে এসে নির্দোষ ভাবে কান্নাকাটি করিস । কান্নাগুলো করলে কে তোকে সাহায্য করবে ? তোকে কে বেশী ভালবাসে ?”গোপাল চোখের জল ফেলে বললেন, “দাদা, তুই আমাকে বেশী ভালবাসিস ।”

সেই রকম হচ্ছে তাঁর প্রীতি । বলরাম কৃষ্ণকে দশ দেহে সেবা করেন—এক দেহে নয়, দশ দেহে :

চৈতন্যচন্দ্রের প্রিয়-বিগ্রহ বলাই ।
তান-স্থানে অপরাধে মরে সর্ব্ব ঠাঁই ॥
মূর্ত্তিভেদে আপনে হয়েন প্রভু-দাস ।
সে-সব লক্ষণ অবতারেই প্রকাশ ॥
সখা, ভাই, ব্যজন, শয়ন, আবাহন ।
গৃহ, ছত্র, বস্ত্র, যত ভূষণ, আসন ॥
আপনে সকল-রূপে সেবেন আপনে ।
যারে অনুগ্রহ করেন, পায় সেই জনে ॥

(চৈঃ ভঃ ১/১/৪২-৪৫)

সেইজন্য, নিত্যানন্দ প্রভু বলরাম থেকে অভিন্ন রূপ হয়ে চিন্তা করলেন, “প্রভু দণ্ড নিয়ে চলে যাচ্ছেন—তিনি আমাকে কেন বহন করবে ?” তখন তিনি কী করলেন ? তিনি দণ্ডটাকে তিন খণ্ড করে ভেঙ্গে দিয়ে ভার্গী নদীতে ভাসিয়ে দিলেন । কৃষ্ণপ্রেমে অভিভূত হয়ে মহাপ্রভু কিছু লক্ষ্য করলেন না, তিনি শুধু আগে হেঁটে হেঁটে যেতে থাকলেন ।

পুরীর পাশে আঠারনাল সেতুর নিকটে এসে মহাপ্রভুর দণ্ডের কথা মনে পড়ে গেল । তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “নিত্যানন্দ, আমার দণ্ডটা দাও !”

নিত্যানন্দ প্রভু তখন মিথ্যা কথা বললেন, “তোমার যখন কীর্ত্তনে ভাব এসেছে আর অষ্ট-সাত্ত্বিক-বিকার হয়েছে, তখন তুমি দণ্ডের উপর পড়ে গিয়েছিলেন । দণ্ডটা তিন খণ্ড হয়ে গেছে বলে আমি তাকে ভার্গীতে ভাসিয়ে দিলাম ।”

মহাপ্রভু রেগে গিয়ে বললেন, “নিতাই, তুমি কি আমার সঙ্গে চালাকি করছ ? আমি সব কিছু ছেড়ে দিয়ে নবদ্বীপ থেকে এই সবে মাত্রা ধন নিয়ে এসেছি আর তুমি কি করেছ ! তুমি এটা নষ্ট করেছ ! আমি কী জন্য এই জগতে অবতীর্ণ হয়েছি ? তুমি তো সব জান । আমি আর কিছুই নিয়ে আসিনি, সবে ধন নীলমণি একটা দণ্ড—লাঠি !—নিয়ে এসেছি, সেটাও তুমি ফেলে দিলে ? যাও ! আমি তোমাদের সঙ্গে যাব না । হয় আমি আগে যাব, তোমরা পিছনে আসবে ; তা না হয় তোমরা আগে যাও, আমি পিছনে আসব । কোনটা করবে ? তাড়াতাড়ি বল ।”

বুদ্ধি করে সবাই ভাবলেন, “আমরা যদি আগে চলে যাই, প্রভু পিছনে গিয়ে কোন দিকে চলে যাবে ? আমরা ওকে কখনও খুঁজে পাব না । আর যদি প্রভু সামনে যাবে ওকে দূর থেকে দেখা যাবে ।” তাই নিত্যানন্দ প্রভু বললেন, “তুমি এগিয়ে যাও আর আমরা পিছনে যাব ।”

শুনে মহাপ্রভু ওখান থেকে এমন দ্রুত ভাবে হাঁটতে শুরু করলেন—মত্তহস্তীর ন্যায় !—যে ওরা সব দৌড়িয়েও তাঁর পাশে যেতে পারলেন না ! হেঁটে হেঁটে মহাপ্রভু একবারে জগন্নাথ মন্দিরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন ।

জগন্নাথ মন্দিরে ঠাকুরের সামনে একটা বাধা আছে—মহাপ্রভু মন্দিরে দৌড়িয়ে ঢুকে সেই বাধায় আটকে পড়ে গেলেন । পড়ে গিয়ে মুখ দিয়ে ফেনা বেরতে শুরু করল, তিনি ‘জগন্নাথ’ও বলতে পারলেন না—শুধু “জ-জ-গ-গ, জ-জ-গ-গ” বলতে থাকলেন । তাঁর চেহারাও বিকট হয়ে গেল—মানুষের আকৃতির মত মোটেই দেখতে নয় ।

যে পাগলের মত মানুষ মন্দিরের মধ্যে দৌড়িয়ে যাচ্ছিলেন দেখে মন্দিরের পাহারাদাররা তাঁকে মারতে যাচ্ছিল । কিন্তু মহাপ্রভুর প্রভাবে ওরা আর মারতে পারল না—মহাপ্রভুর চেহারা, তাঁর উজ্জ্বল্য, তাঁর ঐশ্বর্য দেখে কেউ সাহস পেল না । একজন সার্বভৌম ভট্টাচার্য্যের কাছে গিয়ে খবর দিলেন, “ প্রভু, এই দিকে আসুন, মন্দিরে কিরকম লোক এসেছে ! একবারে জ-জ-গ-গ বলে মুখ দিয়ে ফেনা বেরচ্ছে ! ও চিৎ হয়ে পড়েছে  ।” জগন্নাথ মন্দিরে গিয়ে আর মহাপ্রভুর অবস্থা দেখে সার্বভৌম ভট্টাচার্য্য বললেন, “যে হউক আর সে হউক, আমার বাড়িতে একে নিয়ে চল ।”

সেইভাবে মহাপ্রভু পুরীতে আগমন করেছিলেন ।

 


 

← মহাপ্রভুর পুরীতে যাত্রা : ভুবনেশ্বর শ্রীলিঙ্গরাজ সার্বভৌম ভট্টাচার্য্যের সাথে মিলন →

 

অনন্তশ্রীবিভূষিত ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংসকুলচূড়ামণি বিশ্ববরেণ্য জগদ্­গুরু শ্রীশ্রীমদ্ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজের পদ্মমুখের হরিকথামৃত


ডাউনলোড


 

সূচীপত্র

সূচনা :
শ্রীজগন্নাথদেব
মহাপ্রভুর ইচ্ছা ও পুরীতে যাত্রার আরম্ভ
মহাপ্রভুর পুরীতে যাত্রা :
শান্তিপুর
রেমুণা
সাক্ষীগোপাল
ভুবনেশ্বর
ভুবনেশ্বর শ্রীলিঙ্গরাজ
আঠারনালা
শ্রীপুরীধামে :
সার্বভৌম ভট্টাচার্য্যের সথে মিলন
সার্বভৌম ভট্টাচার্য্যের শিক্ষা
কাশী মিশ্রের কথা
রামানন্দ রায়ের পুনর্মিলন ও প্রকৃতি
ভক্তদের সহিত শ্রীক্ষেত্রে বার্ষিক মিলন
রাজা প্রতাপরুদ্রের প্রতি কৃপা
গোবিন্দ প্রভুর শিক্ষা
দর্শনের আর্ত্তি
শ্রীআলালনাথের কথা
কালিদাসের ব্যতিক্রম
সার্বভৌম ভট্টাচার্য্যের প্রসাদে রুচি
“ষাঠী বিধবা হয়ে যাক !”
গঙ্গা মাতা গোস্বামিণী
শ্রীগোপাল গুরুর কথা
শ্রীজগদানন্দ পণ্ডিতের প্রেম
শ্রীলসনাতন গোস্বামীর সঙ্গ
রামচন্দ্র পুরীর কথা
শ্রীপরমানন্দ পুরীর ভক্তিকূপ
দামোদর পণ্ডিতের বিদায়
ছোট হরিদাসের শাস্তি
গুণ্ডিচা-মার্জ্জন লীলা
শ্রীনারায়ণ ছাতায়
চটকপর্ব্বতের কথা
গম্ভীরা—বিরহের জ্বলন্ত ঘর
শ্রীল হরিদাসঠাকুর : নামাচার্য্য শিরোমণি
শ্রীগদাধর পণ্ডিত : মহাপ্রভুর ছায়া
শ্রীরঘুনাথদাস গোস্বামীর শ্রীপুরীধামে আগমন ও ভজন
পরিশেষ

বৃক্ষসম ক্ষমাগুণ করবি সাধন । প্রতিহিংসা ত্যজি আন্যে করবি পালন ॥ জীবন-নির্ব্বাহে আনে উদ্বেগ না দিবে । পর-উপকারে নিজ-সুখ পাসরিবে ॥